নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কিছু কথা কিছু ব্যথা

ফেরদৌস প্রামানিক

আমি মানুষ হিসেবে একটু ভাবুক টাইপের , যেসব ভাবনার সমাধান আগে হয়নি আর সামনেও হওয়ার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই ।

ফেরদৌস প্রামানিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

কালো রাত! ( রি পোস্ট )

০২ রা মার্চ, ২০১৬ রাত ৯:২৩




সাজ-সকালে এমন বাঁধার মুখে পড়বে সে যে, তাও বা কীভাবে বুঝা যায়? সেই সকাল থেকে ঘরের বউ মিন মিন করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলছে। কাঁদতে কাঁদতে বলছে- ‘ওরে আল্লারে, তুমিই হামাক রক্ষা করো। তুমাক ছাড়া আর কাক হামি ডাকমু? ওগো, হামার কথা তুমি তো শুনিচ্ছ না! তুমি কি তোমার বেটিডার কথাও চিন্তে করবে না? দ্যাশত কখন যে গণ্ডগোল বাঁধে বলে কথা, তুমাগেরে কি এডেই আক্কেল জ্ঞান? হামার ভাত খাওয়া লাগবি না। তুমরা বাপ বেটা ঘরত থাকো!’ রমিজ মিয়া ভালো করেই জানে, এই মৌসুমে দিনাজপুরে না গেলে বাকী ছয়মাস তারা এই গাঁও গেরামত ভিক্ষেও পাবে না। খিদের চাইতে বড় হায়েনা বুঝি আর কিছুই নাই। প্যাটত খিদে থাকলে আপনও পর হয়ে যায় আর পর হয়ে যায় শত্রু। তাই বউয়ের কথার গোঁ ধরে কোন লাভ নেই-সে কথা রমিজ মিয়া ভালোভাবেই জানে। আর এটাও জানে শুধু তার একার কামাইয়ে সংসারে সচ্ছলতা আসবে না, তাই বাইশ বছরের জোয়ান বেটাডাকও সে কামলাই বানাছে যাতে সংসারে একটু স্বচ্ছলতা আসে! ভবিষ্যতে ও যাতে দুটো ভালো-মন্দ খ্যায়ে পরে বাঁচে! দ্যাশের অবস্থা খারাপ হলে তাদের কী? দ্যাশ কী তাদেরকে দুবেলা খ্যাতে দিবি? সে জানে, নেতা বঙ্গবন্ধু নাকি দ্যাশত পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের ডাক দিছে! দ্যাশত যুদ্ধ শুরু হলে তো তাদের কামলা-প্যাটও বন্ধ হয়ে যাবি! পাকিস্তানের সরকার ভালো না- এটা সে বুঝ। কিন্তু উপায়হীন গরীবের ঘরে এসব রাজনীতি দিয়ে কি প্যাট চলে? দ্যাশটা স্বাধীন হোক, এটাও রমিজ মিয়া চায় মনেপ্রাণেই। কেউ কেউ আবার বলে পাকিস্তান সরকারের সাথে কি যুদ্ধত টিকা যাবি? তার কেমন জানি মনে হয়-যাবি! রেডিওর মোদে (মধ্যে)নেতার ভাষণের সময় যত মানুষের আওয়াজ সে শুনছে, এত মানুষ যুদ্ধত নামলে ঠিকই যুদ্ধত জিতা যাবি! আর নেতা শেখ সাহেব তো ঠিক কথাই কছে, হামাগেরে দ্যাশ হামরাই চালামু, অন্যের মাতব্বরি করার দরকারডা কী? রমিজ মিয়া ভাবে, যুদ্ধ যদি বাঁধেই তখন তাড়াতাড়ি বাড়িত চলে আসমু! আর গরীব ম্যানষের সাথে তো ওদের আবার যুদ্ধ কীসের? ওরা যুদ্ধ করবে নেতাদের সাথে, শিক্ষিত ছেলেপেলের সাথে। কেমন যেন এক ধরণের নির্ভারতার মধ্যে রমিজ মিয়া তার তেরো বছরের মেয়ে ফুলকলিকে আর বউকে রেখে ছেলে কামালকে নিয়ে দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে চলে যায়। পেছন থেকে তার বউ মেয়ে অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে আসে, আঁচলে চোখের পানি মোছে। ওরা শেষবারের মত শুধু একবার পেছনে তাকায়-যেন মায়া মমতাই ওদের বড় বাঁধা। তাই তাকানোর মায়াটাকেও তারা সেভাবেই পাশ কাটিয়ে দূরের উদ্দেশ্যেই পা বাড়ায় জোরে জোরে।

একটা নিটোল সর্পিল, দু ধারে ঘাস জড়ানো পথ, যেন আকুল করে ডেকে নিয়ে যায় যেকোন আগন্তুককে এই ডুমুরকান্দি গ্রামে। ইংরেজির হিসাবে ১৯৭১ সালের ২৫মার্চ সেদিন।ফুলকান্দি উপজেলার বিভিন্ন রাস্তায় পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মিদের গাড়ির বহর বাড়তে থাকে। এসব গাড়ির কথা আসে কানে আসে করিমন বেওয়ার,সে বেশ ভয়ে ভয়েই তটস্থ থাকে। তার স্বামী সন্তানই বা দিনাজপুরে কেমন আছে? কী হত এসময় বাড়তি থাকলে? দুটো কম পয়সা কামাই করে শাক-ডাল দিয়ে খেলেই তো চলতো। ছেলেটা তো তার চোখের সামনেই থাকতো, থাকতো প্রাণের স্বামীটাও। এই অল্পবয়সী মেয়েটা নিয়ে একা একা তার সাহসে কি কুলোয়? ২৫শে মার্চের বিকেল। গাঁয়ে ছম ছম করা পরিবেশ নামে দুপুরের পর থেকেই। পরপর কয়েকটা আর্মির গাড়ি এসে থামে গ্রামের উত্তরপাড়ার দিককার প্রাইমেরী স্কুলটাতে! দরজার কপাট দুম দুম করে বন্ধ হয়ে সকলেরই যায় নিমিষেই! সন্ধ্যা নামতে গেলেও উত্তর পাড়ার পিছনের পাথারে কেউই তার বাঁধানো গরু-ছাগলও আনতে যায় না। গোঁফওয়ালা পাকিস্তানী আর্মিরা হুংকার ছাড়ে, আজিছে ইয়ে স্কুল বন্দ্‌ হ্যায়! কোয়ি হারামজাদা ইধারমে নেহি আনেকা! কথাগুলো গরম ভ্যাপসা বাতাসেই মিশে যায়। শুধু স্কুলের হেডমাস্টারের কানেই তা গরমকরা লোহার মত বিঁধে!

অন্যান্য দিনের মত আজ গাঁয়ে কেন জানি পাখির কলরবে সন্ধ্যা নামে না, যেন ওরা সব বোবা হয়ে গেছে অজানা কোন আশঙ্কায়। যেন এ এক জনমানবহীন , পশু-পাখিহীন, এক সুবিশাল মরুভূমি অথবা নির্বাক শুন্যপূরী! যেখানে মানুষ আছে, কিন্তু তাদের সাড়া নেই, চলাফেরা নেই, দোকানের মাচাংএ মানুষগুলোর আড্ডা নেই, ঘরের গিন্নিদের চুড়ি পাতিলের অদ্ভুত সুন্দর টুংটাং আওয়াজ নেই। মায়েদের মুখে ঘুমপাড়ানী গান নেই। টিনের চালে গাছের মরা কোন চিকন ডাল পড়লেই সে শব্দে ঘরের বাসিন্দাদের বুক ধক্‌ করে উঠে! সন্ধ্যা রাত্রি পার না হতেই রমিজ মিয়াঁর বাড়ির পেছন দিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শোনা যায়। বাঁচাও গো, কেরা কেরা আছ, বাঁচাও! ওরে আল্লারে বাঁচাও। নারীর সাথে পুরুষের আহাজারিও কানে আসে করিমন বেওয়ার। পেছনের দরজা দিয়ে উর্ধ্বাশ্বাসে কলের পাড়ের দিকে সে দৌড় দেয়। বেড়ার উপর দিয়ে উঁকি দিয়ে যা দেখে তাতে তার শরীর রক্তশূন্য হয়ে আসে! কয়েকটা বাড়িতে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে, বউ-ঝি আর বেটি ছলের কান্না যেন খোদার আরশ পর্যন্ত পৌছে যাচ্ছে। আগুনের লেলিহান শিখা যেন আসমানকে জাহান্নামের ছাদ বানায়ে ফেলেছে! এরপর হঠাৎ পরপর কয়েকটা গুলির শব্দ! কী হল? বেটাছলদের আওয়াজ যেন মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল! আর সঙ্গে সঙ্গে বেটিছল আর বউ-ঝিদের কান্নার আওয়াজ সপ্তম আসমানের দিকে ছুটতে লাগলো কর্ণভেদ করে! যতদূর বোঝা যায় মেয়েছলগুলোকে স্কুলের দিকেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, চুলের মুঠি ধরে, টেনে-হিচড়ে আর মাঝে মাঝে বন্দুকের বাট দিয়ে পেটাতে পেটাতে! সর্বনাশ! হিম হয়ে যাওয়া শরীরে কাঁপছে করিমন বেওয়া থরথর করে, চোখদিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার, আর আঁচলের কোণা ধরে ফুলকলিও অঝোরে কেঁদে চলেছে মায়ের সাথে। কী মনে করে সে মেয়েকে দ্রুতবেগে ঘরে চলে আসলো, দড়াম দড়াম করে জানালাগুলো বন্ধ করে দিল, দরজায় খিল লেগে শক্ত বাঁশ দিয়ে পেছন থেকে মাটির সাথে ঠেস দিল। তারপর চৌকির কোণায় বসে ঠকঠক করে মা মেয়ে কাঁপছে, কাঁদছে, আর আল্লাহকে ডেকেই চলেছে।

প্রায় আধাঘণ্টা পরে বুটের আওয়াজ যেন ভূমিকম্পের মত কাঁপুনি তুলে তাদের আঙ্গিনার দিকেই স্পষ্ট হতে লাগলো। হঠাৎ তাদের দরজায় লাথির শব্দ, ফুলকলি ভয়ে ‘ওমা’ বলে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে। করিমন সকল কাঁপুনি সত্ত্বেও মেয়ের মুখ হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। আর্মিরা বলে,- দরওয়াজা খোল্‌ মাগী, আজছে হামলোক তুমকো শরাব পিয়াবো। তারপর হাসির আওয়াজ আসে, হায়েনার মত। দরজা ভেঙ্গে ফেলে আর্মিরা! মা মেয়েকে খুঁজে পেতে বেশী বেগ পেতে হয় না জানোয়ারগুলোর। চিৎকার করে বলে, ইয়ে তো জওয়ানি লারকি হেয়, হামলোক বহুত খোশ হো! এদিকে দুটো অসহায় নারী ও বালিকার জীবন-মরণ বাঁচার আকুতি আর আওয়াজে আসমানই যেন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়, তবুও নেকড়েগুলোর মনে মায়া জন্মে না। চৌকির উপর এক ধাক্কাতেই ফেলে দেয় বালিকাকে! সাতফুট উচ্চতার কাছাকাছি দু তিনটে দানব শুভ্র, কোমল, পবিত্র আর পুষ্পতুল্য কিশোরীর উপরে শুরু করে নারকীয় অত্যাচার। আকাশ বাতাসে তার চিৎকার উল্কার মত ছুটতে থাকে। মেয়েটার প্রতিটা চিৎকার যেন একেকটা মৃত্যু! বরং এর চেয়ে তার মৃত্যুই শ্রেয় ছিল! এবং প্রায় ঘণ্টাখানেকের অসহনীয় আদিম হিংস্রতার কবলে পড়ে ফুলকলির মৃত্যু ঘটে! করিমন বেওয়া প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি পৌছে যায় সেই একইরকম পাশবিক ধংস্বযজ্ঞে! এরপরেও শুয়োরগুলো ক্ষান্ত হয় না। বাইরে এসে পুরো বাড়িটাতেই আগুন ধরিয়ে দেয়। গনগনে উন্মত্ত আগুনে অগণিত করিমন বেওয়া আর ফুলকলিরা তারাফুল হয়ে আকাশের দিকে ছুটতে থাকে, মুহূর্তেই ওরা হয়ে যায় আকাশে জ্বলতে থাকা একেকটা লুব্ধক!

কিয়ামতসম একটা মাস কেটে যায় ডুমুরকান্দি গ্রামে। পুড়ে পুড়ে খাঁ হয়ে যাওয়া প্রতিটা পাড়াই যেন একেকটা বধ্যভূমি, মহাশশ্মান! একদিন অমাবস্যার রাতে গাঁয়ের রাস্তায় তিনটে পাকিস্তানী আর্মি হনহন করে হেটে আসছে পশ্চিম পাড়া থেকে পূর্ব দিকে। মধ্যপাড়ার আগের রাস্তাটায় দুপাশে ঘন বাশঝাড়, গাবগাছে দিনের বেলাতেও অন্ধকারে ভূতুরে পরিবেশ মনে হয়। আর রাতের বেলা চাঁদ উঠলেও ঐ জায়গাটি দেখলে মনে হবে ওখানে অমাবস্যাই লেগে আছে! আর্মিরা হাটছে, সাথে বাটুল রাজাকারও আছে। ঐ জায়গাটিতে আসতেই অকস্মাৎ রাস্তার দু’ধার থেকে গোটাচারেক মূর্তি ওদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে! সবাই ওদের বন্দুকটাই আগে কব্জা করতে যায়। কিন্তু দুজন আগে রামদা দিয়ে দুজনের গর্দানে দুটো কোপ বসিয়ে দিলে ওদের ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে, কিন্তু ওরাও ততক্ষণে ট্রিগার চেপে দিয়েছে, ফলে ঐ দুটো মানবমূর্তিও লুটিয়ে পড়ে মাটিতে! বাটুল রাজাকার বাঁশঝাড়ের মধ্য দিয়েই উর্ধাশ্বাসে ছুটতে থাকে। বাকী দুজন মানব খুব সহজেই তৃতীয় আর্মির বন্দুক নিজেদের কব্জায় নিয়ে ফেলে। পেছন থেকে একজন এক কোপে মাথাটা দেহ থেকে আলাদা করে ফেলে। এরপর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দেহটার উপরেই উন্মাদের মত দুজন এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকে! কয়েক মুহূর্তের জন্য ওরা যেন মানব কসাই বনে যায়! হঠাৎ স্কুলটার দিক থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। একজন তখন আরেকজনকে বলে, বাপরে, তুই চলে যা, আমি দেখছি। কিন্তু সে বলে, আব্বা তুমিই যাও, হামাক নিয়ে চিন্তা করো না! কিন্তু বাবা বলে, নারে বাপ, তুক যে বাচতেই হবে!তুই আগে যা বাপ্‌! নদীর দিকে যা! ছেলেটা নদীর দিকে দৌড় দেয়, যতটা সম্ভব শক্তি দিয়ে, আর বাবাটা পেছন দিকে। শেষবারের মত হাঁক ছাড়ে বাবা, বাপ্‌, তুক কিন্তু বাচতেই হবে। হামাগেরে দ্যাশটার জন্যেই! বাপটা হাঁক ছাড়ে যেন আর্মিরা সে আওয়াজ শুনেই তার পিছেই ধাওয়া করে, ছেলের পিছে পিছে যাতে না যায়!

দুই.
=====
মাঝখানে চল্লিশটা বছর কেটে যায়, শামুকের মত গড়িয়ে গড়িয়ে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে স্বাধীন কিছু মানুষকে নিয়ে। এই দীর্ঘ সময় পরে ডুমুরকান্দি গ্রামে সবকিছু আবার নতুন করে স্থায়ী হয়ে উঠেছে অনেক আগেই। এখন অন্য মানুষ, অন্য ঘর অথবা অন্যরকম কিছু অনুভূতিও। পূর্ব পাড়ার পাথারের প্রায় এক প্রান্তের শেষে, কিছুদিন হল বসতি গড়েছে মোকছেদ মিয়া আর তার সদ্য বিবাহিত ছেলে নজিবর। ওদিকটা ফাঁকা দেখে অনেকেই নিষেধ করেছিল বাড়ি না করার। কিন্তু মোকছেদ মিয়া নিরুপায়। অন্য কোথাও তার মাথা গোজার মত একতিল পরিমাণও জমি নেই। ভোরবেলা নজিবর চৌকিতে বসে বউয়ের গাল টিপে বলে, বউরে, তুক ছ্যাড়ে হামার মন দূরে যে য্যাতেই চায় না। ওর বউ মুচকি হেসে বলে,
- তাহলে যাও কেন? আমি তো চাইই যে তুমি যায়ো না। তুমি চলে গ্যালে সবই কেংকা জানি আরো ফাঁকা ফাঁকা লাগে এই পাথারের মধ্যে।
- পাথার কোথায় রে বউ, এখান তো দু কদম হাটলেই তো ছায়েম চাচার বাড়ি।
- সে তুমি চাই যাই বলো, চিৎকার দিয়ে ডাকলেও তো কারো কানে পৌছায় না, এরই নাম কি তোমার দু কদম?
- দেখিস ছয়মাসের মোদে (মধ্যে) তো আকরাম চাচার বাড়ি করে ফেলবে ঐ সামনের জমিতে!
- তবুও তোমরা দুডে পুরুষ মানুষ ঘরত না থ্যাকলে কত ভয় অ্যাসে যে ভর করে তা তুমি বুঝবে কেংকা করে? সেডে তো হামরা শাশুরি-বউ বুঝি!
- বউরে, হামার মনেত তো ভয় লাগেই। তুরা দুডে মানুষ, কখন যে কী হয়? কিন্তু পেটের খাবার যোগাড় করতে হলে তো কাম করবের যাওয়াই লাগবি! তাছাড়া তুর প্যাটত হামার ছল আসিচ্চে সামনে! ওর জন্য দুডে পয়সা ব্যবস্থা করে রাখা লাগবি না? বউ, কয় মাস রে?
- যাও!বলে লজ্জায় গলিয়ে পড়ে নজিবরের বউ। শাড়ির আঁচলে কামড় দিয়ে বলে, চার মাস!
- তাই নাকি! তুই একটু সাবধানেই কাম-ক্যাজ করিস বউ!নজিবর দেখে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষটি আবারো কাঁদো কাঁদো হয়ে যাচ্ছে!
- নজিবর বেশ আদুরে ও ধরে আসা গলায় বলে, কাঁদিস্‌ না বউ! মোকছেদ আর ওর ছেলে নজিবর দুটো বাইং, চারটা কাঁচি, কয়েকটা দড়ি আর ব্যাগে কিছু কাপড়-চোপড় পুটলি বেধে চলে যায় দূরের দেশে। দিন শেষে এক বিছানায় শুয়ে পড়ে শাশুড়ি-বউ। মৃদু স্বরে ঝি ঝি পোকার ডাক আসে; সেই সাথে হঠাৎ দু একটা হুতোম পেঁচার হাঁকও আসে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ থাকে না ওদের। খাটুনির শরীর। তাই ঘুমই ওদের বড় আপন সই! ওরা অঢেল ঘুমে হারিয়ে যায় নীল পরীর দেশে!

স্কুলের পাশে একটা কোনরকম ভাঙ্গা টিনের ঘরে গাজার আসর বসে প্রতিরাতে। শেষ হয় রাত বারোটা থেকে একটার পরে। তখন রাত প্রায় বারোটা ছুই ছুই। আসরে কেউ একজন বলে, বন্ধু, তুই বলতো, শালার কি মাল রে! যেমন পূর্ব তেমন তার পশ্চিম! আহ! কলজে জ্বলে যায় রে দোস্ত মনে হলে! আরেকজন বলে উঠে, শালা, তুই চেয়ারম্যানের বেটা, তুই চাইলে সবই সম্ভব! এখানে বসে ঠোট কামড়িয়ে, ইশ্‌ ইশ্‌ করে কোন লাভ আছে? মুহুর্তেই ওরা একে অপরের দিকে তাকায়, একটা কেমন ধরণের পাশবিক হাসি দেয় সবাই। মুহূর্তেই জানোয়ার, হায়েনা কিংবা নেকড়ের মত জ্বল জ্বল করে উঠে ওদের চোখগুলো। একজন বলে উঠে, এই, আরেক স্টিক করে গাঁজা ভর্‌ তো, নেশা হলে মাল খাওয়ার মজাই আলাদা! ওরা কথা বলতে থাকে এলোমেলো ভাবে, শালী, এত সুন্দর হয়ে জান্মাছ ক্যান? তাও আবার কামলার ঘরে, আবার বিয়াও হছে কামলার ঘরেই! হামাগেরে মনডাও যে তোমার জন্য পুড়ে, তোমার আগুনে হামরাও ছাই হয়ে যাবার চাই! গাঁজার ধোঁয়া উঠে কুণ্ডলী পেকে। অশ্লীল কথা আর গালি ভেসে বেড়ায় সে ধোঁয়ার সাথে সাথে। খানিক পরেই নেশায় টালমাটাল হয়ে সবাই হাটতে থাকে পূর্ব পাড়ার পাথারটার দিকেই। ফাঁকা জায়গার ঘরটার সামনে গিয়ে পাঁচজনের নেশাগ্রস্ত আদিম শক্তির কাছে গরীবের অসহায় দরজাটা মুহূর্তেই হার মানে খুব কম সময়ের মধ্যেই।

কিছু বুঝে উঠার আগেই শাশুড়ির মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে মুখ বেঁধে ফেলে ওরা, হাত পা বেঁধে ঘরের সামনের এক শক্ত খুটির সাথে বেঁধে রাখে। পাঁচ পাঁচটা নেকড়ের হায়েনার জ্বলজ্বলে চোখ আর লালা ঝরা জিব দেখে বউটার কলিজা শুকিয়ে যায়। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে। কিন্তু পাথার পেরিয়ে সে চিৎকার হয়ে যায় অপস্রিয়মান হাহাকার! দ্যাখ, আল্লাহর দুহাই ল্যাগে, হামাক ছ্যাড়ে দাও; আল্লাও কিন্তু সহ্য করবে না! হামার প্যাটত চার মাসের ছল। ওক্‌ তোমরা ম্যারে ফ্যালো না, নষ্ট করো না! তুমাগেরে মাও বোন নাই? তুমাগেরে প্যায়ত পরিচ্চি! হামাক তোমরা নষ্ট করো না! হায়নাগুলো উচ্চস্বরে দাঁত বের করে হাসে। তাদের কানে কোন কথাই সামান্য মায়া জন্মায় না। বাধ্য হয়ে বউটা তাকের উপর রাখা কোরানটা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয়! বুকের মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরে। পৃথিবীতে কোন মাবুষের কাছে ঠাই না পেয়ে সে আল্লাকেই ডাকতে থাকে! নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে, ডাকে দূরের বাড়ির নেশাগ্রস্তের মত ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলিকে! চেয়ারম্যানের জানোয়ার ছেলেই পা বাড়ায় ওর দিকে। কোরানটা ছিনিয়ে নিয়ে দূরে ফেলে দেয়। শুরু করে পাঁচজন মিলে এক মহা কিয়ামত, মহা ধংস্বলীলা! পাঁচটা হায়েনা খুবলে খুবলে খায় একটা মানব ভ্রুণের আধার হওয়া মা’কে, মায়ের সাথে তাকেও হতে হয় খুন! এরপরে সেই অচেতন শরীরে হারিকেনের তেল ঢেলে আগুন জ্বেলে দেয় তাতে!পশু পশুই, তার পাশবিকতার শেষটাও সে দেখাতে কুণ্ঠাবোধ করে না কখনোই। সে আগুনের শিখা হয়তো খোদার আরশ পর্যন্ত পৌছে যায়, অথবা যায় কিনা-জানা যায় না! হায়েনাগুলো লেজ নাড়তে নাড়তে পালায় দূরে কোথাও। কিন্তু ওরা জানে না, কালো রাত আরেকটা আসবে, গাবগাছ আর বাঁশঝাড়ের মাঝদিয়ে আরেকটা কালো ইতিহাস ফিরে আসবে মোকছেদ আর নজিবরের হাত ধরে! সেদিনও কুৎসিত অন্ধকারে ছেয়ে থাকবে চারিদিক! রাম দায়ের কোপ পড়বে, মস্তক দ্বিখণ্ডিত হবে, ফিনকি দিয়ে ছুটবে তাজা রক্ত! মোকছেদ ঘর্মাক্ত শরীরে হাঁপাতে হাঁপাতে নজিবরকে বলবে, বাপ্‌ আমার, নদীর দিকে যা, দ্যাখে শুনে যাস, এটা কিন্তু ঘুটঘুটে কালো রাত!

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা মার্চ, ২০১৬ রাত ৯:২৯

মাসুদ মাহামুদ বলেছেন: ধন্যবাদ।
শুভ রাত্রী

২| ০২ রা মার্চ, ২০১৬ রাত ৯:৫২

কল্লোল পথিক বলেছেন: সুন্দর গল্প।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.