নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

রাজা সরকার

আমি একজন সামান্য লেখক।

রাজা সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফিরে দেখা এক জন্ম-কথা।

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৩৯


(২)
খুঁড়িয়ে চলা একটি পরিবার থেকে চার চার জন মানুষ চলে গেলে পরিবারটি অনেক শোক-কাতরতার মধ্যেও খাওয়া-পরার জায়গাটাতে একটা স্বস্তির বাতাস পায়। এটা কেউ স্বীকার করে না। কিন্তু মাথাটা ক্রমে হালকা বোধ হতে থাকে। ফসল কী হলো--তাতে কতদিন যাবে--কত ধার কর্জ হবে,-এসবের হিসেব নিয়ে আর ততো মাথা না ঘামালেও যেন চলে। আর কপালও এমন যে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা গেল বিগত অনেক বছরের তুলনায় সব রকমের ফসল যেন এবার বেশ ভালো হয়েছে। জীবনে একটু রস-আস্বাদের এমন নিশ্চিন্ত অনুভব কখনো ঘটেছে বলে রবীন্দ্র বাবু মনে করতে পারছিলেন না। তার জীবন-যাপনের যে রুটিন নিয়ে লোকে আগে নানা কথা বলতো তারা এখন আর তেমন রা কাড়েনা। আসলে একটা গ্রামীণ পরিবারের শীর্ষ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও খাওয়া পরার চিন্তা--কৃষি ফসল নিয়ে চিন্তা--চাষ বাস খরা বৃষ্টি নিয়ে চিন্তা রবীন্দ্র বাবু কোন কালেই খুব একটা করতেন না। সাধু সঙ্গ, ধর্ম-চিন্তা,নাম কীর্তন-- এসব নিয়েই তার জীবন কাটে।ছেলে পুলে কে কীভাবে মানুষ হবে বা আদৌ হবে কিনা বা বয়স হলে মেয়ে বিয়ের চিন্তা--এসব তাকে স্পর্শ করে বলে মনে হয় না। তার উপর সে বা তার পরিবার বা তার আত্মীয় পরিজন এমন একটি দেশের বাসিন্দা যেখানে তাদের থাকা বা বসবাস করা সে দেশের রাজনীতির কাছে, সরকারের কাছে মোটেই কাঙ্খিত নয়। কারণ দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে ১৯৪৭ সনে দেশটা ভাগাভাগি হয়ে গেছে। অথচ হিন্দু হিসেবে তিনি বা তার পরিবার বা তার আত্মীয় পরিজন পড়ে গেছেন পাকিস্তান অংশে। এই শ্রীমন্তপুরে। সে নিয়ে সারা দেশে রায়ট বা একতরফা হিন্দু খেদানো বা হত্যা লুঠ ধর্ষণ বা জোর করে ধর্মান্তকরণ চলেছে। সেইসব খবর তিনি সাত দিনের বাসি খবরের কাগজে কোন সময় পড়েন অথবা পড়েন না। কখনো লোকমুখে শোনেন অথবা কখনো শোনেন না। পরিবারের লোকেদের সঙ্গে এনিয়ে পারত পক্ষে কোনো আলোচনা করেন না। করলে আতংক ছড়াতে পারে । আশা, এসব একদিন ঠিক হয়ে যাবে। আশ্চর্য শ্রীমন্তপুর বা তার সন্নিহিত অঞ্চলে এই জাতীয় আতংকিত হওয়ার মত কোন ঘটনা ঘটেনি । ফলে একদিকে এই আশা, অন্যদিকে সবচেয়ে বড় বল ভরসা তার একমাত্র সঙ্গী মধুবাবু। সংসারে থাকলেও মধুবাবু একজন সাধু । সাধু নামেই তার পরিচিতি। বাড়িতে তার রাধাকৃষ্ণের মন্দির আছে। বাৎসরিক কীর্তন হয় সেখানে। নিরক্ষর মধুবাবুর বাড়িতে রবীন্দ্র বাবু দুবেলা যাতায়াত করেন। উদ্দেশ্য সাধু সঙ্গ। মাঝে মাঝে নিধু বাবুকে গীতা পাঠ ও ব্যাখ্যা করে শোনানো রবীন্দ্রবাবুর একটা মহৎ এবং পছন্দের কাজ। কারণ ধর্ম গ্রন্থের পাঠ বা আলোচনা শোনার মত মানুষ এই ভাগচাষী বা কৃষি নির্ভর ক্ষুদ্র মধ্যসত্ত্বভোগী মানুষের মধ্যে আর তেমন নেই। আশে পাশের গ্রামগঞ্জের মানুষেরা এই কারণে তাদের দুজনকে খুব শ্রদ্ধা ভক্তি করে থাকেন। কারণ ধর্মাচরণে না থাকলেও তাদের ধর্ম-বিশ্বাসে আস্থা অচল।


এতদঞ্চলে কোন সাম্প্রদায়িক গোলমাল না হলেও আতংক আর গুজব ভেসে বেড়াতো বাতাসে। হিন্দুদের মধ্যে তাই একধরণের অস্থিরতা ছিলই । শ্রীমন্তপুরত আর দেশের বাইরের নয়। ঘটনা ঘটতেতো আর সময় লাগেনা।কখন কার কী বিপদ ঘনাবে কে জানে। কিছুদিন আগে রবীন্দ্র বাবুর তিন ছেলে আর তার বৃদ্ধা মা দেশান্তরী হয়েছে। বড় ছেলে অনেক আগেই গেছে। সংসার তাই এখন দুইভাগ হয়ে দুই দেশে । এই ১৯৬৪ সনে তার সংসারে লোক সংখ্যা হ্রাস পেয়ে যা রইলো তার ভার খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। এক ছেলে দুই মেয়ে এখনও তাদের সঙ্গে রয়ে গেছে। বড় দুই মেয়ের বিয়ে অনেক আগেই হয়ে গেছে। একমাত্র পুত্র হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত তার সম্পত্তি খুব একটা ছোট কিছু নয়। তৎসত্ত্বেও তার অভাব আছে নিত্য সঙ্গী হয়ে। এসব অভাব অভিযোগ তাকে স্পর্শ করে না বা করতে পারে না। কারণ তার স্ত্রী। তার স্ত্রী সুপ্রভা বা প্রভা তার ধর্ম চর্চার জন্য এতোটা পরিসর সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে সংসারের ভার কী বস্তু তা জানার মন্দ ভাগ্য তার কোনদিনই হয়নি। তাই দেখা যায় সংসারের ভার বইবার তিনি কেউ নন। সে-সব এতোদিন তার স্ত্রী আর তার বৃদ্ধা মায়ের হাতেই ছিল। এখন মা চলে যাওয়াতে সব তার স্ত্রীর উপরই বর্তেছে।


সংসার এভাবে চলতেই পারতো। কিন্তু চলেনি। দেশকাল বলে একটা ব্যাপার আছে। যাকে উপেক্ষা করা যায় না। ঈশ্বরে সমর্পিত মানুষেরা সব যুগেই যাবতীয় ভগবৎ চিন্তার দ্বারা দেশকাল নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নি। কথায় কথায় সব 'ঈশ্বরের ইচ্ছা'বলা সত্ত্বেও বাস্তবে দেখা যায় ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে কিছু হয়না। মানুষের ইচ্ছাতেই সব হয়। সে মানুষ খারাপ ভাল যাই হোক না কেন। তেমনি রবীন্দ্র বাবুর সংসারে ১৯৬৪ পরবর্তী সুখের চলনে তাল ভঙ্গ হতে সুরু হলো ১৯৬৯এ এসে এক গণ-আন্দোলনের কারণে। সরকারের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন সম্পর্কে না চাইলেও এই অতি প্রান্তিক গ্রামে ঢাকা থেকে নানা বাসি খবর এসে পৌঁছোয়। মধু বাবুর বাড়িতে কোনদিন গীতা-পাঠ সরিয়ে রেখে এসবের আলোচনাও হয় বৈকি। দুঃশ্চিন্তা গ্রস্থ রবীন্দ্র বাবুর মুখে এসব শুনে মধু বাবু মিটি মিটি হাসেন। জোড়া হাত কপালে ছুঁইয়ে তিনি শুধু বলেন সবই রাধা-মাধবের ইচ্ছা--চিন্তার কি আছে অত। তাতে রবীন্দ্র বাবু একটু আপাত হাফ ছাড়েন। কিন্তু কিছুটা দুঃশ্চিন্তার বাতাস বুকের আনাচে কানাচে তার রয়েই যায়।


হঠাৎ কী এমন হলো দেশটার--এতো আন্দোলনই বা কেন--এইতো সে দিন, মাত্র বছর ২২ আগে দেশটা ভাগ হলো। ভাগাভাগি--কাটাকাটি--মারামারির রক্তের দাগ এখনো শুকিয়েছে কি? এর মধ্যেই কে কার বিরুদ্ধে নেমেছে? কী নিয়ে ঝগড়া? মিটমাট একটা করে নিলেইত হয়। ঢাকা-কেন্দ্রিক আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমে অন্য শহরে ছড়ালেও বিস্তির্ণ গ্রামাঞ্চলে তার তেমন প্রভাব নেই। প্রাচীন কাল থেকেই গ্রাম বাংলা কিছুটা স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে। তার উপর নদনদীর বাহুল্য, যোগাযোগের অপ্রতুলতা, ইত্যাদি নিয়ে একটা আন্তঃবিচ্ছিন্নতার মধ্যে পড়ে থাকা ভূখন্ড টি আজ বড় বেসামাল। রবীন্দ্র বাবুর নিজের মানুষ বলতে আছে এখন তার এক বিবাহিতা মেয়ে নিয়তি, যার বিয়ে হয়েছিল মুক্তাগাছা।এখন সে তিন সন্তানের মা, আরো অনেকের মতো তারাও সপরিবারে এদেশেই থেকে গেছে ।


১৯৬৯ এর গণ আন্দোলন ১৯৭১ এ এসে ক্রমে এক ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে মোড় নিল। রবীন্দ্রবাবুর তা জানার কথা নয়। আর জানলেও তা উপলব্ধি করা তার পক্ষে ততখানি সম্ভব নয় যতখানি একজন শহর বা শহরাঞ্চলের মানুষ করতে পারে। কিন্তু দুঃসংবাদ এসব গ্রাহ্য করেনা। তার গতি সততই অপ্রতিরুদ্ধ। সেই সময় অর্থাৎ ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ পরবর্তী সময়ে একদিন তার বিবাহিতা মেয়ে নিয়তিই প্রথম পিতৃগৃহে আসার সুত্রে বয়ে নিয়ে আসে দেশের অনেক দুঃসংবাদ । নিজেদেরও অনেক দুঃসংবাদ। তারা তুলনামূলক ভাবে বড় শহরের নিকটবর্তী হওয়ার দরুণ বেশি সংবাদ রাখে। ফলে তার কথা সবাই কিছুটা বিশ্বাসও করে। কী সেই দুঃসংবাদ? কেনইবা সে এই সময়ে এই সংবাদ বয়ে নিয়ে আসলো? নিয়তির মা সুপ্রভা শিউড়ে উঠলো--রবীন্দ্রবাবু নির্বাক। যা জানা গেল তা হলো ঢাকায় মিলিটারীরা সাধারণ মানুষ মেরে ফেলেছে। তাই নিয়ে বিরাট গোলমাল। এখন নাকি বেছে বেছে হিন্দুদের মারছে। মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মুক্তাগাছার যে গ্রামে তার শ্বশুরবাড়ি সেখানে দল বেঁধে চেনা অচেনা লোকজন ঘুরছে, হিন্দুদের ভয় দেখাচ্ছে,বলছে বাঁচতে চাইলে টেহা দেওন লাগবো, মাইয়া দেওন লাগবো। তারা কারা বোঝা যায় না। কেউ কয় রেজাকার,কেউ কয় শান্তিবাহিনী---আরো কিতা কিতা যেন তারারে কয়। হাতে হাতে তাদের বন্দুক থাকে, তলোয়ার থাকে । অরাজকতা কী বস্তু মানুষ উপলব্ধি করতে সুরু করলো। (চলবে)







মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.