![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফিরে দেখা---২৪,২৫
২৬
ভোর হতে না হতেই মানুষজনের কথায় ঘুম ভেঙ্গে গেল সবার। অনেক কথার মধ্যে একটা চড়া গলা শোনা গেল বলছে—নাউ কার—যায় কই—এই বেডা হুনছ না জিগাইতাছি। একবিল থেকে আর এক বিলে গিয়ে পড়ার পথ এই সরু খাল। দু পাশেই ঘর বাড়ি। বর্ধিষ্ণু গ্রাম। প্রশ্ন-কর্তার দিকে তাকিয়ে অধীর বুঝে নিল এরা শান্তিবাহিনির লোক। নৌকা করে টহল দিচ্ছে। হাতে কয়েকজনের বন্দুক আছে। নিজে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্নকর্তাকে সালাম জানিয়ে গত কয়েকবারের অভিজ্ঞতা দিয়ে অধীর বিষয়টা সামলে নিল। ‘পোয়াতী মাইয়া’ আর ‘হাসপাতাল’ শুনে তাদের আপসে যেতে দিল। একটা বাঁধা পাড় হওয়া গেল।
ইচ্ছে ছিল একটু ছায়া দেখে নৌকা ভিড়িয়ে সকালের দিকেই রান্না খাওয়ার কাজটা সেরে নেবে। হলো না। সামনেই গাইলা বিল। মাছ ধরার নাউ দেখা যায় অনেক। ছায়ার প্রশ্ন নেই। বেলা বাড়তে বাড়তে বাচ্চাদের খিদেও বাড়বে। বড়োরাও বাদ যাবে না। বিল শান্ত দেখে চলন্ত নৌকাতেই নিয়তি দেরি না করে তোলা উনুন জ্বালিয়ে এক হাঁড়ি ভাত বসিয়ে দিল। হানিফ সাহায্য করছে। করিৎকর্মা হানিফের কথা এইসব রান্না সে-ই রাঁধতে পারে। তার কথা চাচির শরীলডা বালা না—চাচি শুয়ে থাকুক, সে-ই রান্না করে ফেলবে। কিন্তু কথা শুনে নিয়তি হাসলেও তার হাতে পুরোটা সে ছেড়ে দেয়নি। চাল ডাল ধোয়া, আলু কাটা, জল এগিয়ে দেয়া এসব টুকটাক সে করে দিচ্ছে আর এইসব বিলের গল্প সে চাচির সঙ্গে করে যাচ্ছে। তার ধারণা চাচির এসব অচেনা। একসময় সে বললো সকলে চাইলে সে এখানে মাছও ধরে দিতে পারে। তার কাছে ছোট একটা জাল আছে । আর বড়শিও আছে। এই বিলে নাকি অনেক মাছ। কিন্তু চাচি মাছের ব্যাপারে অরাজি। রান্নার নানা ঝামেলা। এই শরীর নিয়ে সে কোনমতে এইটুকুই করতে পারছে। নৌকায় এই লম্বা সময় বসে বসে তার পায়ের অবস্থা ভাল না।
বর্ষায় বিল উপচানো জল যেখানে রয়েছে সেখানে গভীরতা কম। এগুলো আসলে ছিল ফসলের ক্ষেত। বর্ষার ক’মাস ডুবে থাকে। কাছাকাছি জলের ভেতর জেগে ওঠা একটু ডাঙ্গা অংশ দেখে সেখানে লগি পুঁতে নৌকা বাঁধা হয়েছিল। উদ্দেশ্য খাওয়ার দাওয়া । রান্না হয়ে গেছে। ভাত, মুসুরির ডাল আর আলু ভাজা। হানিফের মতে ‘জব্বর খানা’একখান পাকানো হইছে। কেউ কেউ খাওয়ার আগে স্নানটানও করে নিল । সমস্যা হলো নিয়তির। প্রাকৃতিক কাজ তথা স্নানাদির জন্য তার একটু আড়াল লাগে। সবার স্নানাদি হওয়ার পর দিবাকর নিয়তিকে নিয়ে সাবধানে নেমে পড়লো জলে। জল খুব বেশি না । তবে কিছুটা জল ভেঙ্গে গিয়ে মাটিতে পা রাখতে হয়। বালতি ঘটি সহ নিয়তি একটু তফাতে গিয়ে কোনমতে স্নানাদি সেরে নিল। শরীর জলের স্পর্শ পেতেই একটু সতেজ হলো মনে হচ্ছে। বদলে নিল কাপড়ও। দিবাকর নিয়তি কেউ এতক্ষণ খেয়াল করে নি একটি ছিপ নৌকা প্রায় তাদের নৌকার গা ঘেঁসে এসে থেমে রয়েছে। নৌকায় বেশ ক’জন মানুষও আছে। শোনা যাচ্ছে অধীর মাঝির গলা। হঠাৎ চোখে পড়তেই দিবাকরের শরীর প্রায় ঠান্ডা হয়ে গেল। চোখে পড়লো তারা নাউ এর পাটাতন তুলে তুলে দেখছে। এক সময় দূর থেকে তারা নিয়তি আর দিবাকরকেও ভালো করে লক্ষ্য করলো। অধীর বা তার ছেলেরা কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে কোন ইশারা করছে না। তবু তারা ধীরে ধীরে জল ভেঙ্গে নৌকার দিকে এগোতে লাগলো। ততক্ষণে অবশ্য আগত নৌকাটি আবার চলতে শুরু করে দিয়েছে। দিবাকর সন্দিগ্ধ চোখে সেদিকে মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো। তা হলে এটা কি সেই মৃত্যুযাত্রার সূচনা? নৌকায় ওঠার পর নিয়তির কাছ থেকে টুকরো টুকরো করে সে এই মুক্তাগাছা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কী ভাবে জন্মালো সবটাই শুনে নিয়েছিল। শোনার পর থেকেই তার অনুভূতির স্তরে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণার জন্ম হয়েছে। এখনকার এই ঘটনা সেই যন্ত্রণাকেই যেন খানিকটা খুঁচিয়ে দিল। যা তাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ জীবিত থাকবে। বহিরঙ্গে যতই তারা হিন্দু পরিচয় মুছে ফেলুক, একটু চেপে ধরলেই তা প্রকাশ হয়ে যাবে। সঙ্গে আনা বোরখা আর সুন্নতি টুপি কতক্ষণ বাঁচাতে পারবে।
খাওয়া দাওয়ার পর একসময় মৈত্যা আর হানিফের হাতে বৈঠা দিয়ে অধীর সামনের দিকে এলো। ছৈএর বাইরে দিয়ে আসাতে নৌকা কিছুটা এক পাশে হেলে গেল। অনভ্যস্ত নিয়তি ও দিবাকর তাতে চমকে গিয়ে উঠে বসলো। একটু তন্দ্রা মত এসে গিয়েছিল।–জামাই বাবা কি ঘুমাইছেন --। গলা শুনে বুঝতে পারলো অধীর এ পাশে এসেছে। দিবাকর আব্রু ঠেলে বাইরে এসে বসলো। বললো---না ঘুম আর আহে কই। দিবাকরের দেয়া একটা বিড়ি ধরিয়ে অধীর বলতে শুরু করলো। বোঝা গেল সে কথা বলতেই এসেছে। তার বক্তব্য হলো পথের পরিস্থিতি ভাল ঠেকছে না। কতদূর যাওন যাইব বলা মুষ্কিল। যাইতে পারলে আশা করা যায় সন্ধ্যে নাগাদ ধরের খালে গিয়ে পড়বো। কথা শুনে নিয়তিও আব্রু সরিয়ে মুখ বার করলো। তা দেখে অধীর আবার বললো –হুনছত মা সবই—অহন একটা মত দাও এরপর কিতা করণ।
সময় মতই তাদের নাও ধরের খালের মুখে পৌঁছে গেছে। কিন্তু সেখানে বেজায় ভিড় নানা ধরণের নৌকার। একটু ফাঁক মত জায়গা পেয়ে তারা তাদের নৌকা ভিড়িয়ে দিল। অধিকাংশ নৌকাতেই রান্নার আয়োজন। অধীর আর হানিফ পাড়ে গেল খাওয়ার জল জোগাড় করতে। এখানে অধিকাংশ নৌকা মাল বোঝাই। দু একটায় সওয়ারী আছে। সবাই এখানে আটকা পড়েছে না বিশ্রামের জন্য থেমেছে বোঝা যাচ্ছে না। দিবাকরকে দেখে পাশের নৌকা থেকে একজন জিজ্ঞেস করলো—মিয়া যাইবাইন কুয়ানে? উত্তরে ‘নেত্রকোণা’ শুনে একজন খুব আশংকিত হয়ে পড়লো। আর একজন রসিকতা করে বললো—ক্যারে মেলেটারিরা দাওয়াত দিছে নি আফনেরারে--।
ইতিমধ্যে আরো দু একজন নতুন নৌকার অতিথিদের ব্যাপারে আগ্রহী হইয়ে উঠলো।----কইত্থন আইছুইন—যাইবাইন কই—কেরে যাইতাছুইন—ইত্যাদি নানা প্রশ্নে একটা জিনিষ সাব্যস্ত হয়ে গেল যে কাজটা দিবাকররা মোটে ভাল করে নাই—অসুখ বিসুখে এখন ঘরে পইড়া মরণ বালা—আর নেত্রকোনায় এখন লোক কই, যা আছে সব রাজাকার , শান্তি আর মিলিটারি। সব পলাইছে। হিন্দুত একঘরও নাই—আওয়ামী করা মুসলমান নেতা কর্মী কেউ নাই--। আর রাত হলেই শুধু খুনাখুনি গোলাগুলি । মগরা নদীতে রাতে যাওয়া মানে যমের হাতে পড়া। তবু হাসপাতালে যেতে হলে দিনে যাওয়াই ভালো।
জায়গাটা অধীরের বিশেষ চেনা। যাতায়াতে বহুবার থেমেছে। জল কোথায় পাওয়া যায় জানে। এখান থেকে মাইল দুয়েক উত্তরে গেলে সেই ঠাকরোকোনার রেলব্রীজ। কিন্তু এখন সন্ধ্যার অন্ধকারে কেমন যেন ভুতুড়ে লাগছে। খুব টিমটিমে আলো নিয়ে দু একটা দোকান । লোকজন বেশ কম। নদীর পাড়ে যা দু একটা বাড়িঘর ছিল যার একটাতে ছিল টিউবকল—সেগুলো মনে হয় ফাঁকা। তবে টিউব কলে দু একজন আছে দেখা যায়। তারা দুখানি মাটির কলসি ভরে নিল। কালকের জন্য খাওয়ার জলের আর চিন্তা নাই। একটু এগিয়ে এসে কলসীটা মাটিতে রেখে অধীর ভাবছিল এক আনার বিড়ি নেবে কিনা। হানিফ লক্ষ্য করছিল কিন্তু--। কোমরে গোঁজা পয়সাটা বের করে মুখ তুলতেই অধীর দেখলো তাদের ঘিরে প্রায় জনা পাঁচেকের একটি দল। সবাই কম বয়সী যুবক। তাদের একজন তাদের যাবতীয় খোঁজ খবর নিতে প্রশ্ন করা শুরু করলো। একসময় তাদের মধ্যে দুজন অধীরদের সঙ্গে সঙ্গে নৌকাতেও এলো। সব দেখে শুনে তারা বলল যে ডাক্তার হাসপাতাল করতে হলে দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসতে হবে। এদিকের অবস্থা ভালনা। আমরা মুক্তিবাহিনির সাহায্যকারী। দুজন চলে যাওয়ার পর বোঝা গেল তারা একটা মুক্তিবাহিনির ঘাঁটিতে এসে পড়েছে। একদিকে নিরাপত্তা অন্যদিকে ভয়। তবু যেন সবার মনে একটা আনন্দের ভাব দেখা গেল। কিন্তু খারাপ করলো নিয়তির শরীরটা। সে শুয়েই থাকলো। রাতের রান্নার ভার নিল হানিফ।
বাড়ি থেকে বেরোনোর পর আজ রাতেই সবার ঘুম বেশ গভীর । গত সারাটা দিনের ক্লান্তি ছিল সবার শরীরে। আশেপাশের একটা নিরাপদ বলয়ের কল্পনাও তাদের আরো আশ্বস্থ করে থাকবে। কিন্তু মাঝ রাতের দিকে চাপাস্বরে কিছু কথা শুনতেছিল অধীর। একসময় তাদের নৌকায় কারোর উঠে আসাও যেন টের পেল। তাতে অধীরের ঘুমটা পুরোপুরি ভেঙ্গেই গেল। শুনতে পেল চাপা গলায় কেউ বলছে—অ মিয়া নাউ খুইল্যা ভাগ তারাতারি—উড উড—সময় নাই কইলাম--। অধীর জেগে দেখতে পেল একজন তাদের নৌকা থেকে লাফ দিয়ে পাশের নৌকায় চলে গেল। অন্যান্য নৌকাগুলো ইতিমধ্যেই নদীর মাঝামাঝি চলে গেছে। আধীর খব দ্রুত নৌকার বাঁধন খুলে লগি টেনে নিয়ে সেও নৌকা ঠেলে ভাসিয়ে দিল। একসময় পাশাপাশি নৌকার মাঝিদের কাছ থেকে জানা গেল যে শম্ভূগঞ্জ আর ময়মনসিং এর মাঝে ব্রহ্মপুত্র ব্রীজ ভেঙ্গে ফেলেছে মুক্তিযোদ্ধারা। খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই মিলিটারি এবং তাদের দোসররা ব্যাপক হত্যাকান্ডে মেতে উঠেছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের ভাটি অঞ্চলের দিকে সরে যেতে হবে। তাদের পরামর্শ অধীর যেন তার নৌকা নিয়ে যতটা সম্ভব তফাতে থাকে। বোঝাই যাচ্ছে নৌকাগুলোতে কিছু মুক্তিযোদ্ধাও আছে।
(চলবে)
©somewhere in net ltd.