নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কিছু কথা কিছু ব্যথা

ফেরদৌস প্রামানিক

আমি মানুষ হিসেবে একটু ভাবুক টাইপের , যেসব ভাবনার সমাধান আগে হয়নি আর সামনেও হওয়ার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই ।

ফেরদৌস প্রামানিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

সীমান্ত বদল !

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৫৩


সীমান্ত বদল
========
===========
“নাহ, বাবা এমন কেন ? আমার ইচ্ছের বাইরেও এভাবে ঘরছাড়া কেন করছেন – এ প্রশ্নটি যেমন আমিই করছি আবার আমিই এর উপযুক্ত জবাবের আদ্যোপান্ত খুব ভালো ভাবে জানি । বাবার কোন এক প্রপিতামহ ‘রুপ নারায়ণ’ নামক ভদ্রলোক বোধহয় এই পুঠিয়ার আংশিক জমিদার ছিলেন একসময় । দুর্দান্ত প্রতাপ, জৌলুশ, আর সীমাহীন অর্থসম্পদের সেই জমিদারের এক বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার আমার এই খানদানী গোঁফওয়ালা রাশভারী শ্রদ্ধাবর পিতা । আজ জমিদারিত্ব নেই বটে, কিন্তু তার হুকুমের তামিল না হলে যে জল্লাদের হাতে মস্তক নামক একান্ত আবশ্যক প্রত্যঙ্গটি দ্বিখণ্ডিত হবে তিনিও স্বয়ং আমার ঐ জন্মদাতাই।” বলছি তখনকার কথা যখন সময়টা ঊনসত্তর সাল । যেমন অল্পের জন্য সত্তর সালটা বাকী, তেমন ভয়ংকর গণজাগরণে এক মহাবিপ্লব আসতেও সামান্যই বাকী । পাড়ায় পাড়ায় আগুন, উঠতি বয়সের তরুণদের মধ্যে সে শিখা উর্ধমূখী হয়ে আকাশকে রক্তিম করছে প্রতিমুহূর্তে । দিয়াশালাইয়ের কাজ করে বাবার হাতলওয়ালা দু’ তিনটে ভলিউমের চাকার রেডিওটা । যার বারুদ হল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, কী গলা, যেন পিষে ফেলবে সব লাল লাল পাকিস্তানি পিপড়েগুলো । আমি বুঝতাম না ‘শোষণ’ জিনিসটা কী । শুধু বুঝতাম স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে আসলে লাটিমখানা হাতে নেয়া মাত্রই যদি বাবা দেখে ফেলে বলতো, আনন্দ, এদিকে আস তো ? কটা ক্লাস হল ?বুঝতাম এটাই শাসন, এটাই শোষণ । একটা গেঁয়ো বালক মন আমার, বিষিয়ে উঠতো ঐ রাক্ষুসে মুখগুলো দেখলেই । এটা তো ওদের দেশ নয়; তাহলে এখানে এরকম জেঁকে বসে থাকে কেন বাবা ? বাবার কাছে প্রশ্নটা পেড়েছিলাম একবার । ‘হায়েনা’দের কোন বাছবিচার থাকেনা বাবা ! ওরা সবকিছুই নখের আর দাতের আঁচড়ে দখল নিতে চায়তো, তাই ওরকম করেই থাকে । কখনো কখনো পুঠিয়ার বাজার সংলগ্ন মহাসড়ক ধরে, আমবাগানের পাশ ঘেঁষে স্কুলে যাওয়ার পথে সেই বুনো হায়েনার দল বাবার দিকে কেমন অগ্নিমূর্তি হয়ে তাকাত, যেন নরকের আগুনের ফুলকি দু চোখের মধ্যে বসানো আছে । বাবা এই আগুনের ফুলকি থেকে, নরকের অগ্নি থেকে তার এই চার ক্লাস পড়ুয়া পুত্রধনকে , যক্ষের ধনকে পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনে । চিবুক বেয়ে নেমে আসা অশ্রুজলের ধারা, ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে অবনত আর ভঙ্গুর এক শিশুমনের আকুতি, অনুনয়-বিনয় – কোনকিছুই বাবার পথ আগলে দাড়াতে পারেনি সেদিন । চেনা জানা মুখ, মাথায় আদর দিয়ে বোলানো সেই মমতাময়ী আত্মীয়দের হাতগুলো, সাদা লোমের ‘টুনু’ নামের পালিত তুলতুলে বিড়ালটা, জলপাই গাছের নিচে পাতানো সেই আয়েশী মাচাং – সবকিছু পেছনে ফেলে এলাম রাণী ভিক্টোরিয়ার ভিটেতে । এ ভিটেখানি দুনিয়াসুদ্ধ সবাই চেনে, জানে । এককালে বাঙ্গাল জাতের লোকেরা বিলেত বলত । এখন আমি বিলেতি নাগরিক, বাবার সেই জবরদস্তিমূলক নির্বাসনের কারণে । তখন ছোট মানুষ, মায়ের কথা ভেবে কেঁদে কেঁদে নাকের শ্লেষ্মা আর চোখের জল একাকার করে ফেলতাম । ছোট মানুষ হলেও তো বুঝতাম ঐ পাকিস্তনি সেনারা আমার, বাবার আর আমাদের এই পুরো মাতৃভূমিরই শত্রু । বাবার সেই সোনার পাতের মত চওড়া কপালখানি তীক্ষ্ণ কিছু বুলেট দখল করে নিয়েছিল পঁচিশের সেই রাতে । জমাট বাধা কালচে রক্তদলা মুখখানিকে আড়াল করে রেখেছিল । চাচাই আমার সকল খরচ চালিয়ে গেলেন সেই থেকে, কলকাতায় এসে আবার বাবার রক্ত-মাখা ভুমিতে ফিরে গিয়েই । কতটা বছর জানি !

বাংলাদেশের জন্ম হল আমার কাছে অনেকদিন পরে, আরেকবার, যেবার লাল সবুজের পতাকা জড়িয়ে দিলাম আমার ছেলে আদিত্যের মাথায় । লন্ডনের পথে ঘাটে চলতে গিয়ে দেশের যে পত্রিকাগুলোয় চোখ বুলাতাম, তার সিক্সটিন্‌থ ডিসেম্বার, নাইন্টিন নাইন্টি ওয়ান – এর পত্রিকার সেই বিজয় উল্লাসের দৃশ্য, ক্ষত-বিক্ষত, নিঃস্ব কিন্তু বিজয়ী আর বীর, যুদ্ধ-ফেরত প্রতিটি মহানায়কের উন্নত শির , সেতারা বেগমদের মত মুক্তি-বেটি বা বীরঙ্গনাদের কান্নাজলে একাকার সাদা, সুতি শাড়ির সমারোহ আর শহীদ মিনারের পাদদেশে অজস্র ফুল হাতে সর্বস্ব খোয়ানো অপরাজিতাদের অশ্রু দেখে নিজেরও অশ্রু সামলাতে পারিনি । পাশের ব্রিটিশ মানুষটা কান্না দেখে বলতো, ওহ্‌ ম্যান, কাম অন ! নাউ ইউ হ্যাভ ইউর অউন কান্ট্রি ! স্মাইল প্লিজ ! তখন ডুকরে কেঁদে না উঠে ডুকরেই হেসে উঠতাম ! ওর নাম হয়তো কান্না কান্না হাসি ! আজও তা জ্বলজ্বল করে । বিলেতে এখন আগের চেয়ে সকল কিছুর গতি , মূল্য আর চাকচিক্যতা বেড়েছে, স্বচ্ছ কাচে ঘেরা দালানগুলো জিরাফের গলার মত হয়ে আকাশ ছুতে চাইছে । বেড়ে উঠেছে আমার ছেলে আদিত্য নারায়ণও । ওর অ্যাক্‌সেন্টটা পুরাটাই ব্রিটিশদের মত আর চেহারাটা ওর দাদুর মত । আমার আর ওর মায়ের আত্মবিশ্বাস ডিঙ্গিয়ে যেদিন ও অক্সফোর্ডে ভর্তি হল, সেদিন ওর কপালের সাথে ওর দাদুর কপালের মিল দেখে আচমকা ধাক্কা খেলাম ! হঠাৎ একদিন বারান্দায় চেয়ার টেনে বসল আমার মুখোমুখি । ঠিক ওর পেছন বরাবর; একটা দেশীয় টিয়াপাখি খাচায় লোহার শিকগুলোয় আঁচর কাটছে আপনমনে । ও বলে উঠলো,
- বাবা, আমি দেশে গেলে তুমি মন খারাপ করবে ?
- হ্যা, করব ! দেশে যাওয়া ছাড়া অন্য কিছু যদি করো তাহলেই মন খারাপ করবোনা আমি ।
- তার মানে তুমি সরাসরি বাধাই দিবে আমায় ! কিন্তু অক্সফোর্ড গ্রাজুয়েটকে ঠিক আটকানো কি যাবে বাবা ?
- দেশ, ভাষা আর মা – এসব কি কারো কাছ থেকে জোর দিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া যায়, আদিত্য ?
- কাল রাতে ‘ হাঙ্গর নদী গ্রেনেড ’ পড়লাম ! কান্না আসছিল ! আই ওয়ান্ট টু গৌ ব্যাক !
- গৌ ব্যাক ? তুমি কখন থেকেই বা বাংলাদেশে ছিলে ? তুমি তো ‘গৌ ব্যাক’ এর পরিবর্তে ‘গৌ’বলবে, নাকি ?
- আমি তোমার হয়ে ব্যাক করতে চাই বাবা । চাদর ঠিক করে নিয়ে বলি ,
- কারো হয়েই যে ফেরা অসম্ভব ! বছরে দু’ থেকে তিনবার কি যাওয়া যথেষ্ট নয় ?
- হিসেবের প্রশ্ন এভাবে এলে সেটা কি নোংরা দেখায় না বাবা ?
- না, যদি তা মহৎ উদ্দ্যেশে হয় ।
আদিত্য আঙ্গুলের ডগা দিয়ে তার মসৃণ নাকের উপর খানিক ঝুলে পরা চশমাকে খানিকটা উপরে তুলে । নিজেও ঝুকে পরা থেকে কোমর সোজা করে খাঁচার পাখিটার দিকে দৃষ্টি ফেরায় , একটা উষ্ণ আর বিরক্তিকর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।
- এখন ভিনদেশী কলোনাইজেশন নেই, কুড়ে কুড়ে খাওয়া যুদ্ধস্মৃতি তাড়া হয়তো করেনা কাউকে, এক বুলেটেই মা ছেলের বক্ষ বিদীর্ণ হয়না । কিন্তু অনেক কিছুই হয় যা হওয়ার কথা নয় ।
- জানি, ছয় মাসের গর্ভধারিণী বঁধুর বুকে কোরান চেপে ধরে করুণ আকুতির পরেও শাশুড়ীর সামনেই চেয়ারম্যানের ছেলে আর ভাতিজার পশুরপাল যুদ্ধের দৃশ্যের মত করে তার উপর ঝাপিয়ে পরেছিল । আমাদের দাদুর গ্রামের পাশের গ্রামেই !
- আমারও তো গ্রাম ওটি , নাকি আদিত্য ?
- না, পুরোটাই দাদুর রক্তে কেনা, মাটিতে মিশে থাকা মগজে গেঁথে থাকা বুলেটের বিনিময়ে ! তুমি তাতে ভাগ বসাতে পারনা, এতদিন স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকার পরে তো কোনভাবেই না । ওটি বরং তোমার পিতৃভূমি !
- উঁচু উঁচু দেয়ালঘেরা দালানে থেকেও ক্ষমতাবান বা নিরীহ – যেকোন মানুষই যেকোন এক কাকডাকা সকালে গলাকাটা শরীরে পত্রিকার শিরোনাম হয় হর-হামেশায় ! তুমি যুদ্ধে যেতে চাইলেও আমিই নিজেই পাঠাতাম তোমায় । কিন্তু কোন নিকৃষ্ট আর অদৃশ্য গৃহযুদ্ধে তো তোমাকে যেতে দিতে পারিনা আদিত্য ।
- তোমার ছেলের নিরাপত্তা নিয়ে তুমি শঙ্কিত বাবা, না ? অক্সফোর্ডের দামী ডিগ্রিটার অবমুল্যায়ন হবে চরমভাবে একটি উন্নয়নশীল দেশে, গাড়ির জানালার কাচের কাছে খালিগাঁয়ের, জট বাঁধা মাথাভর্তি লালচে চুল আর দাঁত না মাজা ভিক্ষুকের মুখের দুর্গন্ধের সাথে মানিয়ে নেওয়ার মত দৃশ্যের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হবে তোমার ছেলেটার – তুমি যেন মেনেই নিতে পারনা বাবা, ঠিক না ?
- হুম, আরো কত্ত ভয়ংকর কিছু ! তুমি এখন কারো কাছে একুশ দফা, ছয় দফা দিতে পারবে কি ? কিন্তু বাবা আমি যদি আগামীর কোন সোনার সবুজ বাংলা গড়ার জন্য দেশে যেতে চাই, তবে ?
- সেটি হবে আগ্নেয়গিরির গভীর থেকে কিছু উদ্ধার করার মত, গভীরে পৌছার আগেই তুমি ভস্ম !
- তবুও, আমি যাবই, দাদুর আদেশ বাবা !
- কীভাবে ? উনি কেন ? এটা কি ইমোশনাল ব্লাকমেইল, আদিত্য ?
- না, স্বপ্নে ! দাদু এসেছিল বুলেটবিদ্ধ চওড়া কপাল নিয়ে । আমার জোড়া চোখের উপর চোখ রেখে বলল, তোকে এখনই যেতে হবে দাদু ! ইট’স আর্জেন্ট ! এভাবে চলতে দেওয়া যায় না । ডু সামথিং, ডিয়ার গ্রান্ডসন ! এটা ত্রিশ লাখেরও বেশী মৃত আত্মার সম্মানের সাথে জড়িত ! আমি দাদুকে ‘ইয়েস’ বলে দিয়েছি !
- যেটা ভালো মনে কর তুমি । ইউর গ্রান্ডফাদার ইজ মাই টপমোস্ট উইকনেস ! আচ্ছা, তুমি যদি স্বপ্নে তাকে দেখেই থাক, তাহলে তুমি তো স্কেচ আঁকতে পার, স্বপ্নের আদলে পারবে বাবাকে আঁকতে ?
- চেষ্টা করব ।


দিন দুয়েক পরে বিছানার পাশে পড়ার টেবিলে আদিত্যের আঁকা স্কেচ দেখে আশাভঙ্গ হল । এটি তো ওর দাদু নয়, কপালটা চওড়া হলেও !
আদিত্য জেদের বশে তবুও সবকিছুই করলো, প্রথম একা একা বাংলাদেশ গমন, প্রথম বাবাকে অমান্য করা । যেন সে পছন্দ করল ‘ বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত’ না হয়ে ‘বাংলাদেশী’ হতে । আমি খুশি হলাম কিন্তু আতংকিত খুশী, হারানোর ভয়ে তটস্থ এক পিতৃমন ! ওকে বিমানে উঠিয়ে দিয়ে ওর মায়ের সাথে চোখ মুছতে মুছতে এয়ারপোর্ট থেকে বেরুবের পথে বাংলা পত্রিকা কিনে সেটাতে চোখ বুলাতেই রক্ত হিম হয়ে আসলো আমার ! চিন্তাশক্তি অক্ষম হয়ে গেল, গা বেয়ে তরতর করে ঘাম ছুটতে লাগলো । আদিত্যের মা অস্থির হয়ে বলল , কি হল গো তোমার ? বললাম, আদিত্য ওর স্বপ্নে দেখা যে স্কেচটি এঁকেছিল , দেখ, পত্রিকার প্রথম পাতায় হুবহু সেই ছবিটা ! ছবিটা এক মুক্তিযোদ্ধার, যে কারও হাতের চড় খেয়ে অভিমানে, নাকি অপমানে আত্মহত্যা করেছে ! তার পরে সপ্তাহ পার না হতেই আদিত্যের টানে চলে আসতে হল আমাদেরও, সীমান্ত বদল বা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন !

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:১৭

বিজন রয় বলেছেন: অনেক ভাল লাগল। +++++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.