নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিংক----পদাতিক/৩২
৩৩
ইতিমধ্যে সুবোধের বাবা, সাহেবকা’র প্রাণের বন্ধু করুণানিধান মুস্তাফি দেহান্তরিত হয়েছেন। তাঁর গ্রামের বাড়িটায় এখন গ্রন্থাগার তৈরি হচ্ছে, তার অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী। সুবোধ নির্বাক। শুধু শুনে যাচ্ছে সাহেবকা’র কথা।
করুণা রোগশয্যায় থাকাকালীন বেশ ক’বার সাহেবকাকে ঐ গ্রামের বাড়ি, অতিথপুরে যেতে হয়েছিল। ডাক্তার ওষুদ পথ্য সব তার মারফৎ-ই ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু অনেক বুঝিয়েও তাকে ভাল চিকিৎসার জন্য ময়মনসিং নিয়ে আসা যায় নি। করুণা’র এক কথা—মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী—আমি চাই যদি ঘটে তা এখানেই ঘটুক।
ঐ সময় একবার করুণানিধান কিছু টাকা তুলে দিয়েছিলেন রব্বানী সাহেবের হাতে। বলেছিলেন—যদি কোনোদিন সুবোধ ফিরে আসে—আর ফিরে এসে যদি সে এই দেশেই থাকতে চায়, তবে এই টাকা হয়তো তার কিছুটা কাজে লাগতে পারে।
রব্বানী সাহেব এই জাতীয় খবরগুলো সুবোধকে দিতে দিতে একসময় নিজেই খুব আনমনা হয়ে পড়লেন। দুলতে লাগলেন করুণার রোগশয্যার মুখ থেকে যৌবনের সেই তেজী মুখের ভেতরকার সময় পার্থক্যে।
মনে পড়লো কথা বলার সেই তখনকার বিশেষ বিশেষ সময়ে করুণার চোখ জ্বলতো। পরবর্তীকালে, মুক্তিযুদ্ধের একটা সময়-তো সমগ্র করুণাকেই জ্বলতে দেখা গেছে।করুণার কণ্ঠস্বর সেই সময় স্বপ্নের এক জবানবন্দী ছিল। আজ মনে হয়, মনে পড়লে একটু কষ্ট কি হয় না—হয়। যৌবনের হিসেব সবসময় নির্ভুল হয় না। এই কথা এই রোগশয্যায় শুয়ে থাকা করুণা ছাড়া আর কে বেশি জানে !
যশোরের ছেলে ছিল করুণা। একটা ভাঙা, ছিন্ন ভিন্ন পরিবার ছিল তাদের। যাদের কেউ কেউ এপারে ওপারে নানাভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই সময়। হয়তো করুণার কোথাও যাওয়া হয়নি। কালক্রমে সে শুধু পড়তে আসে ঢাকায়। তখন সময়টা এমনই যে শুধু ঢাকা নয়, দাঙ্গার আগুনে পুড়ছে সারা দেশ। দাঙ্গা-বিরোধী এক গোপন সভাতেই-তো দেখা তাদের, প্রায় সমবয়সী মঞ্জুর রব্বানীর সঙ্গে। পরিচয়ের পর দেখা গেল তারা একই কলেজের ছাত্র। দেখা সাবিনার সঙ্গেও। সেও ছিল ঐ সভারই একজন। একই কলেজে দাদা মঞ্জুর বা সুবোধের এক ক্লাস নিচে পড়তো সে।
এই সভা থেকেই দাঙ্গা-বিরোধী ছাত্ররা ক্রমে একটা সাধারণ মানুষের সঙ্ঘে পরিণত হওয়ার চেষ্টা চালায়। রাষ্ট্র, পুলিশ এবং নানা সামাজিক পীড়নের মধ্যে তারা ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করলো দেশের অন্যান্য প্রান্তেও। তখন স্বাভাবিক ভাবেই পাশে এলো রাজনীতি, ধর্ম, ভাষা জাতীয় নানা মৌলিক উপলব্ধির টান । ফলে ঘটলো মত-পার্থক্য, পিছুটান, এবং সংস্কার, কু-সংস্কার জনিত নানা ঘটনা উপ-ঘটনা। ফলে তাদের সাফল্য খুব বলার মত কিছু ছিল না। মঞ্জুরের পড়ার ঘর ছিল তাদের মন্ত্রণা কক্ষ। কত রাত ,কত দিন, চিন্তায় দুঃচিন্তায় কেটেছে তাদের এই ঘরে, তার হিসেব নেই। সাবিনার সঙ্গে এইখানে, এই ঘরেই, সেইসব দুঃসহ দিনগুলিতে করুণার অন্তরের যোগাযোগ হয়ে গেল । কীভাবে—তারা উভয়েই এ নিয়ে খুব বেশি যে ভেবেছে তা নয়। নিজেরাই মাঝে মাঝে একা হলে অবাক হয়ে পরস্পরকে প্রশ্ন করতো—এটা কি হওয়ার কথা ছিল? উত্তরে দু’জনেই ‘একদম না’ বলে হাসাহাসি করতো।
তবু একটা দেশ ও জাতির ইতিহাসের মূল স্রোতের প্রতি সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রেরণার পেছনে ছুটছিল যে যৌবন, একসময় তার প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে একটা ছোট সিদ্ধান্তও তাদের নিতে হলো।
সেটা ঊনিশ'শো সাতষট্টি সাল । করুণা এবং সাবিনা বিবাহ। দাদা মঞ্জুর রব্বানীর সহায়তায় এক সাদা কাগজে পাত্র পাত্রীর সম্মতি সূচক বক্তব্য লিখে গোপনে সম্পন্ন হয় সেই বিবাহ। অতঃপর ঘটনা জানাজানি হওয়া মাত্রই আত্মগোপনে চলে যেতে হয়েছিল তাদের। তাদের আর কোনোদিন ঢাকায় ফেরা হয় নি।
ফলস্বরূপ কালক্রমে আত্মীয় পরিজন কর্তৃক পরিত্যক্ত করুণাকে এক শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে থিতু হতে হয়েছিল ভাটি অঞ্চলের এক প্রান্তিক গ্রামে। গ্রামের নাম অতিথপুর। আর মঞ্জুর রব্বানীকে বেছে নিতে হয়েছিল ময়মনসিং শহরে আইনজীবীর পেশা।
সময়ের নিয়মেই একসময় ছাত্র জীবনের সঙ্ঘ-বদ্ধতা শিথিল হয়ে পড়ে। কে কোন দিকে চলে যায় খোঁজ থাকে না আর। সামাজিক নানা উতরোলে তারা অনেকটাই পেছনের সারিতে চলে যায়। তবু যে সম্পর্ক তারা নির্মাণ করেছিল—বিশেষ করে মঞ্জুর রব্বানী, করুণানিধান আর সাবিনা, তাকে তারা সন্তর্পণেই রক্ষা করে চলছিল। কিন্তু বছর পাঁচেকের সুবোধকে রেখে সাবিনার হঠাৎ করে একদিন জীবনাবসান হয় । খবর পেয়ে সস্ত্রীক রব্বানী সাহেব ছুটে গিয়েছিলেন অতিথপুর । করুণার কাঁধে শুধু হাতই রেখেছিলেন। সে দিন কেউ কাউকে সান্ত্বনা দেন নি । জীবনের এই অমোঘ আঘাতকে মেনে নিতে কিছু সময় স্তব্ধ হয়েই কাটিয়েছিলেন তারা। ক’দিনের জন্য করুণাকে ময়মনসিং নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন রব্বানী। করুণা রাজী হননি।
অতঃপর অনাত্মীয় পড়শিদের হাতেই বলতে গেলে সুবোধ বড় হতে লাগলো। মাঝে মাঝে সুবোধকে নিয়ে করুণা এক দু’দিন ময়মনসিং এসে কাটিয়ে যেতেন। উদ্দেশ্য সুবোধকে একটি পারিবারিক স্পর্শ অনুভব করার সুযোগ দেয়া। কিন্তু অনেকের পরামর্শ—এমন কি রব্বানী সাহেবের অনুরোধও করুণানিধান রাখেন নি—পুনর্বিবাহিত হওয়ার প্রশ্নে। সুবোধকে নিয়ে যে তিনি খুব বেশি চিন্তা করেছিলেন, তা নয়। তাঁর বিশ্বাস ছিল সুবোধ বেড়ে উঠবে ঠিকমতোই।
৩৪
সুবোধের মা’এর ধর্ম-পরিচয় গোপন ছিল অতিথপুরে গ্রামে। সুবোধ এই পরিচয় জানতে পারে তার মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার পর। ধর্মের এই দুই তরফের নানা রূপ করুণানিধান সারা জীবন প্রত্যক্ষ করেছেন। উনি চাইতেনও সুবোধ যেন পরিণত বয়সে তার জন্ম-পূর্ব পারিবারিক ইতিহাসটা জানতে পারে এবং নিজস্ব উপলব্ধির জোরেই যেন সে পথ চলতে পারে।
সুবোধ তখন মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার পর ময়মনসিং এ কলেজে পড়ে। সেই সময় থেকেই এই শহরে তার একমাত্র যাওয়ার জায়গা তার সাহেবকা’র বাড়ি। ছোটবেলার সেই ডাক-টা সে বড় হয়েও ছাড়েনি।
আজন্ম আত্মীয়হীন গ্রাম জীবনের এক নিঃসঙ্গতায় বেড়ে ওঠা সুবোধের জন্য রব্বানী সাহেবের বাড়িটা ছিল এক মানসিক আশ্রয় বিশেষ। সেখানেই সে চাচী আম্মা আর কুসুম এর সাহচর্য পেয়ে পেয়ে ধীরে ধীরে তার নিঃসঙ্গতাটুকু সরিয়ে দিতে পেরেছিল। অনুভব করতে শুরু করেছিল জীবনের নানাবিধ অর্থ । ঐ বয়সে তার নিজের জন্ম-পরিচয় জানাটা শুধু নতুন করে এক মাতৃ-সূত্র আবিষ্কারের নেশা তার মধ্যে তৈরি করে দিয়েছিল। পাঁচ বছর বয়সের স্মৃতি হাতড়ানোর সেই শুরু।
তারপর দেখা যায়, ময়মনসিং শহর থেকে ছুটি-ছাটাতেও সে আর গ্রামের বাড়ি খুব বেশি যেত না। কখনো করুণানিধান খবর পাঠালে তবেই যেতো। অথবা প্রয়োজনে করুণানিধান নিজেই আসতেন। করুণানিধান বুঝতেন মা হারানো ছেলেটির মনোভাব। ফলে এই নিয়ে তিনি কখনো অন্যথা ভাবেন নি। শহরে সুবোধের কলেজ আর মেস বাড়িতে থাকা খাওয়া ছাড়া রব্বানী সাহেবের বাড়িই তার নতুন ঠিকানা হয়ে উঠলো। সঙ্গী হয়ে উঠলো কুসুম। সেই অর্থে কুসুমের সঙ্গেই তার যাবতীয় কথাবার্তা—স্বপ্ন দেখা—দেশ-দশের চর্চা—বই পড়া—প্রেম ভালবাসা---ইত্যাদি নিয়ে জড়িয়ে পড়া। এবং একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়তেও আসা। এসব নিয়ে করুণানিধানকে তার হিন্দু গ্রাম-প্রতিবেশীদের কাছে কিছু অসঙ্গত কথাও শুনতে হয়েছে কখনো। শুনে তিনি কষ্ট পেতেন ঠিকই, কিন্তু প্রকাশ্যে এসব তিনি কোনো কালেই গ্রাহ্য করতেন না। বলতেন—আমি-তো জাত ধর্ম নিয়ে বাঁচি না, বাঁচি মানুষ নিয়ে। এ-কথা কেউ পছন্দ না করলেও গ্রামের সম্মানীয় মাস্টার মশায় বলেছেন ধরে নিয়ে প্রতিবেশীরা এক প্রকার মেনে নিতেন।
রাত অনেক হয়েছে। অনেকক্ষণ কথাবার্তার পর রব্বানী সাহেবের যেন হুশ হলো। বললেন—ঠিক আছে, আজ যাও, শুয়ে পড়ো।
কিন্তু কুসুম? কুসুম কোথায়? কেমন যেন বাড়িটা ফাঁকা আর নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে না? শোয়ার আগে এক ফাঁকে চাচী আম্মা নিজেই বলে গেলেন যে কুসুম এখন ঢাকায় থাকে। এক অধ্যাপকের স্ত্রী সে এখন। এই দু’ আড়াই বছরের সময়কালে কত কী পরিবর্তন ! সময় কি আর বসে থাকে?
সুবোধ রাত জাগে। এক শরীর ক্লান্তি নিয়েও তার ঘুম আসে না। কত কি যে মাথায় এসে ভিড় করছে—সুবোধ চিন্তা-স্রোতে শুধু ভাসছে—স্থির হতে পারছে না।
পরদিন রাতের দিকে রব্বানী সাহেব সুবোধকে ডেকে পাঠালেন।
--শোন সুবোধ, কিছু টাকা তোমার বাবা রেখে গেছেন আমার কাছে। সেই টাকা কীভাবে তুমি নেবে, তোমায় ভাবতে বলছি। নিজের ভাল-মন্দ বোঝার বয়স তোমার হয়েছে। তবু করুণার অবর্তমানে শুধু কর্তব্য নয়, অনেকটা স্নেহের টানেই বলবো যে তুমি এসে পড়েছো যখন, তখন থেকে যাও এখানে। কোর্টের ব্যাপার যা করা দরকার আমি করবো। সারেন্ডার করিয়ে জামিনের ব্যবস্থা করা যাবে। বেশি অসুবিধে হবে না। সামরিক চাপ এখন কিছুটা শিথিল।
--আজ্ঞে সাহেবকা, আমাকে একটু ভাবার সময় দিন।
--হ্যাঁ, হ্যাঁ ভাব। কোন তাড়া নেই। ভাব, চাইলে এখানেই থাক বা ঢাকায় গিয়ে একবার—না, না, সেখানে যাওয়া রিস্ক হয়ে যেতে পারে। বরং কুসুমকে খবর দিই। একবার এসে ঘুরে যাক। তারপর জামিন হয়ে গেলে নিজেই যেতে পারবে—দেখ, ভাব।
আর হ্যাঁ, ভাল কথা—ওপারের কথা-তো ভালমতো শোনাই হলো না। কোথায়—তুমি কি সেখানে আত্মীয়দের কাছেই ছিলে? সেদিকের অবস্থাই বা কেমন এখন? তোমার কাকা জেঠারা-তো সব শুনেছিলাম কলকাতার দিকেই আছেন---।
--আজ্ঞে না, সাহেবকা, আমি আত্মীয়দের কাছে যাব কী করে—আমার কাছে-তো তাঁদের কোন ঠিকানা ছিল না। বাবাও কখনো দেন নি। তা ছাড়া---থাক সে সব। তবে ছিলাম কিছু অনাত্মীয় কিছু মানুষের কাছেই। একপ্রকার ভালই ছিলাম---।
এটুকু বলেই সুবোধ যেন একটা পাথর সরালো বুক থেকে। তারপর চুপ করে গেল।
অনেক রাত পর্যন্ত এভাবেই চলল কথা ও নিস্তব্ধতা পাশাপাশি। রব্বানী সাহেব দেখলেন চোখের সামনে, সেই কোলে কোলে ঘুরে বেড়ানো সেদিনের ‘সুবো’—কেমন সময়ের আঁচড়ে আঁচড়ে বড় আর বিক্ষত হয়ে গেছে। করুণা বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে খুব কষ্ট পেত। যে কষ্ট হয়তো আমারও প্রাপ্য। আমি কি করুণার মতোই যন্ত্রণা পেতে পারি—কি জানি, ততোটা নয় হয়তো। তবু সুবোধ-তো ছিল আমাদেরই ভবিষ্যৎ কল্পনার বীজ। আজ ‘সুবো’ মানে আমাদের কৃত-কর্ম।—হয়তো আরো অনেক কিছু—বহমান যুক্তি সংকীর্ণতার বাইরে এক স্বদেশের নাম।
এখন একটি পরিণত যুবক সে। সে কি আমার কথা শুনবে? শুনে কি থেকে যাবে এখানেই?
দু’দিন উদয়াস্ত ঘরের মধ্যেই। বাইরে বের হওয়া যাবে না। এমনকি সিগারেটও তাকে আনিয়ে দিয়েছেন চাচী আম্মা। বলেছেন—বাবা কষ্ট হলেও এছাড়া উপায় নেই। গোপনে অতিথপুর যেতে চেয়েও যেতে পারলো না সুবোধ। সাহেবকার আপত্তি। কিন্তু সাহেবকা-তো আমার সবটুকু জানেন না। সবটুকু বলা সম্ভবও নয় তাঁর কাছে। যে বিশ্বাসে বাবা সারাজীবন তাঁর প্রিয় জায়গাটিতে থেকে গেলেন, সেখানে একবার যেতে না পারলে—
সুবোধ আবেগের বশে যতই আবদার করুক এই সময় অতিথপুর যাওয়া তার পক্ষে ততখানি সুখের নাও হতে পারে। আইনি রক্ষা-কবচ ছাড়া সুবোধের বাইরে কোথাও যাওয়া উচিত হবে না—এমনই মত রব্বানী সাহেবের।(ক্রমশঃ)
©somewhere in net ltd.
১| ২৮ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ২:১২
গোফরান চ.বি বলেছেন: চলুক ।