![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফিরে দেখা এক জন্ম কথা
১৪
নিস্তব্ধ বাড়িটা সন্ধ্যে উতরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটু চঞ্চল হয়ে উঠলো। আধো অন্ধকারে সবাই উঠোনে নেমে এলো ঘর থেকে। নিচু স্বরে কথা আর ফোঁপানো কান্নাও যেন যুগপৎ শোনা যাচ্ছে। বেশি সময় না নিয়ে ভিড়টা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল । এক ভাগ উঠোনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো আর একভাগ চলতে শুরু করলো। চলন্ত ভাগটা সরকারী রাস্তায় ওঠার পর আবছা আলোয় বোঝা গেল সামনে রবীন্দ্রবাবু,পেছনে দুটো ছোট বাচ্চার সঙ্গে নিয়তি আর সবার পেছনে দিবাকর, হাতে একটা বোঁচকা। সন্ধ্যা অতিক্রান্ত শ্রীমন্তপুর আমিত্তিপুরের পথ বেশ সুনশান। হঠাৎ দু একজন দেখা যায়। নীরবেই চলছিল সকলে। কিন্তু আমিত্তিপুরের ঘাটের কাছাকাছি হতেই হঠাৎ শোনা গেল--- দাদা নাহি? মফিজ মিঞা কাছাকাছি হতেই রবীন্দ্রবাবু চিনতে পারলেন। --রওনা হইলেন নাহি? এই সময় রওনা হওয়ার একটাই অর্থ হিন্দু হলে দেশছাড়া হওয়া।---না এই মাইয়া যাইবো শ্বশুর বাড়ি--নাওয়ে তুইল্যা দিয়া আসি--রাইতে ছাড়াত অহন আর যাওন যায় না।---হ দেশের যা অবস্থা-- সাবধানে যাইওগো মা--উফরওলার ভরসা রাইখো। সজ্জন মফিজ সন্ধ্যের নামাজ অন্তে এই সময় রাস্তায় পায়াচারি করেন। রবীন্দ্রবাবু পার হতে হতে বললেন--সাবধানত থাহে হগলেই--উপরওলার দয়া--। --হ হ দোয়া করি --আল্লার ইচ্ছায় মাইয়া নিরাপদেই পওছাবো--চিন্তা কইরেন না।
ঘাটে অধীর একদম প্রস্তুত। তার সময় জ্ঞান আছে। কখন রওনা হলে কখন গিয়ে কোন জায়গায় পৌঁছাবে সব তার জানা। এমনি দেখলে এখন তারে চেনা মুষ্কিল। একটা ময়লা ফতুয়া আর লুঙ্গিতে তার চেহারা এখন অন্য মানুষের। মাথায় বাঁধা গামছা। বাবাকে প্রণাম করতে গিয়ে নিয়তি টের পেল বাবা অঝোরে কাঁদছে। বাবা এই কমাসে সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া একজন। পরিবেশের চাপে মানুষের পরিবর্তন এখন কারো চোখে আলাদা ভাবে চিহ্নিত হওয়ার উপায় নেই যদিও,কারণ সবারই এক অবস্থা, তবু এক ঝলক দেখে নিয়তি ভেবে নিতে পারলো যে বাবা খুব অসহায়।নিজে কিছুটা জলে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে হাত ধরে পরম স্নেহে বাবা তাকে নৌকোর পাটাতনে তুলে দিয়ে মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করলেন। যেন এই মুহূর্তে এক আকাশ নক্ষত্র সাক্ষী রেখে তিনি সব বিপদ বাঁধা নিজের দিকে টেনে নিয়ে মেয়ের যাত্রা নিরাপদ করে দিলেন। অধীর মাঝি--দাদা এইবার বাড়ির দিকে যান--বলে লগিতে জোরে একটা চাপ দিয়ে নৌকাটাকে খালের মাঝাবরাবর নিয়ে গেল। সরিষার খাল নামে খ্যাত এই খালটি আমিত্তিপুরের কাছেই বাঁক নিয়ে দক্ষিণ পশ্চিমের দিকে চলে গেছে। জল থেকে উঠে রবীন্দ্রবাবু বাঁকের আড়ালে অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত নৌকাটিকে লক্ষ্য রাখলেন। নৌকায় বাতি জ্বালানো নিষেধ বলে অন্ধকারে কাউকে আর ঠাহর করা গেল না। শরৎকালের শান্ত খালের জলে নৌকাটির চলে যাওয়ার চিহ্ন কিছুক্ষণ থেকে মিলিয়েও গেল। বুকটা বেশ শূন্য বোধ হলো।
খুব আনমনে রবীন্দ্রবাবু বাড়ির পথ ধরলেন। এইদেশেই তার জন্মকর্ম বিবাহ সংসার সব কিছু। কেন যেন মনে হল এত অনিত্যতা মানুষের কি মানায়? এত দীর্ঘকাল ধরে একটা দুর্যোগ চলতে পারে! ইতিহাসে থাকলেও, রবীন্দ্রবাবুর জানা নেই। অনেকের মত এই মাটিতেই তার নাড়ী পোঁতা আছে। আক্ষরিক অর্থেই যেন এই টান তার আছে। কত মানুষকেইত চোখের সামনে দিয়ে চলে যেতে দেখেছেন সেই টান ছিন্ন করে । কিন্তু নিজের চলে যাওয়ার কথা কখনো ভাবতে পারেন নি। এটাই এখন তার দোষ হিসেবে সবাই দেখে। পরিস্থিতির চাপে নিজেও নিজেকে কখনো দোষী ভাবেন বৈকি। কিন্তু সেটা সাময়িক। আজ এই সন্ধ্যে রাতে কেন জানি নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটাকে এভাবে পাঠানো কি ঠিক হলো—এই অবস্থায়—অন্য কিছু কি ভাবা যেত না--জলেই ভাসিয়ে দিয়ে এলাম!--চোখের জলের আর বাঁধ নেই এখন। নির্জন এই আবছা অন্ধকার তাকে ক্রমশঃ টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির দিকে, নাকি আরো কোন অন্ধকারের দিকে যা জানে না সে।
(ক্রমশঃ)
©somewhere in net ltd.