নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফয়সাল হিমু

ফয়সাল হিমু › বিস্তারিত পোস্টঃ

জন্মান্তর

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১২:০৪

হামিদ বলল, দোস্ত, একটা ব্যাপার খেয়াল করসস?
আমি বললাম, কী?
- এইযে দেখ ইংলিশ রোড আছে, উর্দু রোড আছে। বাংলা রোড নাই ক্যান?
- হুম্মম, নামগুলা সরকারিভাবে চেঞ্জ করে দিলেই হয়।
- তা-ও কাজ হবেনা। তুই পুরান ঢাকায় পাকিস্তান মাঠ কোনটা জিজ্ঞেস করে দেখ, সবাই দেখাইয়া দিবো। কিন্তু, বাংলাদেশ মাঠের কথা জিজ্ঞেস কর, কেউ জানেনা।
- পাকিস্তান মাঠের নামই তো এখন বাংলাদেশ মাঠ।
- কিন্তু কয়জন জানে? তাহলে নাম চেঞ্জ কইরা লাভ কী হইলো বল ? বেশিরভাগ বাঙ্গালি এখনো ইংরেজ আর পাকিস্তানিদেরকেই মনে মনে ওস্তাদ মনে করে।
- হুম্মম, বাদ দে এইসব কথা।
- আচ্ছা, বাদ দিলাম। কিছু খাওয়া। দুপুরে কিছু খাই নাই। ক্ষিধা লাগসে।
- আজকে না দোস্ত আরেকদিন।
- ক্যান আজকে কী টাকা নাই?
- ২০ টাকা আছে। এতে তোর হইব না। তুই যা পেটুক হইতাসস দিনদিন।
- আচ্ছা, চল, সুলতান মিয়াঁর চা খাওয়াবি চল।

সন্ধ্যার আযান মাত্র দিয়েছে। পশ্চিম আকাশ কী অদ্ভুত বিষণ্ণ আলো ছড়িয়ে দিয়েছে সারা পৃথিবীতে! কথাটা ভুল বললাম, সন্ধ্যা তো কেবল এখানেই নামছে। এই সময়েই পৃথিবীর কোথাও গনগনে সূর্য মাথার উপরে, আবার কোথাও মাত্র পূর্বাকাশ ভেদ করে ভোর হচ্ছে, আবার কোথাও নিকষকালো আঁধার।

আমরা ভিক্টোরিয়া পার্ক এর পুরাতন পানির ট্যাঙ্কির সামনে চলে এলাম। এটা ঢাকার প্রথম পানি সরবরাহের ট্যাঙ্ক। এই পার্ক এর নাম নিয়েও একটা বিভ্রাট আছে। এর বর্তমান নাম বাহাদুর শাহ পার্ক হলেও অনেকেই ভিক্টোরিয়া পার্ক বলেই জানে। দুটা নামই একসাথে টিকে গেছে। তাছাড়া দুজনই বিদেশি। তারা বাংলার কেউ না। এই পার্কে সিপাহীবিদ্রোহের শহীদদের জন্য একটা স্মৃতিসৌধের চারপাশে ভুঁড়িওয়ালা নারীপুরুষ চক্কর খায়, আবার অনেক ছেলেমেয়েরা নতুন সম্পর্কে জড়ায়।

হামিদ চায়ে চুমুক দিয়েই বলল, সুলতান মিয়াঁর চা হইলো দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ চা। আমার কী ইচ্ছা করে জানস?
- কী?
- আমি যখন দেশ-বিদেশ ঘুইরা বেড়ামু, সুলতান মিয়াঁরে সাথে কইরা নিয়া যামু। আর ইকটু পর পর চা খামু।
- আহা! কী মজা! সুলতান মিয়াঁর আর খাইয়া দাইয়া কোনো কাজ নাইতো! তরে চা খাওয়ানের জন্য হিমালয়, পিরামিড, অলাস্কায় তোর জন্য চায়ের ফ্লাস্ক নিয়া পিছে পিছে ঘুরবো!
- এইটাইতো জীবন রে পাগলা! তুই বুঝবিনা।
- বুঝা লাগবোনা, চল যাই।
- খাড়া না, লেবু চা খাইলাম। এইবার আরেক কাপ গুড়ের চা খাই। তুই খাবি?
- শালা আমার টাকায় খাইতাসস, আবার আমারে জিগাস, আমি খামু নাকি?
- আরে বুঝস না ক্যান! ফর্মালিটি আরকি!
- তর ফর্মালিটির...

গলায় ধরে গল্প করতে করতে ফিরে আসছিলাম দু'জন। হামিদ হটাত দাঁড়িয়ে গেলো আজাদ হলের সামনে।
এখানে নিশিকন্যারা খদ্দেরের দিকে তাকিয়ে থাকে কামনার চোখে। এদের মধ্যে কাজল পড়া একটা বিশেষ মেয়ের প্রতি হামিদের কয়েকদিন ধরেই আগ্রহ জন্মেছে। আমার মনে হয়, মেয়েগুলর চোখ ঘনীভূত রাতের সাথে মিশে কেমন জ্বলজ্বল করতে থাকে অন্যরকম এক আলোয়। হামিদের অনেকদিনের ইচ্ছে, মেয়েটার সঙ্গে সে কিছুক্ষণ সময় কাটাবে। শারীরিক কোনো চাহিদা মেটানোর জন্য না, শুধু ইকটু রিকশায় ঘুরবে, আর কিছু প্রশ্ন করবে। মেয়েটার সময়ের যা মূল্য হয়, তা দিয়েই ঘুরবে।
আমি বলেছিলাম, মেয়েটা যদি রাজি না হয় ঘুরতে?
- আরে রাজি হবেনা মানে? হতেই হবে।
- কী জিজ্ঞেস করবি?
- তা তোকে বলব কেনো?
- যা-ই জিজ্ঞেস করিস না কেনো, সত্যি উত্তর তোকে কোনোদিন বলবেনা। এরা খুব মিথ্যেবাদী হয়।
হামিদ টিপ্পনী কেটে বলল, তুই জানলি কিভাবে, এরা মিথ্যেবাদী?
- সেটা ওদের জীবনযাপনের চিত্র দেখলেই বোঝা যায়। কপটতা আর ভন্ডামি ছাড়া ওরা টিকে থাকবে বলে তোর মনে হয়?
- তবু মাঝে মাঝে কী সরল লাগে দেখলে। ওই মেয়েটা মনে হয় নতুন এ লাইনে। এখনো চান্স আছে, যদি ওকে ফিরিয়ে আনা যায়!
- ও আচ্ছা, তাই নাকি? তুই ওর কাছে একটা হৃদয়ভারাক্রান্ত দুঃখের কাহিনী শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছিস। তুই কী ওর দায়িত্ব নিবি?
- তা হয়তো নিবোনা। আবার বলা যায়না, নিতেও তো পারি।
- এসব রোমান্টিসিজম বাদ দে। চল, তুই না বলেছিলি, রায়সাহেব বাজারে পুরান ঢাকার সবচেয়ে বড় পতিতালয় আছে। চল, সেখানটায় ঘুরে আসি। তোকে দুঃখের কাহিনী শোনানোর জন্য সেখানে চাতকিনীর অভাব হবেনা।

জজ কোর্ট থেকে জেলা প্রশাসক এর লাল রঙের দালান এ আসার জন্য একটা প্রাচীন সুরকি ইটের ওভারব্রিজ ছিলো ইংলিশ রোডে। রাত যতো গভীর হতো, এই ব্রিজের উপরে পতিতাদের আনাগোনা বৃদ্ধি পেতো। এখন অবশ্য ব্রিজটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের লাল দালানটাও ভেঙে উঠেছে বিশাল মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং।

আমরা সারা রায়সাহেব বাজার ঘুরে ফেললাম। পতিতালয় তো দূরের কথা, ইংলিশ রোডের মতো দাঁড়িয়ে থাকা কোনো পতিতার দেখাও পেলাম না। কাউকে জিজ্ঞেসও করা যায়না এসব ব্যাপারে। পতিতালয়ের আশেপাশে অনেক দালাল থাকে। এরা খদ্দের ধরার জন্য আকারে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে। তেমন কাউকেও পেলাম না কোথাও।
হামিদ বলল, হুমায়ুন আহমেদ কি তাহলে তার বইগুলোতে গুলগাপ্পা মারলো নাকি?
বললাম, হয়তো তার লেখার আমলে ছিলো, এখন নাই। পতিতারা তো উদ্বাস্তুর মতো। নিজের স্বদেশেই ওরা নির্বাসিত জীবন কাটায়।

এরপর কয়েকদিন খুব ব্যস্ত হয়ে গেলাম একটা লেখা নিয়ে। নিত্যদিনের বৈকালিক ভ্রমণে বিঘ্ন ঘটলো। সন্ধ্যা এবং রাতের এলোমেলো হাঁটাহাঁটি করতে পারলাম না। হামিদের সাথেও কয়েকদিন দেখা হচ্ছিল না। এরমধ্যে একদিন ও এসেছিলো কয়েকটা বই দেওয়ার জন্য। বইগুলো নিয়ে গেট থেকেই বিদায় করে দিয়েছি।
"জন্মান্তরবাদ" নিয়ে একটা প্রবন্ধ সাজাচ্ছিলাম আগামী শারদীয় সংখ্যার জন্য। বৈদিক দর্শনে পুনর্জন্ম না থাকলেও উপনিষদে এসে তা সনাতন ধর্মের অন্তর্গত হয়ে গেছে। জন্মদাগ কী সত্যিই পুনর্জন্মের স্মৃতি বহন করে এই জন্মের সাথে কোনো সংযোগ স্থাপন করে কি-না, তা নিয়ে কিছু বাস্তব কেসের ওপর পর্যালোচনা করছিলাম।
হামিদ আমাকে কয়েকটা বই দিয়েছে এ ব্যাপারে। বিনিময়ে ওকে কিছু খাওয়াতে হবে। ব্যাটা খেতে খুব ভালবাসে। বন্ধুমহলে ও 'খোদার খাসি' বলেই সমাদৃত।

একদিন সারারাত জেগে লেখাটা শেষ করে ফেললাম। কিছু কাটছাঁট আর সংযোজনের জন্য হামিদকে দেখাতে হবে।
ভোরের কোমল আলো চোখে মেখে মাত্র ঘুমিয়েছি, এমন সময় দরজায় ঠকঠক। নিশ্চিত হামিদের কাজ। এই এক ট্যালিপ্যাথি। ওর কথা ভাবতে দেরি, বান্দা এসে হাজির হতে দেরি নেই।
ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে দেখি হামিদের ছোটো ভাই ফরিদ।
বললাম, কী রে, এতো সকালে?
ফরিদ হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলল, হামিদ ভাই আর নাই। চইল্লা গেসে।
কাউকে কিছু না বলে গুম হয়ে যাওয়া হামিদের অনেক পুরোনো অভ্যাস। আমিও অনেকবার তার যাত্রার সঙ্গী ছিলাম। যে ছেলেটার স্বপ্ন, একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে ভূমধ্যসাগরের কোনো দ্বীপে বা আন্দিজ পাহাড়ের কোনো আদিবাসী গ্রামে ছন্নছাড়া পথিকের মতো পৃথিবী চষে বেড়াবে, সে হটাত পৃথিবীটাকেই ছেড়ে চলে গেলো!
কিন্তু কেনো?

হামিদ যতই আল্পস কিলিমাঞ্জারো পর্বত চড়ার কথা বলুক না কেনো, তার খুব উচ্চতা ভীতি ছিলো। সেই হামিদ ৯ তলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে, তা ঠিক বিশ্বাস হয়না।
তার ঘরে একটা সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে...
"খুব পাখির মতো উড়তে ইচ্ছে করছে।
হোক না সে অল্প কিছু মুহূর্তের জন্য। ইকারাসের ডানাও গলে গিয়েছিলো।
কিন্তু তার সাধ অপূর্ণ থাকেনি।
এখন আমি নিশ্চিন্তে উড়বো।"
এটাকে কী সুইসাইড নোট বলা যায়? কেমন যেনো কাব্যিক মনে হচ্ছে।

একটা স্বপ্নবাজ টগবগে তরুণ, যার কোনো অভাব নেই, প্রেমে ব্যর্থতা নেই, বাহ্যিক মনঃকষ্টের কোনো কারণ নেই, সে কেনো এভাবে চলে যাবে? এক নাম না জানা নিশিকন্যাকে কী জিজ্ঞেস করবে বলেছিলো, তা আর জানা হলো না!

"প্রেম ছিলো, আশা ছিলো -
জোৎস্নায়, - তবু সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল -
লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।

এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি !

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হলো তার সাধ..."

প্রতিটা আত্মহত্যার পেছনে কোনোনা কোনো রহস্য থাকে। কিন্তু সেই রহস্য কাহিনী ছাপিয়ে আমার প্রচণ্ড আত্মগ্লানি বোধ হতে লাগলো। ওকে সেদিন কিচ্ছু খাওয়াইনি। সারাদিন না খেয়েছিলো ছেলেটা! তাছাড়া আরেকদিন দরজা থেকেই বের করে দিলাম। অনেক গভীর অনুশোচনায় বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠছে বারবার।
ওকে অনেকগুলো কথা দিয়েছিলাম, অনেক পরিকল্পনা ছিলো জীবনের; তার এমন আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটবে, তা আমার কল্পনাতীত ছিলো।

এতকিছুর মধ্যেও আমার মনে হতে লাগলো, হামিদের কী আবার পুনর্জন্ম হবে? তাহলে ওকে আমি চিনবো কী করে? অথবা, হামিদ আমাকে চিনবে তো? অথবা জাপান বা সুইডেনের কোনো পাহাড়ি অঞ্চলে ও আবার জন্ম নিয়েছে ঠিকই। অথচ, আগের জন্মের কারো সাথেই ওর কোনোদিন দেখা হবেনা। এবারের জন্মে যেনো ওর উচ্চতা ভীতি না থাকে। ও যেনো যাযাবরের মতো পৃথিবীর সবগুলো পাহাড়ে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াতে পারে।

কী অদ্ভুত ব্যাপার! জন্মান্তরবাদের অসাড়তা নিয়ে আমি প্রবন্ধ লিখে নিজেই মনে মনে একজনের পুনর্জন্ম দিয়ে দিচ্ছি!
এই স্ববিরোধী বৈপরীত্যের দোলাচলেই আমাদের একটা জীবন অনায়াসে কেটে যায়।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১:০৭

ঢাকাবাসী বলেছেন: বেশ ভাল লাগল। আরো লিখুন।

২| ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:২২

ফয়সাল হিমু বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই :)
আরেকটা গল্প লিখেছি। পড়ে দেখতে পারেন।
http://www.somewhereinblog.net/blog/faisalhimu/30090245

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.