![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
(৪)
দেশছাড়াটা এখন আর নতুন কোন ব্যাপার নয়। ১৯৪৭ থেকেই চলছে ।এদেশ থেকে গণ-নিস্ক্রমণ আর পাশের দেশ ভারতে গিয়ে এক মানবেতর জীবনের ভেতরে ঢুকে গিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা এদেশের হিন্দুদের কাছে অনেকটা ভবিতব্যের মতো হয়ে গেছে। এটা কেউ পারে কেউ পারেনা, এমন কি ভারতের মানবেতর উদ্বাস্তু-ক্যাম্প জীবনের ঘাত সইতে না পেরে অনেকেই ভেসে যায়, আবার অনেকেই পুনরায় ফিরে আসার চেষ্টা করে এদেশেই। এ-সবই ধর্মের দায়। এই উপমহাদেশের বৃহত্তর সমাজের কাছে ধর্ম ছাড়া মনুষ্য-পরিচয়ের আর কোন পরিসর এখনো তৈরি হয়নি। ফলে দেশ রাজনীতি ইত্যাদি যখন ধর্মের এজেন্ডা নিয়ে চলতে চায় তখন সাধারণ মানুষের অবস্থা এর চেয়ে অন্য আর কী হতে পারে।
তাই আবার একবার দেশছাড়ার তাড়াহুড়া। আগেরবারের সঙ্গে এবারের পার্থক্যটা চোখে পড়ার মতো। আগে এদেশ থেকে হিন্দুরা যেতো। এবার ধর্ম নির্বিশেষে সবাই । কম বেশি সব শ্রেণীর মানুষই দেশ ছাড়ছে।
মধু সাধু সকাল সন্ধ্যে হাততালি সহযোগে মন্ত্র পড়ে ঘুরে বেড়ায় গ্রামের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। এই করে সে নাকি গ্রামকে বেঁধে রাখছে যাতে কোন অপশক্তি গ্রামে ঢুকতে না পারে। অন্ধকার আর কু-সংস্কারের সৌজন্যে তার এই কর্ম বেশ বিশ্বাসযোগ্যতাও লাভ করে গ্রামবাসীদের কাছে। রবীন্দ্রবাবু এতটা বিশ্বাসী এই মুহুর্তে হতে পারছেননা। কারণ ঘরে তার সদ্য আগত কন্যা নিয়তির কথায় তার মাথায় ভয় বাসা বেঁধে আছে। তবু বন্ধু মানুষের এ হেন উদ্যোগের প্রতি প্রকাশ্যে অনাস্থা বা অবিশ্বাস জানানোর মত অকৃতজ্ঞ বা সংস্কারমুক্ত তিনি নন। তা ছাড়া তারা এখন খুব বেশি পরস্পর নির্ভর।সারা গ্রাম খাঁ খাঁ করছে--কেউ নেই। শুধু এক প্রান্তে মধু সাধু অন্য প্রান্তে রবীন্দ্রবাবু। অমৃতপুরের মুরুব্বি মানুষেরা তাদের এই সাহসিকতার কোন অর্থ ধরতে পারছেন না। সাধারণ বুদ্ধিতে ধরা যায় যে মধু সাধুর বাড়িতে কোন যুবতী কন্যা সন্তান নেই । বয়স্ক ক-জনাই শুধু রাধা মাধবের সেবার জন্য বাড়িতে থাকছে। ফলে তারা যদি নিজেদের জীবনের পরোয়া না করেন তবে তাদেরকে অকুতোভয় বলা যায়ই। কিন্তু রবীন্দ্রবাবু--তারও কি তাই? না, ঠিক তা নয়। রবীন্দ্রবাবুর ঘরে এক কিশোরী কন্যা আছে, আছে তার সদ্য পালিয়ে আসা কন্যা নিয়তি, যে কিনা মাস আটেকের পোয়াতি। ফলে দেখা যাচ্ছে যে তাদের দু-জনারই, যত বিপদই আসুক এই মুহুর্তে দেশ ছাড়া সম্ভব হচ্ছেনা। ফলে জনশূন্য গ্রামে এই দুই বাড়িতেই সন্ধ্যেয় প্রদীপ জ্বলতে দেখা যায় এখনও। তবে তা কিছুক্ষণের জন্য। কারণ সামান্য আলোর শিখাও রাত বিরেতে বিপদ ডেকে আনতে পারে।
অমৃতপুরের মানুষেরা এসব জানে। দিনে রাতে তারা এই দুই পরিবারের খোঁজ খবর নেয় । নিরস্ত্র নিষ্ক্রিয় হলেও মানুষেরা জানে আসল বিপদ, অর্থাৎ মিলিটারি যদি এসে পড়ে তবে কোন সম্পর্কই কাউকে বাঁচাতে পারবেনা। গত কিছুদিন যাবৎ হঠাৎ হঠাৎ শোনা যাচ্ছে গুলির আওয়াজ। দিনে রাতে যখন তখন। আর শোনা মাত্রই বাড়ির পেছনের জঙ্গল হয়ে উঠছে সবার আশ্রয়। সেটা যে কোন অবস্থায় থাকা হলেও। সুপ্রভার কোমরে বাঁধা থাকে সামান্য স্বর্ণালংকার আর কিছু নগদ টাকা। তিনি নিজেত বটেই, টানা এই আতংকের কারণে বাড়ির সবার মধ্যে একটা আতংকের চিহ্ন যেন ফুটে উঠছে। কথাবার্তায় আচারে ব্যবহারে একটা স্পস্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সব চেয়ে ছোট মেয়েটি পুকুর ঘাটে একদিন স্নান করতে গিয়ে দিনে দুপুরে শুনশান পুকুর ঘাটে ভয় পেয়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসলো । এসে কাঁপতে সুরু করলো। কী হয়েছে প্রশ্নের কোন উত্তর নেই তার কাছে। বাড়ির পেছনে আমগাছ তলায় গিয়ে বসে থাকে নিয়তি। কারও ডাকে সাড়া দ্যায় না। তার বাচ্চাকাচ্চাগুলোও খুব নীরব হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে সব চেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন সুপ্রভা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার মন ও শরীর পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সুরু করে। তার মধ্যেই তার টানতে হয় সংসার। সংসারের উপরি কাঠামো ভেঙ্গে গেছে সেই কবেই। যখন গ্রাম শুদ্ধু একে একে সবাই দেশ ছাড়লো। ফলে এখন আর সমাজ বলে কোন বস্তু নেই। আছে শুধু সংসারের আর্ত প্রাণটুকু। আছে যখন তখন তাকেই বাঁচাতেও হয়। সারাদিন উৎকর্ণ হয়ে থাকতে থাকতে আর সংসারের চাকা ঘোরাতে হয়।
বর্ষার ক'মাস হয়ে গেল। খাল বিল হাওর অধ্যুষিত এই ভাটি অঞ্চলে মিলিটারিরা খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করেনি। শোনা গেছে মোহনগঞ্জ থেকে তারা তাদের পরিধি এদিকে বিশেষ বিস্তৃত করতে পারেনি। আর এই শ্রীমন্তপুরত আরো অগম্য। এখানে শুধু জল নয় রয়েছে বেশ জঙ্গলও। পায়ে হেঁটে এসে হত্যাকান্ড চালানোর ঝুঁকি বোধ হয় তারা নিতে চায়নি। তার উপর ভয় আছে মুক্তিযোদ্ধাদের। তাই তারা বোধ হয় অপেক্ষা করছে বর্ষা শেষের। রবীন্দ্র বাবু এর মধ্যেও সাধুর বাড়িতে যান।সকালের দিকে এক পাক ঘুরে আসেন। কেউ যেন আর ঠিক নেই।(চলবে)
©somewhere in net ltd.