![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(পূর্বপ্রকাশিতের পর)
(৩)
নিয়তির হঠাৎ করে পিতৃগৃহে আসার কারণ যে তার শ্বশুরের ভিটেয় থাকা ক্রমে দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে তা ক্রমে প্রকাশ পেয়ে গেল। এরমধ্যেই একদল রাজাকার একদিন অন্যান্য দিনের মতই তাদের বাড়িতে আসে । কিন্তু এদিন আর টাকা চায় না। বরং সঙ্গে দু'একজন মুরুব্বিগোছের লোকও নিয়ে এসেছে। তাদের দেখে নিয়ম মতোই বাড়ির পুরুষেরা গা ঢাকা দিয়েছে। আর তাদের না পেয়ে শেষে মুরুব্বিরা ডাকে নিয়তিকেই। বাইরের উঠোন লাগোয়া ঘরের বারান্দায় তারা নিজেদের বাড়ির মতই চেয়ার টেবিল বের করে জমিয়ে বসে গেছে। হৃদপিন্ডের কাঁপুনি চেপে রেখে কোলের সন্তানটিকে কোলে নিয়ে নিয়তি অনেকটা বোধশূন্য ভাবেই যেন এগিয়ে গেল। এতদিন দেয়ালে পিঠ ঠেকেছিল, আর আজ যেন সেই দেয়ালটাও সরে গেল । মুরুব্বিদের আদেশে অবশ্য কেউ তাকে স্পর্শ করল না বা কোন কথা বলল না। যা বলার এক মুরুব্বিই বললেন। বক্তব্য খুব সংক্ষিপ্ত।--মাইয়া তুমরা যদি বাঁচবার চাও তো ধর্ম ছাড়ো। এই কথা বলার জন্যই আমরা আইছি। আইছি এই কারণে যে এই মিত্র বাড়ির ভাত কে না খাইছে--আজ তার বাড়ির মানুষের কোন সর্বনাশ হইলে আমরা যতই শান্তিবাহিনী করি, মানতে পারিনা। পলাইয়া কে কয় দিন বাঁচবো কও। বাড়ির বেডাইন(পুরুষ) রা কি এইভাবে তোমরারে বাঁচাইবার পারবো? তাই কই সময় থাকতে কলেমা পইড়া লও । পড়লে আমরা দশজন পাশে আছি। নাইলে কোন অনাচার অইলে আমরারও খারাপ লাগবো। কিন্তু কিছু করণ যাইবো না। উত্তরে নিয়তি যে বক্তব্য রেখেছিল তা যেন নিয়তি নয়, নিয়তির ভেতর থেকে অন্য কেউ রেখেছিল। তা ছিল অনেকটা এই রকম।-- চাচা মরণ বাঁচন উপরওলার হাতেইত জানতাম--আইজ কিছুদিন যাবৎত মরা বাঁচা সমান হইয়া গেছে--বাঁইচা আছি না মইরা গেছি অনেক সময় টের পাইনা। দেশেতো আফনের ধর্ম আমার ধর্ম সবই আছিল। আইজ কী অইলো যে ধর্মডাও ছাড়ন লাগবো--একটা থাকব আর একটা থাকব না-ইবা কেন---দেশেত নানা ধর্মই থাকে--আইচ্ছা আফনে মুরব্বি মানুষ কথাডা কইছেন--তবু ধর্ম ছাইড়া প্রাণবাঁচানোর লোভ নাই চাচা--তয় অবুজ এই পোলাপানগুলা যদি বাঁচে-- আমারে দুই দিনের সময় দ্যান---ভাইব্যা দেহি।
সময় দিতে অস্ত্রধারীরা রাজি নয়। মুরুব্বিদের কথা আর তারা মান্য করবে না।'বেডি'র কথার প্যাচে তারা পড়তে রাজি নয় মোটে। একজন বন্দুকের নল নিয়তির কণ্ঠার উপর চেপে ধরলো। নিয়তির আঁচল ধরা বাকি দুই ছেলে কোলেরটার সঙ্গে একযোগে ডুকরে কেঁদে উঠলো। সন্তানের কান্না মা নিয়তির কানে প্রবেশ করে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আর কিছু সে শুনতে পেলনা। নিয়তি যেমন কানে শুনলোনা, তেমনি চোখেও দেখলোনা। শিশুদের কান্না হন্তারকদের কানে কোন প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে না পারে, মায়ের কানেত করবে,কিন্তু কোথায় কি, নিয়তি যেন কানেও শোনেনা চোখেও দেখে না। কন্ঠায় বন্দুকের নল নিয়ে সে যেন আর তার মধ্যে নেই। মুরুব্বিদের সঙ্গে অস্ত্রধারীদের তর্ক হলো। কণ্ঠায় বন্দুকের নল উপেক্ষা করে নিয়তি কখন যে উঠোনে মাটির উপর বসে পড়েছে সে নিজেও জানেনা। বিগত ক'মাসের মানবেতর জীবন কাটানো মিত্র বাড়ির বড় বউ বাইরের উঠোনে অনেক লোকের সামনে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে বসে থাকাতে বন্দুকের নল এখন তার মাথা তাক করে আছে।
ঠিক এই অবস্থায়ও নিয়তির মৃত্যু হয়নি। কি আশ্চর্য, লক্ষ মৃত্যুর মিছিলে আর একটি মৃত্যু যোগ হলনা--যা নির্ধারিত ছিল একান্ত ভাবেই। বাঁচা মরার মাঝখানে যেখানে আর কোন দেয়াল অবশিষ্ট নেই সেখানে বেঁচে যাওয়ার পরই যেন হাজারটা ভয় মিত্র বাড়ির উঠোনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ঘাতকের অস্ত্রের স্পর্শ যেন নিয়তির হাড় মজ্জা পর্যন্ত ঢুকে বসে আছে। পলায়নপর স্বামী সহ গোটা পরিবার নিয়ে নিয়তি তাই একদিন বাড়ি ছাড়লো রাতের অন্ধকারে। বাড়ি ছেড়ে যাবে কোথায়--সারা দেশ নামক ভূ-খন্ডটি এখন ঘাতকদের পদানত। তবু আড়াল আবডাল দেখে দেখে শাখা সিঁদুর মুছে বোরখা পরে নিয়তি দিন তিনেকের চেষ্টায় বাপের ভিটে, অর্থাৎ শ্রীমন্তপুরে এসে কোনমতে উঠলো। যখন কথা বলার মতো শক্তি আর তার অবশিষ্ট নেই। ফলে ঘটনাক্রম প্রকাশ পেতে কয়েকটা দিন কেটে গেল। কিন্তু নিয়তির ঘটনাক্রম শ্রীমন্তপুরের বাতাসে বেশি দূর যেতে পারলোনা। কারণ ইতিমধ্যে শ্রীমন্তপুর নামক হিন্দু প্রধান গ্রামটি জনশূন্য হয়ে পড়েছে। একমাত্র তার বাপের বাড়ির ক'টা মানুষ এখনো আছে। আজন্মের চেনা গ্রামটি এখন ভয়ের বস্তু হয়ে দাঁড়ালো । মানুষ ছাড়া ভূ-খন্ডের কিবা দিন কিবা রাত। যেদিকে তাকাও শুধু শূন্যস্থান, দু-একটা পাখির ডাক ছাড়া আর কিছু নেই। ভাষাহীন চোখে নিয়তি সেই দিকে তাকিয়ে থাকে। শরীরে তার মাস সাতেকের এক শত্রুর বাস। সার্বিক ভয়ের এই রাজ্যে তার নির্ভয় নড়াচড়া নিয়তি অনুভব করে। কিন্তু চোখে তার জল নেই তাই কাঁদতে পারেনা। (চলবে)
©somewhere in net ltd.