নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চূড়ান্ত রকম ফাঁকিবাজ একজন মানুষ আমি!

ফয়সাল রকি

Know thyself.

ফয়সাল রকি › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্প: অভিশপ্ত

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:৩৭



টিকাল শহর।
দক্ষিণ আমেরিকা।

পুরোনো জরাজীর্ণ মাঝারি আকারের সরাইখানা। ঢুকতেই চার/পাঁচটা টেবিল আর কিছু চেয়ার আছে চোখে পড়ে। রুমের মাঝামাঝির দিকে একটা কাউন্টার, কাউন্টারের পেছনের দিকে কিচেন। শেষ মাথায় দোতলায় ওঠার জন্য একটা সিঁড়ি, যার বেশিরভাগ স্থানেই পলেস্তারা খসে গেছে।
হঠাৎ দোতলা থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে এলো মাঝবয়েসী একজন পুরুষ আর তাকে পেছন থেকে তাড়া করতে করতে নামছে এক যুবতী। যুবতী বললো, তোর কাছে পয়সা নেই তো এসেছিস কেন? সাবধান করে দিচ্ছি, এরপর এ মুখো হলে কিন্তু তোর গায়ের চামড়া তুলে নেবো।
পুরুষটি সম্ভবত মাতাল, তাই হয়তো সিঁড়ি থেকে নামার সময় পড়ে গেল এবং কোনো মতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে ও ব্যর্থ হলো।
যুবতী কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। ফাঁকা কাউন্টার দেখে চিৎকার করতে ডাকলো, বুড়ি, এই বুড়ি!
সত্তরোর্ধ এক বুড়ি কাউন্টারের পেছনের কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো। বুড়ির বাম পাঁয়ে সম্ভবত আঘাত লেগেছে কিংবা খোঁড়া। বুড়ি খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসেছে। তাঁকে দেখে যুবতীর চিৎকারে মাত্রা বেড়ে গেল। বললো, এই বুড়ি, তোমাকে কতবার না বলেছি, এই জঘণ্য লোকটাকে পয়সা ছাড়া আমার ঘরে পাঠাবে না।
- আমি তো পাঠাইনি। ভেতরে গিয়েছিলাম কাজে, আর এই সুযোগে এই বদমাসটা ভেতরে ঢুকে গেছে।
- তুমি ভেতরে গেছো! কাউন্টার ছেড়ে! তোমার দায়িত্ব জানো না? তুমি কিন্তু কাজে ফাঁকি দিচ্ছো বুড়ি!
- না, আমি কাজে-ই ভেতরে গেছি।
- তুমি কাজে ফাঁকি দিচ্ছো। না হলে এই জানোয়ারটা ভেতরে যায় কিভাবে? দারোয়ান কই? দারোয়ান দারোয়ান, এই ব্যাটা দারোয়ান।
যুবতীর ডাকে দারোয়ান ছুটে এলো। তাকে দেখামাত্রই যুবতী বললো, এই জানোয়ারটাকে নিয়ে যাও। একে আর কখনোই ভেতরে আসতে দেবে না।
দারোয়ান প্রায় টেনে হেঁচড়ে পুরুষটিকে বের করে নিয়ে গেল, কেননা, পুরুষটি ছিলো মাতাল। যুবতী বুড়ির কাছে গিয়ে চাপা স্বরে বললো, দেখো বুড়ি, তোমার কাজ মনোযোগ দিয়ে করো। আজ রাতে আর কোনো পুরুষ পাঠাবে না আমার ঘরে।
- নোরা, তুমি বোধহয় আজ একটু বেশিই তেজ দেখাচ্ছো! শোনো মেয়ে, আজ একটা অভিশপ্ত রাত, আর তোমার সেটা বোঝা উচিত।
- তোমার জন্য তো সবরাতই অভিশপ্ত।
- আমার সাথে তেজ দেখিও না।
- তোমার সাথে তেজ আমি দেখাতেও চাই না। তুমি সবসময়ই অভিশপ্ত রাতগুলোকে অভিশপ্ত-অভিশপ্ত বলে নিজের উত্তেজনা সৃষ্টি করো; আর শেষটায় গিয়ে সবকিছু ভন্ডুল করে দাও। গতবারও শেষরাতে তুমি গোলমাল পাকিয়েছো। এবার অন্তত দয়া করে নিজের ঠোঁটদুটোতে আঠা দিয়ে রাখো।
নোরা নামের যুবতীটি ঝড়ের বেগে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। বুড়ি কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখলো। আপন মনে বলতে থাকে, হ্যাঁ, সবসময় তো আমিই গোলমাল পাকাই। আর উনি তো সাধু! প্রতিরাতে একাধিক পুরুষ না হলে যার চলে না, তার অভিশাপ নিয়ে মাথা ঘামানোরই বা দরকার কী! অভিশাপ তো শুধু আমার ওপরই না, তোমার ওপরও। তোমার তাতে কী বা এসে যায়। তোমার তো বরং ভালোই হয়েছে, যৌবন পাচ্ছো জীবনভর। আমার মতো বুড়ি হয়ে থাকতে হলে বুঝতে! এই শরীর নিয়ে, মরার পা’টাও ভালো হয় না কখনো, সারাজীবন এভাবে পাহারা দিতে হবে কাউন্টার...
হঠাৎ দোতলা থেকে ভেসে এলো নোরার কণ্ঠ, বুড়ি, তুমি থামবে?
- হ্যাঁ, এই যে থামলাম।
নোরাকে কি বুড়ি ভয় পায়? হয়তো পায় কিংবা পায় না। তবে বুড়ি থেমে যায়। কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এলো। সবচেয়ে কম আলো যে টেবিলে সেখানে একজোড়া কপোত-কপোতি বসে রয়েছে। তাদের দিকে এগিয়ে গেল বুড়ি। বললো, তোমাদের কিছু লাগবে?
বুড়ির কথায় প্রেমিক-প্রেমিকার কোনো ভাবান্তর হলো না। তারা পরস্পরের হাতে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে বসে ছিলো। তারা হয়তো ফিসফিস করে কথা বলছিলো কিন্তু অন্যকেউ তা শুনতে পায়নি। বুড়ি আবার বললো, এই যে, আমি তোমাদের বলছি। শুনতে পাচ্ছো? তোমরা কিছু খাবে? লাগবে কিছু? শুনতে পাচ্ছো?
প্রেমিক বলে উঠলো, আজ আমি কারো কথা শুনবো না, ঈশ্বরের কথাও না, কোনো বুড়ির কথাও না। শুধু তোমার কথা শুনবো প্রিয়তমা!
- ঠিকই তো, আমার কথা শুনবে কেন! আমার কথা না শোনাই ভালো। শুধু জেনে রাখো আজ একটা অভিশপ্ত রাত।
পাশের টেবিলের দিকে এগোলো বুড়ি। সেখানে একজন লেখক বসে পান্ডুলিপি লিখছে মোমবাতির আলোয়। সে লেখা থামিয়ে বললো, এক কাপ কফি হলে মন্দ হতো না। কী বলো?
- যাক, কেউ অন্তত আমার কথা শুনেছে!
- ভুল বললে, তুমি বলার আগেই আমি শুনেছি।
- সেটাই সেটাই। বসো আনছি।

তৃতীয় টেবিলে, গভীর মনোযোগের সাথে একটা মোটা বই পড়ছে লাস্যময়ী গবেষক সালমা। তবে একইসাথে সরাইখানায় যা ঘটছে তার সবই সে শুনতে পাচ্ছে। বই থেকে মুখ না তুলেই সে বুঝতে পারলো জামাল সরাইখানায় প্রবেশ করেছে। ওরা একসঙ্গে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার কাজ করছে এখানে। পাগলা গবেষক নামে বন্ধুমহলে পরিচিত। সালমার মনে হলো, সে ওর টেবিলের দিকেই আসছে। হঠাৎ কয়েক সেকেন্ডের দাঁড়িয়ে পড়ে। বুক পকেট থেকে পকেটঘড়ি বের করলো, সময় দেখলো, তারপর আবার ঘড়িটা বুক পকেটে রেখে দিল। তারপর মাথা নিঁচু করে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে কাউকে দেখতে পেল না। তবে আশেপাশে তাকাতেই সালমাকে দেখতে পায়। সালমাকে দেখে ওর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সালমার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, ও, সালমা, তুমি এখানে?
- হ্যাঁ জামাল। বই থেকে মুখ না তুলেই সালমা বললো।
- এখানে কী করছো?
- অপেক্ষা।
- হ্যাঁ, আমার সময় মতো আসার কথা ছিল। কিন্তু আমি বোধহয় দেরি করে ফেলেছি।
- দেরি করে ফেলেছো।
- আমি মাঝে মাঝে আমার ঘড়িটা খুঁজে পাই না। এখনও খুঁজে পাচ্ছি না।
- তোমার গবেষণা কতদূর এগোলো? দেখো, তোমার জন্য নতুন একটা সোর্স পেয়েছি, তবে মায়া সভ্যতাকে নিয়ে সবচেয়ে বিস্তারিত কিন্তু তোমাকেই লিখতে হবে।
জামাল ঘড়ি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বললো, আমার ঘড়িটা সময় মতো খুঁজে না পেলে আমি সময় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি না।
- প্রযুক্তিতে মায়ানরা যে কিভাবে এতো এগিয়ে গেল তা কিন্তু এখনো বোঝা গেল না।
- আমার ধারণা, মায়ানদের সময় ঘড়ি ছিলো না। আর থাকলেও তারা তা মাঝে মাঝে খুঁজে পেতো না।
- মায়ানরা বালুঘড়ি ব্যবহার করতো। পিরামিডগুলোতে কিন্তু বালুঘড়ি পাওয়া গেছে।
- মায়ান বালুঘড়ি।
- হ্যাঁ, পরেরবার যদি সুযোগ পাই তাহলে তোমার জন্য একটা বালুঘড়ি রেখে দেবো।
- গতরাতে স্বপ্নে আমি একটা বালুঘড়ি দেখেছি।
- আমিও গত রাতে স্বপ্নে বালুঘড়ি দেখেছি।
- আসলে মায়ানদের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে, স্বপ্নেও বোধহয় আমি ওদের দেখতে শুরু করে দিয়েছি।
- হতে পারে, তবে মায়ানরা ভীষণ স্বপ্নবিলাসী ছিলো।
- কিন্তু আমি তো স্বপ্নবিলাসী নই। আমি বাস্তববাদী। গতরাতে দেখা ভয়ংকর স্বপ্নটা স্রেফ ভুলে গিয়েছিলাম। কিংবা ভুলতে চেয়েছিলাম।
- আমিও একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি।
- মায়ানদের নিয়ে?
- মায়ানদের নিয়ে।
- ভোর রাতে?
- ভোর রাতে।
- এবার আমি বোধহয় কিছু একটা বুঝতে শুরু করেছি।
- ভীষণ ভয় করছে আমার।
- আমার ঘড়িটা যে কোথায় রাখলাম! সময়টা একবার দেখতে পারলে ভালো হতো।
- তোমার ভয় করছে না জামাল? আমরা কি কোনো মায়াজালে আটকা পড়ছি?
- মায়া কিংবা মায়াজাল!
- আমি কিন্তু স্বপ্নটা এখনো ভুলতে পারছি না।
- স্বপ্ন? কী স্বপ্ন বলতো!
সালমা কোনো উত্তর না দিয়ে আবার পড়ায় মনোযোগ দিল যেন জামালের কথা শুনতে পায়নি। জামাল কিছু একটা বলতে গিয়েও বললো না। হয়তো কী বলতে বুঝতে পারলো না কিংবা সালমা মনোযোগ নষ্ট করতে চাইলো না কিংবা কিছু একটা ভুলে যেতে চাইলো। পকেট থেকে একটা খবরের কাগজ বের করে পড়তে শুরু করলো। বুড়ি এসে পাশের টেবিলে কফি পরিবেশন করছে। ওদের দেখে খানিকটা খুশি হয়ে বললো, বাহ, তোমরা দেখি দু’জন হয়ে গেছো। কিছু খাবে? চা-কফি?
ওদের কেউ কোনো উত্তর দিল না। সালমা এক সেকেন্ডের জন্য বুড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। বুড়ি বললো, ঠিক আছে, তোমরা কি চকলেট খেতে চাও? ডার্ক-লিকুইড চকলেট? আশাকরি অনেক ভালো লাগবে তোমাদের।
সালমা বুড়ির দিকে না তাকিয়ে আপন মনে বললো, আমার মনে হয় খাবার সময় হয়ে এসেছে।
- তাহলে বলো কী দেবো?
- চকলেট, তরল চকলেট! মায়ানদের অনেক পছন্দের আইটেম ছিলো।
- তোমরা দেখছি মায়ানদের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানো!
জামাল বললো, আসলে আমি আমার ঘড়িটা খুঁজছি। তবে মায়ানরা নাকি বালুঘড়ি ব্যবহার করতো। ভাবছি একটা বালুঘড়িই রেখে দেবো সাথে।
- কেন? ওটা যাতে আবার সময় মতো খুঁজে না পাও সেজন্য?
জামালও বুড়ির দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকালো।
তোমাদের চকলেট আসছে। বলে বুড়ি কাউন্টার পেরিয়ে ভেতরে চলে গেল।
বুড়ি চলে যেতেই জামাল খবরের কাগজ ছেড়ে সালমার দিকে তাকালো। বললো, সালমা, তুমি সেই সেই অদ্ভুত ভূতুড়ে জাহাজটার কথা জানো? ঐ যে, সেই জাহাজটা, যেটা অনিশ্চয়তা, নিত্যতার দিকে যাত্রা করে। যার ভবিষ্যত একটাই। অনন্তকাল ধরে ভেসে থাকা। জাহাজের খালাসী থেকে শুরু করে ক্যাপ্টেন সবাই অভিশপ্ত ছিলো। ওদের মৃত্যু নেই। অভিশপ্ত জাহাজটার সাথে ওরাও ছিলো অভিশপ্ত।
- অভিশাপ থেকে অভিশপ্ত।
- আসলে সময় মতো ঘড়ি খুঁজে না পেলে কোনো কিছুই মতো মনে করা যায় না। এমনকি জাহাজের নামটাও মনে করা যায় না।
- অভিশপ্ত প্রতিটি মানুষই চেয়েছিলো অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে। কারণ তারা মানুষ। মানুষ কখনো কোনো শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চায় না।
- কিন্তু সালমা, চারপাশে তাকালেই দেখতে পাবে মানুষ সবসময়ই কোনো না কোনো শৃঙ্খলে আবদ্ধ। ক্ষমতার শৃঙ্খলে, পুঁজিবাদের শৃঙ্খলে এমনকি ধর্মের ভুল বিশ্লেষিত গোঁড়ামীর শৃঙ্খলে। এই অদৃশ্য শৃঙ্খল মানুষ ভাঙবে কিভাবে? তবে তুমি বোধহয় জানো না, মানুষ কখনো একটি শৃঙ্খল ভাঙতে পারে না। ভালোবাসার শৃঙ্খল। দেখো, যে যুবক বুকে বোমা বেঁধে আত্মঘাতী হামলা চালায়, সেই হয়তো আগের রাতে প্রেমিকার কাছে নিঃশব্দে শেষ বিদায় নিয়েছে। কেন? শৃঙ্খল ভাঙ্গার জন্য?
- কিন্তু অভিশাপের শৃঙ্খল হতে মুক্ত হতে হলে তোমাকে সেই অদ্ভুত ভুতূড়ে জাহাজের কাছেই ফিরে যেতে হবে। কারণ একমাত্র ওরাই পেরেছিলো শেষ পর্যন্ত অভিশাপ মুক্ত হতে। ফ্লাইং ডাচম্যান।
- তুমি তো সত্যিই চমৎকার নাম মনে রাখতে পারো। কিন্তু আমি কেন যে আমার ঘড়িটা বারবার হারিয়ে ফেলি!
- অভিশপ্ত হলেও ফ্লাইং ডাচম্যানের সবাই কিন্তু অমরত্ব লাভ করেছিলো। সারাজীবন মানুষ মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা নিয়েই বেঁচে থাকে, তাই বেঁচে থাকাটা অর্থপূর্ণ। কিন্তু তুমি যদি সারাজীবন; না না, অনন্তকাল বেঁচে থাকো, তখন মৃত্যু কামনা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না তোমার। তখন বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে যাবে। তখন কিছুতেই যদি কোনো অর্থ থেকে থাকে তা কেবল তোমার মৃত্যুতেই।
- কালরাতের স্বপ্নটাতেও এরকম কিছু ছিলো। জন্ম, মৃত্যু, অপমৃত্যু কিংবা অমরত্ব। যেখানে কোনো মৃত্যু নেই, নেই কোনো জন্মান্তর। বেঁচে থাকা আর বেঁচে থাকা। আসলে তখন হয়তো যমদূত তার ঘড়িটা হারিয়ে ফেলবে। কাজেই বুঝতেই পারবে না, কখন তোমার সময় শেষ হবে।
- শোনো জামাল, আমি বাঁচতে চাই। শুধু বাঁচতেই চাই না, তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চাই। যতটুকু সময় পাই, কেবল তোমাকে ভালোবাসতে চাই। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই জামাল। চলো না আমরা বিয়ে করি।
- হুম।
- বিয়ে। বিয়ে করছি আমরা আজই। এখনই।
- কিন্তু সালমা, হাতে ঘড়ি না থাকলেও আমি বলতে পারি যে, এখন রাত। কাজেই অন্তত কাল সকাল পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতেই হবে।
কখন যে পাশে বুড়ি এসে পড়েছে ওরা বুঝতেই পারেনি। বুড়ি বললো, হ্যাঁ, তোমাদের সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আপাতত তোমাদের জন্য চকলেট এনেছি। তরল চকলেট।
বুড়ি কথায় ওরা বাস্তবে ফিরে এলো। বুড়ি বললো, কিন্তু স্বপ্ন নিয়ে কী যেন একটা বলছিলে তোমরা? তোমরা কি সত্যিই কোনো ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছো?
জামাল বললো, হ্যাঁ, আমি খুবই ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি। তবে স্বপ্নের শুরুটা মোটেও ভয়ংকর ছিলো না।
সালমা বললো, আমার ধারণা আজ রাতে ঘুমালে একই স্বপ্ন তুমি আবার দেখবে। প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
- না, আজ রাতে আমি এক বিন্দুও ঘুমাচ্ছি না। ভয়ঙ্কর স্বপ্ন কেউ বারবার দেখতে চায় না।
- আমি চাই। কাল রাতের স্বপ্নটা ভয়ঙ্কর হলেও আমি সেটা আবারো দেখতে চাই।
- তোমার তো কোনো কিছুতেই ‘না’ নেই।
- তুমি একবার মিলিয়ে দেখো আমার সাথে। আমার ধারণা আমরা দুজনই একই স্বপ্ন দেখেছি।
- যা প্রায় অসম্ভব।
- অসম্ভব হতে পারে, তবে মিলিয়েই দেখো একবার। তুমি আর আমি দৌড়াচ্ছি। তিনবছর আগে মরে যাওয়া কুকুর জ্যাকিও দৌড়াচ্ছে আমাদের সাথে। চারপাশে কেমন যেন একটা অন্ধকার, ঠিক ঘুটঘুটে বলা যায় না আবার স্পষ্ট কিছু দেখাও যায় না। আমরা দৌড়াচ্ছি। কিন্তু কেন দৌড়াচ্ছি জানি না। সম্ভবত ভয়ঙ্কর কিছু একটা তাড়া করেছে আমাদের যেন দৌড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। একটা বনের মধ্যে দৌড়াচ্ছি আমরা। জ্যাকি মাঝে মাঝে খানিকটা এগিয়ে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। যেন রাস্তা পরিস্কার আছে সে খবরটাই দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ঝিমিয়ে থাকা গাছের গুড়ির সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। তুমিও দাঁড়িয়ে পড়লে। তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললে-
সালমাকে থামিয়ে দিয়ে জামাল বললো, তাড়াতাড়ি করো। ওরা ধরে ফেলার আগেই আমাদের দৌড়াতে হবে।
সালমা বললো, আমরা আবার দৌড়াতে শুরু করলাম। এল কাস্তিইয়ো পিরামিডের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দীর্ঘপথ দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে লাগতে লাগলাম। এল কাস্তিইয়োর দেয়ালে একটা দরজার মতো দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। কাছে যেতেই মনে হলো একটা বিশাল আকৃতির জন্তু মুখ হাঁ করে রয়েছে। আমরা সে মুখের ভেতর দিয়ে পিরামিডে প্রবেশ করলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য! যতই ভেতরে যাচ্ছি ততই আলোকিত হচ্ছে চারপাশ। পিরামিডের সবচেয়ে দক্ষিণে যে ঘরটা যেখানে দেবতা সাইজিনের মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল সেখানে পৌঁছালাম আমরা। হঠাৎ মনে হলো কিভাবে যেন জোছনার আলো এসে আলোকিত করেছে ঘরটা। আমরা আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলাম।
- হঠাৎ মনে হলো জ্যাকি আমাদের সাথে নেই! এলোমেলোভাবে চারপাশে তাকিয়ে খুঁজলাম জ্যাকিকে, কিন্তু ওকে দেখলাম না। তুমি সাইজিনের মূর্তিটা স্পর্শ করলে। আর সাথে সাথেই-
- হ্যাঁ, স্পর্শ করার সাথে সাথেই দেবতা সাইজিন জীবন্ত হয়ে উঠলো। দু’পাশ থেকে ছুটে এলো দুটো হিং¯্র নেকড়ে। সাইজিনের পাশে তারা রক্ষীর মতো দাঁড়ালো।
ওদের স্বপ্ন মন দিয়ে শুনছিলো বুড়ি। সে এবার যোগ করলো, এবং পিরামিডের ছোট ঘরটা, যেটার সিলিং এতো নিচুতে যে সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না, সেটা বড় একটা মাঠে পরিণত হলো। তেপান্তরের মাঠ! এক প্রান্ত হতে আরেক প্রান্ত দেখা যায় না, এমন একটা মাঠ।
ওদের দু’জনের দেখা একই স্বপ্ন বুড়ি কিভাবে জানলো এ নিয়ে কারো মনে কোনো প্রশ্ন এলো না। সালমা বললো, সাইজিন কয়েক কদম এগিয়ে এলো। বললো- স্বাগতম সভ্য মানুষ। আমি দেবতা সাইজিন। আমি ভূমিকম্প ও মৃত্যুর দেবতা। আমি ক্ষমতাধর কিন্তু অভিশপ্ত! তাই সকলেই আমাকে ভয় পায়... হা হা হা... তোমরা ভয় পাও আমাকে?
জামাল যোগ করলো, ঠিক তখনই নেকড়ে দু’টো মৃদু গর্জে ওঠে। থাবা দিয়ে মাটিতে আঁচড় কাটে। তখন কেন যেন আমাদের সমস্ত ভয় দূর হয়ে গেছে। তবে খানিকটা শীত শীত লাগতে শুরু করে। বলি, হে মহান সাইজিন, সময়ের সাথে সাথে মায়া সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে। আমরা যা দেখছি তা কেবলমাত্র কল্পনা কিংবা বিভ্রম। আপনার প্রতি শ্রদ্ধাপূর্বক জানাচ্ছি যে, দেবতা কিংবা দৈবিক শক্তিতে আমি বিশ^াস করি না। মানুষ বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান রূপ লাভ করেছে আর এভাবেই বিলীন হয়ে যাবে। বিলীন হয়ে যাবে মানব সভ্যতা। দেব-দেবী বলতে আসলে কিছু থাকার কথা নয়।
মহান সাইজিন বলে, তোমরা মানুষেরা এই একই ভুল সবাই করো। আমি তোমার সামনে বর্তমান। ক্ষমতাধর দেবতা সাইজিন! এই মেয়ে তুমিও কি দেবতায় বিশ্বাসী নও?
সালমা বললো, আমি তখন বললাম, বলতে দ্বিধা নেই, তবেও আমিও ঠিক বিশ্বাস করছি না তোমাকে।
সাইজিন বললো, সাবধান মেয়ে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছো, ভষ্ম হয়ে যেতে পারে তোমার চোখ! শোনো, মায়া সভ্যতা হলো সবচেয়ে সমৃদ্ধ সভ্যতা। এখন পর্যন্ত তোমরা মায়া সভ্যতা সম্পর্কে তেমন কিছু জানো না, কারণ আমরা তোমাদের জানতে দিইনি। তবে তোমরা যারা মায়ানদের নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করবে, তারা মারা পড়বে আমার দুই রক্ষীর হাতে।
আমি বললাম, তাহলে এখন কি আমাদেরও মৃত্যু হবে?
তুমি বললে, এখন না সালমা, আমি বেশ বুঝতে পারছি, এটা স্বপ্ন। আর স্বপ্নে কারো মৃত্যু হতে পারে না, হলেও সেটা বাস্তব জীবনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।
বললাম, কিন্তু মহান দেবতা সাইজিন?
তুমি বললে, কল্পনা!
সাইজিন তার রক্ষী নেকড়েদের দিকে ইশারা করতেই নেকড়ে দুটো আমাদের দিকে তেড়ে এলো। আমার বাম হাতের কড়ে আঙ্গুলে কামড়ে দিল, তোমারও। আঙ্গুল রক্তাক্ত হয়ে গেছে। সাইজিন বললো, তোমরা এখন স্বপ্ন দেখছো। তবে স্বপ্ন ভাঙ্গার পরেও তোমরা রক্তটা দেখবে। যন্ত্রণা পাবে। এখন দেখো মেয়ে, এই ছেলে এখন থেকে আর কোনো কথা বলতে পারবে না। সে এখন থেকে বোবা হয়ে গেল।
তুমি কথা বলার চেষ্টা করছো কিন্তু পারছো না। চিৎকার করছো কিন্তু কোনো শব্দ হচ্ছে না। তুমি গলা চেপে ধরেছো আতংকে। আমিও ভয় পেয়ে গেছি। সাইজিন বললো, এবার বলো মেয়ে, তুমি কিভাবে মরতে চাও?
বললাম, আমি মরতে চাই না।
- মরতে তোমাদের হবেই। তোমরা ভয়ানক অন্যায় করেছো। মায়াদের সম্পর্কে যেটুকু জানতে দেয়া হবে, তারচেয়ে বেশি জানবার অধিকার তোমাদের নেই।
- মহান সাইজিন। আপনি আমাদের শাস্তি দিন কিন্তু মৃত্যু নয়।
- আমি তো মৃত্যুর দেবতা! আমি তো মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনো শাস্তি দিতে পারি না। তবে হ্যাঁ, আমি অভিশাপ দিতে পারি। তোমরা কি অভিশপ্ত হতে চাও?
- অভিশাপ?
- হ্যাঁ, অভিশাপ! ধরে নাও তোমাদের অভিশাপ দিলাম- অমরত্ব! তোমরা অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকবে মৃত্যুর আশায়। তোমাদের মৃত্যু নেই। এখন বলো কি চাও- মৃত্যু না অমরত্ব?
- মৃত্যু চাই না মহান সাইজিন। আপনি আমাদের অভিশাপ দিন। কিন্তু অভিশাপ থেকে মুক্তির কোনো উপায় কি নেই?
- অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে চাও? ঠিক আছে সেটাও সম্ভব। প্রতি ২৬০ রাতে একটি অভিশপ্ত রাত আসবে। সেই অভিশপ্ত রাতে অন্যকেউ যদি অভিশপ্ত হতে চায় তাহলে তোমরা মুক্তি পেতে পারো। ফিরে পেতে পারো স্বাভাবিক জীবন, পেতে পারো স্বাভাবিক মৃত্যু! আর না হলে অপেক্ষা করতে হবে আরো দীর্ঘ ২৬০টি রাত, সে রাতে তোমাদের বয়স কমে যাবে ২৬০ রাতের সমান! তোমরা কোনোভাবেই মরতে পারবে না, শত চেষ্টা করেও না। এমন কি আত্মহত্যার দেবতা ইকটাবও তোমাদের কোনো সাহায্য করতে পারবে না।
হঠাৎ বুড়ি বললো, অভিশপ্ত রাতে তিনবার অভিশপ্ত বাক্য উচ্চারণ করলে তোমরাও অভিশপ্ত হয়ে যাবে! তবে তাতে হয়তো অন্য কেউ অভিশাপ মুক্ত হবে। তোমরা কি মনে করতে পারো কী বলতে হবে?
ওদের আলোচনায় ছেদ পড়ায় জামাল খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বুড়ির দিকে তাকালো, সাথে খানিকটা বিস্ময়ও রয়েছে। বললো, তুমি কিভাবে জানলে বুড়ি?
বুড়ি ইতস্তত করে বললো, জানি। কারণ একই স্বপ্ন আমিও হয়তো দেখেছিলাম, কিংবা দেখিনি।
- তারপর?
- তারপর অনেকগুলো ২৫৯টি রাত চলে গিয়ে আবার ফিরে আসে ২৬০তম রাত! অনেকবার উচ্চারিত হলেও বাক্যটি এখনো অভিশপ্ত!
সালমা বললো, এলোমেলো কথা বলছো কেন বুড়ি? শোনো জামাল, এই বুড়ি উল্টোপাল্টা কথা বলে আমাদের বিভ্রান্ত করতে চায়।
জামাল বললো, বুড়ি তুমি তো উল্টোপাল্টা কথা বলছো। এখন বলতো আমার ঘড়িটাকে তুমি কোথায় দেখেছো?
- আমি মোটেও উল্টোপাল্টা বকছি না। মহান সাইজিন ২৬০ দিনের কথা বলেছিলো কারণ ওরা জুলোকিন ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতো যেখানে ২৬০ দিনে বছর হিসাব করা হতো। ওরা চুলচেরা হিসাব নিকাশ করতো, হিসাবে কখনো ভুল করতো না।
বুড়ির উত্তেজিত কণ্ঠ শুনে দোতলা থেকে নেমে এলো নোরা। বললো, বুড়ি! তুমি চুপ করো। এরা যদি অভিশপ্ত বাক্য উচ্চারণ করতে না পারে- তো না পারুক। তোমার তো উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই। সাবধান বুড়ি।
নোরার কথায় নিরবতা নেমে আসে। নোরা আবারো দোতলায় উঠে গেল। সালমা নিরবতা ভেঙ্গে বললো, শোনো জামাল, আমি তোমাকে নিয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকতে চাই। সারাজীবন শুধু তোমাকেই ভালোবাসতে চাই, আর তুমি চালিয়ে যাবে তোমার গবেষণা। এসো না, আমরা মহান সাইজিনের কাছে নিবেদন জানাই।
- স্বপ্ন কখনো সত্য হয় না। ফ্রয়েড বলেন, মানুষের মনের তিনটি স্তর আছে। এরমধ্যে সবচেয়ে গভীরে অবদমিতভাবে যে ইচ্ছেগুলোকে তুমি লুকিয়ে রাখো, কিছুতেই লোকসম্মুখে আনতে চাইবে না, তারাই তোমার স্বপ্নে হানা দেবে। মূলতঃ এসবই তোমার অবদমিত যৌন কামনার ফল, যা কখনোই বাস্তবে ঘটবে না।
- আমি জানি।
- অবদমিত যৌন কামনা।
- এবার বলবো- আমি জানি না।
- হুম, অবদমিত। মনের গভীরতম স্তরে। যেখানে কোনো ঘড়িও লুকিয়ে রাখা যাবে না। কেবল অবদমিত থাকবে যৌনকামনাগুলো।
- তোমার স্বপ্ন যদি সত্য না হয়, না হোক। আমার স্বপ্ন সত্য হোক এই কামনায় আমি মহান সাইজিনের কাছে নিজেকে সমর্পন করবো।
- তার আগে এসো একটু ভেবে দেখি আমাদের জীবনে কোনটা বেশি প্রয়োজন?
- কোনটা?
- মৃত্যু না অমরত্ব?
- কিন্তু আমি আসলে অমরত্ব চাই না।
- আমিও চাই না।
- তাহলে অবশ্যই মৃত্যু চাই।
- হ্যাঁ মৃত্যু।
- কিন্তু এখনি মৃত্যু চাই না।
- ঠিক বলেছো। আমাদের জীবনের হয়তো এখনো অনেকটা সময় বাকি।
দু’জন মোটামুটিভাবে যখন নিশ্চিত হয়ে গেল যে ওরা অমরত্ব চায় না, ঠিক তখন বুড়ি খুব তেজি একটা ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলো, ঠিক বলেছো। তোমাদের জীবনে এখনো অনেক কিছু করার আছে। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছোটা কোথায়? মৃত্যুর সামনে এসে সবাই শাস্তিই পেতে চায়। আর শাস্তির মুখোমুখি হয়ে শাস্তি পেতে না চাইলে মৃত্যু যে অবধারিত। আমি অনেককেই জানি যারা ফিরে যেতে চেয়েছিল গতানুগতিকতায়; কিন্তু তোমরা জেনে রাখো, এ কোনো আইনী শাস্তি নয় যেখানে তোমাদের উকিল মহাশয় মিথ্যা সাক্ষ্য প্রমাণ দাঁড় করিয়ে বাঁচিয়ে আনবে। এ হলো অভিশাপ। মহান সাইজিনের অভিশাপ থেকে কেউ কখনো মুক্তি পায়নি, পাবেও না। হ্যাঁ, মৃত্যু তোমরা কামনা করতেই পারো। তবে তা হবে আজই, এখানেই। অথবা তোমরা বেঁচে থাকতে পারো অনন্তকাল, ভালোবাসতে পারো একে অপরকে। কেউ তোমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না কখনো, এমনকি মহান সাইজিনও না। তোমাদের ঘিরে থাকবে এক মায়াজাল, মায়ার বাঁধন। তোমরা হবে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে সুখী কপোত-কপোতি। আর এজন্য তোমাদের মাত্র উচ্চারণ করতে হবে একটি নিবেদন বাক্য, তিনবার। আমার সাথে সাথে বলে, হে মহান সাইজিন, আমরা মুক্তি পেতে চাই, মৃত্যু নয়। আমাদের অভিশাপ দিন, অমরত্ব দিন।
বুড়ির সাথে সাথে সালমা ও জামাল দেবতা সাইজিনের প্রতি অমরত্বের আর্জি পেশ করে। দ্বিতীয়বারও ওরা বাক্যটি সম্পন্ন করে। উত্তেজনায় বুড়ির চোখ চকচক করে উঠলো। দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে অর্ধেক পথ নেমে এসে পড়েছে নোরাও। বুড়ি বললো, সত্যিই এবার তোমরা আমাকে নিরাশ করোনি। আর মাত্র একবার-
তৃতীয়বার বাক্যটি শুরু করে ওরা দু’জন। কিন্তু ‘হে মহান সাইজিন’ বলার পরই থেমে গেল জামাল। জামাল ও সালমা কি পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে কোনো ইশারা করলো কিনা বুঝতে পারলো না বুড়ি। বললো, কী হলো? থামলে কেন?
- আমি মাঝে মাঝে আমার ঘড়িটা খুঁজে পাই না।
- ঘড়ির সাথে এর কী সম্পর্ক?
- ঘড়ি খুঁজে না পেলে আমি অনেক সময় সবকিছু মনে করতে পারি না।
- কিন্তু তোমাকে তো মনে করতেই হবে! এখন তো পরীক্ষার সময়। আর মাত্র একবার বলতে হবে তোমাদের ।
- না বুড়ি, আমি ঘড়িটা খুঁজে পেলেই শুধুমাত্র আরেকবার চেষ্টা করবো মনে করার। সালমা, তুমি কি আরো কিছুক্ষণ থাকবে এখানে?
সালমা বললো, জামাল, আমরা একটা স্বপ্ন নিয়ে কথা বলছিলাম। তোমার মনে নেই?
- না সালমা। হয়তো ঘড়িটা খুঁজে পেলে ভালো হতো। কিন্তু কী নিয়ে কথা বলছিলাম যেন?
- অমরত্ব কিংবা মৃত্যু নিয়ে।
- ও, থাক তাহলে, জরুরী কিছু নয়। কালরাতে এসে বাকিটা আলোচনা করা যাবে। চলো, আজ বরং চলে যাই।
জামাল ও সালমা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বুড়ি বুঝতে পারছে না হঠাৎ কী হয়ে গেল? কেন ওরা শেষবারের মতো অমরত্ব চাইলো না কিংবা পুরোপুরি বদলে গেল যেন কিছুই হয়নি। বুড়ি হঠাৎই ক্ষেপে গিয়ে বললো, তোমরা এভাবে চলে যেতে পারো না। মহান সাইজিন কিন্তু তোমাদের ছাড়বে না।
জামাল বললো, হয়তো ছাড়বে অথবা ছাড়বে না। কিন্তু যেহেতু কী বলতে হবে সেটা মনে করতে পারছি না, আপাতত আমরা চলে যেতে চাই।
- আমি জানি, তুমি ইচ্ছাকৃত ভুলে গেছো। তোমরা পারলে না, হেরে গেলে।
- হয়তো জিতে গেলাম।
- আমি বুঝতে পারছি, তোমরা মোটেও সাহসী নও। আর অনন্তকাল বেঁচে থাকার মতো সাহসী তো একদম নও। তাই তোমরা অমরত্ব চাও না, মৃত্যু চাও।
বুড়ির কথার কোনো উত্তর না দিয়ে জামাল ও সালমা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বেরিয়ে গেল সরাইখানা থেকে। সিঁড়িতে দাঁড়ানো নোরা হতাশ ভঙ্গিতে বললো, বুড়ি তুমি আবারো একটা সুযোগ নষ্ট করলে। তোমাকে তো বলেইছিলাম চুপ থাকতে।
বুড়ি নোরার কথা সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে বিড়বিড় করতে করতে কাউন্টারের পেছনে চলে গেল।


ছবি: গুগলমামা।

মন্তব্য ২০ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (২০) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:৫০

ভুয়া মফিজ বলেছেন: চমৎকার গল্প......তবে হেয়ালীটা আরেকটু কম হলে ভালো হতো, আরেকটু রীডার-ফ্রেন্ডলী হতো। :)

অনেককিছুই পরিস্কার না করে এড়িয়ে গিয়েছেন। যেমন, স্বপ্ন ভাঙ্গার পর ওদের আঙ্গুলে রক্ত ছিল কিনা!
বাই দ্য ওয়ে, এটা কি অনুবাদ?

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:১৫

ফয়সাল রকি বলেছেন: স্বপ্ন ভাঙ্গার পরের ব্যাপারটা স্পষ্ট করার দরকার ছিল, মিস করে ফেলেছি। তবে অনুবাদ না, মৌলিক। আর হেয়ালীর ব্যাপারটা এমনই, হয়তো কমানো যেতো কিংবা যেতো না :)
চমৎকার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
অফটপিক, এর আগের পোষ্টটা মনে হয় চোখে পড়েনি। সময় পেলে দেখবেন।

২| ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:১৭

রাজীব নুর বলেছেন: মনে হচ্ছে গল্পটা আগে কোথায় যেন পড়েছি।

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:১৭

ফয়সাল রকি বলেছেন: এমন তো হবার কথা না, আগে কোথাও দিই নি। তবে অন্য কোনো লেখার সাথে মিল খুঁজে পেলে অন্য কথা। যাইহোক, মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

৩| ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:১০

জুলিয়ান সিদ্দিকী বলেছেন: ওয়েস্টার্ন সিনেমার একটা সুবাস আছে শুরুতে। গল্পের বুনট মন্দ না। কিন্তু আমি বিভ্রান্ত সরাইখানা দেখে। আম্রিকায় এখনও সরাইখানা আছে?

০১ লা জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:৩২

ফয়সাল রকি বলেছেন: আম্রিকায় সরাইখানা আছে কিনা জানি না ভাই। তবে পুরো গল্পটাই যেহেতু ফ্যান্টাসি তাই সরাইখানা থাকলেও থাকতে পারে! তবে মায়া সভ্যতার সবচেয়ে বড় শহর টিকাল-এর ধ্বংসাবশেষ এখনো আছে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

৪| ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৪৩

আমি তুমি আমরা বলেছেন: -তাহলে কি নোরা অভিশপ্ত ছিল? জামাল আর সালমা অভিশপ্ত হয়ে গেলে কি নোরা অভিশাপ থেকে মুক্তি পেত?

-স্বপ্ন ভাঙ্গার পরেও কি ওদের আঙ্গুলে রক্ত ছিল?

-বুড়ি কিভাবে সালমা আর জামালের স্বপ্নের কথা জানে? সে কেন চায় জামাল আর সালমার ওপর অভিশাপ নামুক? তাহলে কি সে অভিশাপ মুক্ত হবে? বুড়ির এখানে কি স্বার্থ?

-জামালের ঘড়ির ভূমিকাটা গল্পে অস্পষ্ট মনে হয়েছে।

-গল্পের মাঝখানে অনেকটুকু অংশ জুড়ে সংলাপগুলো হেয়ালিপূর্ণ, পাঠক খেই হারিয়ে ফেলতে পারে। ওই অংশে সংলাপ আরেকটু কমিয়ে আনলে গল্পের গাঁথুনিটা টানটান হবে বলে মনে করি।

০১ লা জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৪৩

ফয়সাল রকি বলেছেন: আপনি ঠিক ধরেছেন। বুড়ি আর নোরা অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে চায়, আর সেজন্য জামাল আর সালমাকে অভিশপ্ত হতে হবে। রক্তের ব্যাপারটা আমি মিস করে গেছি। আর হেয়ালীপূর্ণ কথার ব্যাপারটা কিন্তু কারো কারো কাছে মন্দ লাগেনি, আমার কয়েকজন বিশেষ পাঠকের কথা বলছিলাম আরকি। তবে আপনার সাজেশনটা মাথায় থাকলো।
চমৎকার একটা মন্তব্যের জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ।

৫| ০১ লা জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:১৯

ইসিয়াক বলেছেন: নববর্ষের শুভেচ্ছা রইলো ।
আগামী প্রতিটি দিন আপনার ভালো কাটুক এই কামনা রইলো

০১ লা জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:২১

ফয়সাল রকি বলেছেন: ধন্যবাদ ইসিয়াক।
আপনার প্রতিও শুভেচ্ছা রইল।

৬| ০১ লা জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৪

শিখা রহমান বলেছেন: ফয়সাল গল্পটা অফলাইনে পড়েছিলাম। ভালো লেগেছে। তবে কয়েকটা জায়গায় একটু হোঁচট খেয়েছে গল্পটা।
তারপরেও অনেক ভালো লেগেছে। গল্পে ভালোলাগা রেখে গেলাম।

শুভকামনা ও নববর্ষের শুভেচ্ছা রইলো।

০১ লা জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০২

ফয়সাল রকি বলেছেন: চমৎকার একটা মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপু। লেখা পড়ে ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগছে। আমি কিন্তু আপনার কবিতার বিশেষ ফ্যান। আর রঞ্জনের প্রেমিকারা... বইটা কেনার পরে মনে হয়েছিলো, একটা অটোগ্রাফ পেলে মন্দ হতো না :)

৭| ০১ লা জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৮

জুল ভার্ন বলেছেন: গল্পে মাঝেমধ্যে কিছুটা ছন্দপতন মনে হলেও খুব ভালো লেগেছে।

০১ লা জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪২

ফয়সাল রকি বলেছেন: মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভ্রাতা।

৮| ০২ রা জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:৪৬

রূপম রিজওয়ান বলেছেন: চমৎকার গল্প! আপনার ছোটগল্পগুলো দারুণ লাগে।
শুভকামনা জানবেন।

০২ রা জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০৫

ফয়সাল রকি বলেছেন: ধন্যবাদ রূপম রিজওয়ান ভাই। পাশে থাকবেন।

৯| ২১ শে জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:৫৫

স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন:
দারুন লাগলো। একটু হোঁচট খেলেও সামলে নিয়েছি।
ভালো লাগা নিন ++

২১ শে জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:১০

ফয়সাল রকি বলেছেন: মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
তবে হোঁচটটা কোথায় খেলেন জানলে একটু সুবিধা হতো।
ভালো থাকবেন।

১০| ২১ শে জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:১৩

স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন:
ধরতে পারছি না। :)

২১ শে জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:১৯

ফয়সাল রকি বলেছেন: তাহলে হোঁচটটা বেশি বড় ছিল না মনে হয় :-B
প্রতিমন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.