নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাবুই পাখি

Footprint of a village boy!

ফারজুল আরেফিন

আমার ভার্চুয়াল ঘর, যেমন ইচ্ছে তেমন সাঁজাই। অতিথিকে স্বাগতম।

ফারজুল আরেফিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নির্বাচিত কবিতা সমগ্র - ৫

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ ভোর ৫:১০

লোকেন বোসের জর্নাল - জীবনানন্দ দাস

সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি —

এখনো কি ভালোবাসি?

সেটা অবসরে ভাববার কথা,

অবসর তবু নেই;

তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে

এখন শেলফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভলভ ভাবে

সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না।



পুরোনো চিঠির ফাইল কিছু আছে:

সুজাতা লিখেছে আমার কাছে,

বারো তেরো কুড়ি বছর আগের সে-সব কথা;

ফাইল নাড়া কি যে মিহি কেরানীর কাজ;

নাড়বো না আমি

নেড়ে কার কি লাভ;

মনে হয় অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব,

সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে

মানে এই — অমিতা বলছি যাকে —

কিন্তু কথাটা থাক;

কিন্তু তবুও —

আজকে হৃদয় পথিক নয়তো আর,

নারী যদি মৃগতৃষ্ণার মতো — তবে

এখন কি করে মন কারভান হবে।



প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি

সেই সব মৃগতৃষ্ণিকাতলে ঈষৼ সিমুমে

হয়তো কখনো বৈতাল মরুভুমি,

হৃদয়, হৃদয় তুমি!

তারপর তুমি নিজের ভিতরে ফিরে এসে তব চুপে

মরীচিকা জয় করেছো বিনয়ী যে ভীষন নামরূপে

সেখানে বালির সৎ নিরবতা ধূ ধূ

প্রেম নয় তবু প্রমেরই মতন শুধু।

অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে?

অমিতা নিজে কি তাকে?

অবসর মতো কথা ভাবা যাবে,

ঢের অবসর চাই;

দূর ব্রহ্মাণ্ডকে তিলে টেনে এনে সমাহিত হওয়া চাই

এখনি টেনিসে যেতে হবে তবু,

ফিরে এসে রাতে ক্লাবে;

কখন সময় হবে।



হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোঁটে —

হৃদয় কেন যে কাঁপে,

'ভালোবাসতাম' — স্মৃতি — অঙ্গার — পাপে

তর্কিত কেন রয়েছে বর্তমান।

সে-ও কি আমায় — সুজাতা আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলো?

আজো ভালোবাসে নাকি?

ইলেকট্রনেরা নিজ দোষগুনে বলয়িত হয়ে রবে;

কোনো অন্তিম ক্ষালিত আকাশে

এর উত্তর হবে?



সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে;

অমিতা কি মিহিজামে?

বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে — সবই।

ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে;

সময়ের এই স্থির এক দিক,

তবু স্থিরতর নয়;

প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়।







শীতরাত - জীবনানন্দ দাস

এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;

বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,

কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।



শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে -

সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।



এদিকে কোকিল ডাকছে - পউষের মধ্য রাতে;

কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব'লে?

কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?

তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ'য়ে যেতে দেখেছি,

তারা কিশোর নয়,

কিশোরী নয় আর;

কোকিলের গান ব্যবহৃত হ'য়ে গেছে।



সিংহ হুঙ্কার ক'রে উঠছে:

সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,

স্থবির সিংহ এক - আফিমের সিংহ - অন্ধ - অন্ধকার।

চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে

মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে যায় সব।



সিংহ অরন্যকে পাবে না আর

পাবে না আর

পাবে না আর

কোকিলের গান

বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খ'শে খ'শে

চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।

হে পৃথিবী,

হে বিপাশামদির নাগপাশ, - তুমি

পাশ ফিরে শোও,

কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর।







সে - জীবনানন্দ দাস

আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;

বলেছিলো: 'এ নদীর জল

তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল:

সব ক্লান্তি রক্তের থেকে

স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;

এই নদী তুমি।'



'এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?'

মাছরাঙাদের বললাম;

গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।

আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;

জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে

কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।



সময়ের অবিরল শাদা আর কালো

বনানীর বুক থেকে এসে

মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে

ঢের আগে নারী এক - তবু চোখ ঝলসানো আলো

ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি

না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী।







অন্য প্রেমিককে - জীবনানন্দ দাস

মাছরাঙা চ'লে গেছে -- আজ নয় কবেকার কথা;

তারপর বারবার ফিরে এসে দৃশ্যে উজ্জল।

দিতে চেয়ে মানুষের অবহেলা উপেক্ষায় হ'য়ে গেছে ক্ষয়;

বেদনা পেয়েছে তবু মানুষের নিজেরও হৃদয়

প্রকৃতির অনির্বচনীয় সব চিহ্ন থেকে দু' চোখ ফিরিয়ে;

বুদ্ধি আর লালসার সাধনাকে সব চেয়ে বড় ভেবে নিয়ে।



মাছরাঙা চ'লে গেছে -- আজ নয় কবেকার কথা;

তারপর বারবার ফিরে এসে ডানাপালকের উজ্জলতা

ক্ষয় ক'রে তারপর হয়ে গেছে ক্ষয়।

মাছরাঙা মানুষের মতো সূর্য নয়?

কাজ করে কথা ব'লে চিন্তা করে চলেছে মানব;

যদিও সে শ্রেষ্ঠ চিন্তা সারাদিন চিন্তানাশা সাগরের জলে

ডুবে গিয়ে নিঃশব্দতা ছাড়া আর অন্য কিছু বলে?







আমাকে একটি কথা দাও - জীবনানন্দ দাস

আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো

সহজ মহৎ বিশাল,

গভীর; - সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে

মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন,

আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর।

সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো:

সেই দিনের - আলোর অন্তহীন এঞ্জিন চঞ্চল ডানার মতন

সেই উজ্জ্বল পাখিনীর - পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে

অগ্নির মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন।







১৩৩৩ - জীবনানন্দ দাস

তোমার শরীর —

তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্ দিকে জানি নি তা — মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোনদিকে জানি নি তা — হয়েছে মলিন

চক্ষু এই — ছিঁড়ে গেছি — ফেঁড়ে গেছি — পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে

কত দিন — রাত্রি গেছে কেটে!

কত দেহ এল, গেল, হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে

দিয়েছি ফিরায়ে সব — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে

নক্ষত্রের তলে

বসে আছি — সমুদ্রের জলে

দেহ ধুয়ে নিয়া

তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া!

তোমার শরীর —

তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্দিকে — ফলে গেছে কতবার,

ঝরে গেছে তৃণ!

*

আমারে চাও না তুমি আজ আর, জানি;

তোমার শরীর ছানি

মিটায় পিপাসা

কে সে আজ! — তোমার রক্তের ভালোবাসা

দিয়েছ কাহারে!

কে বা সেই! — আমি এই সমুদ্রের পারে

বসে আছি একা আজ — ঐ দূর নক্ষত্রের কাছে

আজ আর প্রশ্ন নাই — মাঝরাতে ঘুম লেগে আছে

চক্ষে তার — এলোমেলো রয়েছে আকাশ!

উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা! — তারই তলে পৃথিবীর ঘাস

ফলে ওঠে — পৃথিবীর তৃণ

ঝড়ে পড়ে — পৃথিবীর রাত্রি আর দিন

কেটে যায়!

উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা — তারই তলে হায়!

*

জানি আমি — আমি যাব চলে

তোমার অনেক আগে;

তারপর, সমুদ্র গাহিবে গান বহুদিন —

আকাশে আকাশে যাবে জ্বলে

নক্ষত্র অনেক রাত আরো,

নক্ষত্র অনেক রাত আরো,

(যদিও তোমারও

রাত্রি আর দিন শেষ হবে

একদিন কবে!)

আমি চলে যাব, তবু, সমুদ্রের ভাষা

রয়ে যাবে — তোমার পিপাসা

ফুরাবে না পৃথিবীর ধুলো মাটি তৃণ

রহিবে তোমার তরে — রাত্রি আর দিন

রয়ে যাবে রয়ে যাবে তোমার শরীর,

আর এই পৃথিবীর মানুষের ভিড়।

*

আমারে খুজিয়াছিলে তুমি একদিন —

কখন হারায়ে যাই — এই ভয়ে নয়ন মলিন

করেছিলে তুমি! —

জানি আমি; তবু, এই পৃথিবীর ফসলের ভূমি

আকাশের তারার মতন

ফলিয়া ওঠে না রোজ — দেহ ঝরে — ঝরে যায় মন

তার আগে!

এই বর্তমান — তার দু — পায়ের দাগে

মুছে যায় পৃথিবীর পর,

একদিন হয়েছে যা তার রেখা, ধূলার অক্ষর!

আমারে হারায়ে আজ চোখ ম্লান করিবে না তুমি —

জানি আমি; পৃথিবীর ফসলের ভূমি

আকাশের তারার মতন

ফলিয়া ওঠে না রোজ —

দেহ ঝরে, তার আগে আমাদের ঝরে যায় মন!

*

আমার পায়ের তলে ঝরে যায় তৃণ —

তার আগে এই রাত্রি — দিন

পড়িতেছে ঝরে!

এই রাত্রি, এই দিন রেখেছিলে ভরে

তোমার পায়ের শব্দে, শুনেছি তা আমি!

কখন গিয়েছে তবু থামি

সেই শব্দে! — গেছ তুমি চলে

সেই দিন সেই রাত্রি ফুরায়েছে বলে!

আমার পায়ের তলে ঝরে নাই তৃণ —

তবু সেই রাত্রি আর দিন

পড়ে গেল ঝ’রে।

সেই রাত্রি — সেই দিন — তোমার পায়ের শব্দে রেখেছিলে ভরে!

*

জানি আমি, খুঁজিবে না আজিকে আমারে

তুমি আর; নক্ষত্রের পারে

যদি আমি চলে যাই,

পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই

যদি আমি —

আমারে খুঁজিতে তবু আসিবে না আজ;

তোমার পায়ের শব্দ গেল কবে থামি

আমার এ নক্ষত্রের তলে! —

জানি তবু, নদীর জলের মতো পা তোমার চলে —

তোমার শরীর আজ ঝরে

রাত্রির ঢেউয়ের মতো কোনো এক ঢেউয়ের উপরে!

যদি আজ পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই

যদি আমি চলে যাই

নক্ষত্রের পারে —

জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

*

তুমি যদি রহিতে দাঁড়ায়ে!

নক্ষত্র সরিয়া যায়, তবু যদি তোমার দু — পায়ে

হারায়ে ফেলিতে পথ — চলার পিপাসা! —

একবারে ভালোবেসে — যদি ভালোবাসিতে চাহিতে তুমি সেই ভালোবাসা।

আমার এখানে এসে যেতে যদি থামি! —

কিন্তু তুমি চলে গেছ, তবু কেন আমি

রয়েছি দাঁড়ায়ে!

নক্ষত্র সরিয়া যায় — তবু কেন আমার এ পায়ে

হারায়ে ফেলেছি পথ চলার পিপাসা!

একবার ভালোবেসে কেন আমি ভালোবাসি সেই ভালোবাসা!

*

চলিতে চাহিয়াছিলে তুমি একদিন

আমার এ পথে — কারণ, তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন।

জানি আমি, আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই।

তারপর, কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি! — তাই আস নাই

আমার এখানে তুমি আর!

একদিন কত কথা বলেছিলে, তবু বলিবার

সেইদিনও ছিল না তো কিছু — তবু বলিবার

আমার এ পথে তুমি এসেছিলে — বলেছিলে কত কথা —

কারণ, তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন;

আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই;

তারপর, কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি — তাই আস নাই!

*

তোমার দু চোখ দিয়ে একদিন কতবার চেয়েছ আমারে।

আলো অন্ধকারে

তোমার পায়ের শব্দ কতবার শুনিয়াছি আমি!

নিকটে নিকটে আমি ছিলাম তোমার তবু সেইদিন —

আজ রাত্রে আসিয়াছি নামি

এই দূর সমুদ্রের জলে!

যে নক্ষত্র দেখ নাই কোনোদিন, দাঁড়ায়েছি আজ তার তলে!

সারাদিন হাঁটিয়াছি আমি পায়ে পায়ে

বালকের মতো এক — তারপর, গিয়েছি হারায়ে

সমুদ্রের জলে,

নক্ষত্রের তলে!

রাত্রে, অন্ধকারে!

তোমার পায়ের শব্দ শুনিব না তবু আজ — জানি আমি,

আজ তবু আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

*

তোমার শরীর —

তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর, মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন।

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্দিকে জানি নি তা — হয়েছে মলিন

চক্ষু এই — ছিঁড়ে গেছি — ফেঁড়ে গেছি — পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে

কত দিন — রাত্রি গেছে কেটে

কত দেহ এল, গেল — হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে

দিয়েছি ফিরায়ে সব — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে

নক্ষত্রের তলে

বসে আছি — সমুদ্রের জলে

দেহ ধুয়ে নিয়া

তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া!







মনে হয় একদিন আকাশের - জীবনানন্দ দাস

মনে হয় একদিন আকাশের শুকতারা দেখিব না আর;

দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে এক ঝাড় জোনাকি কখন

নিভে যায়; দেখিব না আর আমি পরিচিত এই বাঁশবন,

শুকনো বাঁশের পাতা-ছাওয়া মাটি হয়ে যাবে গভীর আঁধার

আমার চোখের কাছে; লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে সে কবে আবার

পেঁচা ডাকে জ্যোৎস্নায়; হিজলের বাঁকা ডাল করে গুঞ্জরণ;

সারা রাত কিশোরীর লাল পাড় চাঁদে ভাসে-হাতের কাঁকন

বেজে ওঠে : বুঝিব না-গঙ্গাজল, নারকোলনাডুগুলো তার

জানি না সে কারে দেবে- জানি না সে চিনি আর শাদা তালশাঁস

হাতে লয়ে পলাশের দিকে চেয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়ে রবে কি না…

আবার কাহার সাথে ভালোবাসা হবে তার-আমি তা জানি না-

মৃত্যুরে কে মনে রাখে?-কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো মাস

নতুন ডাঙার দিকে-পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা

দিন তার কেটে যায়- শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ?







শঙ্খমালা - জীবনানন্দ দাস

কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে

সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,

বলিল, তোমারে চাই:

বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ

খুজেছি নক্ষত্রে আমি কুয়াশার পাখনায়-

সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক

জোনাকির দেহ হতে-খুজেছি তোমারে সেইখানে-

ধূসর পেচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে

ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে

সোনার সিড়ির মতো ধানে আর ধানে

তোমারে খুঁজছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।

দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা;

সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা-

বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,

শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।

কড়ির মতন শাদা মুখ তার;

দুইখানা হাত তার হিম;

চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম

চিতা জ্বলে: দক্ষিণ শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়

সে আগুনে হায়।

চোখে তার

যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!

স্তন তার

করুণ শঙ্খের মতো – দুধে আর্দ্র-কবেকার শঙ্খিনীমালার!

এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।







সুচেতনা - জীবনানন্দ দাস

সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ

বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;

সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে

নির্জনতা আছে।

এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা

সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।

কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;

তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।

আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রের ঘুরে প্রাণ

পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো

ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু,

দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত

ভাই বোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে;

পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;

মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।

কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে

দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;

সেই শস্য অগণন মানুষের শব;

শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়

আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়াসের মতো আমাদেরও প্রাণ

মূক করে রাখে; তবু চারিদকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।

সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে — এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;

সে অনেক শতাব্দীর মানষীর কাজ:

এ বাতাস কী পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;–

প্রায় তত দূর ভালো মানবসমাজ

আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে

গড়ে দেব আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।

মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসছি,

না এলেই ভালো হত অনুভব করে;

এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি

শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;

দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়–

শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।







স্বপ্নের ধ্বনিরা - জীবনানন্দ দাস

স্বপ্নের ধ্বনিনা এসে বলে যায়: স্থাবিরাতা সব চেয়ে ভালো

নিস্তব্ধ শীতের রাতে দীপ জ্বেলে

অথবা নিভায়ে দীপ বিছানায় শুয়ে

স্থবিরের চোখে যেন জমে ওঠে অন্য কোন বিকেলের আলো।

সেই আলো চিরদিন হয়ে থাকে স্থির,

সব ছেড়ে একদিন আমিও স্থবির

হয়ে যাব; সেদিন শীতের রাতে সোনালী জরির কাজ ফেলে

প্রদীন নিভায়ে রব বিছানায় শুয়ে:

অন্ধকারে ঠেস দিয়ে জেগে রব

বাদুড়ের আঁকাবাঁকা আকাশের মতো।

স্থবিরতা, করে তুমি আসিবে বল তো।







তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও - জীবনানন্দ দাস

তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও — আমি এই বাংলার পারে

র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;

দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে

ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে

নেচে চলে-একবার — দুইবার — তারপর হঠাৎ তাহারে

বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে হৃদয়ের পাশে;

দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ — শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে

শঙ্খের মতো কাঁদে: সন্ধ্যায় দাঁড়ালে সে পুকুরের ধারে,

খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন্ কাহিনীর দেশে –

‘পরণ-কথা’র গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে,

কল্মীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীরে –

নীরবে পা ধোয় জলে একবার — তারপর দূরে নিরুদ্দেশে

চ’লে যায় কুয়াশায় — তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে

হারাব না তারে আমি — সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে।







তোমাকে - জীবনানন্দ দাস

একদিন মনে হতো জলের মতন তুমি।

সকালবেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা–

অথবা দুপুরবেলা — বিকেলের আসন্ন আলোয়–

চেয়ে আছে — চলে যায় — জলের প্রতিভা।

মনে হতো তীরের উপরে বসে থেকে।

আবিষ্ট পুকুর থেকে সিঙাড়ার ফল

কেউ কেউ তুলে নিয়ে চলে গেলে — নীচে

তোমার মুখের মতন অবিকল।

নির্জন জলের রঙ তাকায়ে রয়েছে;

স্থানান্তরিত হয়ে দিবসের আলোর ভিতরে

নিজের মুখের ঠান্ডা জলরেখা নিয়ে

পুনরায় শ্যাম পরগাছা সৃষ্টি করে;

এক পৃথিবীর রক্ত নিপতিত হয়ে গেছে জেনে

এক পৃথিবীর আলো সব দিকে নিভে যায় বলে

রঙিন সাপকে তার বুকের ভিতরে টেনে নেয়;

অপরাহে আকাশের রং ফিকে হলে।

তোমার বুকের ‘পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল;

তোমার বুকের ‘পরে আমাদের বিকেলের রক্তিল বিন্যাস;

তোমার বুকের ‘পরে আমাদের পৃথিবীর রাত;

নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস।







পঁচিশ বছর পরে (মাঠের গল্প) - জীবনানন্দ দাস

শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে

বলিলাম: ‘একদিন এমন সময়

আবার আসিয়ো তুমি, আসিবার ইচ্ছা যদি হয়!–

পঁচিশ বছর পরে!’

এই বলে ফিরে আমি আসিলাম ঘরে;

তারপর কতবার চাঁদ আর তারা,

মাঠে মাঠে মরে গেল, ইদুর — পেচাঁরা

জোছনায় ধানক্ষেতে খুঁজে

এল-গেল। –চোখ বুজে

কতবার ডানে আর বায়ে

পড়িল ঘুমায়ে

কত-কেউ! — রহিলাম জেগে

আমি একা — নক্ষত্র যে বেগে

ছুটিছে আকাশে

তার চেয়ে আগে চলে আসে

যদিও সময়–

পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয়!–

তারপর — একদিন

আবার হলদে তৃণ

ভরে আছে মাঠে- -

পাতায় শুকনো ডাঁটে

ভাসিছে কুয়াশা

দিকে দিকে, চুড়ায়ের ভাঙা বাসা

শিশিরে গিয়েছে ভিজে — পথের উপর

পাখির ডিমের খোলা, ঠান্ডা-কড়কড়!

শসাফুল — দু-একটা নষ্ট শাদা শসা

মাকড়ের ছেঁড়া জাল, শুকনো মাকড়সা

লতায় — পাতায়;

ফুটফুটে জোছনারাতে পথ চেনা যায়;

দেখা যায় কয়েকটা তারা

হিম আকাশের গায় — ইদুর পেঁচারা

ঘুরে যায় মাঠে মাঠে, ক্ষুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজও মেটে,

পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে!

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১২:২২

মিথী_মারজান বলেছেন: জীবনানন্দ দাশ!!!! :) :) :)

অনেক অনেক অনেক ভাল লাগলো। এই খুশিতে আমার একটুখানি ছোট্ট "জীবনানন্দ" ভাললাগা আপনার জন্য রেখে গেলাম-

"যেতে হবে বলে
তুমি গেছ চলে,
দূরে গেছ সরে;
যেতে হবে! তাই আমি হাতখানা ধরে
তোমারে আনি নি ডেকে কাছে !
একদিন, তবু-মনে আছে
তুমি এসেছিলে;
আমারে বাস নি ভালো সেই দিনও, জানি আমি,
কিন্তু তুমি ভালোবেসেছিলে
তোমার ভিতরে যেই নারী আছে তারে,
জানিয়াছি- কত ভালোবাসিতে সে পারে !
আমারে বাসনি তুমি ভালো,
কিন্তু সেই নারী- আজ সেও কি ফুরালো
তোমার অন্তরে !.. "

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১:১১

ফারজুল আরেফিন বলেছেন: সুন্দর।

সবই তো ফুরায় একসময়, ভাললাগা বারবার আসে-ভালবাসা একবার আসে। হৃদয়ের উপর জোর কী কখনো খাটে!

২| ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১:৫২

চর্যা পদ বলেছেন: জীবনান্দের সব কবিতার আমি অন্ধ ভক্ত। আর উনার 'বোধ' কবিতা আমার অসহ্য রকম ভালোলাগে।

আলো-অন্ধকারে যাই
মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়-
ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কিছু তুচ্ছ হয়,
পন্ড মনে হয়,
সব চিন্তা- প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়!

০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ২:৩৫

ফারজুল আরেফিন বলেছেন: পড়েছিলাম আগে, আবার পড়লাম। ভালো লাগলো আবারও, ধন্যবাদ আপু।

জীবনানন্দের কবিতার কাছে অন্য সব কবিতা পানসে লাগে! কাল অতিক্রম হয় দ্রুত, আমি শুধু পড়ে থাকি জীবনানন্দের কবিতার বন্ধনে!!

৩| ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ২:৫৩

আশরাফুল ইসলাম দূর্জয় বলেছেন:
জীবনানন্দ, অনেক প্রিয় এক কবি।
তার 'বোধ' আমার অনেক অনেক প্রিয়।
'চর্যাপদ' ভাইয়া উপরে এটি একটু শেয়ার করেছেন।
_ আমি আমার প্রিয় আরেকটি কবিতা দিয়ে গেলাম।
_______________________________________________

সহজ

আমার এ গান
কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে–
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে–
তবুও হৃদয়ে গান আসে!
ডাকিবার ভাষা
তবুও ভুলি না আমি–
তবু ভালোবাসা
জেগে থাকে প্রাণে!
পৃথিবীর কানে
নক্ষত্রের কানে
তবু গাই গান!
কোনোদিন শুনিবে না তুমি তাহা, জানি আমি–
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে–
তবুও হৃদয়ে গান আসে!

তুমি জল, তুমি ঢেউ, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন
তোমার হেদের বেগ– তোমার সহজ মন
ভেসে যায় সাগরের জলে আবেগে!
কোন্‌ ঢেউ তার বুকে গিয়েছিল লেগে
কোন্‌ অন্ধকারে
জানে না সে!– কোন ঢেউ তারে
অন্ধকারে খুজিছে কেবল
জানে না সে! রাত্রির সিন্ধুর জল,
রাত্রির সিন্ধুর ঢেউ
তুমি একা! তোমারে কে ভালোবাসে! — তোমারে কি কেউ
বুকে করে রাখে!
জলের আবেগে তুমি চলে যাও —
জলের উচ্ছ্বাসে পিছে ধু ধু জল তোমারে যে ডাকে!

তুমি শুধু এক দিন — এক রজনীর!–
মানুষের ুমানুষীর ভিড়
তোমারে ডাকিয়া লয় দূরে — কত দূরে!
কোন্‌ সমুদ্রের পারে — বনে — মাঠে — কিংবা যে আকাশ জুড়ে
উল্কার আলেয়া শুধু ভাসে! —
কিংবা যে আকাশে
কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ
জেগে ওঠে, ডুবে যায় — তোমার প্রাণের সাধ
তাহাদের তরে!
যেখানে গাছের শাখা নড়ে
শীত রাতে — মড়ার হাতের শাদা হাড়ের মতন! —
যেইখানে বন
আদিম রাত্রির ঘ্রাণ
বুকে লয়ে অন্ধকারে গাহিতেছে গান!–
তুমি সেইখানে!
নিঃসঙ্গ বুকের গানে
নিশীথের বাতাসের মতো
একদিন এসেছিলে —
দিয়েছিলে এক রাত্রি দিতে পারে যত!

০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৩:০২

ফারজুল আরেফিন বলেছেন: অন্যরকম ভাললাগা ভাই, এই ভাললাগার কোন সীমা নাই। ধন্যবাদ দূর্জয় ভাই।

এই পোস্টে কবির আরো কিছু কবিতা সংযোজনের চেষ্টা করবো। :)

৪| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১১:৪৬

মাহী ফ্লোরা বলেছেন: চমৎকার পোস্ট।:)

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১:০৮

ফারজুল আরেফিন বলেছেন: :) :) :)

থ্যাংকস

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.