![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিংক---পদাতিক/২৮
২৯
পুলিশ আর দেরি করেনি। ফিরে আসার দিন দশেকের মাথায় কমলকে তারা তুলে নিলো। সঙ্গে আরও সাতজন দাগি। সব একসঙ্গেই কমলের ঘরে জমা হয়েছিল রাতে। পুলিশ ঢুকেছিল ঊর্মিলার ঘরেও। বাচ্চাগুলো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠাতে পুলিশের জোর ধমক আছড়ে পড়েছিল ঘর জুড়ে। তার মধ্যে শুনতে হয়েছিল—তোর ভাতার কইরে? কোথায় পাঠিয়েছিস? সময় আছে এখনও বল, নয়তো মাগী জানিস-তো পুলিশের চোখ---
--কইছি-তো জানি না—কতবার কমু?
--জানিস না! আচ্ছা, ঠিক আছে—আর একদিন দেখবো কেমন জানিস--। বলতে বলতে পুলিশ অফিসারটা বেরিয়ে যেতেই গন্ধটা পেল। চেনা গন্ধ। মদ।
শেষ রাতের দিকে ঘণ্টা দু’এক ধরে গোটা বস্তি জুড়ে চললো তল্লাসি। তল্লাসি-তো নয়, এক কথায় তাণ্ডব। সব নীরব, টু শব্দ করার উপায় নেই। পুলিশ অপরাধী মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ জনের দলটা কাক ডাকার আগেই বস্তি ছাড়লো। মিলিয়ে গেল ভ্যানের আর জিপের শব্দ।
ঊর্মিলা আবার শুয়ে পড়লো। একসময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। বেলা পর্যন্ত ঘুমনোর অভ্যেস ঊর্মিলার কোন কালে নেই। কিন্তু আজ সকাল আটটা বেজে গেলেও ঊর্মিলার হুঁশ নেই। এদিকে বাচ্চাগুলো উঠে পড়েছে। উঠে নিজেদের মধ্যে তারা খেলাধুলা, ধাক্কাধাক্কি, ঝগড়াজাটি করে চলেছে। কেউ কেউ মাকে মাঝে মাঝে নালিশও করছে। কিন্তু মা’এর তাতে ঘুম ভাঙছে না।
একবার পারুল এলো ঊর্মিলার খোঁজ নিতে। এসে ঘরের বিশৃঙ্খলা দেখে ঊর্মিলাকে প্রায় ঠেলে তুললো সে। ঊর্মিলাও জেগে উঠে বসে ঘরের অবস্থা দেখে অবাক।
পারুল গতরাতের কিছু খবরাখবর দিল ঊর্মিলাকে দিল। তাদের বস্তিটা যে দিন দিন অপরাধীদের আস্তানা হয়ে উঠছে তাও জানালো। ঊর্মিলা মনে মনে ভাবে কবে এটা অপরাধীদের ছিল না---? পারুল এই বস্তিতে খুব বেশিদিন হয়নি এসেছে। মেয়েটি ভাল। ও চায়, গরীব মানুষের বস্তি হলেও অপরাধীরা যেন এখানে আশ্রয় না পায়। কিন্তু এই সব কাজ করা যে কত কঠিন ঊর্মিলা জানে।
অনেকদিন পর পারুল আসাতে তার দৈনন্দিন রুটিনে আজ ছেদ পড়লো। শরীরও ভাল না। একসময় ঊর্মিলা পারুলকে বলল-ও, –নারে আর পারতাছিনা। ভালই-তো ছিলাম রে—ঐ ছোঁড়াটা আওনের আগে। কী বুদ্ধিতে যে করতে গেলাম দোকান—মানুষের চোখ, চোখ ত না, যেন লোহার শলা—তেলে ভাজা থুইয়া আমারেই খাইতে চায়—হায় ভগবান---। তাও যদ্দিন সুবোধটা ছিল—একটা বল ভরসা ছিল। এখন কার ভরসায় কী করি--। ভাবতাছি কাইল থেকে আবার সবজির লাইন ধরুম। দোকান আর করুম না। পারুলও সায় দিল।–হ্যাঁ তাই কর দিদি, একা মেয়েমানুষ তুমি---।
শেষ দিনের তেলেভাজা বিক্রির টাকাটা কোমরে বেঁধে আবার হলদিবাড়ির ট্রেনে চড়ে বসলো ঊর্মিলা। এবার এই সাত সকালে সঙ্গে নিয়ে এসেছে বড় ছেলেটাকে। বছর দশেকের ছেলে। বাকিগুলো ঘরেই থাকলো। পারুলকে বলে এসেছে দুপুরে একবার দেখে যাওয়ার জন্য।
ট্রেনের হকারের কাছ থেকে চা আর পাউরুটি নিয়ে খেতে খেতে চলেছে মা আর ছেলে। পুরনো মুখ আর একটাও দেখা যাচ্ছে না। সব কি কাজ ছেড়ে দিয়েছে?—ভাবতে ভাবতেই ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়ে গেল পবনের মা। এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে বুড়ি। এই বয়সেও চালিয়ে যাচ্ছে। ঊর্মিলাকে দেখে ঠেলেঠুলে কাছে এলো।
--কী গা, এতকাল পর আবার চল্লা কই—
--আর সব কই মাসি?
--সব আর কই—কেউ কেউ খইস্যা গেছে—কেউ কেউ আছে এদিক ওদিক—বেশির ভাক্ রেল-বাজারে দুকান নিছে—
--তা, তুমার খবর কও মাইয়া—শুনছিলাম তুম্যো নাকি কিয়ের দুকান দিছ?
--হ্যাঁ গো মাসি, দিছিলাম ঠিকই—কিন্তু কপাল, কপাল যাইব কই—টিকাইতে পারলাম না—তাই আবার পুরানা পথই ধরলাম---।
৩০
সুবোধ মুস্তাফি এখন সুকুমার মণ্ডল। জাহানারা, নমিতা মণ্ডল। ফারাক্কা অঞ্চলের ভোট বাবুরা তাদের এই নাম তুলে নিয়ে গেছে। আদি নিবাস লেখা হয়েছে জলপাইগুড়ি। রেশন কার্ডও হয়েছে তাদের। এখানে চোখের সামনে রেললাইন নেই। রেললাইন আছে, তবে দূরে। দূরে বলতে এখানে যা চোখে পড়ে তা ফারাক্কার পাওয়ার স্টেশনের চিমনি। চিমনির উচ্চতা দেখে জাহানারা মনে মনে আল্লাহ্’র নাম নেয়। বল ভরসা চায়। উচ্চতার বিবশ করা প্রকাশ আর আল্লাহ্’র ভরসা—এই দু’এর মধ্যে জাহানারা যেন একটু দম নেয়। তবু বেশিক্ষণ চিমনির দিকে তাকাতে পারে না। সে ঘরে ঢুকে পড়ে। এটা ঠিক যে এতদিন-কার বস্তি এটা নয়। একটু ভাল। ভাড়া কম। মাত্র চল্লিশ টাকা। এখন তাদের ঘরে একটা তৃতীয় কণ্ঠ মাঝে মাঝে শোনা যায়। সেই তৃতীয় কণ্ঠের উৎস একটি শ্যামলা রঙের শিশু । নাম রাখা হয়েছে তার লালন। সুবোধের খুব সখের নাম। যে কিনা তাদের বিছানায় প্রায় সারাদিন শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝে শরীরের সব শক্তি সংহত করে সে চীৎকার করে। জাহানারার সতর্ক চোখ কান তাই সব সময় বিছানার দিকে। মাঝে মাঝে পড়শি কল্পনা মাসি এসে আদর করে যায় বাচ্চাটিকে। হাসতে হাসতে বলে—‘আমার নাগর কেমন আছে দেখে যাই’।
অদূরেই সরকারী কোয়ার্টার। কত যে কোয়ার্টার গুনে শেষ করা সহজ নয়। কল্পনা মাসির যাতায়াত আছে ওখানে। তার কাঁথা সেলাইয়ের কাজ। কাঁথা যে এত সুন্দর আর চাহিদার বস্তু হতে পারে—শুনে-তো জাহানারা অবাক। তার আজন্ম চেনা এই বস্তুটির সম্পর্কে আগে তেমন করে কখনো ভাবতে পারে নি। এখন ভাবে। নিজেও সে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করে। সেলাইয়ের মজুরি ভাল। তবে পরিশ্রম আছে। নক্সা অনুযায়ী সেলাই টানতে টানতে পিঠে ব্যথা হয়। কাজটা জাহানারা ছোট বেলাকার অভ্যেসের সূত্রে বেশ রপ্ত করে নিয়েছে। কল্পনা মাসিই ধরিয়েছে কাজটা। সে নিজে কোথাও যায় না। যেতে পারেও না বাচ্চাটার জন্য। মাসিই সব আনে। কাপড়,সুতো---। কিছু নিজে করে, কিছু জাহানারার মত আরো কয়েকজনকে দেয়। নক্সা বুঝিয়ে দেয়। এই সূত্রে এই অঞ্চলে মাসির বেশ চেনা জানা।
জাহানারা মনে মনে ভাবে আল্লাহ্’র দোয়ায় এই যাত্রায় ও তারা বেঁচে গেছে। কল্পনা-মাসির সঙ্গে দেখা আর পরিচয় না হলে, তারা আজ কোথায় থাকত, কোথায় ঠাঁই হত কে জানে! যেভাবে বছর খানেক আগে শিয়ালদহ স্টেশন ছেড়ে ছিল এক ভোরবেলায়—ভাবলে এখনও গা’এ কাঁটা দেয়। এক মাত্র ভরসা ছিল সুবোধের সাহস আর উপস্থিত বুদ্ধি। তাই-বা আর কতক্ষণ মানুষকে বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে—নিশ্চয়ই আল্লাহ্’র দোয়া সাথে ছিল। যদিও সুবোধ এসব শুনে খুব নরম করে হাসে। সান্ত্বনা দেয়।
ট্রেন থেকে সেদিন কেন আমাদের ফারাক্কা স্টেশনে নেমে পড়তে হয়েছিল সুবোধকে অনেক বার জিজ্ঞেস করে করে সেদিন শেষে জানা গেল। ওর কথা হলো—সে দিন আমাদের টিকিট ত কাটা ছিল বঙ্গাইগাঁও পর্যন্ত। কিন্তু যেতে যেতে একবার মনে হলো যে আমাদের নিউ জলপাইগুড়ি হয়েই-তো যেতে হবে । আর বঙ্কু ঠিকাদার বা শিবু মিত্তির যদি খুব বেশি উঠে পড়ে লাগে তবে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে আমাদের পুলিশের মুখোমুখি হওয়া বিচিত্র নয়। তাই মাঝ পথে নেমে পড়া। আর আমাকে না বলার কারণ আমার সহজে ভয় পাওয়া স্বভাবের জন্য। আমার সম্পর্কে কথাটা শোনার পর আমি ওর পিঠে একটা কিল দিয়েছিলাম।
সেদিন ফারাক্কা স্টেশনে তারা নেমেছিল দুপুর বেলা। স্টেশনে তেমন ভিড় ছিল না। কেমন ফাঁকা ফাঁকা । তবে চড়া রোদ। তৃষ্ণা মেটানোর জন্য তারা স্টেশনের জলের কল থেকে চোখ মুখে জল ছিটালো এবং খেলও। অতঃপর স্টেশন থেকে বেরিয়ে তারা রাস্তায় নেমে এলো। কোথায় যাবে—কী করবে—এসব ব্যাপার তখনও ঠিক হয়নি। ভাবনাটা সুবোধের মাথায় সবে চড়তে শুরু করেছে এমন সময়ই হঠাৎ দেখা গেল জাহানারা রাস্তায় বসে পড়ছে। সুবোধ পেছন ফিরে তাকিয়ে তার কাছে যেতে যেতে জাহানারা প্রায় শুয়েই পড়লো রাস্তায়। ঝুঁকে পড়ে সুবোধ জাহানারার মাথা তুলে ধরে কথা বললেও জাহানারার কোন জবাব নেই—চোখ আধ-খোলা। তাদের ব্যাগ পত্র রাস্তার উপর ছড়ানো—সুবোধ জাহানারাকে অর্ধেক তুলে ধরে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। তাদের এই অবস্থা দেখে দু’একজন করে করে ভিড় জমতে থাকলো। অসুস্থ-জন মহিলা বলে অনেকেরই কৌতূহল হলেও প্রকাশ করলো না। বরং কেউ কেউ বললো—রিক্সা করে নিয়ে যান, সামনের বাজারে একজন ডাক্তার আছে। কেউ বললো—তার চে হাসপাতালেই নিয়ে যান।
বিপদটা এত অতর্কিত যে সুবোধ প্রায় নির্বাক। ক’মুহূর্ত এভাবে কাটলো খেয়াল নেই—হঠাৎ ভিড়ের ভেতর থেকে একজন মহিলা, হাতে এক বোতল জল নিয়ে ‘কই দেখি, সর তোরা’—বলতে বলতে সুবোধকে এক পলক দেখে নিয়ে নিচু হয়ে জাহানারার মুখে বেশ ক’বার জলের ঝাপটা দিল। দু’এক মিনিট দেখে মনে হলো যেন কাজ হয়েছে। জাহানারার কথা বলার চেষ্টা করছে। মহিলাটি ভিড়ের দিকে তাকিয়ে একজনকে বললো—এই একটা রিক্সা ডাকতো ভাই। রিক্সা আসতেই মহিলাটি আর সুবোধ দুজনে মিলে জাহানারাকে তুলে দিল রিক্সায় তাদের ব্যাগ পত্র সহ।
এরপর শুধু ডাক্তারখানা নয়, শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের কথামত যেতে হলো হাসপাতালেও। সেখানে ভর্তি করে নেয়ার পর ডাক্তারের কাছে এক প্রস্থ বকাঝকা শোনা ।--কিছুই খোঁজ রাখেন না, এদিকে বাবা হচ্ছেন। পেশেন্টের শরীরে কিছু আছে? রক্তশূন্য—প্রেশার একদম লো—কী করেন আপনি? কোথায় থাকেন?---এরকম আরো নানা প্রকারের অনুযোগ আর প্রশ্নের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে যখন সুবোধ বেশ কাহিল তখনই তার হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো একটা ফর্দ—যান, এখুনি ওষুদগুলো নিয়ে আসুন’।
সময় পার হয়ে গেল তিন দিন, তিন রাত। অতঃপর জাহানারার গলায় স্পষ্ট স্বর শোনা গেল। চোখ খুলে বললো—আমি কোথায়? হাসপাতাল শুনে বললো—ক্যান্--কী অইছে আমার-- আমি থাকুম না এইখানে, নিয়া চল আমারে—হায় আল্লাহ্--কোন্খানে আইন্যা ফালাইলা আমারে---। সুবোধ যতই তাকে সান্ত্বনা দেয়, চুপ থাকতে বলে, জাহানারা কোন কথাই শুনতে চায় না। হাতে স্যালাইনের নল দেখে আর এক দফা প্রশ্ন। কিন্তু প্রশ্ন পর্যন্তই—উত্তর সে শুনতে চায় না মোটে।
এই দম্পতির কথাবার্তা বোধ হয় কর্তব্যরত সিস্টার শুনে থাকবে। একটু পরে তিনি উদয় হয়ে সুবোধকে বাইরে যেতে বললেন। ফিমেল ওয়ার্ডে একজন পুরুষের এতক্ষণ থাকা দৃষ্টিকটু—তাই সুবোধ বিনা বাক্যে জাহানারার দিকে তাকাতে তাকাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
বেরিয়ে আর যাবে কোথায় সুবোধ। এই ক’দিন তার সামান্য মাল পত্র নিয়ে কখনো সে হাসপাতালের আউট ডোর,কখনো জাহানারার পাশে, কখনো ওষুদ কিনতে বা কখনো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একা একা চুপচাপ। এরমধ্যে তার চেহারাও যথেষ্ট ভেঙেছে। চুল দাড়ি উস্কো খুস্কো। যেখানে বসতে পারে সেখানেই একটু করে ঘুমোয়।
স্টেশন প্ল্যাটফর্মে একদিন দুপুরবেলা এভাবেই ঝিমোতে ঝিমোতে একটি মহিলা কণ্ঠের প্রশ্নে সে চম্কে উঠলো ।
--আরে আপনার স্ত্রী-ই না সেদিন রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?
--আজ্ঞে হ্যাঁ। বলে সুবোধ উঠে দাঁড়াতে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মহিলা বলে উঠলেন—না, না, আপনি বসুন বসুন—বিশ্রাম নিন্। তা উনি কেমন আছেন এখন?
--আছেন ভালই,তবে হাসপাতাল থেকে ছাড়তে আরও দিন কয়েক লাগবে—বলেছেন ডাক্তার বাবু।
--হাসপাতাল ! হাসপাতাল কেন?
--না, মানে ঐদিন ডাক্তারখানা যাওয়ার পর ডাক্তারবাবু দেখে বললেন হাসপাতালে নিয়ে যান, লিখে দিচ্ছি।
--তা হয়েছ কী, কিছু বোঝা গেল?
--হ্যাঁ, এই রক্তশূন্যতা, লো প্রেশার---এই সব বললেন ডাক্তারবাবু।
--আচ্ছা, আচ্ছা,তা আপনি এখানে আছেন কোথায়?
--এখানে মানে, এখন-ত ঐ হাসপাতালেই রাতে থাকছি—আর দিনের বেলাটা এদিক ওদিক—এখানে এই প্ল্যাটফর্মেও মাঝে মাঝে বসি।
--মানে, আপনি কি এখানে থাকেন না?
--না, সেদিনই আমরা ট্রেন থেকে এখানে নেমেছিলাম কিছু সময় আগে। তারপরই-তো এমন অবস্থা—
--এখানে কি কোন আত্মীয় বাড়ি---
--না, না, এখানে ঠিক আত্মীয় নয়, পরিচিত একজনের খোঁজে এসেছিলাম। পাওয়ার স্টেশনে কাজ করেন। কিন্তু গিয়ে শুনলাম উনি কিছুদিনের জন্য বাইরে গেছেন। ঘরে তালা।
--ও—আচ্ছা, তা হলে-তো বেশ অসুবিধার কথা।
--আসলে আমি একটা কাজের খোঁজে এসেছিলাম।
--ঠিক আছে, আমি ত এখন একটু ব্যস্ত আছি, বুঝতেই পারছেন হাতে জিনিস-পত্র, তা আপনি কি এখানে বসছেন কিছুক্ষণ? তা হলে আমি ফেরার পথে একটু হাসপাতাল ঘুরে যেতাম ওনাকে দেখার জন্য। ওখানে আমার চেনাজানা আছে একটু। আপনার পেশেন্টের অসুবিধা হবে না যদি একটু বলে দিই বা আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। যদিও এখানকার এই হাসপাতালটি বেশ ভাল বলেই জানি।
--ঠিক আছে, আমি আরো কিছুক্ষণ বসছি—আপনি আসুন। খুব ভাল হয় যদি একটু পরিচয় করিয়ে দেন। খুব উপকার হয়---।
--হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক আছে—তা ভাই আপনার নামটা?
--আমি সুকুমার মণ্ডল। আমার স্ত্রীর নাম নমিতা মণ্ডল।
--আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি বসুন তা-হলে—
হাতে একটা বড় বিগ শপার ভর্তি—মনে হলো কাপড় চোপড়। কাঁধে একটা ছোট ব্যাগ ঝোলানো। এতক্ষণ বেঞ্চির উপর নামিয়েই কথা বলছিলেন। কত বয়স পঞ্চাশ পঞ্চান্ন। দেখে খুবই কর্মদক্ষ মনে হয়। ব্যাগ দুটো তুলে নিয়ে প্ল্যাটফর্ম পার হয়ে সরকারী কোয়ার্টারের দিকে পথ চলতে লাগলেন।
সুবোধ যেন একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখতে পেল। নিজেকে তার কিছুটা হাল্কা মনে হতে লাগলো। অভিযাত্রী হিসেবে এটা তার কোন ধাপ জানে না। তবে প্রতিটি ধাপেই যেন অনেক কিছু, অনেক নতুন কিছুর অপেক্ষা। সঙ্গে তার তাৎক্ষণিক গল্প রচনার এই দক্ষতাকে সে আর মিথ্যা-কথন বলতে চায় না। আত্মপরিচয় বিনির্মাণের এই প্রয়াস যে তার টিকে থাকার, বেঁচে থাকার প্রক্রিয়ায় নিহিত এক রসায়ন—যা তার কাছে এখন তথাকথিত সত্যেরও অধিক রূপে প্রতিভাত মনে হয়।(ক্রমশঃ)
©somewhere in net ltd.