নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পঞ্চম প্রতিবিম্ব

প্রতিদিন খাবার সময় যখন টেবিলে বসি, সামনের চার আয়নায় আমার চারজনকে দেখি। একেকজন একেক স্বভাবের। তাদের ভেতর থেকে একেক সময় একেকজনকে বেছে নেই। চার প্রতিবিম্বের সামনে আমি হই, পঞ্চম প্রতিবিম্ব...

পঞ্চম প্রতিবিম্ব › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটা গান ও ফেলে আসা কিছু স্মৃতি

১৯ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ৯:২৪





আমি কখনওই ভালো স্মৃতি রোমান্থন করতে পারি না। পারি না বলতে এইরকম লিখে লিখে করতে পারি না। আমার স্মৃতিগুলো বেশীরভাগ সময়ে ঠিক তখনই আসে, যখন মন মেজাজ খুব খারাপ করে এই দুনিয়ার সবাইকে তাদের অধিকার মত একটু একটু করে দোষ বন্টন করতে থাকি তখন।
আমি খুব গান শুনি। আর তাই আমার এই পিচ্চি জীবনে যতকিছু স্মরণীয় হয়ে আছে, তার সব কিছুই কিছু কিছু গানের কলিতে আটকা পড়ে গেছে। ওই গান গুলা যখনই শুনি, তখনই মেমোরি ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যায়- আরি, অমুক দিন তো ওই ঘটনাটা ঘটছিলো!!!
আমার খুব সোনালী ছেলেবেলা না থাকলেও যতটুকু পেয়েছি তার জন্য আমার পরিবার আর উপরওয়ালার কাছে হাজার শুকরিয়া। হয়ত এখনকার কোনো ছেলেমেয়েরা এমন একটা শৈশব কল্পনাও করতে পারে না। যাই হোক, যা করতে চাচ্ছিলাম তাই করি।
একটা গান নিয়ে কিছু কথা বলি।

আমি তখন খুব ছোট, স্কুলে ভর্তি হই নি। আমরা দাদা বাড়িতে থাকি। আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। একগাদা বাচ্চা পুলাপানে পুরো বাড়িত ভর্তি। কোমরে কোনোরকমে হাফ প্যান্ট পরেই আমরা ঘর থেকে দৌড় দিয়ে বের হয়ে যেতাম। সারাদিন হইচই, আগান বাগানে ঘুরে; লাটিম, ছোঁয়াছুঁয়ি, (বিশেষ ক্ষেত্রে কানামাছি), গাছের ডাল দিয়ে এখানে ওখানে মাটি খোঁচাখুঁচি খেলে একরকম মাটিকাটা কিষেণ (আমাদের অঞ্চলে মজুরদের কিষেণ বলে ডাকা হয়) হয়ে দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরতাম। এবং আম্মুর অমানবিক(!) নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচবার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে চলে যেতাম পুকুরে। মনে ক্ষীণ আশা যদি আম্মু এসে দেখে যে আগেই গোসল করে ফেলেছি, তাহলে ওইদিনের মত আর সাবান দিয়ে গোসল করা লাগবে না। কিন্তু বিধি বাম। বেশীরভাগ দিনই ধরা পড়ে যেতাম। আর সাবান দিয়ে পরিষ্কার করানোর নামে দেওয়া হতো অমানবিক নির্যাতন। আমি বুঝে উঠতে পারতাম না, প্রতিদিন সাবান নিয়ে কেন গোসল করতে হবে। প্রতিদিন সাবান দিয়ে আমাকে ডলা হতো, আর এই জগৎ সংসারের নিষ্ঠুরতায় চিল্লায় চিল্লায় কাঁদতাম।
যাইহোক, গান নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অনেক বক বক করে ফেলেছি। আসল কথায় আসি। আমার দাদাজান খুবই ধর্মভীরু মানুষ ছিলেন। তাই আমাদের পারিবারিক অবস্থা সেই সময়ে অত্যন্ত ভালো থাকা সত্ত্বেও আমাদের পুরো বাড়িতে একটা টিভিসেট বা রেডিও ছিলো না। গান জিনিসটা আমার মাথায় পাকাপাকি ভাবে ঢুকলো ভাইয়ার স্কুলে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে গিয়ে। স্কুলে গিয়ে দেখলাম আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা কুয়াশার মধ্যে শীতে কাঁপতে কাঁপতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর মাইকে অল্প সাউন্ডে বাঁজতেছে,

“সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে,
এক মধ্যবয়সী নারী এখনও রয়েছে হাত বাড়িয়ে..
খোকা ফিরবে, ঘরে ফিরবে, ঘরে ফিরবে… নাকি ফিরবে না ”

আমি গানের মাথামুন্ডু কিছুই না বুঝে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, খোকা কই গেছে ভাইয়া? ভাইয়াও আমার মত খানিকক্ষণ মাথা চুলকে বিজ্ঞেরমত উত্তর দিলো, আরে বুঝলি না? ওই মহিলার একটা ছোট ছেলে আছে তোর মত। সে কই যেন খেলতে গেছে। তারপর ছেলেধরা এসে নিয়ে গেছে। তাই ঘরে নাই। একা একা খেলতে বের হলে এইরকম ধরে নিয়ে যায়।
ছেলেধরার জিনিসটা এম্নিতেই তখন আমাদের পুলাপান সমাজে অত্যন্ত ভীতিকর জিনিস। তাদের নিয়ে নানা ধরনের ভয়ংকর তথ্য আমরা জেনেছি পাড়ার বড় ভাইদের কাছ থেকে। ছেলেধরারা সুন্দর করে ডাকে, তাদের হাতে থাকে একটা বস্তা। যদি কোনো বাচ্চা তাদের সাথে কথা বলে, অম্নি তারা এসে সেই বাচ্চাটাকে বস্তায় পুরে নিয়ে যায়। আর পরে ক্লিনিকে বিক্রি করে দেয়। এম্নিতেই ছেলেধরার ভয়, এখন গান আর ভাইয়ার ব্যাখ্যা শুনে আমার মাথার মধ্যে দৃশ্যটা পুরোপুরিভাবে ঢুকে গেলো। ‘কুয়াশা ঘেরা একটা রেললাইন, সেখানে একজন মহিলা ময়লা একটা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। তার খোকা কোথাও খেলতে গিয়ে হারিয়ে গেছে এখনও ফিরে আসে নি। তাকে একজন ছেলেধরা একটা বস্তায় করে নিয়ে চলে গেছে। তারপর ক্লিনিকে বেঁচে দিয়েছে।’

আমার কি একটা হলো এরপর থেকে। আমি আর একা একা খেলতে যাই না। ভয় করে যদি হারিয়ে যাই, আমার আম্মুও যদি ওই মহিলার মত পাগল হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। আম্মু ব্যপারটা খেয়াল করলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। আমি তাকে আমার ভয়ের কথা খুলে বললাম। আম্মু হাসতে হাসতে বললো, ‘আরে বোকা ছেলে। ওই মহিলার খোকা খেলতে গিয়ে হারিয়ে যায় নি। মুক্তিযুদ্ধে গেছিলো, সেখান থেকে হারিয়ে গেছে। তাই আর ফিরে আসে নি। তবে সাবধান অপরিচিত কারো দেওয়া কিছু খাবি না। কারো সাথে কথাও বলবি না। তাহলে কিন্তু সত্যি সত্যি হারিয়ে যাবি। আর আমি পাগলী হয়ে রাস্তায় দাঁড়ায় থাকব।’ মুক্তিযুদ্ধ কি জিনিস আমি বুঝলাম না। তবে ধরে নিলাম সেটা করার জন্য বড় হওয়া লাগে। আর খোকারা যদি মুক্তিযুদ্ধে যায় তাহলে আর ফিরে আসে না। আমি আম্মুকে বললাম, আম্মু আমি কখনও মুক্তিযুদ্ধে যাব না। যেখানেই যাব সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে আসব। তোমাকে কখনও পাগল হয়ে রাস্তায় দাড়াতে হবে না। আম্মু কি বুঝেছিলো কে জানে। খানিকটা হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, ‘আমার ছোট ছেলেটা এত বোকা হলো কিভাবে!!’

যতদূর মনে পড়ে আমি কখনও অপরিচিত কারো সাথে কথা বলি নি তারপর থেকে। আর যদি বস্তা হাতে অপরিচিত কেউ ডাকতো, আমি দৌড় দিয়ে বাড়ি চলে আসতাম আর আম্মুকে বলতাম একটা ছেলেধরা আমাকে ধরে নিয়ে যেত আরেকটু হলেই। আম্মু হাসতো আর বলতো আমার বোকা ছেলে।
যাই হোক, গানটা আমার মধ্যে বেশ প্রভাব ফেলেছিলো। আমি প্রায়ই গুন গুন করে গাইতে চেষ্টা করতাম, যে লাইন ভুলে যেতাম সেখানে হুউউ হু হুউউউ করে চালিয়ে দিতাম। এখনও গানটা শুনলেই আমার চোখে সামনে কুয়াশার মধ্যে একটা মহিলাকে রেললাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। সে অপেক্ষায় আছে কখন তার খোকা ঘরে ফিরবে… আর আম্মুর কথাগুলো মনে পড়ে। আমি পুরো ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যাই। আর ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো ভাসতে থাকে।

আব্বু আম্মুর থেকে এখন বহু দূরে আমি। না, মুক্তিযুদ্ধে যাই নি, জীবন যুদ্ধে এসেছি। এখানেও হারিয়ে যাবার ভয় আছে, হেরে যাবার ভয় আছে। আব্বু আম্মু পাগলের মত অপেক্ষা করে আছে সন্তানের নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য- সেটাকে অপূর্ণ করে ফেলব কিনা তার ভয় আছে। কতটুকু কি পারব জানি না তবে গানের খোকার মত হারিয়ে যাওয়া চলবে না, ছেলেবেলায় কথা দিয়েছিলাম ফিরে যাব…

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১১:২১

চাঁদগাজী বলেছেন:


সাদামাটা

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.