নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

রাজা সরকার

আমি একজন সামান্য লেখক।

রাজা সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফিরে দেখা এক জন্ম কথা।

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫১

ফিরে দেখা---২৬

২৭
বিগত ক’মাস যাবৎ দেশজুড়ে নানান অরাজকতা,গোলমাল,স্বাধীনতার লড়াই, মুক্তি আন্দোলন-- ইত্যাদির মধ্য থেকে ‘সংগ্রাম’ নামে একটা শব্দ মানুষের মুখে মুখে বেশ চলছে। প্রত্যন্ত গ্রাম দেশেও এই শব্দটা দিয়েই অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে। যেমন,- অমুক জায়গার সংগ্রামের খবরডা হুনছুইন নাহি—বা হালার পুতেরা সংগ্রামের ডরে আর এই বর আইতনা—ইত্যাদি। আর এই শব্দটির সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের নানান কর্মকান্ডই মূলত যুক্ত। বঙ্গদেশের সুবিখ্যাত বর্ষা যখন পাততাড়ি গোটাতে শুরু করেছে তখন সেই ভেবে রাখা মিলিটারি আক্রমণের আতঙ্কও ছিল পাশাপাশি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা যে গোপনে গোপনে এতটা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে তা সাধারণ মানুষেরা ধরতে পারেনি। এদিকে ওদিকে ‘সংগ্রাম’এর ঘনঘটায় তারা যুগপৎ শিহরিত ও চিন্তিত।

২৫শে মার্চ ও তৎপরবর্তী কিছু ভয়াবহ ঘটনা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ পাওয়াতে পাক মিলিটারি প্রশাসন তার ক্লিনজিং অপারেশন এখন খুব সংহত উপায়ে গোপনে গোপনে করে যাচ্ছিল। তাদের আশা ছিল বর্ষার পরপর তারা তাদের কাজ শেষ করে ফেলতে পারবে। কিন্তু ময়মনসিং জেলার পরিস্থিতি সেই সংকেত দিচ্ছে না। জেলার পূর্ব অংশের সঙ্গে রেল যোগাযোগটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আর তারই দু দুটো ব্রীজ ধ্বংস! জায়গায় জায়গায় মিলিটারি ক্যাম্প ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার মুখে। কারণ সড়ক পথ এই জেলায় অধিকাংশ কাঁচা । বর্ষায় তা এখন প্রায় চলাচলের অযোগ্য। তার উপর নদীবহুলতাও একটা সমস্যা। অনেক নদীতে মোটর যান পারাপারের মত ব্রীজ নাই। ফলে বাধ্যত জলপথ এবং স্থানীয় রাজাকার, শান্তিবাহিনি ইত্যাদির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সবচেয়ে চিন্তার বিষয় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতা নিয়ে। আপাত অশক্ত, দুর্বল স্বাস্থ্যের মানুষগুলো এত সাহস কোথা থেকে পায়—উস্কানির কথা বলা হলেও, শুধু ইন্ডিয়ার উস্কানিতে এতটা সাহসিকতা---বলা হয় ‘দেশপ্রেম’---সত্যি সত্যি এই ‘দেশপ্রেম’ শব্দটার কোন বাস্তবতা এখনও আছে কি না---এত হত্যা ধর্ষণের পরেও---থাকলে কীভাবে থাকতে পারে---কিঞ্চিৎ মস্তিষ্কওলা সামরিক অফিসারেরা ভেবে পাচ্ছেনা। ‘ব্লাডি বাঙালি’ উচ্চারণ করতে ঠিক আগের মত জোশ পাওয়া যাচ্ছেনা।ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে বিগত যুদ্ধের কথিত এত বীরত্বের গাঁথা কি শুধু নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে মারা আর নারীদের উপর বীভৎস অত্যাচারের মধ্যেই হারিয়ে গেল! মিলিটারি প্রশাসনের প্রয়োগ পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করার কোন ভাবনা চিন্তা উপর মহলে হচ্ছে কিনা কে জানে!

অপারেশনের অফিসাররা এখন নিজেদের রক্ষা করার জন্য স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে ব্যস্ত। সড়ক পথে ময়মনসিং টু মোহনগঞ্জ যোগাযোগ স্থাপনের আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। শহরের মহল্লা থেকে গ্রাম সর্বত্র শান্তি বাহিনিকে তাদের সহযোগীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। খুব বেশি প্রয়োজন হলে মিলিটারি কল করতে বলা হয়েছে। নদ নদী জল জঙ্গলের দেশে গেরিলার প্রথম টার্গেট হওয়ার দুর্ভাগ্য তারা এড়াতে চাইছে। কিন্তু কার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে---গত ক’মাস ধরে যা যা হয়েছে তাতেত সব টার্গেট প্রায় শেষ। ঝাঁপিয়ে পড়তে হলে নিজের ভাই বেরাদরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। তবু চেষ্টার ত্রুটি রাখা চলবে না। ঘরে ঘরে গেরিলা খোঁজ, আওয়ামী খোঁজ, কাফের মালাউন খোঁজ, প্রয়োজনে শিশ্ন চেক করো। মেয়েছেলেদের হিন্দু মুসলমান নেই। ঐসব ঘরের আউরত হলেই নির্দেশিকা মোতাবেক কাজ। তবে ঢাকা সহ বড় বড় শহরগুলিতে মিলিটারি আগের মতই সক্রিয় থাকছে। মাথা গরম কোন অফিসারের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে ‘মাদারচোদ’---বর্ডারে বসে বসে বর্ডার গার্ডরা কী করছে-- দুষ্মন ইন্ডিয়ান ফৌজীরা ট্রেনিং দিয়ে দিয়ে গেরিলাদের দেশের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। শোনা যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে নাকি তারাও কিছু কিছু থাকছে। হাড্ডিসার বাঙালির চেহারা মনে হলেই মাথা আরও গরম হয়ে যাচ্ছে। যদিও উপর মহল থেকে বলা হয়েছে ‘মানুষ চাই না—মাটি চাই’। প্রয়োজনে সব শেষ করে দাও। মানুষ আমরা পয়দা করে নেব। একদম খাঁটি মুসলমান ।
২৮
অধীরের সাহস আর অভিজ্ঞতা বলছে রাতটা পার হলে কোন একটা ডাঙ্গা দরকার। জলে এখন বেশি বিপদ। মনে মনে প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো যে নেত্রকোণা হাসপাতালেই যাবে। নদীর ঘাট থেকে হাসপাতাল কাছেই। এখান থেকে নেত্রকোণা খুব বেশি দূর নয়। নিয়তি মায়ের শরীরও ঠিক নেই। ডাক্তার দেখানোর সুযোগে কয়েক ঘন্টা হাসপাতালে থাকা যাবে। খোঁজ খবর নিয়ে পরে যা করার করা যাবে। এখন সঙ্গের নৌকাগুলোও আর কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে না। অধীরও আর এই অঞ্চলের কাছাকাছি থাকার সাহস পাচ্ছে না। মৈত্যা আর হানিফকে বৈঠা দিয়ে দিবাকরের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলো। নিয়তি শোয়া বসার মধ্যেই আছে। কথা বলছে না খুব একটা। ঘন ঘন প্রস্রাবের উপসর্গ হয়েছে। মাঝে মাঝেই তার প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে হচ্ছে। নৌকার সামনের দিকটায় কেউ তাই যাচ্ছে না। দিবাকরকে নিজের পরিকল্পনা শুনিয়ে সে নিজেও একটা বৈঠা নিয়ে ছেলেদের দ্রুত হওয়ার নির্দেশও দিল। মরিয়া অধীর মনে মনে ভগবানকে স্মরণ করে চলতে লাগলো। অসুস্থ পোয়াতী নিয়ে যাওয়ার কারণে যদি কেউ তাদের হত্যাও করে তা হলে বুঝবো যে দুনিয়া খারাপ মানুষের হাতে চলে গেছে। সেখানে আমরা বাঁচি কেমনে!

মগরা নদীতে পড়তে পড়তে কিছুটা বেলা হয়ে গেল। রাতে না পড়ে ভালই হয়েছে। বেলা ১০টার মধ্যে তারা হাসপাতালের ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে দিল। পাশাপাশি খান চার পাঁচেক নৌকাও আছে। এখন দিবাকর আলাউদ্দিন ব্যাপারির কল্পিত খোলসে ঢুকে গেল। নিয়তি ঢুকে গেল ময়না বিবির খোলসে। সঙ্গে পরে নিল সেই মুক্তাগাছা থেকে আনা বোরখাটাও। বাচ্চা দুটোকে চিড়ামুড়িগুড় দিয়ে হানিফের সঙ্গে থাকতে বলা হলো। হানিফকে তাদের পছন্দ। বড়শি দিয়ে নদীতে মাছ ধরার কথা আছে। তাতে তারা খুব খুশি। নৌকাজীবী অধীর অনেকদিন আগে থেকেই কলিমুদ্দি হয়ে আছে। দিবাকর নিয়তি আর অধীর হাসপাতালে গেল। অধীর এর আগেও বার কয়েক হাসপাতালে এসেছে। কিন্তু এবার এসে সে খুব অবাক হলো। মহকুমার একমাত্র সরকারি হাসপাতাল । অথচ বেশি ভিড় নেই। ফাঁকা ফাঁকা হাসপাতাল। আউটডোরে কিছু সময় অপেক্ষার পর একজন ডাক্তার পাওয়া গেল। পরে জানা গেল এখন তিনি একাই ডাক্তার এখানে। রুগির বিবরণ শুনে লেবার রুমের একজন নার্সকে ডেকে পাঠালেন। রুগিকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সব দেখে শুনে রিপোর্ট দিতে বললেন। একসময় রুগি ছাড়া শুধু নার্স এলেন একটা কাগজ নিয়ে। ডাক্তার ইঞ্জেকশন ওষুদপত্র যা লেখার লিখে দিলেন। রুগির বাড়ির লোকেদের বলা হলো ঘন্টাখানিক সময় লাগবে।

বাইরে ঘোরাঘুরি করা ঠিক হবে না ভেবে তারা দুজনই নৌকায় ফিরে এলো। অধীর বলতে বলতে আসলো যে ভগবানের অশেষ করুণা যে সময়মত তারা হাসপাতালে আসতে পারলো আর একটা ডাক্তারও পাওয়া গেল। দিবাকরের মনে অবশ্য দ্বিধা ভয় রয়ে গেছে।কারণ নিয়তিকে হাসপাতালে রেখে আসতে তার মন সায় দিচ্ছিল না। উপায় নেই এতক্ষণ বসে থাকার। কে কোন কথা জিজ্ঞেস করবে তার কি ঠিক আছে! আবার এদিকে বাচ্চাদুটোকেও রেখে গেছে। নৌকায় এসে দেখে ভাত বসিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাতের মধ্যেই আলু সেদ্ধ দেয়া হয়েছে। আজকের রান্নার কাজ মৈত্যা করছে। ভালোই হলো। অধীর আর দিবাকর একদিকে বসে বসে বিড়ি টানছে। মাঝিদের সঙ্গে মাঝিদের একটা আত্মীয়তা থাকেই। পাশের নৌকার এক মাঝি সঙ্গে অধীরকে ডেকে কথা বললো । বলতে বলতে একসময় অধীর নিজে সে-ই নৌকাতেই গেল।

এতক্ষণ খিদের কথা কেউ না বললেও ভাত হয়ে যাওয়ার পর তাদের খিদে লেগে গেল। বাচ্চাদের নিয়ে মইত্যা আর হানিফকে খেয়ে নেয়ার কথা বলল দিবাকর। এরমধ্যে অধীর ফিরে এলো এবং তারা দুজন আবার হাসপাতালের পথে হাঁটা দিল। যেতে যেতে অধীর দিবাকরকে বললো ---হুনেন জামাইবাবা ময়মনসিং যাওনের আর কাম নাই---ময়মনসিং থাইক্যা অহন বেক মানুষ ভাগতাছে---গেলে বিপদ খুব বেশি হইতে পারে---মায়রে লইয়া আর দেরি করন যাইতোনা---কাইল রাইতেই মুক্তির লগে মিলিটারির গোলাগুলি হইছে এইহানে---আমরারে আসতে দেইখা হেই মাঝিরাও অবাক হইছে---আইজ নাহি কার্ফু লাগবো। তারা হাসপাতালে পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিয়তিকে নিয়ে নার্স বাইরে এলো। এখন আর ডাক্তার নেই। আউটডোর ফাঁকা। নার্সই ওষুদ পত্র বুঝিয়ে দিল। বলল ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছে । জ্বর আসতে পারে। চিন্তার কিছু নেই। কমে যাবে। পানি বেশি করে খাওয়াবেন। বাড়ি নিয়া যান। শরীরে রক্ত কম আছে। ভাল খাওয়াদাওয়া করাবেন। আর এই কাগজটা সঙ্গে রাখবেন যত্ন করে। রাস্তাঘাটে লাগতে পারে। বলে প্রেসক্রিপশনটা দিবাকরের হাতে দিল। আরো বললো যে পনের দিন পর আবার এখানে দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মনে মনে সবাই ভাবলো আর কি আসা হবে---।

নৌকায় ফিরে বাকি ভাত তারা খেয়ে নিল। নিয়তি খুব সামান্য খেল। খেয়ে ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। অধীর আর কাল বিলম্ব না করে নৌকা ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে নিয়তিকে দিবাকর চারদিকের পরিস্থিতির কথা বললো এবং শেষে বললো যে আমরা শ্রীমন্তপুর ফিরে যাচ্ছি। নিয়তির চোখে এবার এই প্রথম জল দেখলো দিবাকর। মনে মনে দিবাকর ভাবলো মরণ ছাড়া কোনকিছুইতো আমাদের হাতে নেই । ছৈ এর বাইরে এসে সে দেখলো তাদের নৌকা নেত্রকোনা ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে। তিনজন মিলে বাইছে।
(চলবে)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.