নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

রাজা সরকার

আমি একজন সামান্য লেখক।

রাজা সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফিরে দেখা এক জন্ম কথা।

২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫০

ফিরে দেখা১৫,১৬,১৭

১৮
কাজ আর কাজ। কাজ দিয়েও নারীকে বেঁধে রাখার এই সংসারী কৌশল। একদিন বুঝে গেলেও আর ফেরার পথ থাকে না তখন। কেননা ততদিনে সে পরিত্রাণহীন এক মা। হয়তো তখন গর্ভে্র সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখার তাড়া তৈরি হয়েছে। ভোর রাত থেকেই সুপ্রভা টের পাচ্ছেন। অন্য দশটা কাজের মধ্যেই এটাও পড়ে--এমন স্বাভাবিক। যেমন হয়তো একদিন আগে নিজেদের ঢেঁকি-ঘরটাকে নিজেই একটু ঠিকঠাক করে নিয়েছেন। ওটাই আঁতুড় ঘর। বড় মেয়েটার সময় বাপের বাড়িতে গিয়েছিলেন। পরেরগুলো সব এখানে এই ঢেঁকি-ঘরের আঁতুড়েই পৃথিবীর আলো দেখেছিল। কাঁথা কাপড় খড় ও আরো টুকিটাকি কিছু এনে রাখা হয়েছে সেখানে। সকালে শ্বাশুরি গিয়ে ও পাড়ার সাবিত্রীর মাকে সঙ্গে করেই নিয়ে এলেন। উনিই ধাত্রী। বসে আছেন বারান্দায়। চোখের সামনে প্রসুতি কাজ করে চলেছেন। মাঝে সুপ্রভার উদ্দেশ্যে বলছেন—অ বউ আর ঘুইরো না—আহ অহন--। সুপ্রভা কোনমতে সকালের রান্নাটাও করে দিলেন। একসময় হয়তো টের পেলেন আর সময় নেই। শ্বাশুরিকে বললেন—মা পুলাফানডিরে খাইতে দিয়াদিয়েন। আমি যাইতাছি-। হ-যাও বৌ—আর দেরি কইরোনা শোও গিয়া। হয়তো ঘন্টাখানিক বাদে একটা নতুন গলার কান্না বাড়িতে ছড়িয়ে পড়লো । কান্না শুনে সচকিত আশেপাশের বৌ ঝিরা ছুটে এলো—উলু দিল--। সুপ্রভা কষ্ট করে একবার দেখে নিল সন্তানের মুখ—তারপর একটা শ্রান্তির ঘুম। সন্তান প্রসবের জন্য কোন আতিশয্য লাগে না। রবীন্দ্রবাবু সন্তানের মুখ দেখলেন। দেখতে হয় তাই দেখা। আঁতুড় ঘরের আড়াল সরিয়ে ধাইয়ের কোলে নিয়ে আসা কাঁথা কাপড়ের পুটুলিতে জড়ানো একটা মানুষের ছানা--দেখলেন। তারপর হয়তো ধীরে সুস্থে পশ্চিম পাড়ায় সাধুর বাড়ি্র দিকে চলে গেলেন।

এভাবেই সুপ্রভা আর তার সন্তানেরা পৃথিবীর একটি কোণে এসে ভিড়েছিলেন। এখন যেখানে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর হুমকি। কী করা উচিত, কিছুই ঠিক করে উঠতে পারছেন না। আর এই সময় তারই এক কন্যা; নিয়তি, যে কিনা নিজেও আজ তিন সন্তানের মা, তার মতই মৃত্যুর হুমকির মুখে পড়ে ভয়ে আতঙ্কে নিজের ঘর বাড়ি ছেড়ে তার কাছে এসে উপস্থিত, সঙ্গে আপাত অদৃশ্য গর্ভে আরেকটিকে নিয়ে। একান্তই প্রাণে বাঁচার আশায়। অথচ যখন যে কোন মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে, যখন মৃত্যুকে একটু অপেক্ষা করতে বলে মনে হয় একবার সেই অল্প বয়সে দেশান্তরী করে দেয়া সন্তানকটিকে একটু দেখে আসি। এত প্রাণের আধার সুপ্রভা প্রাণ রক্ষার কথা ভেবে ভেবেই না এতদিন ধরে স্বামীর সঙ্গে তর্ক বিতর্ক করে যাচ্ছেন। চোখের সামনে গ্রাম খালি হয়ে গেলেও তার স্বামীকে নড়ানো গেলনা। মনে মনে এই স্বামী-পুরুষটির উপর তার অসহায় ক্রোধ যখন পূর্ণমাত্রায় তখনই নিয়তির আসা--। একান্তে একসময় নিয়তিকে বললেনও—এক বিপদ থাইক্যা বাঁচনের লাইগ্যা আরেক বিপদের মধ্যে আইয়া পরছস—আইসাত অহন বেকটিরে ফালাইছস আরেক বিপদে--। মাথা না তুলে নীরবে এইসব কথা শুনতে শুনতে নিয়তি মনে মনে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো—আমারোতো তুমার মতন দশা—তুমরার এই জামাইত বর্ডারের কথা হুনলেই ভয়ে কাঁপে—সেই মানুষরে লইয়া কীবায় যাওনের কথা ভাবি—।একসময় হয়তো এসব অসহায়তার কথা মাকে সে বলেও। সুপ্রভার ক্রোধ হয়তো তাতে আরো বর্ধিত হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। সংসারের এই অকামের পুরুষগুলোর উদ্দ্যেশ্যে মেয়ের কাছেই কিছুক্ষণ ক্ষোভ উগড়ে নিজের ভাগ্যকেই দোষারোপ করতে থাকেন।

এই সময় সুপ্রভার তার শ্বাশুরির কথা খুব মনে পড়ে। দীর্ঘ দিন সংসারে পরামর্শ করার মত একজন মানুষইতো ছিলেন। ছেলেদেরকে সময়মতোত ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দেয়ার পরামর্শত তার সঙ্গেই করে ছিলেন। এক সময় মানে ৬৪ সনে মেজ ছেলের সঙ্গে এগার বার বছরের ছোট দুটো ছেলে যাবে বলে শ্বাশুরিও সঙ্গে গেলেন। আর এই যাওয়াত যাওয়াই—বছর দুইয়ের মধ্যে তিনি স্বর্গে গেলেন—আর একবার দেখাও হলোনা। দেশের মতি গতি বোঝার ভার যেন তখন তাদের মত প্রায় লেখাপড়া না জানা দুই মহিলার উপরেই বর্তেছিল। একসময় সংসারের যাবতীয় ভার তারা তুলে নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু এই সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার তাদের উপর আসে কি করে একজন জলজ্যান্ত পুরুষ বাড়িতে থাকতে! এ যাবৎ এই জীবনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের মূল্য তার এই হতাশা। স্বামীর নির্লিপ্ততাকে তিনি আর তার আধ্যাত্মিকতার ছায়ায় দেখতে রাজি হননা। একান্তে মায়ের এই ক্ষিপ্ত রূপ নিয়তি আগে কোনদিন দেখেছে বলে মনেও পড়েনা। বাবার উপর এত রাগ ! তবু সে মাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলো। বলল—অত চিন্তা কইরনা মা পথ একটা ঠিকই বাইরবো। এরপর পথের সন্ধান যে নিয়তিই করবে একটা সেটা প্রথমে সুপ্রভা ভাবতে পারেন নি। এরপরই নিয়তি যেমন একদিন অধীর কাকুর সঙ্গে দেখা করে তেমনি একদিন সালাউদ্দিন চাচার বাসায়ও যায়। সালাউদ্দিন চাচাই ঠাকরোকোনা পর্যন্ত খবর নিয়ে অধীর মাঝিকে বাড়িতে ডেকে বুঝিয়ে দিয়েছেন । ওখান থেকে পরবর্তী পথের খোঁজখবর যার কাছ থেকে নিতে হবে তার নামও বলে দিলেন। অধীর অভিজ্ঞ । নিজেও সে জানে।

১৯
ন্যুনতম চাহিদা হলেও জীবন সচল রাখতে গেলে ন্যুনতমটাই যে অনেক কিছু মনে হচ্ছে গত কয়েক মাস ধরে। মোহনগঞ্জে মিলিটারি ক্যাম্প হওয়ার কথা শোনা গেলেও গ্রামের মানুষকে প্রয়োজনে মোহনগঞ্জেও যেতে হয়। পুলিশ মিলিটারির ভয় সত্ত্বেও এই যাতায়াত করতে হয়। বর্ষার সুযোগে নৌকায় যাতায়াত হওয়াতে মন্দের ভাল হয়েছে। পাকিস্তানী খানসেনাদের জলে ভয় । ভাটি অঞ্চলের এই সুবিধাটা আছে। হাতুড়ে ডাক্তার মধুসাধুর পুত্র যোগেশকেও মোহনগঞ্জে যেতে হয় ওষুদ আনতে। দেশজোড়া এই নৈরাজ্যেকালীন বর্ষা কালে রোগব্যাধিরত আর বিরাম নেই। বিশেষ করে বাচ্চাদের। দলে মিশে যোগেশ লুঙ্গি পরেই যায়। পাড়ার মুদি দোকানের মাল পত্র শেষ হলে বসে থাকার উপায় নেই দোকানদারের। মানুষের তাগাদার কারণে তাকেও যেতে হয়। উপরওলার স্মরণ নিয়ে সকলেই নৌকায় চেপে বসে। কপাল ভাল বলতে হবে এখন পর্যন্ত তেমন কোন বিপদ হয়নি কারোর। স্থানীয় সাপ্তাহিক হাট প্রথম প্রথম বন্ধ থাকলেও এখন সপ্তাহের শুক্রবার বসে। এ নিয়ে অবশ্য থানা থেকে ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার কাছু মিয়ার কাছে একটা হুমকি চিঠি পাঠানো হয়েছিল। তাতে বলা হয় যেকোনো প্রকারে বাজার যেন পরের শুক্রবার খোলা থাকে। না হলে মিলিটারি ক্যাম্পে গিয়ে ক্যাপ্টেনের কাছে কারণ দর্শাতে হবে। ব্যস, বাজার বসে যায় নির্দিষ্ট দিনে।

স্থানীয় বাজারগুলো চালু রাখা খুব জরুরি। ওখানে শুধু লেন দেন বিক্রি বাটা হয় না, হয় আরো কিছু, যা থেকে স্থানীয় ইনফরমাররা নানা খবরাখবর তুলতে পারে। তাছাড়া দেশি মুরগি বা খাসি ক্যাম্পের জন্য নেয়া যায়। মূল রেশন ময়মনসিং থেকে এলেও লোকাল নরম মাংস সাহেব সুবোরা খেতে পছন্দ করে। যদিও মাছ তথা মছলি তারা একদম পছন্দ করে না। বাজার খোলার পর এই সব সংগ্রহের কাজে আমিত্তিপুরের জব্বার প্রতি শুক্রবার সারাক্ষণ বাজারেই থাকে। সিভিল ড্রেসের একটা টিম, শান্তিবাহিনি না রাজাকার কে জানে, বাজারে ঘুরে বেড়ায় । তাদের কারো হাতে রাইফেল, কারো হাতে খাপে ঢোকানো সোর্ড বা লাঠি থাকে। বাজারের দোকানদার বা নিরিহ ক্রেতারা প্রথম দিকে কিছুটা ভড়কে গেলেও কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মানিয়ে নেয় । কারণ তারা কিছু ক্ষতি করে না। বরং যেচে আলাপ সালাপও করে। একদিন যোগেশ ডাক্তার তাদের সামনে পড়ে ।--ডাক্তর সাব আছুইন কেমন ? সামান্য তোতলা গো-বেচারা ডাক্তার থতমত খেয়ে অনেক কষ্টে বলে উঠে—অ অ আ আছি বালা—আছি বালা। --বালা আছুইন না—হা হা—তো আফনাগো জাইতের হগলেইত গেছে গিয়া , আফনে অহনও আছুইন এইডা খুব বালা অইছে—রোগ বালাইএর লাগি ডাক্তার বদ্যিত লাগেই। ভয় ফাইন্যাযে আমরা আছি আফনাগো পাহারায়,---বলে দলটা হাসি মষ্করা করতে করতে অন্য দিকে যায়।

অতঃপর সেদিন বাড়ি ফেরার পথে যোগেশ অনেক ভেবেও এদের কারোর মুখ মনে করতে পারলো না। অথচ জন্ম থেকে সে এই অঞ্চলেরই একজন। ডাক্তারির স্বার্থে অনেক দূরের মানুষের সঙ্গেও তার জানাশোনা। তবে--। যোগেশকে খুব চিন্তিত দেখালো। হায়রে, ঘাতক যখন পাহারার কাজে নামে তখন আমরা—। আমরার মাফুজ মিয়ার পোলা জব্বার কী কাম করে—কোথায় করে—এটাও একটা চিন্তা যে বাজারের মধ্যে বাহিনির লোকদের সঙ্গে সেও ঘোরে-- সেইতো আমার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছিল। পোলাডা কী চায় কে জানে!

আমিত্তিপুরের জব্বার মোহনগঞ্জের ক্যাম্পের শুরু থেকেই আছে। ঝাড়ুদারের কাজ করে। থানা আর মিলিটারি ক্যাম্পের মধ্যে সারাদিন যাতায়াত করতে হয়। যোগাযোগের মাধ্যম সে। থানার বড়বাবুর কাছে প্রতিদিন তাদের গ্রাম সহ আশপাশের গ্রামের খবরাখবর সরবরাহ করতে হয়। জব্বার সত্যিই খুব এলেমদার ছেলে। সকালে কাজে বেরিয়ে গিয়ে তার বাড়ি ফিরতে রাত হয়। ক্যাম্পে তার খুব খাতির। তাতে নিজের চাষাভুষাদের গ্রামে তার গুরুত্ব পাওয়ারই কথা। কিন্তু তার সমবয়সী বন্ধুরা তা মানে না। দেখলেই এখনও আগের মতই পুঙ্গির ভাই, চুতমারানি হালা—ইত্যাদি সম্বোধন করে থাকে। আবার উপর তলার খবরাখবরও জানতে চায়। উত্তরে দাঁত বের করে হাসলেও মনে মনে সে খুব কষ্ট পায়। মনে মনে সে ভাবে—তুমরা হালা আমারে বুন্দা পাইছ—জিগাইলা আর আম্মো কইলাম—ঐ সব বড় মাইষের মুখের খবর—তরার লাহান চাষার বেডা চাষাদের দেওনের লাইগ্যা না। তবু সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে একটা উত্তর সে দেয় যে---খবর আর কিতা—রাইখ্যসের লাহান লাশ এহেকটা--খালি খাওনের ফরমাইস—চারদিকের ফানি দেইখ্যা ভয় ফায়—আমারে দেখলে খালি কয়—লেড়কি লে আও—টেকা মিলেগা--লে লো সিগারেট ---। বলে হয়তো একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। কিন্তু এটা পরিষ্কার হয়না যে জব্বার তার সাহেবদের জন্য লেড়কির ব্যব্যস্থা করে কিনা। সন্দেহটা তাই থাকে। মফিজের ব্যাটা জব্বার এভাবেই একটা সন্দেহের বস্তু হয়ে যায়। এমনকি সাথে পাছে না থাকা সৈয়দ আকবর আলির কাছেও। গ্রামের পেছন দিকের ক্ষেতে লাশ পাওয়ার পর বেশি সাহস করে একদিন সে আকবর আলি সাহেবের বারান্দায় গিয়ে হাজির হয়। নিজের ইজিচেয়ারে চোখ বুজে আধশোয়া অবস্থায় থাকা আকবর আলি টের পান যে কেউ এসেছে।কিন্তু চোখ খুলে যাকে দেখলেন তাকে ঠিক চিনতে পারলেন না। বললেন—কেডা তুমি---/আজ্ঞে আমি মফিজ মিয়ার ব্যাটা জব্বার---/ও আইচ্ছা ভালা—তুমারেত আগে দেখচি মনে অইতাছেনা—থাক কই তুমি---/আজ্ঞে আমিত গেরামেই থাহি---/ও আইচ্ছা তা এইহানে কুন কামে—/আজ্ঞে লতিফ ভাইরে দেহিনা অনেকদিন, তেনা্র লগে একটা কাম আছিল—/তুমি কি লেহাপড়া কর—/আজ্ঞে না—/তুমি লেহাপড়া করনা,লতিফের লগে তুমার কাম,বুঝতাছিনা কি কইবার চাও,তয় হুন, লতিফত ঢাকায় থাইক্যা পড়তো , কিন্তু কয় মাস তার কুন খবর পাই না। তা এহন কও তুমার কামডা কি--। জব্বার এই পর্যন্ত শুনে একটু বেকায়দায় পড়ে গেল। এবার তার উঠে পড়তে হয়। --আজ্ঞে চাচা কাম তেমন কিছু না –লতিফ ভাই আহোক--ঠিক আছে--আইজ আমি যাই--। বলে আর দেরি না করে সে বারান্দা থেকে নেমে পড়লো। এবং তাড়াতাড়ি পা চালালো। আকবর আলি তার গমন পথের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন।

(চলবে)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.