নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুঃখের কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। ভালোবাসা হলো দুঃখ, এক ঘরে কবিতা ও নারী।
বাসায় ফিরতেই পুতুল ঝাঁপ দিয়ে কোলে এলো এবং গলা ধরে বললো, আব্বু, আজ চকবার খাব। আমি বললাম, ঠিক আছে।
সে আমার গলা ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললো, না, আমি চকবার খাব।
এটা পুতুলের একটা কথা বলার ধরন। ওর কোনো একটা আবদারে রাজি হলেও সে বার বার ঐ একই কথা বলতে থাকবে। আমরা এখন বুঝতে পেরেছি, ওর আবদারে রাজি হওয়ার পরও ও নিশ্চিত হতে পারে না যে ওর আবদার মেটানো হবে, তাই বার বার একই কথা বলে ওর দাবির পক্ষে শক্তি বাড়াতে থাকে। অথচ আবদার মেটানো হয় নি এমন কোনো নজির নেই।
পুতুল বললো, আমি চকবার খাব।
আমি বললাম, আমি কি মানা করেছি?
পুতুল আমার চুল টেনে ধরে বললো, না না, আমি চকবার খাব।
আমি ঠাট্টা করে বললাম, না, চকবার কিনে দেব না।
সে এবার দুহাতে আমার চুল টানতে টানতে চিৎকার করে একই বুলি বলতে লাগলো, না, না, আমি চকবার খাব …।
পুতুলের মা এক ধমক দিতেই সে চুপসে গেল।
ওকে কোল থেকে নামিয়ে জামা বদল করতে থাকলাম। জুতা ছাড়তে লাগলাম চেয়ারে বসে। সে মুখটা ভীষণ ম্লান করে আমার শরীর ঘেঁষে গলা ধরে দাঁড়ালো। আমি পুতুলের মুখের দিকে গম্ভীর ভাবে তাকালাম, হেসে দিয়ে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, চিন্তা করো না, বিকেলে চকবার এনে দেব।
গোসল সেরে এই মাত্র বাথরুম থেকে বের হয়ে এলো টুটুল। সে আধভেজা শরীরে ভেজা তোয়ালে জড়িয়ে সামনে আসতেই পুতুল দৌড়ে তার কাছে গিয়ে বললো, আব্বু আজ চকবার কিনে দেবে।
টুটুল সামনে এসে নাকি সুরে কান্না জুড়ে দিয়ে বলতে লাগলো, আব্বু, আমাকেও চকবার দিতে হবে।
এ হলো আরেক জ্বালা, সবকিছু কেনা হয় জোড়ায় জোড়ায়, একটা পুতুলের জন্য আরেকটা টুটুলের জন্য। এমন কখনোই হয় নি যে কোনো একটি জিনিস পুতুলের জন্য কেনা হয়েছে, অথচ টুটুলের জন্য হয় নি।
আমি টুটুলকে বললাম, হ্যাঁ দেব।
আমাকে কয়টা দেবে?
একটা।
পুতুল এ কথা শুনে তেড়ে এলো, টুটুলকে একটা দিলে আমাকে দুটি দিতে হবে।
এটাও আরেক জ্বালা। টুটুলকে কোনো কিছু দেয়াটা পুতুল সহ্য করতে পারে না। এখন অবশ্য সে আগের চেয়ে অনেক নমনীয় হয়েছে। পুতুল যখন চিপস্, চকোলেট, চুইংগাম ইত্যাদি মুখরোচক খাবারগুলো প্রথম প্রথম খাইতে শিখলো, তখন থেকেই বাসায় ওদের জন্য কিনে আনা এসব খাবার পুতুল একা খেতে চাইত, টুটুলকে সে কোনো ভাগই দিতে চাইত না। আমি এক-আধটু চালাকি করতাম বইকি। যেমন, গোটা দশেক চকোলেট নিয়ে এলাম। পকেটের এক কোনায় চার পাঁচটা রেখে দিতাম, বাকিগুলো জামার ভেতরে কৌশলে লুকিয়ে রাখতাম। ঘরে এসে ঢুকতেই প্রথমে দৌড়ে এসে টুটুল পকেটে হাত ঢুকাত। চকোলেট বের করে আনতেই পুতুল সামনে এসে হাজির এবং এক থাবায় টুটুলের হাত থেকে ওগুলো ছিনিয়ে নিয়ে আমার কোলে ঝাঁপ দিত।
আমি টুটুলকে বোঝাতাম, তুমি তো আব্বু বড়ো, তাই না? পুতুল হলো ছোটো আর দুষ্টু। তোমাকে কয়েকদিন পর আবার এনে দেব, কেমন? টুটুল কাঁদো কাঁদো হয়ে দুচোখ ডলতো। একসময় পকেটের বাকি চকোলেটগুলো লুকিয়ে টুটুলের হাতে গুঁজে দিতাম। কিন্তু মুহূর্তেই সে রাষ্ট্র করে পুতুলকে জানিয়ে দিত যে, তারও ভাগে সমান সংখ্যক চকোলেট দেয়া হয়েছে। তখন যে লংকাকাণ্ড বাঁধতো তা কেবল থামতো ওদের মায়ের হস্তক্ষেপে। ওদের মায়ের একটুখানি চোখ রাঙানোই যথেষ্ট, সব ঠান্ডা।
ওরা দুজনেই এখন আগের চেয়ে বুদ্ধিমান হয়েছে, অবশ্য ছোটো বয়সের বুদ্ধিমান যাকে বলে, তাই। টুটুলের বয়স আট, পুতুলের বয়স ছয় বছর। দুজনে মুহূর্তে লংকাকাণ্ড বাঁধায়, আবার দেখি সারাদিন ঘরের কোনা-কাঞ্চিতে, ড্রইংরুমে, বারান্দায় নিগূঢ় মনে দুজনে একত্রে খেলা করে যাচ্ছে। ওদের ধেলাধুলার সরঞ্জামাদির টুনটুনানি শব্দের চেয়ে গুনগুন স্বরে অনর্গল কথা বলাই আমি বেশি শুনতে পাই।
আমি শুয়ে ছিলাম, খাওয়া দাওয়ার পর বিশ্রাম নিচ্ছি। পাশে সাজেদা (ওদের মা) ঘুমোচ্ছে। পুতুল ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বললো, আব্বু … চকবার।
আমি বললাম, বিকেলে।
ও বললো, না এখন।
এ সময় হঠাৎ কে যেন ঘরে উঁকি দিল, তাকিয়ে দেখি অরিন।
আমি সুর করে টেনে টেনে ডাকি, হ-রি-ন।
অরিন আহ্লাদী ও কপট রাগত সুরে টেনে টেনে বলে, হরিন বলেন কেন? আমি হরিন না, বলেন অরিন।
ও … তোমার নাম নরিন?
নরিন না, অরিন … অরিন।
তাই বলো, এতক্ষণ ভুল শুনেছি, এসো মা জেরিন। এসো।
অরিন একদৌড়ে কাছে এসে আমার বুকে খামচি কেটে বলে, বলেন অরিন, স্বর-এ-অ, র-ই-কার রি, দন্ত্য-ন, অরিন।
আমি ওর গলা ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে বলি, জ-এ-কার জে, র-ই-কার রি, দন্ত্য-ন, জেরিন।
অরিন আমাকে জোরে এক ঘুসি দিয়ে বলে, আমি আপনার সাথে কথাই বলবো না। তারপর পুতুলকে টেনে নিয়ে সে ড্রইং রুমে ছুটে যায়।
অল্পক্ষণ পরই পুতুল আবার ঘরে ঢোকে। তারপর আমার কানে কানে বলে, আব্বু, চকবার।
এখন তো অনেক রোদ। আমি বিকেলে তোমাদের নিয়ে দোকানে যাব, তখন হবে, কেমন?
এক লাফে টুটুল ঘরে ঢোকে। বলে, আমাকে টাকা দাও, আমি নিয়ে আসি।
পাশের বিল্ডিংয়ের নীচতলায় একটা দোকান আছে, ফাস্ট ফুডের দোকান। ও-দোকান থেকে চকোলেট, চিপস্, চুইংগাম, চকবার কিনে খাওয়ার সামান্য অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যে টুটুলের হয়েছে।
টুটুলের পেছনে পুতুল, পুতুলের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অরিন। টুটুল আর পুতুল দুজনেই ঘন ঘন আর্জি জানাচ্ছে, যেন টাকা দিয়ে দিই, ওরা একদৌড়ে নীচে গিয়ে চকবার কিনে আনবে।
আমি বলি, এখনো বাইরে অনেক রোদ, আরো পরে যেও।
পুতুল এক লাফে আমার বুকের ওপর চড়ে বসে গলা টিপে ধরলো, আমার শরীর ঝাঁকি দিয়ে বলতে লাগলো, টাকা দাও, টাকা দাও, টাকা দাও …।
ওদের চাপাচাপিতে আমি নমনীয় হই, জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে রোদের তীব্রতা অনুমান করি। কিছুটা কমে আসছে বইকি। এমন সময়ে সাজেদা বললো, বাজারে যাও। মাছ তরকারি সব ফুরিয়ে গেছে।
আমি বললাম, সন্ধ্যার পরে গেলে হয় না?
সাজেদা বলে, রাতে আনাজপাতি কোটাকুটি করতে বিরক্ত লাগে। সকাল সকাল এগুলো নিয়ে এসো।
আমি অলসভাবে শরীরে আড়মোড়া দিয়ে বলি, ব্যাগটা তাহলে দাও দেখি।
মুহূর্তে টুটুল আর পুতুল লাফিয়ে উঠলো, ওরাও যাবে। তবে বাজারে নয়, ওরা আমার সাথে নীচে যাবে। পাশের বিল্ডিংয়ের নীচতলায় যে ফাস্ট ফুডের দোকানটা আছে, সেখান থেকে ওদের চকবার কিনে দিতে হবে। লাফাতে লাফাতে ওরা ভালো পোশাক পরতে গেল আর তখনই বাচ্চাদের উদ্দেশে সাজেদা চোখ রাঙিয়ে উঠলো, এই খবরদার! এখন কেউ নীচে যাবে না।
আমি বলি, যাক না। চকবার কিনে দিই, ওরা খেতে খেতে বাসায় ফেরত আসবে।
না। সাজেদা তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, এত দাম দিয়ে চকবার খাওয়ার দরকার নেই। এই না গত সপ্তাহে একবার কোন-আইসক্রিম কিনে দিলে? আইসক্রিম কি এত ঘন ঘন খায়? এতে কোনো গুণ আছে? বরং দাঁত নষ্ট হয়ে যায়।
পুতুল বলে ওঠে, আমার তো এখনো দাঁতই পড়ে নি। এই দাঁত দিয়ে যত খাওয়া যায় খেয়ে নিই …
চুপ বেয়াদব মেয়ে। সাজেদা শাসিয়ে ওঠে।
আমি বললাম, আজ যেহেতু ওরা এত করে বলছে, আজকে না হয় খেতে দাও। কী বলো?
সাজেদা কঠিন চোখে তাকিয়ে বলে, তুমিই যত নষ্টের গোড়া। ছেলেমেয়ে দুটোকে মাথায় তুলছো। আদর দিয়ে দিয়ে ওদের মাথাটাকে খাচ্ছ তুমি। বলে সে ব্যাগ জোগাড় করতে চলে গেল।
আমি প্রস্তুত। টুটুল আর পুতুল প্রস্তুত। ওদের সাথে অরিনও খুশিতে ডগমগ। নীচে গিয়ে চকবার কিনে দেব, ওরা খুশিতে নেচে নেচে খাবে।
দরজা খুলতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে সাজেদা বলে, এক কাজ করো। শুধু টুটুলকে নিয়ে যাও। চকবার কিনে ওর হাতে পাঠিয়ে দাও। বাসায় এনে খাবে।
যদিও তৎক্ষণাৎ ওরা দমে গেল, কিন্তু চকবার তো নির্ঘাত কেনা হবে, অতএব পরক্ষণেই খুশিতে ওরা ঝলমল করতে লাগলো।
লাফাতে লাফাতে সিঁড়ির রেলিংয়ে পিচ্ছিল খেতে খেতে দ্রুত গতিতে টুটুল নীচে নেমে যায়, আবার ওপরে উঠে আমাকে হাত ধরে টেনে জলদি নামতে বলে। রাস্তায় নামার পর সে আমার আগে আগে দৌড়ে দোকানে চলে গেল। আমি যখন সেখানে পৌঁছলাম, ততক্ষণে টুটুলের হাতে চকবার চলে এসেছে। সে উচ্ছ্বাসে অস্থির। দোকানদারকে বলে, আংকেল, আমার আব্বুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে নেন। বলেই সে চকবার হাতে বাসার উদ্দেশ্যে দৌড়।
পাঁচটা চকবার কিনেছে টুটুল। আমি কিনলে অবশ্য চারটা কিনতাম। টুটুল, পুতুল, অরিন, সাজেদা - প্রত্যেকের জন্য একটা করে। আমি যেহেতু বাজারে যাচ্ছি, চকবার খাওয়ার সময় আমি উপস্থিত থাকছি না, সুতরাং আমার জন্য চকবারের দরকার নেই। আমি আবার এসবে ততটা আসক্তও নই।
বাজারে যেতে যেতে সাজেদাকে ক্ষেপানোর জন্য মাথায় একটা দুষ্টুবুদ্ধি চাপলো। রাত্রে মাছ কোটা ওর একেবারে অসহ্য। আনাজ কোটাও বিরক্তিকর। ভাবলাম, আজ এমন ধরনের মাছ কিনবো যা কুটতে গেলে খুব কষ্ট হয়, আবার না কুটেও খাওয়া যায় না, যেমন বাতাসী মাছ। মাছটা একটু পঁচা জাতীয় হলে ‘বিস্ফোরণটা’ দেখার মতো হবে। বাজার করে আমি ঠিক ঠিক রাত করে বাসায় ফিরবো।
কিন্তু তার আগে এতক্ষণ আমি বাজারে কী করবো? বাজারে না যায় ঘোড়ার ঘাস কাটা, না যায় গরু চরানো, (দুটোরই সামান্য অভ্যাস আছে ধরে নিতে পারেন)। চট করে মাথায় বুদ্ধি খুলে গেল। এই হাই ইনফরমেশন টেকনোলজির যুগে ঘাটেপথে সাইবার ক্যাফে গজিয়ে উঠেছে। সময় কাটানো কোনো ব্যাপারই না।
ইন্টারনেট ব্রাউজিং শুরু করলাম। বিষয়টা খুবই উদ্ভট - মাছ। সবচাইতে বড়ো জাতের মাছ। সবচাইতে ছোটো জাতের মাছ। তিমি কিংবা হাঙ্গর ও শীল মাছ অবশ্য এর মধ্যে বিবেচনায় ধরবো না।
মাছ সম্বন্ধে বহু তথ্য জোগাড় করলাম। তারপর মাছের বাজারে গেলাম। বাতাসী মাছের বদলে বেলে মাছ পেলাম, গুঁড়া হলে চচ্চড়ি চলতো, কিন্তু বেলের সাইজ একটু বড়ো, কুটতে হবে। আল্লাহ আমার মনোবাঞ্ছনা পূরণ করেছেন, মাছটা একটু পঁচা ধরনেরও। মাছ কুটতে কুটতে সাজেদা রেগে আগুন হবে, আমি তখন মৎসবিষয়ক তথ্য প্রচার করতে থাকবো। এটা অবশ্য আগুনে কেরোসিন ঢালার মতো হবে … অ্যাাডিং ফিউয়েল টু ফায়ার।
সাজেদাকে বাজার সওদা হস্তান্তর করার পর আমি অবাক হয়ে গেলাম। পঁচন ধরা বেলে মাছ নেড়েচেড়ে সে বললো, মাছটা একটু পঁচে গেছে, কিন্তু মোটেও রাগ কিংবা বিরক্তি প্রকাশ করলো না। কী ভাবলাম আর কী হতে যাচ্ছে! সংসারে মাঝেমধ্যে এক-আধটু ঝগড়াফ্যাসাদ না হলে প্রেম-ভালোবাসা গাঢ় হয় না। ধূর!
মাছ কুটতে কুটতে খানিকটা রাত হয়ে গেল। পুতুলকে ভাত খাইয়ে শুইয়ে দেয়া হয়েছে, সে ঘুমোচ্ছে। তাকে ভোর ছয়টায় উঠে স্কুলে যেতে হবে। টুটুল শুয়ে শুয়ে একধ্যানে টিভিতে কার্টুন দেখছে। আমাকে দেখেই সে শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। তারপর আমার গলা ধরে বললো, আব্বু, পুতুল চকবার খায় নি।
খায় নি? কেন?
বলবো না।
টুটুল আর পুতুলকে নিয়ে এ এক ভীষণ সমস্যা। এরা মাঝে মাঝে একেকটা রহস্যের জাল সৃষ্টি করে, হঠাৎ এক জায়গায় এসে প্রশ্ন করলে বলে বসে, বলবো না। যদি একবার কোনোমতে ‘বলবো না’ কথাটি বলে বসে, তবে সাধ্য কি কারো আছে যে ওদের মুখ দিয়ে কেউ সেটা বলাতে পারে? দু-ভাইবোনের মধ্যে আবার দারুণ ভাব, একে অপরের মনের খবর রাখে, দুজনে জুটি বেধে কাজ করে। আমি দেখেছি, পুতুল যদি বলে, ‘বলবো না’, সেটা টুটুলও বলবে ‘বলবো না’। এরা দুজনেই কিন্তু পুরো জিনিসটা জানে, আবার দুজনেই একত্রে তা গোপন করে রাখে। কিন্তু যেই মাত্র একজনে সেটা প্রকাশ করে দিল অমনি দেখা যায় অপরজনও সেটা গড়গড়িয়ে বলে দিচ্ছে ।
পুতুল কেন চকবার খায় নি, বলো তো?
ব-ল-বো না। টুটুল টেনে টেনে সুর করে বলে।
আমি দেখি, এ অরণ্য রোদন। না বলে না বলুক। স্বভাবমতো একবার নিজে এসেই সব হড়হড় করে বলে দেবে। দাম বাড়িয়ে লাভ নেই।
আমি টুটুলকে বললাম, আমি জানি পুতুল কেন খায় নি। তবে এটা আমাকে বলার দরকার নেই। তুমিও এটা কাউকে বলো না। খুব লজ্জার কথা তো।
টুটুল খিল খিল করে হেসে উঠে বলে, মিথ্যা কথা। তুমি জানো না।
আমি জানি। তুমি না বললেও আমি জানি। কারণ, আমার বুদ্ধি তো আর তোমার চেয়ে কম না!
তোমার কোনো বুদ্ধিই নাই। তুমি বোকা, পঁচা।
ছিঃ আব্বু। আব্বুকে কেউ এ কথা বলে?
হ্যাঃ, বলে।
না বাবা, আর কোনোদিন বলো না।
বলবো।
ঠিক আছে বলো। এখনই বলো।
না, বলবো না।
আমি হেসে দিলাম। টুটুলও হাসলো আমার হাসি দেখে।
খাওয়ার টেবিলে কথাটি মনে পড়লো। সাজেদাকে জিজ্ঞাসা করি, পুতুল চকবার খায় নি কেন?
কী জানি, পুতুল জানে আর ওর কপাল জানে।
হঠাৎ টুটুল বলে, আব্বু, চকবার খাব।
চকবার খাবে তো পাবে কই?
ফ্রিজে আছে।
ফ্রিজে যেটা আছে ওটা পুতুলের চকবার। আর আছে আমারটা (আমি মনস্থির করি ওকে আমারটা দেব, যদি জোর করে। অন্যথায় আমারটাও পুতুলের জন্য রেখে দেব)।
কিন্তু টুটুল ফ্রিজ খুলে সবগুলো চকবার বের করে এনে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দেয়। বলে, দেখো কত্তগুলি চকবার!
আমি এতগুলো চকবার দেখে বলি, তোমরা খাও নি?
সাজেদা বলে, নরম হয়ে গিয়েছিল বলে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলাম। পরে টুটুল একটা বের করে খেয়েছে। আমি একটু মনক্ষুন্ন হয়ে বলি, চকবারের জন্য মেয়েটা এত আন্নাতান্না করলো, ওর জন্যই চকবার আনা হলো, আর ওকে না খাইয়ে শুইয়ে রেখেছ?
ও না খেলে আমি কী করবো? আমি কত সাধলাম না?
খেল না কেন?
টুটুল বলে বসলো, আমি জানি।
বলো তো কেন খায় নি?
বলবো না। টুটুল এ কথা বলে গম্ভীর হয়ে যায়। ইতোমধ্যে সে একটা চকবার খুলে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা তিনটা চকবার টুটুল ভাগ করে দিতে লাগলো - একটা ওর মা’র দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, এটা আম্মুর, একটা আমার দিকে ঠেলে বলে, এটা আব্বুর। তৃতীয়টা সে হাতে নিয়ে ফ্রিজে রাখতে যায় আর বলে, এটা পুতুলের।
আমি টুটুলকে ভর্ৎসনা করি, তোমার ভাগে তো পড়লো দুটো, পুতুলের জন্য একটা কেন?
হঠাৎ আমার একটা কথা মনে পড়ে যায়। সাজদাকে বলি, অরিন চকবার খায় নি?
সাজেদা বলে, বললাম না গলে যাচ্ছিল বলে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলাম। পরে তো অরিন চলেই গেল।
সাজেদার ওপর বাস্তবিক আমার প্রচণ্ড ক্ষোভ জন্মালো। আমি নিশ্চিত চকবার গলে যাওয়াটা সাজেদার একটা অজুহাত মাত্র। আসলে সে অন্য বাসার একটা মেয়েকে দামি একটা চকবার খাওয়াতে পছন্দ করে নি।
কিন্তু আমার মনের রাগটাকে কীভাবে প্রকাশ করি? আমার শরীরের ভেতর চাপা রাগটা ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে থাকলো, ভেতরে লাভার উদ্গীরন হচ্ছে, মুখ না পেয়ে কেবলই তা তোলপাড় করে যাচ্ছে।
রতে শুয়ে সম্পূর্ণ নিজে থেকে টুটুল আমাকে রসহ্যটা ফাঁস করে দিল। আসলে ঘটনাটা হলো- গতকাল পুতুল এবং টুটুলকে অরিন চকবার খাইয়েছিল। বিনিময়ে পুতুল কথা দিয়েছিল সে আজ অরিনকে খাওয়াবে। সে উদ্দেশ্যেই সে অরিনকে অনেক ঘটা করে দাওয়াত করে এনেছিল এবং চকবার খাওয়ার জন্য ওরা এতখানি উতলা হয়ে উঠেছিল। বাসায় চকবার আনার সঙ্গে সঙ্গে ও-গুলোকে ফ্রিজে চালান দিয়ে দেয়া হয়। চকবার বের করে দেয়ার জন্য ওরা মায়ের কাছে অনেক আকুতি মিনতি করেছিল। তার মা ‘বাড়তি’ মেয়ের জন্য চকবার বের করে নি। আমার ধারণা, সংকোচের কারণেই পুতুল তার মাকে বলতে পারে নি যে সে অরিনকে চকবার খাওয়াবার জন্য দাওয়াত করে এনেছিল।
আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি আমার অন্তর্চোখে দেখতে পেলাম অরিন মেয়েটি চকবার খেতে না পেয়ে আশাহত হয়ে অত্যন্ত ম্লান মুখে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেছে। পুতুল তার সাথিকে চকবার খাওয়াতে না পারার বেদনায় ও লজ্জায় ঘরের ভেতরে শুয়ে মুখ লুকিয়ে ছিল। আমার বুকটা হুহু করে উঠলো, আমার পুতুল, আমার টুটুল, ওরা যদি কারো বাসা থেকে এরূপ আশাহত হয়ে ফিরে আসে, তা জানতে পারলে আমার বুকের পাঁজর কি ভেঙে খান খান হয়ে যাবে না?
আমি টুটুলের দিকে ফিরে ওর গলা ধরে শুয়েছিলাম, আমার পাশে সাজেদা, তার পরে পুতুল।
সাজেদা আমাকে বাহু ধরে আস্তে টান দিল। নিথর দেহে আমি চিৎ হয়ে শুইলাম। সাজেদার হাত আমার বুকের ওপর বিচরণ করতে থাকে। আমার গলা থেকে ভারী স্বগতোক্তি বেরুতে থাকে, - সাজেদা, বিশ বছর বয়সে আমি প্রথম কোক খেয়েছিলাম। চকবার খেয়েছি তারও অনেক পরে। আমার বাবা গরীব ছিল। আমিও গরীব। তবে বাবার তুলনায় আমি কিছুটা ধনী। আমাদের ছেলেমেয়েরা ধনী-গরীবের সংজ্ঞা বোঝে না। ওরা বোঝে যেটা ভালো সেটা ওদের চাই-ই চাই। সব তো আর দিতে পারি না। মাঝেমধ্যে চকবার, কোক, আইসক্রিম কিনে দিই, যাতে ওদের মনে কখনো এই ধারণা না জন্মায় যে ওরা ওদের পছন্দের জিনিসটা চায়, আর আমরা খরচ বাঁচানোর জন্য তা দিই না। ওরা যাতে বুঝতে না পারে গরীবের ঘরে ওদের জন্ম হয়েছে। ছোটোবেলায় আমাদের গাছের সবচাইতে ভালো আম আর বরই আমি জসিম আর নুরুকে খাওয়াতাম। নতুন খেজুরের গুঁড় ওদের না খাওয়ানো পর্যন্ত আমার মনে শান্তি আসতো না। তদ্রূপ জসিমদের বাড়ির বেলগাছের অর্ধেকটা যেত আমার পেটে, বাকিটা ওর। নুরুদের বাড়িতে যেই জাম্বুরা গাছটা ছিল তার একটা জাম্বুরাও আমাদের তিনজন ছাড়া অন্য কারো পেটে যেত না। ছোটোবেলার সঙ্গীদের খাওয়ানোর মজাটা যে কত মধুর তা আমরা ভুলে গেছি। আমার মনে হয় কী জানো, মনে হয় আমরা অতীতে যেমন গরীব ছিলাম এখনো আমাদের মনটা তেমনি গরীবই রয়ে গেছে। আসলে আমরা ছোটোলোকই রয়ে গেছি- সাজেদা আমার মুখ চেপে ধরলো। আমি ওর আবেগ ধরতে পেরে আর কথা বলি না।
পরদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে অবাক হয়ে যাই- এ দেখি চকবার পার্টি! এত চকবার! টুটুল, পুতুল এবং তাদের স্পেশাল গেস্ট অরিন। একেক জনের হাতে দুটো করে চকবার। ঠোঁটেমুখে সবখানে ক্রিম লেগে আছে। চকবার গলে গিয়ে হাত বেয়ে পড়ে যাচ্ছে। পাগলগুলো একটা চকবার ফ্রিজে রেখে দিয়ে বাকিটা খেতে পারতো, ওদের পাশেই তো ফ্রিজ।
পুতুল উচ্ছ্বসিত স্বরে বললো, সবার ভাগে দুটা করে।
তাই? আমার দুটা কই?
টুটুল এক হাতে ওর দুটি চকবার ধরে রেখে ফ্রিজের দরজা খোলে। তারপর ভেতর থেকে চারটা চকবার বের করে এনে টেবিলের ওপর রাখে। সে আমাকে দেয় দুটি, আর ওদের আম্মুকে দেয় দুটি।
সাজেদা রান্নাঘরে ছিল। দুটি চকবার উঠিয়ে অরিন দৌড়ে রান্না ঘরে যায়- আন্টি- তোমার চকবার।
সাজেদা চকবার হাতে ডাইনিং টেবিলে এসে আমার গালে টুসি মেরে বলে, খাও না?
সাজেদা তার ভাগের একটা চকবার দেয় অরিনকে আরেকটা দেয় পুতুলকে।
টুটুল কেঁদে ওঠে, আমার একটা কম পড়ে গেল!
আমার দুটো থেকে আমি টুটুলকে একটা দিয়ে আরেকটার প্যাকেট খুলি। তারপর সাজেদার মুখের দিকে এগিয়ে দিই।
সেপ্টেম্বর ২০০৩
**সুগন্ধি রুমাল, ছোটোগল্প সংকলন, একুশে বইমেলা ২০০৪।
'সুগন্ধি রুমাল'-এর ডাউনলোড লিংক
২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:৫২
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: গল্পটি ভালো লেগেছে জেনে আনন্দিত। ধন্যবাদ জাহাঙ্গীর নয়ন ভাই।
২| ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৪৬
রাজীব নুর বলেছেন: এবার বইমেলাতে আপনার কোনো বই আসবে?
২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:০০
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: না ভাই, বই প্রকাশ করাটা খুব ঝামেলা মনে হয়। প্রচুর এডিট করা দরকার, যা করার জন্য যথেষ্ট সময় ও ধৈর্য আপাতত নাই। দেখি ভবিষ্যতে হয় কিনা।
ধন্যবাদ।
ঘুরে আসুন-১
ঘুরে আসুন-২
৩| ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৫৩
মনিরা সুলতানা বলেছেন: চমৎকার লেখা ; আমাদের গল্প, সময়ের গল্প।
ভালোলাগা।
২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:২৪
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপু।
৪| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১০:৩৭
সোহানী বলেছেন: এইতো ঝামেলায় ফেললেন.... আমি হলাম আইসক্রিমের পোকা। মারাত্বক আইসক্রিম খাই। আর চকবার আমার খুব প্রিয়। এখন মারাত্বক ঠান্ডা বলে বাসায় ক'দিন আনা বন্ধ রেখেছি। কারন আমি একা না বাচ্চারাও খায়। তাই ঠান্ডা লাগার ভয়।...... যাহোক কালই আনবো
গল্পে যথারীতি ভালোলাগা প্রিয় সোনবীজ ভাই।
৫| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:৩৮
বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: মনে হচ্ছিল মলাটে মোড়া গল্প বই পড়ছি, সেই কলেজ জীবনে ছাপার অক্ষরে পড়া গল্পগুলোর মত অনুভূতি। খুব বেশী ভালো লেগেছে। +++++
©somewhere in net ltd.
১| ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:২০
নাঈম জাহাঙ্গীর নয়ন বলেছেন: ২০০৩!!! তারমানে এখন টুটুল পুতুল যথাক্রমে ২৫' ২২ বছরের হয়ে গেছে।
ভালো লাগলো ভাই বাস্তব গল্পটি, সুন্দর লিখেছেন