![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Click This Link ফিরে দেখা---১৪
১৫
সম্ভবত ১৯৩৩ সালে সুপ্রভার বিয়ে হয় রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে। পিতৃগৃহ ছিল বারহাট্টা অঞ্চলের দশাল নামক গ্রামে। শুকনোর দিনে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর পালকি করে একটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল স্বামীর ঘরে আসার জন্য। আর তাতে সারা শরীর ব্যাথা হয়ে গিয়েছিল, মনে আছে সুপ্রভার। ঐ একবারই পালকিতে চড়া। পরে নিজের মেয়েদের বিয়েতে পালকি লাগলেও যাত্রা পথ তাদের বেশি ছিলনা। বাড়ি থেকে মোহনগঞ্জ রেল ইস্টিশন। ৪ মাইল রাস্তা। তারপর রেলগাড়ি করে যাওয়া। পালকি দেখলে এখনও সুপ্রভার শরীর ব্যাথা হওয়ার কথা পড়ে। আরো মনে পড়ে যে গোধূলী বেলায় শ্রীমন্তপুরের বাড়ির সামনে যখন পালকি থামলো তখন নতুন বউ দেখার জন্য কত ভিড়,কত আগ্রহ বউ ঝিদের । কিন্তু স্বপ্ন ভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। মুখের কাপড় সরিয়ে ঠোঁট-কাটা কেউ হয়তো মন্তব্যটা করে থাকবে যে—অ মা—এই দু দেহি কড়াইয়ের লাহান কালা রঙ। সুপ্রভার হুশ ফিরেছিল যে তার গায়ের রঙ কালো। তবে তার অতি ফর্সা শ্বাশুরি বলেছিলেন গা’ এর রঙ দিয়া কি অইবো—আমি বংশ দেইখ্যা বউ আনছি। সুপ্রভা সেদিনই জানলো যে তাদের বংশ উঁচু বংশ ছিল। কিন্তু গাত্র বর্ণ বংশ --এসব নিয়ে ভাবার সময় সুপ্রভা বেশি পাননি। বৌ-ভাতের দিন তার স্বামী হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। খবরটা কানে যেতেই বুকটা তার শূন্য বোধ হলেও সামলে নিলেন কোন ভাবে।মাথায় জল, ডাক্তার কবিরাজ—বাড়িশুদ্ধ হুলুস্থুলের মধ্যে ঘোমটার আড়াল থেকে সুপ্রভা একঝলক দেখে নিলেন স্বামীকে। বারান্দায় শায়িত সাদা মোমের মত গা’এর রঙ এর ক্ষীণ স্বাস্থ্যের এক যুবক। বিয়ে বাড়ির হৈচৈ ধকল বোধ হয় সহ্য হয়নি। জ্ঞান ফিরলেও তারপর সারারাত ঘুমন্ত এক স্বামীকে নিয়ে ঠায় বসে কাটে তার ফুলশয্যার রাত।
নতুন বৌকে অনেক নিন্দে-মন্দ শুনতে হয়। যেমন গা’এর রঙ শ্যামলা হলে সেটা হবে কড়াইয়ের মত কালো। সুপ্রভার স্বাস্থ্য ভাল, সুগঠিত—সেটা শুনতে হয়েছে--অ—রোগা পাতলা ছেড়া ভয়েই আগে আগে ফিট অইয়া গেছেগা—কীবায় ঘর সংসার করবো—ভগমান জানে। তখনকার দিনের আন্দাজে সুপ্রভার বিয়ে একটু বয়স হয়েই হয়েছিল। বিয়ের সময় সে ছিল অষ্টাদশী। এসব নিয়েও প্রতিবেশীদের খোঁচানো কম ছিল না। কিন্তু সেই অজ্ঞান হওয়ার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েই তার সংসার জীবন শুরু হয়। রুগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে অসম্ভব খিটখিটে বদরাগী এক স্বামী তার প্রাপ্য হয়। প্রায় লেখাপড়া না-জানা সুপ্রভা তার বুদ্ধির প্রখরতা দিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই সংসারে হাল ধরে নেয়। যৌথ সংসার থেকে তাদের যখন আলাদা করে দেয়া হয় তখন তাদের সংসার ছোট। বিধবা সৎ শ্বাশুরি আর তাদের ছোট ছোট দুটি বাচ্চা। বড়টি মেয়ে পরেরটি ছেলে। কৃষি নির্ভর পরিবার, ফলে বেশ কিছু কামলাও তাদের ভাগে পড়লো। এরপর আর নিন্দে মন্দ শোনার জন্য সুপ্রভার পেছনে তাকানোর সময় হয়নি। পরিবারের সকল ভার তার উপর। রান্নাবান্না,জামা কাপড় ধোয়া, মাটির ভিটে মাটিরই সব কিছু—তার লেপাপোছা,ধান শুকোনো,ধান সিদ্ধ করা, অতঃপর ঢেঁকি ঘরে ধান ভেনে চাল বের করা---এক কথায় গ্রাম্য সংসারের যাবতীয় কাজ বাড়ির বউকেই করতে হয়। যে ঠিক মত করতে পারবে সে টিঁকে যাবে। টিঁকে সহজে অনেকেই যায় না। অনেকেই রোগে ভোগে অকালে বিদায়ও নেয়। সুপ্রভা টিঁকেছিল। কারণ শরীরে সামর্থ্য ছিল। সামর্থ্য ছিল অন্তত দু তিন বছর অন্তর অন্তর সন্তানের জন্ম দেয়ারও। ফলবতী স্ত্রীলোক ছাড়া গ্রাম সমাজে স্ত্রীসত্ত্বার কোন মূল্য নেই। একে একে দশটি সন্তানের মা হলেন সুপ্রভা।
ঐ সময়ের এক অতি প্রান্তিক বাংলার গ্রামে যে যুগ চলছে তাকে প্রাক আধুনিক যুগ বলা যায়। দু একজন শিক্ষিত মানুষ থাকলেও অধিকাংশের ছিল ছিটেফোঁটা পড়াশোনা অথবা নিপাট নিরক্ষর। দৃশমান কুসংস্কারের আড়ালে অদৃশ্য রোগ জীবানুর মত অসংখ্য কুসংস্কারে ঘেরা গ্রাম জীবন। মাথার উপর ধর্মের সার্বিক আবরণ। সঙ্গে অশিক্ষিত এক পুরুষতন্ত্র। নারীর অবস্থান যেখানে যৌনতা আর শ্রমের নিষ্পেষনে ঘেরা। এরমধ্যেই সুপ্রভার জীবনের চাকা গড়াতে শুরু করলো। সব কিছু ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দেয়ার মানুষ ছিলেন না সুপ্রভা। নিজের লক্ষ্য নিজে নিজেই স্থির করে নিলেন। এ বিষয়ে বিশ্বস্থ এক সাহায্যের হাত পেয়েছিলেন, যেটা তার শ্বাশুরির হাত। একটা জিনিষ তারা শুরুতেই ঠিক করে ফেলেছিলেন যে অন্তত ছেলে সন্তানগুলোকে মুর্খ রাখা চলবে না।কৃষি জমি নির্ভরতার অবসান ঘটাতে হবে। তাই যে ভাবেই হউক তাদের লেখা পড়া শেখাতে হবে। মেয়েদের হয়তো ততটা সম্ভব না । এই প্রান্তিক অঞ্চলেত নয়ই। তবে প্রাইমারী শিক্ষা যদি পেতে পারে, যদিও খুব কঠিন কাজ সেটা--। তাছাড়া মেয়েদের শিক্ষা সম্পর্কে তাদের উভয়েরই কোন পূর্ব ধারণা নেই। এতদঞ্চলে বর্তমান সময় পরিসরে একটি শিক্ষিত মেয়ের অবস্থান কী হতে পারে সেই ভাবনাটা ভাবতে তারা অক্ষম হয়ে পড়ে। যদিও সবটাই তাদের টিঁকে থাকার প্রশ্নে ভাবা।
১৬
এসব নিয়ে রবীন্দ্রবাবুর মাথা ব্যাথা খুব একটা ছিল না । সংসারে সক্রিয়তা—বা কৃষিকাজে মনোনিবেশের সময়কাল তার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একসময় জমিজমা সব আধিয়ারদের বুঝিয়ে দিয়ে তিনি উদাসীন, সংসারে এক সন্ন্যাসীর জীবন বেছে নিলেন। তখন থেকেই বন্ধু হয়ে গেল মধু সাধু, ভগবত চিন্তা, আর নামকীর্তন। শ্বাশুরি বউয়ের কর্ম বা কর্ম-পরিকল্পনারর কোন খোঁজ আর রাখলেন না। কিন্তু সংসার ঠিকই চলতে শুরু করলো। এই দুই মহিলা ক্রমে সংসারের গুরুভারের তলায় জায়গা করে নিলেন। সুপ্রভা দম নেয়ার মত ফুরসত পেলে কখনো সখনো ভাবতেন তার স্বামী পুরুষটির হয়তো অনেক পূণ্যভাগ্য। সবার ভাগ্য এক হয় না। ঈশ্বরই বুঝি ঠিক করে দেন সংসারে কার ভাগ্য কী দিয়ে গড়া থাকবে। সংসারে থেকেও নিরুপদ্রবে ভগবত চিন্তা ক’জন করতে পারে! বিষয়ী ভাবনার বাইরে থেকে গিয়ে বিষয়ের সুখ সুবিধে পাওয়াত ভাগ্যের কথা। আর সেই ব্যবস্থার কারিগর যেহেতু সে নিজে, তবে পূণ্যের ভাগ তার নিশ্চই আছে। পতির পূণ্যেইত তার পূণ্য। সুপ্রভার পুরুষতন্ত্র বোঝার কথা নয়।
তবু একটা জীবন--একটা মানুষ তার ভেতর সে কোথাও না কোথাও হয়তো তার গড়ে উঠা ব্যক্তিত্বের সন্ধানসুত্রটি রেখে যায় । রবীন্দ্রবাবু শোন যায় কৈশোরেই পিতৃহারা হয়েছিলেন। তার পিতা তৎকালীন সময়ে বেশ কৃতি পুরুষ ছিলেন। শিক্ষিত আইনব্যবসায়ী মানুষটি ভাল সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। প্রথম স্ত্রী বিয়োগের পর দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন। সহায়সম্পত্তি যা সেসবই ছিল তখনকার সামাজিকতায় এক যৌথ পরিবারের দখলে। নিতান্ত অল্প বয়সেই পিতা মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তান বেশ বিপদে পড়ে গেলেন। সংসারে তখন সদ্য বিধবা মায়েরও বয়স তেমন বেশী নয়। সম্পত্তিলোভী আত্মীয়দের হাতে তখন একই সংসারে তারা দুজনই কমবেশী নির্যাতিত। একমাত্র উত্তরাধিকারী যেহেতু পুত্র রবীন্দ্র, তাই সেই হিসেবে তার উপর নির্যাতনের মাত্রাটা অনেক বেশী ছিলো । আর এইসব সহ্য করতে না পেরে পুত্র রবীন্দ্র তখন একদিন বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে চলে যান। কোথায় গেলেন বাড়ীর কর্তা ব্যক্তিরা তার কোন খোঁজও নিলেননা । দিন গড়িয়ে যেতে যেতে যখন তা প্রায় বছর ঘুরতে চলল তখন আর থাকতে না পেরে রবীন্দ্রবাবুর মা একদিন মরিয়া হয়েই মুখ খুললেন। বাড়ীর কর্তার কানে যথারীতি কথাটা গেল। বাড়ীর কর্তা শুনে মন্তব্য শোনালেন যে সৎ ছেলের জন্য এত দরদের কী আছে —- সংসারে এই সৎ মা’য়েরত আর খাওয়াপরার অভাব হবেনা—- । কিন্তু মাতৃস্বভাব সংসারে একটি বিরল জৈবিক অনুভূতি। তখনকার ঐ অনগ্রসরতার মধ্যেও সেই মা ক্রমে বিদ্রোহই করে বসলেন। প্রশ্ন তুলে বসলেন সম্পত্তি নিয়েও। কিছুটা লোকজানাজানিও হয়ে গেল। তাতে কিছু আত্মীয়স্বজন রবীন্দ্রবাবুর মা তাঁর স্বপক্ষে পেয়ে গেলেন। বাড়ীর কর্তাদের টনকও নড়লো। আলোচনা সভা হলো বিস্তর। শেষে ঠিক হলো যে পুত্রের সন্ধানে খোঁজ খবর করা হবে। সেই মতো কাছাকাছি নানা জায়গায় খোঁজখবরে একসময় জানা গেল যে রবীন্দ্র উত্তর ভারতের দিকে গেছেন। আর সেই সুত্রে এক আত্মীয়কে সংগে নিয়ে রবীন্দ্রবাবুর মা রওনা হয়ে গেলেন সেই অঞ্চলের দু’একটা তীর্থ স্থানে খোঁজ নিতে। কপাল ভালো যে মাসখানিক ঘোরাঘুরির মধ্যেই পুত্রকে পাওয়া গেল বৃন্দাবনের এক আশ্রমে। প্রায় কংকালসার কালাজ্বরে আক্রান্ত অসুস্থ রবীন্দ্র। কোনমতে তাঁকে নিয়ে বাড়ী ফিরে তারপর চলল দীর্ঘ চিকিৎসা শুশ্রুষা। সেই থেকে ক্ষীণজীবী পুত্রটির স্বাস্থ্য অনেকদিন পর ফিরলেও হয়তো তার মানসিক স্বাস্থ্যটা আর প্রয়োজন মাফিক ফেরেনি। একজন সদ্য যুবকের যে ধরণের বিষয়আশয় ঘটিত চিন্তা সেই যুগে থাকা দরকার ছিলো তা তার ছিলোনা। মানসিক গঠনের ঐ ঘাটতিটা আর বাকি জীবনে তাঁর পুরণ হয়েছিল বলে মনে হয়নি।
১৭
বৃটিশ ভারতে স্বাধীনতা, দেশভাগ, বাংলাভাগ এসব খবর সেই সময় এই প্রান্তিক গ্রামে অনেক বাসি হয়ে এলেও তা অনেকদিন যাবৎ নেহাৎ গল্পের বিষয় হিসেবেই ছিল। সেই গল্পের আসর কোন সম্প্রদায় মেনে হতোনা। এটাকে খোলামেলা কথা না-বলার মত বিষয় হিসেবে তখনও কারো মনে হয়নি। হাটে বাজারে বৈঠক খানায় উৎসব পার্বনে সবখানেই সেই গল্প চলতে পারতো। তা নিয়ে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ঠাট্টা রসিকতাও চালু ছিল। হিন্দুদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে এই ভাবনাটাও তেমন জন্মায়নি। অনেকের এমন ধারণা ছিল যে, কিছুদিন ধৈর্য ধরো সব আবার ঠিকঠাক হয়ে যাবে। অবশ্য কখনো কখনো দাঙ্গা রায়টের কোন খবরের বীভৎসতা বাতাসে ভাসতে ভাসতে যখন এই অঞ্চলে এসে পৌঁছে যেত তখন কারো কারো মুখ একটু কালো হয়ে যেত বইকি। স্বতস্ফুর্ততা কেমন যেন কমেও যেত।
সমস্যাটা তৈরি হলো পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে। এখন যারা গ্রামের প্রাইমারীতে পড়ে বা যারা দূরের কোনো হাই ইস্কুলে পড়ে বা যারা সদ্য মেট্রিক পাশ করেছে—এদের ভবিষ্যত কী? ৪৭ এর পর অনেকদিনত কেটে গেল---আর কতদিন ধৈর্য ধরা যায়—আর কীইবা ঠিক হয়ে যাবে—দিন দিনত খবরের রঙ পাল্টাচ্ছে। একসময় দুপক্ষের মধ্যে দাঙ্গা টাঙ্গা হতো। এখনতো অনেক দিন যাবৎ শোনা যাচ্ছে, যা হচ্ছে তা এক তরফা। হিন্দু পালায় জান মান নিয়ে। সম্পদ পড়ে থাকে থাক। আগে মান প্রাণ বাঁচাই। কিছুদিন যাবৎ এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে সুপ্রভার--অরণ্যের বাঘিনীর মত সে সন্তানের নিরাপত্তার জন্য চারদিকের ঘ্রাণ নেয়। গন্ধ ভাল ঠেকে না। একান্তে সে এইসব আলাপ তার শ্বাশুরির সঙ্গেই করে । কখনো সখনো সুযোগ পেলে স্বামীকে শোনায়। স্বামী শোনেন হয়তো, কিন্তু নীরব থাকেন। সন্তানাদি সহ এতবড় ভদ্রাসন তুলে নিয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার কথা পাগলের প্রালাপ ছাড়া আর কিছু মনে হতো না রবীন্দ্রবাবুর। কিন্তু ১৯৬৪ সনের দাঙ্গা যেন তাদের ঘর বাড়ি গ্রামের উপর ঝাপটা দিয়ে গেল। শম্বুক গতিতে হলেও ততদিনে যোগাযোগ ব্যবস্থার খানিকটা উন্নতি ঘটে গেছে। ম্যাট্রিক পাশের পর কীসের এক ইন্টারভিউ দিতে মেজছেলে ঢাকায় গিয়ে সেই দাঙ্গার ভেতরে পড়ে গিয়েছিল এবং কোন ক্রমে প্রাণে বেঁচে ফিরেছে—এই খবর ছিল একেবারে সদ্য এবং আকাড়া । যার অভিঘাত আগের কোনো খবরের মতো সামান্য ছিল না। ছিল একটু বেশিই। রবীন্দ্র বাবুকে নিস্পৃহ দেখালেও সুপ্রভা ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলেন। কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়ে সন্তানের শেষরক্ষা কীভাবে হবে! উদয়াস্ত এই পরিশ্রম, এই সংসার—সবই যদি এতই অনিত্য হয়---সুপ্রভা এই প্রথমবার যেন সংসারে তার এতদিনকার যাত্রাপথটা পেছন ফিরে দেখতে পায়।
সুপ্রভার আর সন্তান হবে না। শেষ সন্তানটির বয়স বছর আট। মোট দশটি সন্তানের জননী হলেও আদর করে নাম রাখা গীতা নামের প্রথম কন্যা সন্তানটি বছর দশেক বয়সে মারা যায়। পেটের রোগ হয়েছিল। প্রথম সন্তানের মৃত্যুতে শোকে ভেঙ্গে পড়ার সময় ছিল না তার। কারণ ততদিনে আরো তিনটি সন্তান তার মুখের দিকে চেয়ে থাকতে শুরু করেছে। শিশু সন্তানের অবোধ চোখের সামনে তাকে অপরাজিত মাতৃত্বের চেহারাটাই তুলে ধরতে হয়েছিল। অতঃপর ধীরে ধীরে শোক চলে গেলে স্মৃতির মণিকোটায় শুধু থেকে যায় সে। তার আর রোগ বালাই থাকে না—সে আর বড়ও হয়না। শুধু মাঝে মাঝে কুসংস্কারের সুতো ধরে সে আসে । রাতের অন্ধকারে সঙ্গী সাথীর জন্য নাকি সে ঘুরে বেড়ায়। কে যেন বলে, অ গীতার মা সাবধান হয়ো কই রাইতের সময় পুলাপানের শিয়রে মুইড়া ঝাডা রাইক্কো--। সুপ্রভা এইসব কথা শুনে ভয় পায়। বিছানা ভরা পুলাপানের অসুখ বিসুখ হলেত কথাই নেই—রাত বিরেতে উঠে উঠে শিয়রের ঝাঁটা টেনে নিয়ে সে অন্ধকারে অশীরী তাড়ায়। আবার পরক্ষণেই গীতার পান্ডুর মুখ মনে ভেসে উঠলে বুক ঠেলে কান্নাও আসে। কার হাত থেকে সে কাকে বাঁচায়। ঘুমন্ত স্বামী সন্তান নিয়ে অন্ধকারে সে প্রকৃতই অসহায় ও একা। অলৌকিকের বিরুদ্ধে টিঁকে থাকার এই যুদ্ধে তাকে সাহায্য করার কেউ থাকে না।
(চলবে)
©somewhere in net ltd.