![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মানুষ হিসেবে একটু ভাবুক টাইপের , যেসব ভাবনার সমাধান আগে হয়নি আর সামনেও হওয়ার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই ।
বিনয়
==========
ফেরদৌস
এক.
সেদিন কী যেন একটা মামুলি কাজে এক সরকারী অফিসে ঢুঁ মেরেছিলাম – ও হ্যা, জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধারের বিষয়ে সম্ভাব্য উপায় বাতলে নেয়ার জন্য। তাও তো সেটা হবে হয়তো বছর চার-পাঁচেক আগের ঘটনা। আমার নিজেরই চাচী পরিচয়পত্রটি খুইয়েছেন; তাই বাংলাদেশী বৈধ নাগরিক হয়েও উনি কোন দাপ্তরিক কাজ হতে উদ্ধার হতে পারছেন না কেঁদে কেটেও। তাছাড়া কাগজে কলমেও উনার দৌড় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তই। অফিস-আদালত ঘাটা উনার জন্য অসহায়ত্ব ছাড়া কিছুই নয়। তো উনার কিঞ্চিৎ উপকার করার মহান মনোবৃত্তি নিয়েই বেশ পরিপাটি হয়ে, ফুলবাবু সেজেই অফিসে গেলাম; যাতে সমাদর না করলেও কদাকার আচরণে অর্ধচন্দ্র জাতীয় কোন ব্যাপার-স্যাপার না ঘটে। কেননা সুদূর পারস্য হতে এ বাংলাদেশ-সবখানেই তো শেখ সাদীর মত জ্ঞানীগুণীরাও পোশাকের জোরেই অধিক সম্মান লাভ করেন, জ্ঞানের জোরে নয়। আর সেখানে আমি তো কেউকেটা, গেঁয়ো, অনার্স পড়ুয়া এক সাধারণ ছাত্রমশাই।
নির্বাচন কমিশনের উপজেলা অফিস বেশ ঘন-পল্লবিত একটা জায়গায়। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় হাতের ডানে দক্ষিণে উত্তরমুখী বারান্দা মাড়িয়ে ভেতরে গেলাম। ভেতরে বড় সাহেবের কক্ষের সামনে দরজায় কাঁচুমাচু হয়ে উঁকি দিলাম। বড় সাহেব ধূমপান করছেন তার স্প্রিং চেয়ারে বসে, পায়ের উপর পা তুলে। পা দুটোর আগা সামান্য দুলছে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে! দেখে মনে হচ্ছে বাংলা বিহার উড়িষ্যা – এই তিন প্রদেশের জমিদারীও উনার জন্য নেহায়েৎ কিঞ্চিত বৈ কিছু নয়; উনি আসলে দিল্লি সালতানাতের মোঘল সম্রাট হওয়ার যোগ্যই বেশী। এই অকাজের একবিংশ শতাব্দীতে জন্ম নেয়া- সম্ভবত ইশ্বরের সাথে তার চরম শত্রুতার দরণই হয়েছে! অবয়বে যা বুঝলাম, বয়স পয়তাল্লিশ পেরুনো, তীব্র কালো রঙের ত্বক হওয়ায় তার সিগারেটখোর ঠোটটি যে আরো কী অসম্ভব কালো তা আমার বোধগম্য হল না কোনভাবেই। তার কক্ষের ভেতরে আর কোন মানবপ্রাণী নেই আমি ছাড়া; সম্ভবত সেটি নির্বাচনের মৌসুম ছিলনা বলেই। মারাত্মক আদবের সাথে একটা সালাম দিয়ে বললাম,
- ভেতরে আসতে পারি, স্যার?
চশমার উপর দিয়ে বড় বড় চোখ দিয়ে তাকালেন। যেন আমি উনার পাওনাদার, হালখাতার কার্ড নিয়ে উনার কাছে এসেছি! খানিকটা কপাল ও নাক কুঁচকালেন। অস্ফুটস্বরে বললেন,
- ‘হুম’। বুঝলাম এটাই অনুমতি। টিপ টিপ পায়ে টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। বসতেও বললেন না; সম্ভবত অতিথিদের সারিতে পাঁচটা চেয়ার খালিই পড়ে ছিল। আমি অনুমান করলাম, জমায়েতবদ্ধ না হলে বোধহয় এসবে বসার অনুমতি মেলে না। গম্ভীর গলায় বললেন,
- কী করো? সর্বনাশ! ‘তুমি’ করে সম্বোধন! আরো থতমত খেলাম। ভয়ে ভয়েই উত্তর দিলাম,
- অনার্সে পড়ি।
- কোথায়?
- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
- কোন সাবজেক্ট?
- রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
মনে হল নির্বাচন কমিশন অফিসে না গিয়ে ভুল করে বুঝি থানায়ই এসে পড়লাম নাকি। প্রশ্ন চলতেই থাকল,
- কোন ইয়ার ?
- থার্ড ইয়ার।
- রেজাল্ট কেমন?
- মোটামুটি।
- কী সমস্যা?
- স্যার, আমার এক আত্মীয়ার জাতীয় পরিচয়পত্রটি হারিয়ে গেছে। এটি পুনরায় পেতে হলে কী করতে হবে?
- ঢাকায় যেতে হবে। এটুকু বলে সিগারেটে টান দিলেন, লম্বা করে ধোঁয়া ছাড়লেন। কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললাম,
- তারপর, স্যার?
- তেজগাঁও অফিসে যেতে হবে।
- সেখানে গিয়ে কী কী করতে হবে? আগে থেকে কিছু কি সাথে নিয়ে যেতে হবে?
এবার যেন বজ্রপাত হল তার মাথায়। বাজখাঁই কণ্ঠে চিৎকার করে ধমক দিয়ে বলে উঠল,
- সবকিছু কি আমি বকবক করে বলে দিব নাকি! বাইরে আমার কর্মচারী আর পিয়নদের জিজ্ঞেস করো গে!
বিড়ালের মত লেজ গুটিয়ে নিঃশব্দে বের হয়ে আসলাম। মনে মনে বললুম, আপনি নবাব হলে তো আপনার পিয়নরা জমিদারের চেয়ে কম কীসে! অফিসের দু তিন কিলোমিটারের মধ্যে ওদের কোন ছায়াই নেই। একজন সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার এমন মনোমুগ্ধকর বিনয় সম্বলিত ব্যবহার দেখে সেদিন যারপরনাই চোখে সরষে ফুল দেখেছিলাম! সম্ভবত উনাদের সিলেবাসে কোনদিনও ঐ ছোট্ট লাইনটা অন্তর্ভুক্ত ছিলই না – ‘ব্যবহারেই বংশের পরিচয়’ – যেটা আমরা মুড়ির টিন মার্কা বাসেও সহস্রবার পড়েছি এবং মনে-প্রাণেও গেঁথে নিয়েছি।
দুই.
আমার বাসায় যে হকারটা প্রতিদিন পত্রিকা দিয়ে যায় দরজার ফাঁক দিয়ে, উনি ধর্মে হিন্দু আর আমি মুসলিম। আমি উনাকে সম্বোধন করি ‘দাদা’ বলে আর উনি আমাকে ‘স্যার’ বলে। বহুবার জোরাজুরি করেছি যে আমাকেও আপনি ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করবেন। না, উনার ঐ একই কথা আপনারা শিক্ষিত মানুষ। ওটা ছাড়া অন্য কিছু ডাকতে পারবো না যে! একদিন সকালে ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেই উনিও পত্রিকা হাতে নিয়ে হাজির। আমার হাতে পত্রিকাটি দিতেই হাত ফসকে সেটি মেঝেতে পড়ে গেল! উনি হতদন্ত হয়ে ছোঁ মেরে সেটা উঠিয়ে নিয়ে বললেন, মাফ করবেন স্যার, আমি আসলে বুঝতে পারিনি। আমি বললাম,
- না, না, দাদা, এখানে মাফ চাইবার কী আছে! ওটা তো আমার হাত থেকেই পড়লো।
- না স্যার, আমিই মনে হয় আপনার হাতে ঠিকঠাক দেইনি।
- আরে ধুর, আপনি আপনি শুধু শুধু নিজেকে দোষ দিচ্ছেন দাদা! দিন তো ওটা, সমস্যা নেই।
তবুও অপরাধীর মত জড়তায় আড়ষ্ট হয়ে পত্রিকাটি ওনার পরণের প্যান্টের সাথে মুছিয়ে পুনরায় হাত দিয়ে আরো কয়েকবার মুছলেন। যখন নিশ্চিত হলেন ওতে কোন ধূলো-বালি নেই তখন সেটি আমার হাতে দিয়েই তড়িঘড়ি করে চলে গেলেন। আমি শুধু হা হয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ! একজন অল্পশিক্ষিত পত্রিকার হকার, কীই বা তিনি বোঝেন শিক্ষা-অশিক্ষা, সম্মান-অসম্মানের ভেদাভেদ, তবুও তিনিই কিনা আমার জীবনে বিনয়-পাঠের এক মহান শিক্ষাগুরু হয়ে থাকলেন – শুধু সেই কারণেই যে এই কিছু সময়ের জন্য আমার ‘হা’ বনে যাওয়া!
তিন.
সাধারণত আমার অফিসে সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের ক্ষেত্রে কখনোই একচোখা নীতি, তেলে মাথায় তেল দেয়া, ফকির-আমীরের মত ভেদাভেদ বা বৈষম্য করিনা আমি। পর্যায়ক্রমে সবাইকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টাই থাকে সবসময়। তবে উপরের চাপ অগ্রাহ্য করার শক্তি কখনোই আমাদের থাকে না। তখন আমাদের হাত দিয়ে উপরওয়ালারা দুর্বল আর কম প্রভাবশালী গ্রাহকদের ক্ষেত্রে বে-ইনসাফী করে থাকেন। একদিন দশ-বারো জনের একটা লাইনে মহিলা, আরেকটা দশ-বারোজনের লাইনে বৃদ্ধ বা জোয়ান সবধরনের লোকজন ঘেমে ঘেমে হয়রান। হঠাৎ পেছন থেকে এক আগন্তুক লাইনের লোকজনকে টপকে কাউন্টারের সামনে এসে বলছে,
- আমার চেকটা একটু আগে দেন তো! বললাম,
- কেন?
- আমার একটু বেশী তাড়া আছে! দেন না, কোন সমস্যা হবে না।
- লাইনে দাঁড়ানো লোকগুলোরও তো তাড়া এবং ক্লান্তি দুটোই আছে। শুধু আপনাকে আমার তাড়াতাড়ি দিতে হবে কেন? একটু কড়া গলাতেই বললাম, এভাবে কেন চেক দিচ্ছেন? লাইনে দাড়ান!
সাথে সাথে দেখি বায়ুর গতিতে ম্যানেজার এসে উনাকে বলছে,
- কিছু মনে করবেন না শফিক মামা! উনি আমাদের এখানে নতুন বদলী হয়ে এসেছে। আপনাকে চিনে নাইতো, তাই!
আমাকে ধমক দিয়ে ম্যানেজার বললেন,
- এখন থেকে মামা আসলেই আগে উনাকে সহযোগিতা করবেন। প্রতিমাসে বিদেশ থেকে উনার প্রায় এক কোটি থেকে অর্ধকোটি টাকা রেমিট্যান্স আসে! ভবিষ্যতে যেন ভুল না হয়।
আমি এবং লাইনে দাঁড়ানো সকল গ্রাহক হতবাক হয়ে কথাগুলো গিললাম। হয়তো উনি টাকার কুমির দেখে কোন গ্রাহকও কিছু বলার সাহস করলো না।
আমি তৎক্ষণাৎ উনার কাছে ক্ষমা চাইলাম। অনেক অনুনয়-বিনয় করে বললাম,
- আমার অজ্ঞতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন কিন্তু মামা। আপনি সোফায় গিয়ে আরাম করে বসুন। আমি কয়েক মিনিটের মধ্যে আপনার টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
একটা গরম বাতাস সম্ভবত ঘামে জবুথবু হওয়া অপেক্ষারত সকলের নাক দিয়ে বেরিয়ে আসলো। যাকে আমরা বলি দীর্ঘশ্বাস। মনে মনে আমি বললাম, এটাও এক প্রকারের বহু মূল্যবান মানব আচরণ, মূল্যবান মানুষের প্রতি, যার নাম সমীহ করা, বিনয় দেখানো। তবে সেটা শুধু বিনয়ের নামে নামকাওয়াস্তে মন-ভুলানো ঘৃণাভরা অভিনয়!
২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:১৭
ফেরদৌস প্রামানিক বলেছেন: ইয়েস স্যার !
২| ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৮:০২
বিজন রয় বলেছেন: অসাম লেখা।
+++++
২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:১৭
ফেরদৌস প্রামানিক বলেছেন: অনেক অনেক খুশি হলাম।
৩| ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৪২
নাসলিমা বলেছেন: খুব ভাল লাগল
২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:১৮
ফেরদৌস প্রামানিক বলেছেন: শুনে অনুপ্রাণিত হলাম।
৪| ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:২৪
প্রামানিক বলেছেন: পুরোটাই পড়লাম। ভাল লাগল।
২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:২০
ফেরদৌস প্রামানিক বলেছেন: প্রামানিক ভাই, খুশি হলাম। আপনার চমৎকার ভূত সিরিজের পরবর্তী গল্পগুলো কই ?
৫| ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:০৭
আরণ্যক রাখাল বলেছেন: বিনয়!!!!
অমাবস্যার চাঁদ
২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:২০
ফেরদৌস প্রামানিক বলেছেন: সেই সাথে ভাই ডুমুরেরও ফুল !
৬| ০১ লা মার্চ, ২০১৬ সকাল ১১:৪৩
অপর্ণা মম্ময় বলেছেন: এরকম ভাবে কত দীর্ঘশ্বাসই না আমরা ফেলি!
©somewhere in net ltd.
১|
২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৫:২০
কালনী নদী বলেছেন:
