![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
(৫)
নিয়তি মাঝে মাঝে ভাবে সে কি ভেতরে ভেতরে পাথর হয়ে যাচ্ছে। মাথা তার কেমন খালি খালি লাগে। গুলির শব্দ শোনা মাত্র সে মন্ত্র-চালিতের মতো উঠে পালায়। সবসময় যে স্বামী বা বাচ্চাগুলোর খোঁজ করে তাও না। ভারি পেট নিয়ে পালাতে যাওয়ার সময় কেউ তাকে সাবধানও করে না। যদিও কথা সবারই কমে গেছে, তবুওতো তার মা--, সুপ্রভা তার সঙ্গে কেন কথা বলেন না !এর আগে কতবার সে পিতৃগৃহে এসেছে মনে নেই। বিবাহিত কন্যা মায়ের কাছে আসলে সবচেয়ে সুখের ব্যাপার হয় মায়ের। কত সুখ দুঃখের কথা থাকে তাদের। একটু ভাল মন্দ খাওয়ানো। মেয়েকে ভারি কাজ করতে না-দেয়া। পুকুর থেকে স্নান করে এলে কাপড়টা পর্যন্ত শুকোতে দেয়ার কাজটাও মা করে দিতে চান। বাচ্চাকাচ্চাদের ঝক্কি ঝামেলা সব সামলানোও যেন মা'র হাতে। যে কটা দিন মায়ের কাছে থাকবে আদরে সুখে থাকবে--এটাই মায়ের ইচ্ছে। সব মাতৃ-হৃদয়ে বোধ হয় এই জায়গাটা মেয়েদের জন্য থাকে। শত পুরুষতান্ত্রিকতার মধ্যে মা তার হৃদয়ের এই জায়গাটা বাঁচিয়ে রাখতে চান। অন্তত যতদিন পারেন। কিন্তু মায়ের এই তেমন কথা না-বলাটা এই বারই নিয়তি লক্ষ্য করেছে। এতো বিপদ ডিঙ্গিয়ে মেয়ের আসা,তার উপর সে পোয়াতি,তারপরও মায়ের এই নির্লিপ্ততা কেমন যেন খটকা লাগে নিয়তির। কিন্তু এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে যে দু-দন্ড বসে কথা বলবে তার ফুরসৎ কোথায়। বাড়িতে থাকলেও যে সবাইত দৌড়ের উপরই আছে।
নিয়তির স্বামী দিবাকর যে সারাদিনমান কোথায় থাকে, কোথায় সময় কাটায় সব সময় বোঝা যায় না। এমনিতে সে অনেকটা আড়াল নিবাসী মানুষ। লাজুক,ভীতু ,স্ত্রী-নির্ভর,-তায় আবার শ্বশুর বাড়িতে আপাত আশ্রিত। দেশে গোলমাল সুরু হওয়ার সময় সে টানা দু'তিন সপ্তাহ টাইফয়েডে ভোগে এখন আরো যেন আড়ালে চলে গেছে। কথা বলতে না হলে যার ভাললাগে, তার এই রকম বাড়ির পরিবেশে বেশ সুবিধেই হলো মনে হয়। রাতে তাদের আলাদা শোয়ারও পাট নেই। হন্যমান মানুষদের যেন একঘরে একসাথে শোয়ারই কথা। গোটা-তিনেক তক্তপোষের উপর ভাগাভাগি করে তাই তারা সবাই একঘরে থাকে। নিয়তির এই স্বামীটিকে নিয়ে কোন সমস্যা নেই বটে, কিন্তু এইরকম বিপদের দিনে একজন পুরুষ মানুষের অনেক কর্তব্য থাকে। কিন্তু দিবাকরের উপর কোন ব্যাপারেই ভরসা করা যায় না। সেই সময় মুক্তাগাছা থাকার দিনগুলোতো শরীরে জ্বর নিয়ে তাকে পালিয়ে পালিয়েই থাকতে হয়েছে। এখনও তার শরীরের যা অবস্থা তাতে কোন ভারি কাজও তার পক্ষে সম্ভব নয়। নিয়তি তাই ভাবে যে তার স্বামী তেমন ভরসা-যোগ্য হলে এই বাপের ভিটেতে এসে আশ্রয় না নিয়ে অন্যদের মত বর্ডারের দিকেই হয়তো চলে যেতো। নিয়তি আক্ষেপ করে মনে মনে যে চাইলেই কি আর দেশছাড়া যায়। তার উপর তার নিজের শরীরের এই অবস্থা।
এদিকে দিনের পর দিন নিয়তি লক্ষ্য করে যাচ্ছে রান্না ঘরে মায়ের নিঃশব্দ কান্না। অথচ মা কিছুই বলেন না। কিছু জিজ্ঞেস করলে সেই কান্না ফোঁপানিতে রূপান্তরিত হয়। যদিও এই অবস্থাটা বেশিদিন চললনা। কারণটা একদিন প্রকাশ পেয়ে গেল। আর সেটা তার বাবার সঙ্গে মায়ের কথা কাটাকাটিতে। তাতে পরিষ্কার হয়ে গেল তার মা'র এমত আচরণের কারণ আসলে গ্রামের অন্যান্যদের সঙ্গে বর্ডারের দিকে তাদের একসঙ্গে যেতে না পারা। এই যেতে না-পারাটা যে তার কাছে কতটুকু হতাশার সেটা এ-জগতের আর কেউ অনুভব করতে পারবে না। দেশের এই অবস্থা শুরুর কিছুদিন পরেই যখন সবাই বুঝে গেল যে না এটা কোন সাধারণ গোলমাল নয়, এটা সহজে মিটে যাবে এমনও নয়, এই গোলমালে দেশজুড়ে মানুষের মৃত্যু-মিছিল শুরু হয়েছে, তাতে তাদেরও হয়তো একদিন সামিল হতে হবে, তখন একটা বাঁচার চেষ্টাত করতে হবে। কিন্তু বাঁচার চেষ্টাটা কোথায়? সারাজীবনধরে যে মানুষটির সঙ্গে সে ঘর করছে তার কথা আর কী বলবে--সে কি কোনদিন বুঝবে বড়গুলোর সঙ্গে ছোট ছেলে দুটোকেও হাত ধরে যেদিন দেশছাড়ার জন্য ছেড়ে দিতে হয়েছিল অনিশ্চিত এক জীবনের দিকে, তাদের মুখ না দেখে একজন মা কীভাবে মরে! সেদিনওতো ঐ কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল নিরাপত্তার কথা ভেবেই। আর আজওত নিরাপত্তাই একটা বড় কারণ। নিরাপত্তার ছায়া থাকলে আমিই কি আর এতো উতলা হয়ে পড়তাম! এখন দেশজুড়ে সবাই মার খাচ্ছে--একসময়তো হিন্দু বলে শুধু আমরাই মার খেতাম। সংসারটাও তো এই ভয়-ভীতি নিরাপত্তার অভাব থেকেই ভাঙ্গলো। কিন্তু সংসারের কর্তার সে-দিকে চোখ কই। এখন এই অবস্থায়ও কেমন যেন নির্বিকার। সব শরিকসহ গ্রামের সবাই যখন গ্রাম শূন্য করে চলে গেল তখন আমরা কার ভরসায়, কীসের ভরসার রয়ে গেলাম?
বিপদ মাথায় নিয়ে যেদিন নিয়তি এ বাড়িতে এসে পৌঁছোল সেদিন নিয়তি লক্ষ্য করেনি যে তার বাবা মা'র তখন এ বাড়িতে থাকার কথা নয়। তাদেরও বর্ডারের দিকে চলে যাওয়ার কথা। তারা চলে গেলে নিয়তির বড় কোন বিপদ হতেই পারতো। মাত্র দুদিন আগে গ্রাম খালি হয়েছে। সুপ্রভা তখনো হাল ছেড়ে দেননি। স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা তখনও নানা ভাবে করে যাচ্ছেন। আর ঠিক এই সময়ই স্বামী সন্তানসহ নিয়তির এ বাড়িতে আসা। আর এ আসা যে কী, কত বিপদের ভেতর দিয়ে আসা--সুপ্রভা শুনে শিউড়ে উঠলেও নিয়তির জন্য তার সেই অনুভুতি কোথায়--এই মা কি সেই মা নয়? এভাবে এখানে চলে আসাটা কি তা হলে ভুল হয়েছে? ভারি শরীর নিয়ে নিয়তি যখন এসব ভাবতে বসে তখন যেন তার খরখরে চোখ একটু জলের জন্য হাহাকার করে। দিনেরবেলা যতটা সম্ভব বেশি সময় সে বাড়ির পেছনের জঙ্গলের কাছাকাছিই সে বসে থাকে। এ যেন ভুত-প্রেতের জীবন সুরু হয়েছে তাদের। (চলবে)
©somewhere in net ltd.