নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৭ক নম্বর কানাগলির শেষ মাথায় ডানদিকে একটা ছয়তলা হলুদ বাড়ি, আর বামদিকের প্লটটা দীর্ঘদিন ধরে খালি থাকতে থাকতে অস্থায়ী ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে। হলুদ বাড়িটার নাম- আশ্রয়। ছয়তলা পর্যন্ত লিফট বাধ্যতামূলক না হওয়া সত্তে¡ও বাড়িটিতে লিফট আছে এবং সেখানে মাত্র দশটি পরিবারের বসবাস। নিচতলায় পুরোটা গ্যারেজ ও গার্ডরুম এবং অন্যান্য প্রতিটি তলায় দুইটি করে ইউনিট, যার একটিতে বাড়িওয়ালা সোবহান সাহেব সপরিবারে বসবাস করেন। রাত দেড়টার দিকে বাড়ির সামনে একটি সাদা মাইক্রোবাস থামলো। মৃদু শব্দ হলো। সোবহান সাহেব গাড়ির শব্দ পেলেন না। তাছাড়া শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়েন।
মাইক্রোবাসটাকে রাস্তার বামপাশের প্লটটার পাশ ঘেঁষে পার্ক করে চারজন যুবক নেমে এলো। ওদের একজন পিপিই পরেছে আর বাকি তিনজনের মুখে রয়েছে চাইনিজ নিনজা মাস্ক। কোভিড-১৯ ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য ইদানীং প্রায় সবাই মাস্ক ব্যবহার করছে আর যারা সরাসরি কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে যাচ্ছে তারা পিপিই ব্যবহার করছে যা ব্যবহারকারীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে রাখে।
পিপিই পরিহিত ব্যক্তি অন্যান্যদের থেকে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়েছে। তাদের একজন সোবহান সাহেবের বাড়ির সদর দরজায় টোকা দিলো কয়েকবার। প্লেইনশিট-এঙ্গেলের দরজা। বাইরে থেকে সহজে ভেতরে কিছু দেখা যায় না, তেমনি ভেতর থেকেও বাইরে দেখা যায় না। তবে ভেতর থেকে দেখার জন্য ছোট্ট চার ইঞ্চি বর্গক্ষেত্র বিশিষ্ট একটা জানালা দেওয়া আছে যা কেবল ভেতর থেকেই খোলা যায়। যুবকটি আরো কয়েকবার টোকা দিলো। গার্ডরুমটা সম্ভবত বেশি দূরে নয় আর গার্ড তোতা মিয়ার ঘুমও হয়তো খুব একটা গাঢ় হয়নি ফলে দ্রুতই সে জেগে গেল। যুবক আবারো দরজায় টোকা দিলো। ওরা আশেপাশের বাসার দিকেও নজর দিলো, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। রমজান মাস। এ সময় রাত একটা দেড়টা পর্যন্ত খুব বেশি মানুষ জাগে না। কাজেই ওদের উপস্থিতি আশেপাশের বাসিন্দাদের নজরে পড়েনি।
তোতা মিয়া চোখ কচলাতে কচলাতে দরজার কাছে এসে বলল, কে? কারে চান?
যুবক বলল, আমরা জরুরি মেডিকেল সার্ভিসের লোক।
তোতা মিয়া ছোট জানালা খুলে বাইরে তাকালো। মাস্ক পড়া কয়েকজন মানুষ দেখলো। বলল, কার কাছে যাইবেন?
- সোবহান সাহেবের বাসায় যাব। উনি আমাদের হটলাইনে ফোন করেছিলেন।
- ও, এত রাইতে আইছেন কেন? সকালে আহেন।
- আমরা তো চব্বিশ ঘণ্টাই কাজ করছি। উনার সিরিয়াল অনুযায়ী এসেছি। করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।
- আমাগো বিল্ডিংয়ে তো কারো করোনা হয় নাই।
- এখনো করোনা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আমরা নমুনা সংগ্রহ করে, টেস্ট করে তারপর জানাবো। গোপনে নমুনা নিয়ে যাব যাতে সন্দেহবশত কেউ আপনাদের বিল্ডিং-এ সামনে বা কোনো সদস্যকে ডিসটার্ব না করে। আপনি দয়া করে একটু গেটটা খুলেন।
- এত রাইতে আইছেন আপনেরা, গেট খুলা ঠিক হইবো না।
- আপনি বরং সোবহান সাহেবের সাথে কথা বলেন। আমরা ফোনে ধরায় দেই।
যুবক মোবাইল ফোন বের করে ডায়াল লিস্টে একটা নম্বর খুঁজতে শুরু করল। তোতা মিয়া বলল, ‘স্যারে কি আপনাগোরে ফোন দিছে? হেয় তো নিজেই অসুস্থ।’
- হুম, সেজন্যই তো এসেছি। তাড়াতাড়ি করেন, আমাদের আরো কয়েক জায়গায় যেতে হবে। কি, কথা বলবেন আপনার স্যারের সাথে?
তোতা মিয়া কিছু না বলে মূল দরজার পাশের ছোট গেইটের তালা খুলতে শুরু করল। ওরা নিঃশব্দে অপেক্ষা করল কিছু সময়। গেইট খোলা মাত্র ভেতর প্রবেশ করল তিনজন, তারপর কয়েক সেকেন্ড পরে ঢুকলো পিপিই পরিহিত ব্যক্তি। তোতা মিয়া মাথা বের করে বাইরে তাকালো, আর কাউকে দেখতে পেল না। তবে একটা সাদা মাইক্রোবাস চোখে পড়ল। ভেতর ফিরে দরজা আটকানো মাত্রই তোতা মিয়ার মাথার দুই ইঞ্চি দূরে পিস্তলের নল ঠেকালো যুবক। বলল, ‘কোনোরকম শব্দ করলে গুলি খাবি। একদম চুপ। আমরা তোর কোনো ক্ষতি করতে চাই না। আমরা কারোই কোনো ক্ষতি করতে চাই না, হা হা হা।’
তোতা মিয়া কোনো কথা বলল না কিন্তু ওর হাতে থাকা চাবির গোছাটা টুপ করে পড়ে গেল। মোজাইক করা মেঝেতে ভোঁতা একটা আওয়াজ হলো। সে চরম মাত্রার ভয় পেয়েছে। পিপিই পরিহিত ব্যক্তি বলল, ‘ত। দেরি করা যাবে না। হাত পা বেঁধে রাখ ওকে।’
কাছে পিঠেই একটা পুরোনো হাতওয়ালা কাঠের চেয়ার পাওয়া গেল। চেয়ারটায় একসময় গদি ছিল, ছেঁড়া গদির অবশিষ্টাংশ দেখা যাচ্ছে। আপাতত গদি ছাড়াই বসানো হলো তোতা মিয়াকে। ওদের একজনের ঘাড়ে একটি স্কুল ব্যাগ ঝোলানো, সেখান থেকে এক টুকরো নাইলনের দড়ি বের করল। হাত-পা বাঁধার ক্ষেত্রে ওদের দক্ষতা চোখে পড়ার মতো। মুখে একটা টেপ সেঁটে দেওয়া হলো। দ্রুতই কাজ শেষ হয়ে গেল। পিপিই পরিহিত ব্যক্তি দুইজনকে সঙ্গে নিয়ে সিঁড়ির দিকে গেল আর যে যুবকটি দরজায় টোকা দিয়ে গার্ডের সাথে প্রাথমিক কথোপকথন চালিয়েছিল তাকে গার্ডের গার্ড হিসেবে রেখে গেল।
সিঁড়িতে পা দিতেই পিপিই পরিহিত উল্লা বাহিনীর প্রধান সলিমউল্লাহর মনে হলো, অনেকদিন পর এরকম সিঁড়িতে পা দিলো সে।
অনুসারী একজন যুবক বলল, ‘ওস্তাদ, বাসায় লিফট আছে তো! ছাইড়া দেই?’
সলিমউল্লাহ মুহূর্তের জন্য থমকালো, তারপর বলল, ‘না থাক। তিন তলা তো হাঁইটাই যাই।’
যুবকটি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু অন্যজন তাকে ইশারায় থামিয়ে দিলো। আজকের অপারেশন সম্পর্কে ওরা তেমন কিছু জানে না। ঘণ্টাখানিক আগে ওদের তিনজনকে ওস্তাদ বলল, রেডি হইয়া নে। সেহরি কইরা আসি।
অন্যান্য বছর সেহরি করার জন্য বের হলে ওরা হয়তো পুরান ঢাকার রাজ্জাক হোটেল কিংবা সিটি কলেজের পাশের স্টার কাবাবে যেত কিন্তু এবছর করোনা ভাইরাসের কারণে ঘোষিত লকডাউনে সেহরি করার মতো কোনো রেস্টুরেন্ট খোলা নেই। ওস্তাদের কথা শুনে ওদের হয়তো মনে হয়েছিল পরিচিত কারো বাসায় যাবে। কিন্তু বাসায় ঢোকার আগে জানালো কীভাবে বাসায় ঢুকতে হবে।
তিন তলার ডান পাশের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে স্কুল ব্যাগ থেকে এক গোছা চাবি বের করতে দেখে সলিমউল্লাহ বলল, ‘আলফাজ, সাবধানে খুলবি। শব্দ কম।’
আলফাজ নামক যুবকটি হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল দরজার সামনে। তালাটার দিকে তাকিয়ে ওর মনে হলো, এই তালা সহজেই খোলা যাবে কিন্তু ভেতর থেকে যদি সিটকিনি দেওয়া থাকে? তখন অবশ্য ঝামেলা বেড়ে যাবে। কায়দা করে সিটকিনিও খুলতে হবে বাইরে থেকে।
কিছু না বলে গোছা থেকে চাবি বাছাই করতে শুরু করল আলফাজ। অন্য যুবকটি বলল, ওস্তাদ, সেহরির কী হইবো?
সলিমউল্লাহ খুব অবাক দৃষ্টিতে তাকালো যুবকের দিকে। ওর নাম ছোকটু, নতুন এসেছে দলে। আকারেও খুব একটা বড়োসড়ো নয়, কোনোরকম পাঁচ ফুট পার হবে হয়তো। নতুন আনকোরা ছেলে ছোকড়া নিয়ে সে সাধারণত কোনো অপারেশনে যায় না। এরকম পরিস্থিতিতে যে ছেলে তিন তলা সিঁড়ি দিয়ে না উঠে লিফটে উঠতে চায় তাকে নিয়ে ভবিষ্যতে ভাবতে হবে।
এক গোছা চাবির মৃদু শব্দে হোক বা ছোটকুর কথায় কিংবা নিতান্ত কাকতালীয়ভাবেই হয়তো তিন তলার বাম পাশের ফ্লাটের সদর দরজায় খুট করে একটা শব্দ হলো। দরজাটা সামান্য খুলে মাঝবয়েসি একজন মানুষ উঁকি দিলো। উল্লা বাহিনীর তিনজনই স্থির, পিনপতন নিস্তব্ধতা। এরকম অপ্রত্যাশিত ঘটনা খুব একটা ঘটেনা। মাঝবয়েসি মানুষটি ঘুম ঘুম চোখে ওদের দেখে বুঝতে পারলো না কী ঘটতে চলেছে। বলল, ‘আপনারা কারা?’
আলফাজ হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থা থেকে নড়লো না। এমন সময় তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে গেলে বিপত্তি হতে পারে। ছোটকু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ওকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে সলিমউল্লাহ বলল, আমরা ইমার্জেন্সি মেডিকেল টিম। করোনা ভাইরাসের স্যাম্পল কালেক্ট করতে এসেছি। হট লাইন নম্বরে ফোন করা হয়েছিল।
- ও। কিন্তু এত রাতে এসেছেন কেন?
- আমাদের তো চব্বিশ ঘণ্টাই কাজ করতে হয়। দেশের অবস্থা তো ভালো না, প্রচুর রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
- তা ঠিক, তা ঠিক।
- আপনার পরিবারের সদস্যরা সুস্থ আছে তো? জ্বর, সর্দি, কাশি?
- না না, কোনো সমস্যা নেই।
- আপনি যান, শুয়ে পড়ুন।
করোনা মহামারিকালীন সময়ে পিপিই পরিহিত একজন নমুনা সংগ্রহকারী যে বাসায় আসতে পারে- বিষয়টা উনার কাছে স্বাভাবিক মনে হলো। উনি সন্তুষ্ট হয়ে দরজা লাগিয়ে দিচ্ছিলেন হঠাৎ আলফাজের দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেলেন। সন্দেহ হলো কি না বলা যাচ্ছে না, তবে খুব অবাক হয়ে তিনি বললেন, তাহলে আপনারা কলিংবেল না বাজিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করছেন কেন? কলিংবেল তো ভালো! সন্ধ্যাবেলাতেও শুনলাম বাজছে।
- হয়তো ভালো। কিন্তু আমরা তো কলিংবেল বাজাবো না।
- কেন বাজাবেন না?
- এমনি। আমাদের ইচ্ছা।
- মানে? আপনারা কারা?
এ প্রশ্নটার জন্য ছোটকু প্রস্তুত ছিল। কখন যে ওর হাতে কালো রঙের দেশীয় পিস্তলটা উঠে এসেছে সেটা কেউ লক্ষ্য করেনি। বলল, আমরা কেউ না। তুই কে?
- আআআআমিমিমিমি...
ঘুমে পাওয়া ভদ্রলোক পিস্তল দেখে চমকে গিয়ে তোতলাতে শুরু করেছেন।
ছোটকু চাপাস্বরে বলল, ‘চুপ! শব্দ করলে একদম ফুটা কইরা দিমু।’
ভদ্রলোকের তোতলানো চলছেই। এরকম ফালতু একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায় সলিমউল্লাহ খুবই বিরক্তবোধ করছে। সে হাত তুলে থামিয়ে দিলো ছোটকুকে। ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভেতরে গিয়ে ঘুমাতে বললাম; শুনলেন না। এখন একটু তো যন্ত্রণা আপনাকেও পেতে হবে। চলুন, ভেতরে চলুন।’
ভদ্রলোক খুবই ঘাবড়ে গিয়েছেন বোঝা যাচ্ছে। তিনজন সশস্ত্র অপহর্তা তাকে একরকম ঠেলেই ভেতরে নিয়ে গেল। চৌকাঠ পেরোতেই সাজানো গোছানো একটা ড্রইংরুম চোখে পড়ল। আলফাজ ব্যাগ থেকে আরেক টুকরো দড়ি বের করে হাত বেঁধে সোফায় বসালো ভদ্রলোককে। ফিসফিস করে বলল, ‘চাচা, ঘরে কয়জন মানুষ আছে?’
উনি এখনো নিজেকে সামলে নিতে পারেননি। তোতলাতে তোতলাতে বললেন, ‘বউ আর বাচ্চা।’
- আর কেউ নাই?
- নেই।
সলিমউল্লাহ ইশারা করতেই ছোটকু নিঃশব্দে ভেতরের ঘরগুলোতে উঁকি দিলো। দুই বেডরুমের ফ্ল্যাট যার মধ্যে একটি ঘর শূন্য এবং অন্যটিকে ডিম লাইটের মৃদু আলোয় একজন মহিলা ও একজন বালকের বিছানায় ঘুমিয়ে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে ফিরে এলো ছোটকু।
পিপিইটা খুললো সলিমউল্লাহ। দীর্ঘ সময় পিপিই পড়ে থাকার অভ্যাস নেই। তাছাড়া এই অদ্ভুত বস্তু গায়ে চাপিয়ে রাখলে ভেতরে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। ইতোমধ্যে শার্ট-প্যান্ট ঘামে ভিজতে শুরু করেছে। পিপিই খুললেও মাস্ক খুললো না। ভদ্রলোকের সামনে রাখা সোফার সেন্ট্রাল টেবিলে আলতো করে পশ্চাৎদেশ ঠেকালো। সরাসরি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলল, ‘আমরা খারাপ লোক না, ভয় পাবেন না। আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছি। কাজ শেষ হলেই চলে যাবো। ঠিক আছে?’
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন যেন সবটাই সত্যবচন আর উনি সরল মনে বিশ্বাস করেছেন।
- গুড। আপনি শুধু শুধু জড়িয়ে পড়লেন।
ভদ্রলোক এবারো মাথা নাড়লেন। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে দরজা ঠিকঠাক লাগানো হয়েছে কি না সেটা চেক করতে গিয়েছিলেন। দরজার ওপাশে মৃদু শব্দ পেয়ে দরজা খোলাটা ঠিক হয়নি। আইহোল দিয়ে দেখে নেওয়া দরকার ছিল আগে।
- নাম কী আপনার?
- জি, রেজা।
- রেজা সাহেব শুনেন। আপনাকে আবারো বলি, আমরা আপনার কোনো ক্ষতি করতে চাই না। আপনি রিল্যাক্স থাকেন।
রেজা সাহেব মাথা নাড়লেন। মাথা নাড়া ছাড়া আর কিছু করা বা বলার মতো অবস্থা তাঁর নেই।
আলফাজের দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারা করতেই সে ব্যাগ থেকে নতুন এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট আর লাইটার বের করে দিলে ওস্তাদের হাতে। সলিমউল্লাহ সময় নিয়ে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ের প্লাস্টিকের চামড়া ছাড়ালো। ভেতর থেকে এক শলাকা সিগারেট বের করে ফিল্টারের নিচের দিকে তর্জনী দিয়ে টোকা দিলো কয়েকবার। সামনে তাকিয়ে মৃদু হেসে শলাকাটা এগিয়ে দিয়ে বলল, সিগারেট চলে? বেনসন?
রেজা সাহেব ইতস্তত করছেন। হ্যাঁ বা না- কিছুই বলছেন না দেখে সলিমউল্লাহ বলল, বাসায় সিগারেট খান না, তাই তো?
- জি।
- ব্যাপার না। আজকে খান। আজকে একটা বিশেষ দিন। আপনার সাথে আমাদের দেখা হয়ে গেল। বিশেষ দিন, তাই না?
- জি।
- খালি জি জি বললে হবে? সিগারেট নেন। ও, আপনার হাত তো বাঁধা! আলফাজ, ভাইর হাত বাইন্ধা রাখছোস ক্যান? খুইলা দে। হাত বান্ধা থাকলে সিগারেট টানবো কেমনে?
আলফাজ হাতের বাঁধন খুলে দিলে উনি সিগারেটটা নিলেন। সলিমউল্লাহও একটা সিগারেট জ্বাললো। এই অল্প সময়ের মধ্যেই আলফাজ রেজা সাহেবের ব্যবহার করা মোবাইল ফোনটা সোফা থেকে তুলে সরিয়ে রেখেছে, ব্যাগ থেকে একটা ছাইদানিও বের করেছে। সলিমউল্লাহ ধোঁয়া কুন্ডলী ছাড়তে ছাড়তে বলল, বুঝলেন রেজা সাহেব, পৃথিবীটা বড়োই আজব জায়গা! আমরা সবাই যার যার জায়গায় অভিনয় করি আর চরিত্রটা নির্ধারণ করে দেন তিনি, ওপরওয়ালা। কিন্তু নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করি বলে সবাই খারাপ চোখে দেখে। আরে ভাই, আমার ভাগে নেগেটিভ চরিত্র পড়লে আমার কী দোষ বলেন?
রেজা সাহেব যথারীতি মাথা নাড়লেন।
- যাক গে, আপনি কী করেন? ব্যবসা?
- না, চাকরি করতাম।
- করতাম মানে কী? এখন করেন না?
- চাকরিটা সম্ভবত চলে গেছে। একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতাম। লকডাউন শুরু হবার পর কিছুদিন হোম-অফিস করেছি। প্রথম মাসে বেতন কমিয়ে অর্ধেক করে দিয়েছে। পরের মাসে থেকে হোম অফিস বন্ধ। যেহেতু প্রোডাকশন বেইজ কোম্পানি তাই প্রোডাকশন শুরু হবার আগ পর্যন্ত অফিস বন্ধ। এরপর থেকে অফিসে যোগাযোগ করে আর কোনো লাভ হয়নি। কবে খুলবে, কেউ কিছু বলতে পারে না। আদৌ খুলবে কি না, খুললেও আগের মতো সবকিছু থাকবে কি না- কেউ কিছু বুঝতে পারছে না।
- খুবই দুঃখজনক।
রেজা সাহেব সলিমউল্লাহর দিকে তাকালেন যেন সত্যিই সে দুঃখিত হলো কি না তা দেখার চেষ্টা করলেন তবে মুখে কিছু বললেন না।
- লকডাউনের কারণে সবারই কমবেশি সমস্যা হচ্ছে। যাই হোক, রোযা রাখেন আপনারা?
- জি?
- রোযা? সব মুসলমানের জন্য রোযা ফরজ। রোযা রাখেন তো?
-জি, রোযা রাখি।
- খুবই ভালো কথা। সেহরির কী ব্যবস্থা? রান্নাবান্না করা আছে?
- রান্না করে রাখার কথা।
- আপনার কাছে অনুরোধ হলো আমাদের জন্য সেহরির ব্যবস্থা করা। ভাবিকে ডাকেন। আমাদের জন্য একটু গরম ভাতের ব্যবস্থা করতে বলেন। গরম ভাত না হলে সেহরিটা ঠিক জমে না।
- দেখুন, আমি দিন আনি দিন খাই টাইপের মানুষ। আমার বাসায় টাকা-পয়সা, সোনা-গহনা কিছুই নেই। বিশ্বাস না হলে আপনি চেক করে দেখুন। কিন্তু প্লিজ আমার পরিবারকে টানবেন না।
- আহ, আপনি খামাখাই উত্তেজিত হচ্ছেন।
- প্লিজ ভাই, প্লিজ।
- আমি তো তেমন কিছু চাইনি। শুধু এক বেলা সেহরির আয়োজন করতে বলছি। এর বেশি কিছু না। ঠিক আছে?
রেজা সাহেব কিছু বললেন না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন।
- আপনি নিশ্চিত থাকেন, আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না। আমার ছেলেরা আপনার স্ত্রীর কাছেও যাবে না। আপনি যান, ভাবিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেন। সবকিছু বুঝিয়ে বলেন।
রেজা সাহেব এবার মাথা নাড়লেন না। সম্ভবত আশ্বস্ত হতে পারছেন না। আরো কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল সলিমউল্লাহ কিন্তু রেজা সাহেব অনড়, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সলিমউল্লাহ আধ-খাওয়া সিগারেটটা ফেলে দিয়ে প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে তর্জনী দিয়ে টোকা দিলো, একবারের জন্যও সামনে তাকাচ্ছে না। আরো পাঁচ-ছয় সেকেন্ড অপেক্ষার পর সিগারেট থেকে চোখ না-সরিয়ে সে আলফাজের দিকে হাত বাড়ালো। আলফাজ ব্যাগের ভেতর থেকে একটা পিস্তল বের করে উল্লা বাহিনীর প্রধানের হাতে রাখলো। স্পর্শ পেতেই সলিমউল্লাহ কটমট করে তাকালো আলফাজের দিকে, বলল, ‘তুই একটা গাধা। তোর কাছে মেশিন চাইছি? দেখস না হেরা ভদ্রলোক! মেশিন দিয়া কী করুম? পান দে এক খিলি।’
আলতো করে জিহবায় একটা কামড় দিলো আলফাজ। পিস্তলটা ব্যাগে রেখে রুপালি রংয়ের পানের বাক্স বের করল। কারুকার্য করা বাক্সটা দেখে জমিদার পরিবারের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বলে ভ্রম হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এগিয়ে দিলো ওস্তাদের দিকে। বাক্সটা খুলতেই জর্দার মিষ্টি সুগন্ধে চারপাশ ভরে উঠলো। থরে থরে সাজানো মশলা, জর্দা, চুন, কাটা সুপারি, পান রাখা। খুব যত্ন করে এক খিলি পান বানিয়ে মুখে চালান দিলো সলিমউল্লাহ। রেজা সাহেবের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলো। মোলায়েম স্বরে বলল, ‘যান ভাবিকে ডাকেন।’
রেজা সাহেব কী করবেন বুঝতে পারছেন না। পান চাবাতে চাবাতে সলিমউল্লাহর জিহবা লাল হয়ে গিয়েছে। জিহবার লাল রংয়ের কারণে চোখ জোড়াও কেমন যেন লালচে দেখাচ্ছে। রেজা সাহেব আলফাজের দিকে তাকালেন। সে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসলো। ছোটকু পিস্তল তাক করে রয়েছে ওঁর দিকে। উনি হাতের সিগারেটটা ছাইদানিতে ফেলে দিয়ে নিঃশব্দে উঠে পড়লেন। তাঁর মনে হলো, এরা এখনো ভালো ব্যবহার করছে, কতক্ষণ ভালো থাকবে বলা যায় না। তবে এদের খ্যাপানো ঠিক হবে না। যেহেতু মূল টার্গেট অন্য কেউ, কাজেই হয়তো অল্পের ওপর দিয়ে পাড় পাওয়া যেতে পারে।
পেছন থেকে সলিমউল্লাহ ডাকলো, রেজা সাহেব।
- জি!
- আপনার বাচ্চার নাম কী?
- সাকিব।
- বয়স কত?
- জি, আট বছর।
- ভালো। শুনুন, আট বছরের একটা বাচ্চার সামনে বাবা-মার গায়ে হাত তুললে বা খুন খারাপি করলে বাচ্চা দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে। কাজেই উল্টাপাল্টা কিছু করবেন না।
রেজা সাহেবের পা আটকে গেল। বেডরুমের দিকে যেতে পারলেন না।
- খামোখা ভয় পাবেন না। যান। কিন্তু যা করবেন বুঝে শুনে করবেন। ঠিক আছে?
উনি হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বেডরুমের দিকে পা বাড়ালেন।
খানিকক্ষণ বাদে রেজা সাহেব সস্ত্রীক ফিরলেন। সলিমউল্লাহ ততক্ষণে সোফায় গিয়ে বসেছে। কাঁচা ঘুম থেকে জেগে ওঠা হতভম্ব মাঝবয়েসি গৃহবধূকে দেখে সে বলল, ‘আমাদের তিনজনের জন্য সেহরির ব্যবস্থা করেন। আজকে আমরা আপনার অতিথি।’
রেজা সাহেব বললেন, ‘একটু সমস্যা আছে। বাসায় পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল নেই।’
- ও, তাহলে চালের ব্যবস্থা করি। আলফাজ-
রেজা সাহেবের স্ত্রী তাহেরা খাতুন বললেন, ‘চাল লাগবে না। বাসায় চাল আছে।’
- গুড। আর তো সমস্যা থাকলো না।
- অন্য সমস্যা আছে। আমার হাজবেন্ড বলতে পারেনি। আমি বলছি।
- বলেন।
- আমি ডাকাত দলের জন্য রান্না করব না।
সলিমউল্লাহ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো। না বোঝার ভান করে বলল, ‘আরেকবার বলেন, বুঝতে পারি নাই।’
- ডাকাত দলের কারো জন্য রান্না করব না। আপনার যা খুশি করতে পারেন।
- হা হা হা, আপনাকে কে বলল- আমরা ডাকাত?
- আপনারা ডাকাত নন? মাঝরাতে অস্ত্র হাতে অন্যের বাড়িতে আপনারা কী করছেন? বেড়াতে এসেছেন?
রেজা সাহেব প্রচন্ড ভয় পেয়ে কাচুমাচু করে তাকাচ্ছেন। স্ত্রীর রণমূর্তি দেখে অভ্যস্ত কি না বোঝা যাচ্ছে না। হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, ‘ভাই, ওর কথায় কিছু মনে করবেন না।’
তাহেরা খাতুন স্বামীর দিকে অগ্নিদৃষ্টি দিলেন। বললেন, ‘আমি কি ভুল কিছু বললাম নাকি? উনারা তো ডাকাতি করতেই এসেছেন। এই করোনার সময় আমরা তো ভুলেও ঘর থেকে বের হই না। উনাদের তো সেই ভয়ও নেই।’
সলিমউল্লাহ হাত তুলে থামালো। বলল, ‘থামেন। আমি কি একবারো আমাদের পরিচয় দিয়েছি? দেইনি। আমরা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে এই অপারেশনে এসেছি।’
আলফাজ ছাড়া উপস্থিত অন্য তিনজন হকচকিয়ে গেল।
সলিমউল্লাহ তাহেরা খাতুনের দিকে সরাসরি তাকালো। বলল, ‘সোবহান সাহেবের ছেলেকে দেখেছেন?’
- না তো! উনার তো এক মেয়ে!
সলিমউল্লাহ মুচকি হাসলো, বলল, ‘উনার বড়ো একটা ছেলেও আছে। পলাতক। ওর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য-সংগ্রহ করতে এসেছি। ভালো কথা, আপনারা কতদিন ধরে এই বাসায় আছেন?’
- সাত-আট মাসের মতো।
- এই সময়ের মধ্যে একবারও সোবহান সাহেবের ছেলেকে দেখেননি?
- না, দেখবো কী! আমরা তো জানি না যে উনার ছেলে আছে।
- হুম। উনাদের বাসায় আর কে কে থাকে?
- উনারা তো তিনজনই থাকেন। সোবহান সাহেব, উনার স্ত্রী আর মেয়ে ঊর্মি।
- সন্দেহজনক কাউকে আসা-যাওয়া করতে দেখেছেন?
তাহেরা খাতুন হাজবেন্ডের দিকে তাকালো তারপর না-সূচক মাথা নাড়ালো।
- ঠিক আছে। ধরে নিচ্ছি, আপনারা কিছু জানেন না। যাই হোক, এবার অন্তত আমাদের জন্য একটু খাবারের ব্যবস্থা করেন। আপত্তি আছে?
- না না, কোনো আপত্তি নেই। আপনি তো শুরুতে বললেই পারতেন।
- হ্যাঁ, তা হয়তো বলা যেত। সারাদিন একঘেয়েমি ডিউটি করি তো, মাঝে মধ্যে একটু নাটকীয়তা ভালো লাগে আর কী। হা হা হা।
তাহেরা খাতুন রান্নাঘরের দিকে রওয়ানা দিলেন।
- রেজা সাহেব, বসেন। আচ্ছা, উনাদের বাসায় ভাড়ার টাকা দিতে যান? নাকি উনি এসে কালেক্ট করেন?
রেজা সাহেব মাথা চুলকালেন। বললেন, একই ফ্লোরে বাসা তো। যেতে হয় না। দরজায় দাঁড়িয়ে কলিংবেল দিলেই হয়।
- আপনাদের কী ধারণা? এই বিষয়টা উনারা গোপন করলেন কেন?
- জানি না। আমি তো আজই প্রথম শুনলাম। কী করেছিল? খুন?
- বেশ কয়েকটা মামলা আছে। বুয়েটে পড়তো, সিভিলে। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। তখনই বেশ কয়েকটা কেস হয়। এর মধ্যে মার্ডার কেসও আছে। বেশিরভাগ কেসই ভুয়া। পরবর্তীতে গ্রæপিং এর পাল্লায় পড়ে হল ছাড়তে হয়। লেখাপড়াও শেষ করতে পারেনি। এখন পলাতক। আবার হয়তো কোনো একদিন ক্ষমতায় এলে সবকিছু মিটমাট করে ফেলবে। ততদিন পর্যন্ত আমরা ধরার চেষ্টায় আছি।
- আপনারা যে সত্যিই পুলিশ এর প্রমাণ কী?
সলিমউল্লাহ ও রেজা সাহেব প্রশ্নকারীর দিকে তাকালো। যৌক্তিক একটা প্রশ্ন নিয়ে তাহেরা খাতুন রান্নাঘর থেকে ফিরে এসেছে। সলিমউল্লাহ মোটেও ঘাবড়ালো না। সহজভাবেই বলল, সাদা পোশাকে যখন থাকি তখন এই প্রশ্নটা বারবার শুনি। আলফাজ, ম্যাডামকে একটা কার্ড দাও।
আলফাজ ব্যাগ থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে দিলো। কোনো এক ডিবি পুলিশের কাছ থেকে সংগ্রহ করা। কার্ডটা হাতে নিয়ে তাহেরা খাতুন বিড়বিড় করে পড়ল, প্রকাশ রঞ্জন দাস, পরিদর্শক-তদন্ত।
- আপনি হিন্দু? প্রকাশ রঞ্জন দাস?
সলিমউল্লাহ মনে মনে একটা কষে গালি দিলো আলফাজকে। ব্যাটা ভুল কার্ড ধরিয়ে দিয়েছে। মুখমÐলে গালির ছাপ পড়তে দিলো না। বলল, কেন হিন্দু হলে সমস্যা?
- না না না। আপনাকে দেখে হিন্দু মনে হয়নি।
- চেহারা দেখেই কি সবকিছু বোঝা যায় ম্যাডাম? আমাদের দেখে তো আপনি ডাকাত মনে করেছিলেন! যান, চুলায় ভাতটা চাপিয়ে দিন। নিচে মেইনগেটে আমার আরেকজন কন্সটেবল আছে আর এরা দুইজনসহ মোট তিনজনের জন্য সেহরির ব্যবস্থা করেন। আমি খাবো না। আর হ্যাঁ, ভাতটা তাড়াতাড়ি চুলায় দিয়ে আসুন। সোবহান সাহেবের ফ্ল্যাটে ঢুকবো, আপনার হেল্প লাগবে।
প্রায় পনের মিনিট পর তাহেরা খাতুন সোবহান সাহেবের বাসার কলিংবেল চাপলো। ঊর্মি দরজা খুলে তাহেরা খাতুনের পেছনে সলিমউল্লাহকে দেখে একটু চোখ কুঁচকে তাকালে সলিমউল্লাহ কিছু একটা ইশারা দিলো। তাহেরা খাতুন বলল, ‘আংকেল-আন্টি কোথায়? বাসায় নেই?’
- আছে। বাবা ঘুমোচ্ছেন। আর মা উঠেছেন।
- একটু ডাকো। বলো, ডিবি থেকে লোক এসেছে, কথা বলবে।
- ঠিক আছে। বলছি।
ঊর্মি এক পা পিছিয়ে এসে সলিমউল্লাহকে বলল, আপনি ভেতরে আসেন।
সলিমউল্লাহ ভেতরে ঢুকে ড্রইংরুমের সোফায় গিলে বসল। তাহেরা বেগম নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকতেই ঊর্মি দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে বলল, ভাইয়া! তুমি এত নাটক করতে পারো!
সলিমউল্লাহ দাঁত বের করে হাসলো। বলল, ‘কেমন আছিস রে পিচ্চি?’
- খুব ভালো আছি। মা, দেখে যাও কে এসেছে!
রাহেলা বেগম ছেলেকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আমার মন বলছিল তুই দুই-একদিনের মধ্যেই আসবি। শুকায় গেছিস, খাওয়া দাওয়া কিছু করিস না? নাকি?
- আমি মোটেও শুকাইনি মা। তুমি শুধু শুধু এসব বোলো না তো, বেশি বেশি খেয়ে মোটা হয়ে যাব। তখন পুলিশ দৌড়ানি দিলে আর রক্ষা নাই।
- তোর যত অলক্ষণে কথা।
- বাবা কেমন আছে?
- শরীর খুব একটা ভালো না। ডায়বেটিকস বেড়ে গেছে। করোনার কারণে নিয়মিত বাইরে হাঁটতে যেতে পারে না। ডাক্তারও পাওয়া যায় না। চেকআপ করানোও কঠিন হয়ে গেছে।
- হুম, আর কিছুদিন যাক। ইন্ডিয়া নিয়ে একটা ফুল চেকআপ করায় আনবো। বর্ডারটা খুলুক।
- সে দেখা যাবে।
- কী রান্না করেছো মা?
ঊর্মি পাশ থেকে বলল, তোমার জন্য বড়ো একটা ইলিশ মাছের মাথা রাখা আছে ফ্রিজে। মা, তুমি ভাইয়ার পাশে বসো, আমি খাবার গরম করছি।
মুচকি হাসলো সলিমউল্লাহ।
বেসিনে গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে বসল সে। ঊর্মি খাবার গরম করে প্লেটে বেড়ে দিলো কিন্তু সলিমউল্লাহর খাওয়া হলো না। পাশের ফ্ল্যাট থেকে একটা ভোঁতা আওয়াজ ওর কানে এলো। গুলির শব্দ। সাইলেন্সার লাগানো থাকলেও কেমন যেন ভোঁতা একটা আওয়াজ হলো যেটার সাথে সলিমউল্লাহ পরিচিত। ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে দরজার দিকে পা বাড়ালো। দরজা খুলতেই দেখলো ছোটকু ধুপধাপ শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামছে। ওকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। বলল, ‘ওস্তাদ মাফ কইরা দিয়েন।’
ছোটকু একটা অঘটন ঘটিয়েছে! রেজা সাহেবের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। আলফাজের গায়ে হেলান দিয়ে তাহেরা খাতুন মেঝেতে বসে পড়েছেন। উনার ডান হাঁটুর সামান্য উপরে সৃষ্ট ক্ষত থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে। রেজা সাহেব দুই হাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। সলিমউল্লাহ পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকলো। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আলফাজের দিকে ভ্রæ কুঁচকে তাকালো। সে ভয়ার্ত স্বরে বলল, উনি মোবাইলে কারে যেন ঘটনা জানাইতাছিল, তখন ছোটকু দেইখা ফালাইছে। ছোটকুরে অনেক কিছু কইছি, কিন্তু থামাইবার পারি নাই-
সলিমউল্লাহ চারপাশে নজর বোলালো। কাছে পিঠেই একটা ওড়না পেল। সেটা দিয়ে তাহেরা খাতুনের ক্ষতস্থানটা বেঁধে দিলো। রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়াটা জরুরি। তারপর দ্রুততার সাথে পিপিইটা পড়ে ফেলল। সোফার ওপর রাখা স্কুল ব্যাগটা তুলে নিয়ে আলফাজকে ইশারা করল বের হয়ে যাবার জন্য। রেজা সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা একটু সচেতন হলে দুর্ঘটনা ঘটতো না। আমরা হাসপাতালে খবর দিয়ে দিচ্ছি। এম্বুলেন্স চলে আসবে একটু পরেই। ভয় পাবেন না, খুব কাছে থেকে ফায়ার হবার কারণে ক্ষতটা একটু গভীর হয়েছে।
দুজনে বের হয়ে সিঁড়ি ধরতেই আলফাজ বলল, ‘ওস্তাদ লিফট খুলা। উপরে উঠতাছে।’
- লিফট?
তিন তলায় এসে দরজা খুলে গেল। নিচ তলায় রেখে আসা যুবকটি ছোটকুর শার্টের কলার ধরে আছে।
ওরা লিফটে ঢুকে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বাটনে চাপ দিলো। নিচের দিকে নামা শুরু করতেই আচমকা লিফট বন্ধ হয়ে গেল।
মাঝরাতে লোডশেডিং!
উল্লা বাহিনীর সদস্যরা জানে না যে বাসার জেনারেটরটা কয়েকদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। লকডাউনের কারণে কোনো মেকানিক পাওয়া যাচ্ছে না।
ছবি: গুগল মামা।
১৯ শে মে, ২০২২ দুপুর ১:৪০
ফয়সাল রকি বলেছেন: যা বলছেন ততটা নয়।
তবে পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
২| ১৯ শে মে, ২০২২ রাত ৯:৩১
খাঁজা বাবা বলেছেন: অনেক বিস্তারিত।
২২ শে মে, ২০২২ বিকাল ৪:৩২
ফয়সাল রকি বলেছেন: ধন্যবাদ খাঁজা বাবা।
৩| ২৮ শে মে, ২০২২ রাত ১১:৪০
ঢুকিচেপা বলেছেন: গল্পটি আমার কাছে ভালো লেগেছে।
মাঝখানে সেহরী খেতে চাওয়ার অংশটুকু হুমায়ূন টাইপ লেগেছে তাছাড়া খুব সুন্দর।
যে জায়গায় শেষ করেছেন তাতে আমি লিফটের মধ্যে আটকে আছি, পরের পর্ব লিখে উদ্ধার করুন।
আশায় রইলাম।
৩০ শে মে, ২০২২ বিকাল ৪:০৩
ফয়সাল রকি বলেছেন: ধন্যবাদ ঢুকিচেপা। যদিও আমি রেগুলার না, তারপরও মনে হলো অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম!
হুমায়ুন টাইপ বলতে বোধহয় খানিকটা নেগেটিভ বুঝালেন, আমি কিন্তু উনার লেখার খুব ভক্ত।
লিফটের মধ্যে আটকা পড়া থেকে উদ্ধার করতে চাই না। থাকুক আজীবন।
©somewhere in net ltd.
১| ১৮ ই মে, ২০২২ রাত ৮:৪৮
রাজীব নুর বলেছেন: এটা শুধু গল্প নয় টেলিফ্লিম।