নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

রাজা সরকার

আমি একজন সামান্য লেখক।

রাজা সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফিরে দেখা এক জন্ম কথা।

২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৫:১০

ফিরে দেখা--২২,২৩

২৪
খবরটা জব্বারের মারফত গ্রামে এলো। আকবর আলি মিলিটারি ক্যাম্পে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে আনতে যেতে হবে। আগের দিন লোকটা হেঁটে হেঁটে পুলিশের সঙ্গে গেল আর পরের দিনই এই খবর। সালাউদ্দিন খবরটা শোনার পর দেরি করেনি। জনা পাঁচেক লোক জুটিয়ে নৌকা করে সে মোহনগঞ্জের দিকে রওনা হয়ে গেলো। লোক কি আর সহজে যোগাড় করা যায়! ক্যাম্পের নাম শুনে সবাই ভয় পায়। তবু যুবকদের বাদ দিয়ে ক’জন মাঝ বয়সী নিয়েই তারা মোহনগঞ্জ গেল। ফিরলো সন্ধ্যের আগে আগে। আসার পথে নৌকা নিয়ে অনেকটা ঘুরে তারা আমিত্তিপুরের ঘাটে এসে উঠলো। প্রায় অর্ধচেতন বিধ্বস্ত আকবর আলি—দেখেই বোঝা যায় যে তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। মেরে ফেলেনি যে এই ভাগ্য। মিলিটারি ক্যাম্প থেকে প্রাণ নিয়ে ফেরা ভাগ্যের ব্যাপার। আকবর আলির বৃদ্ধা স্ত্রী স্বামীকে দেখে নিজেই প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে শুশ্রূষা করার জন্য গ্রামেরই দুজন মহিলা এলেন। একা আছেন বলে গ্রামের দুজন ছেলে আগের রাতেও আকবর আলির বাড়িতে রাতে ছিল। আজও তারা থাকবে। যোগেশ ডাক্তার একবার গিয়ে দেখে এসেছে। আলাদা করে সালাউদ্দিনকে বলে এসেছে অবস্থা ভালো নয়। রাইতে খবর টবর লইন যে--।

পরের দিন সাতসকালে দু দুটো খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো । একটা আকবর আলির ইন্তেকাল আর একটা ঠাকরোকোনার রেলব্রীজ ধ্বংস। নেত্রকোনা থেকে মোহনগঞ্জ আসার রেলপথ বন্ধ। বর্ষার জল কমলে মিলিটারিদের দৌরাত্ম বাড়বে এই আশংকার মধ্যে নতুন এই খবরে ভয় না অভয় বুঝতে পারছে না মানুষ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খুব অনাড়ম্বর ভাবে আকবর আলির দাফনের কাজ সম্পন্ন করা হল। এবারে সমস্যা হলো তার বৃদ্ধা স্ত্রীকে একা বাড়িতে কীভাবে রাখা যায়। তাদের ছেলে মেয়ে এই সময় কে কোথায় আছে কে জানে! দীর্ঘদিনের সঙ্গী স্বামীকে হারিয়ে বৃদ্ধা শোকে প্রায় বোবা হয়ে গেছেন। তবু তিনি যেহেতু গ্রামের মানুষ গ্রামের লোকেরই আপাতত দায়িত্ব তার দেখা শোনা করার।

আকবর আলির মৃত্যু আর ঠাকরোকোনার রেলব্রীজ ধ্বংস--এই দুই খবরে রবীন্দ্রবাবুর বাড়িতে কোন বাড়তি কথা তৈরি হয় না। শরীর টেনে টেনে জীবন যে-ভাবে চলছিল তাই চলছে। ছেলে সুবল মাঝে মাঝে দুরন্ত গতিতে ছুটে এসে নিচু গলায় মাকে খবরের শিরোনাম জানিয়ে আবার একই গতিতে কোথাও উধাও হয়ে যায়। খবর শুনে ভেতরে ভেতরে কাঁপুনি হলেও সুপ্রভা তা প্রকাশ করেন না বা স্বামীকে কিছু জিজ্ঞেসও করেন না। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও একবার রবীন্দ্রবাবু মধুসাধুর বাড়ি ঘুরে আসেন। তবে আজ সকালটা তার আমিত্তিপুরেই কেটেছে। বয়সে তার থেকে কিছুটা বড় হলেও আকবর আলির সঙ্গে তার অনেকটা বন্ধুত্বের সম্পর্কই ছিল। শেষ বয়সে তার এই পরিণতি অভাবনীয়। শেষ যাত্রার সঙ্গী হয়ে তিনি সারাক্ষণ শুধু ভাবছিলেন একটা ডুবন্ত দেশের মানুষ আমরা—ঈশ্বর ছাড়া আমাদের আর কে বাঁচাতে পারে---!

দুই দিন হতে চললো নিয়তিরা রওনা হয়ে গেছে। কোন খবর নাই। অধীর ফিরলেত খবর। এখন কোথায়,কোন জায়গায় আছে, কেমন আছে—ভাবনার আর শেষ নেই। মাথায় সারাদিনই এক ভাবনা। এক টুকরো আশার কথা সালাউদ্দিন আজ এক ফাঁকে শোনালো যে রেলব্রীজ উড়িয়ে দেয়াটা আমাদের অঞ্চলের জন্য ভাল খবর। মুক্তিযোদ্ধাদের নাকি ভাটি অঞ্চলের কোন কোন জায়গায় দেখা যাচ্ছে। দূরে দূরে কোথাও কোথাও সংঘর্ষের খবরও নাকি পাওয়া যাচ্ছে। যদিও এসব ভালো খবর কোন অর্থে বুঝতে রবীন্দ্রবাবুর অসুবিধে হচ্ছে । মুক্তিযোদ্ধা, সংঘর্ষ---এসবের সুত্র ধরে মিলিটারির আগমন ঘটলে আমরা যাই কোথায়! স্থানীয় সাপ্তাহিক বাজারে গেলে এসব তথ্য শোনা যায়। রবীন্দ্রবাবু বহুকাল বাজারে যান না। ফলে খবরাখবর তাকে গ্রাম থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। আর কদিনের মধ্যেই আমন ধান কাটা শুরু হবে। গোটা বর্ষাকালটা নানা রকম দুঃসংবাদের স্রোতে কাটাতে কাটাতে কৃষকরা এখন যেন কাজ চাইছে। কাজ পেলে যেন প্রাণের ভয় তাড়ানো সম্ভব হবে।
২৫
নৌকা লগি দিয়ে ঠেলে মাঝ গাঙে নেয়ার পর অধীর বৈঠা নিয়ে বসে। জল বেশি। এবার সঙ্গী হিসেবে সে হানিফ ছাড়াও গ্রামের আর একজন ছেলেকে নিয়েছে। তার আসল নাম পরাণ। পরাণ অধীরেরই ছেলে । কিন্তু এটা বলা যাবে না নিরাপত্তার খাতিরে। তারা দুজনেই মুসলমান পরিচয়ে যাচ্ছে। বুদ্ধি কাজে লাগবে কিনা কেউ জানে না। তবু বিপদে একজনের পরিচয় ফাঁস হলে দুজনেই যাতে বিপদে না পড়ে। বাঁচার জন্য কত কি করতে হয়। এখন তার নাম দেয়া হয়েছে মোতালেব। ডাক নাম মৈত্যা। সে তার বাবার মতই দক্ষ মাঝি। সওয়ারি বওয়ায় কাজ সে করে না। সে মালামাল আনা নেয়া করে। হানিফের কাজ টুকটাক। প্রয়োজনে বৈঠাও ধরে। তবে এই সময় অধীর আর মৈত্যা দুজনের হাতেই বৈঠা। মাঝ রাত্তিরটায় তাদের ইচ্ছা রাজাখালি খাল শেষ করে তারা হাঁসকুরি বিল পার হবে। বর্ষায় এসব বিল হাওরে পরিনত হয়। চারদিকে শুধু জল আর জল। দিক ঠিক রাখা মুষ্কিল। তবে এ-সব জল-পথ অধীরের হাতের তালুর মত চেনা। ঘন্টা দুয়েক চলার পর অধীর তার নিজের জায়গায় মৈত্যাকে বসিয়ে একটু তামাক নিয়ে বসলো। হানিফ জোরাজুরি করছিল বৈঠা ধরার জন্য। তাকে বৈঠা দেয়া হলো বটে,কিন্তু সাবধান করে দেয়া হলো যে জলের শব্দ যেন বেশি না হয়। অন্য সময় হলে এই পরিস্থিতিতে গুন গুন করে গলায় গান আসার কথা । কিন্তু আজ তা সম্ভব নয়। শুধু আজ কেন, মাঝিদের গলা থেকে গান ক’মাস হলো মুছে গেছে।
নৌকা ভেসে চলার তাল শরীরে প্রবাহিত হতে না হতেই বাচ্চাদুটো ঘুমিয়ে পড়লো। ভাদ্র-আশ্বিনের ভেজা গরম উধাও। খাল, যা এখন অনেকটা নদীর মতো— শরীর জুড়ানো হাল্কা বাতাস দিচ্ছে। নিয়তিরও চোখ বুজে বুজে আসছে, আবার পরক্ষণেই জেগে উঠছে। নৌকার ছইয়ের ভেতরটা খারাপ না—তাদের একটা পরিবারের পক্ষে চলে যায়। দুই দিকেই ঢাকা আছে। এইরকম নৌকা করে ছোটবেলা নিয়তিরা কত গেছে। ভাটির দেশের মানুষের কথাই আছে “ বর্ষায় নাও, হেমন্তে পাও”। ঘুম নেই দিবাকরের। ঠায় বসে সে । নৌকার সামনের দিকে ছইয়ের বাইরে । বিগত ক’মাসে দিবাকর চুল দাড়ি কিছুই কাটেনি। লুঙ্গি আর গেঞ্জিতে তাকে এখন আবহমানের এক নৌকাজীবী বলেই মনে হবে। মাঝে মাঝে খুব আড়াল করে বিড়ি ধরাচ্ছে আর টানছে। আদিগন্ত জল আর রাত্রির ফুরফুরে বাতাস তাকে কখনো আনমনা করতে পারছে না। মাথায় চিন্তা কীভাবে পৌঁছোবে গন্তব্যে। দুপাশের ঘুমন্ত জনপদ থেকে এখন আর আলোর ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছেনা। অর্থাৎ রাত হয়েছে।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সবাই যাহোক কিছু খেয়ে এসেছে। এখন প্রায় মধ্য রাত। তার মধ্যে মাঝিদের টানা পরিশ্রম চলছে, ক্ষিদে লাগার কথা। ছইয়ের ভেতর থেকে শুধু জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ বা কথা শোনা যাচ্ছে না। একটু আগেই নিয়তি জেগে উঠে বসেছে। পাশে কখন এসে দিবাকর শুয়ে পড়েছে টের পায় নি। সন্ধ্যে রাতের জমাটি অন্ধকার এখন বেশ ফিকে হয়েছে। মেঘ মুক্ত আকাশের এই আলোই যেন তাদের দরকার। নৌকার পেছন দিক ঢাকার কাপড় সরিয়ে নিয়তি দেখলো পরাণ আর হানিফ পাটাতনের উপর ঘুমিয়ে আছে। একলা অধীর কাকা বৈঠা বেয়ে চলেছে। নিয়তি বলল—কাহা কিছু খাইবাইন—চিড়া মুড়ি গুড় আছে—দিয়াম ?---হ মা খাওন ত কিছু লাগেই—আইচ্ছা রও আর একটু বাইয়া লই।

অধীর আরো কিছুটা বেয়ে একটা জায়গায় গিয়ে নৌকাটা লাগালো। যেদিকে লাগালো সেদিকটায় ফসলের ক্ষেত—কাছাকাছি ঘরবাড়ি নেই । নদীর অন্যদিকটায় আঁচ করা যায় গ্রাম আছে। সামনে তাকালেই চোখে পড়ে বিশাল জলরাশি। ঐটাই হাঁসকুরি বিল । এখন হাওরের রূপ তার। পাড়ের দিকে লগি পুঁতে নৌকাটাকে বেঁধে ছেলে দু জনকে ডেকে তুললো অধীর। নিয়তির উদ্দেশ্যে বলল—লও মা অহন চাইলে তুমি পাড়ে লামতে পারবা—পরিষ্কার জাগা—জামাইরে লইয়া লামতে পার। কথা বার্তার মধ্যে দিবাকর উঠে পড়লো। একটা বালতি আর মগ নিয়ে সে আর নিয়তি আস্তে আস্তে মাটিতে পা রাখলো। দিবাকর আর নিয়তি নামার পর একসময় বাচ্চা দুটো উঠে পড়ে। অধীর দাদুকে তারা চেনে, কিন্তু মা বাবাকে না দেখে তারা অবাক চোখে চারদিকে খুঁজছে। ছইয়ের বাইরে এসে তারা দুই ভাই দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একজন আস্তে আস্তে অধীরকে জিজ্ঞেস করলো--দাদু মায় কই গেছে। অধীর সমস্যাটা বুঝে গিয়ে বললো –মায় আইতাছে—অহনি আইয়া পড়বো —তুমরা মুতবা ভাই—তাইলে এইহান থাইক্কাই ছাইরা দেওছে দেহি। বলতেই তারা দুই ভাই মজা এবং লজ্জা মিশিয়ে কিছুটা হেসে নিল। যথারীতি তারা নৌকাতে দাঁড়িয়েই পেচ্ছাব করে নিল। নিয়তি ফিরতে ফিরতে অধীর ব্যাপারটা সামলে নিল।

একসময় সকলেই নৌকায় এসে বসলো। নিয়তি টিন খুলে চিড়ে মুড়ি আর গুড় দিল সবাইকে। বাড়ি থেকে আনা খাওয়ার জল এখনও চলবে। পরে বিলের মাঝামাঝি থেকে খাওয়ার জল নেয়া হবে। কিছুটা বিরতি, কিছুটা বিশ্রাম শেষে তারা আবার রওনা হলো। এই বিল, যা বর্তমানে হাওড়ে রূপান্তরিত ভোরের আগেই পাড়ি দিতে হবে। আকাশ পরিষ্কার, বাতাস তীব্র নয়---এটাই হাওড় পার হওয়ার আদর্শ পরিবেশ। এই ভাটি অঞ্চলে জল-পথে রাত বিরেতে তেমন বিপদের কথা জানা নেই। তবে এখন দিনকাল আলাদা। অধীরের ইচ্ছা এই বিলটা পার হয়ে পরের বিলে পড়ার আগে জায়গা বুঝে থামতে হবে অথবা চলতে হবে। তারপর আছে রান্না খাওয়ার সামান্য ব্যবস্থা করা। দিনের আলোতে এলাকার অবস্থা আঁচ করা যাবে। এখন নৌকা বাইছে হানিফ আর মৈত্যা। অধীরের ঘুম পাচ্ছে, তবে সে ঘুমোচ্ছেনা। বিলের মাঝ বরাবর এলে নৌকার মুখ কোনদিকে যাবে দেখিয়ে সে একটু ঘুমোবে। (চলবে)

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৫:২৮

চাঁদগাজী বলেছেন:



অনন্ত যাত্রা?

২| ২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৫:২৯

চাঁদগাজী বলেছেন:

ওহ স্যরি, শুরু হয়েছে অনেক আগে, বুঝতে পারিনি।
ভালো

২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:৩১

রাজা সরকার বলেছেন: মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.