নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

াহো

াহো › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশ গণপরিষদ [১০ এপ্রিল, ১৯৭২] ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার যে ঘোষণা করেছিলেন এবং যে ঘোষণা মুজিব নগর থেকে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়েছিল তার সঙ্গে এই গণপরিষদ একাত্মতা প্রকাশ করছে।বাংলাদেশ গণপরিষদ [১০ এপ্রিল, ১৯৭২] :

২৯ শে মে, ২০১০ বিকাল ৩:১০

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কীয় প্রস্তাব

http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=3036

বাংলাদেশ গণপরিষদ [১০ এপ্রিল, ১৯৭২]



বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে বাংলাদেশের গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং ঐ দিনই সংসদে সে প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বাংলাদেশ গণপরিষদে গৃহীত এই ঐতিহাসিক প্রস্তাবটি সংসদের লিখিত কার্যবিবরণী থেকে ভাষা, বানান, বাক্যরীতি অবিকল রেখে সাপ্তাহিক-এর পাঠকদের জন্য ছাপানো হলো

সংগ্রহ ও গ্রন্থনা : শুভ কিবরিয়া



জনাব স্পীকার : আমি একটা কথা বলছি। আপনাদের কথা হচ্ছে যে, এর আগে আপনারা অনেকে অভিযোগ করেছেন যে, মাইক নাই। আমি খবর নিয়ে জানলাম, প্রত্যেকের মাইকই ঠিক আছে। যিনি এই সভায় যখন কথা বলবার অধিকার পাবেন, তখন যে অপারেটর আছেন, তিনি মাইক দেবেন। (এই পর্যায়ে একই সঙ্গে কয়েক জন সদস্য কথা বলার জন্য দাঁড়ান) এক একজন করে দাঁড়ান। আপনারা বসুন। আপনারা গোলমাল করলে আমি শুনতে পাব না।



বিধি সংক্রান্ত প্রশ্ন

স্পীকারকে সম্মান প্রদর্শন সম্পর্কে

জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর : আমি বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করে বলতে চাই যে, মাননীয় স্পীকার যখন সভায় ঢুকবেন, তখন সেই মর্মে একটা ঘোষণা হওয়া প্রয়োজন। তখন মাননীয় সদস্যদের এবং দর্শকদের দাঁড়িয়ে মাননীয় স্পীকারকে সম্মান প্রদর্শন করার রেওয়াজ আছে।

জনাব স্পীকার : অবশ্য এ রেওয়াজ আছে, ঘোষণাও করা হয়েছে। মেম্বাররা দাঁড়াবেন, কি দাঁড়াবেন না সেটা তাঁদের ইচ্ছা। (এই পর্যায়ে জনাব প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা করার জন্য দাঁড়ান এবং কয়েকজন সদস্যও কথা বলার জন্য উঠে দাঁড়ান) আপনারা একটা কথা জেনে রাখবেন, যখন আমাদের পরিষদ নেতা কথা বলার জন্য দাঁড়াবেন, তখন কেউ কথা বলবেন না। এটা পার্লামেন্টারি কনভেনশন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : যে বৈধতার প্রশ্ন সদস্য সাহেব তুলেছেন, এটা ঠিক। পার্লামেন্টারি কনভেনশন অনুসারে যখন স্পীকার হাউসে আসবেন, তখন ঘোষণা করা দরকার। ঘোষণার পরে স্পীকার আসবেন ও সদস্যরা দাঁড়াবেন। আমি আশা করি ভবিষ্যতে এটা ঘোষণা করা হবে।



শোক প্রস্তাব

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : স্পীকার সাহেবের অনুমতি নিয়ে আমি একটা শোক প্রস্তাব উত্থাপন করতে চাই। জনাব স্পীকার সাহেব, “বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে বাংলার যে লক্ষ লক্ষ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন তাঁদের মহান আত্মার প্রতি এই পরিষদ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে যে সমস্ত মাননীয় পরিষদ সদস্য তাদের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে উজ্জীবিত করেছেন, সেই সমস্ত স্মরণীয় ও বরণীয় বীর সহকর্মী সদস্যদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এই পরিষদ শোক জ্ঞাপন করছে। মাননীয় পরিষদ সদস্য জনাব আমিনুদ্দিন, জনাব আমজাদ হোসেন, জনাব মসিউর রহমান, জনাব নাজমুল হক সরকার, জনাব আব্দুল হক, ডাক্তার জিকরুল হক, জনাব সৈয়দ আনোয়ার আলী ও জনাব এ কে সরদার মুক্তি সংগ্রাম চলাকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। তারা ছাড়াও গত নির্বাচনের পর পরই জনাব আহ্মদ রফিক গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির শিকারে পরিণত হন এবং চট্টগ্রামের বীর সন্তান ও আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জনাব এম এ আজিজ ইন্তেকাল করেন। এই সমস্ত সংগ্রামী নেতার বিদেহী আত্মার সঙ্গে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শহীদ ভাই-বোনেরা, যারা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আত্মবলি দিয়েছেন ও ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের শিকার হয়েছেন তাদের জন্য এই পরিষদ তাদের আত্মদানের গৌরবময় স্মৃতিকে চিরকাল স্মরণ রাখবে এবং এই পরিষদকে তাদের আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম চিরকাল অনুপ্রাণিত করবে। এই পরিষদ তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।”

আমি আশা করি সকলে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করবেন। জনাব স্পীকার সাহেব, আপনি এক মিনিট তাদের আত্মার জন্য মাগফেরাত কামনা করবেন।

(সদস্যরা দাঁড়িয়ে মোনাজাত করবেন এবং জনাব স্পীকার মোনাজাত পরিচালনা করেন।)



স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কীয় প্রস্তাব

জনাব স্পীকার : আমার কাছে একটা প্রস্তাব দেখছি। স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কীয় প্রস্তাব। সেটা উত্থাপন করবেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব। আমি প্রস্তাবটি উত্থাপন করবার অনুমতি দিচ্ছি।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম : মাননীয় স্পীকার সাহেব, আপনার অনুমতি নিয়ে পরিষদে আমি একটা প্রস্তাব গ্রহণের জন্য পেশ করছি :

“ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের যে বিপ্লবী জনতা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, প্রতিরক্ষা বিভাগের বাঙ্গালীরা, সাবেক ইপিআর ও পুলিশ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন, আজকের দিনে বাংলাদেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত বাংলাদেশ গণপরিষদ সশ্রদ্ধচিত্তে তাদের স্মরণ করছে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার যে ঘোষণা করেছিলেন এবং যে ঘোষণা মুজিব নগর থেকে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়েছিল তার সঙ্গে এই গণপরিষদ একাত্মতা প্রকাশ করছে।


স্বাধীনতা সনদের মাধ্যমে যে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল আজ সে সনদের সঙ্গেও এই পরিষদ একাত্মতা ঘোষণা করছে।

এক্ষণে এই পরিষদ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার সেই সব মূর্তপ্রতীক ও আদর্শ, তথা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করছে।”

জনাব মোঃ আজিজুর রহমান : এই প্রস্তাবটিতে আমার কিছু সংশোধনী আছে। সেই সংশোধনী হচ্ছে এখানে ‘ছাত্র, যুবক’ বলা হয়েছে; তার সঙ্গে বুদ্ধিজীবীর কথা জুড়ে দেয়া হোক।

মিসেস নূর জাহান মুরশেদ : মহিলাদের কথা এতে নেই।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম : সংশোধনীটি গ্রহণ করলাম।

ডাঃ আসহাব-উল হক : আনসার ও মোজাহেদদের নাম দেয়া হোক। মোজাহেদ বাহিনীতে থেকে বহু আনসার সংগ্রাম করেছেন, বহু আনসার মারা গেছেন। তাদের নাম স্পষ্টাক্ষরে দেখতে চাই।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম : প্রস্তাবে বুদ্ধিজীবী এবং মহিলা, মোজাহেদ এবং আনসার, যাঁদের আত্মত্যাগ বাংলাদেশের সংগ্রাম ও স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়েছে, তাঁদের নামভুক্তির জন্য যে সংশোধনী দেয়া হয়েছে, তা গ্রহণ করলাম।

জনাব স্পীকার : অর্ডার, অর্ডার, একজনে বলুন।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম : এক কথায়, শিক্ষক, সাহিত্যিক সবাইকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়।

এই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের যে সমস্ত রাজনৈতিককর্মী সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেছিলেন, তাদের নামও জুড়ে দেয়ার প্রস্তাব করছি।

মিসেস নূর জাহান মুরশেদ : মাননীয় সভাপতি সাহেব, গত ২৬ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, সে সম্বন্ধে আমি জানতে চাই।

জনাব স্পীকার : আমি বলছি প্রস্তাবের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি বসুন, আপনারা বসুন।

জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী : দেখা যাক প্রস্তাবটির পক্ষে কে আছেন, বিপক্ষে কে আছেন, তারপর অন্য কথা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : এটা একটা শোক প্রস্তাব। যেটা বাদ পড়ে, মাননীয় সদস্যের বা সদস্যার বলার অধিকার রয়েছে যে, সেটা জুড়ে দেয়া হোক। এই পরিপ্রেক্ষিতে যে ঘোষণা করা হয়েছিল, এটার সঙ্গে তার কোনো মিল আছে বলে মনে করি না। যদি আপনি সত্যই কিছু দেখতে চান, নিশ্চয়, আমি অনুরোধ করছি, দেখতে পারেন। আর আমাদের বোঝা উচিত আমরা গণপরিষদের সদস্য। জনাব স্পীকার সাহেব, আপনাকে কার্যপ্রণালী বিধি নিয়ে চলতে হবে। সদস্যরা এটা বুঝবার চেষ্টা করবেন।

মিসেস সাজেদা চৌধুরী : আমি যে প্রস্তাব দিচ্ছি, সেই প্রস্তাব গ্রহণ করুন। এখানে ছাত্রের কথা আছে, ছাত্রীর কথাও বলা হোক।

জেনারেল মহম্মদ আতাউল গণী ওসমানী : জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের এই সার্বভৌম পরিষদের নিকট আমার আবেদনÑ যদি স্বতন্ত্রভাবে বিভিন্ন বাহিনীর উল্লেখ করা হয়, তাহলে উচিত হবে যে, আমরা নিয়মিত বাহিনী এবং নিয়মিত বাহিনীর মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উল্লেখ করি এবং সাবেক ই পি আর (বর্তমানে বাংলাদেশ রাইফেলস্), সশস্ত্র পুলিশ এবং গণবাহিনীর বীর যুবকদের উল্লেখ করি। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উল্লেখ করা হয় নাই। আমার আবেদন তাদের কথা উল্লেখ করা উচিত এবং করা হোক। আশা করি এই সংশোধনী গ্রহণযোগ্য হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জেনারেল সাহেবের বুঝা উচিত প্রস্তাবে সামরিক বাহিনীর নাম নেওয়া হয়েছে। তখন ই পি আর ছাড়া অন্য নাম আমাদের জানা ছিল না। সামরিক বাহিনীর কথা বলা হয়েছে। তখন এয়ার ফোর্স ছিল, নেভী ছিল, সবাই সামরিক বাহিনীতে ছিল। সামরিক বাহিনীর বাঙ্গালীদের কথা বলেছেন জেনারেল সাহেব। আশা করি, তা গ্রহণ করবেন। আর একবার পড়ে পরিষ্কার করে শুনানো হবে।

জনৈক সদস্য : মুক্তি বাহিনীর কথাও উল্লেখ করা হোক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : আলাদা প্রস্তাব আসবে। আপনারা শান্ত হন। যারা সাহায্য করেছেন, সহানুভূতি দেখিয়েছেন, তাদের নামও প্রস্তাবে আসবে।

জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী : গণপরিষদ সদস্যদের সম্পর্কে যে শোক প্রস্তাব আনা হয়েছে, তাতে সবাই পড়ে। জনাব মাহবুব আলীর প্রতি আমাদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে।

জনাব স্পীকার : সংশোধিতভাবে যে প্রস্তাব এসেছে, আমি আপনাদের কাছে তাই পড়ে শোনাব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জনাব স্পীকার সাহেব, ঐ প্রস্তাবটা আপনি মেহেরবানি করে আমাদের কাছে দিয়ে দিন; ওটা নতুন করে সংশোধন করে জনাব নজরুল ইসলাম হাউসে পড়বেন।

জনাব স্পীকার : এই প্রস্তাব সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে, আর কিছু বলার প্রয়োজন নাই।

(কয়েকজন সদস্যের একসঙ্গে দ-ায়মান)

জনাব স্পীকার : ‘অর্ডার প্লীজ’।

জনাব মোঃ ময়েজ উদ্দিন : জনাব স্পীকার সাহেব, আমি একটি অধিকারের প্রশ্ন তুলতে চাই। এই পরিষদের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করার পর শপথ-পত্রে দস্তখত করার অধিকার আমার আছে। আমি শপথ গ্রহণ করেছি। কিন্তু শপথ-পত্র এখনো পাই নাই। এমন কোনো ফাইলও নাই যাতে আজকের কর্মসূচী দেখতে পারি, আমি এই অধিকার প্রস্তাব উত্থাপন করলাম।

জনাব স্পীকার : আমি সদস্যদের কাছে অনুরোধ করছি আপনারা নিজ নিজ প্যাড খুঁজে দেখুন।

জনাব মোঃ ময়েজ উদ্দিন : স্পীকার সাহেব, আমরা আগেও জানিয়েছি যে, আমরা কোনো শপথপত্র পাই নাই। এখন পর্যন্ত তার কোনো ব্যবস্থা করা হয় নাই।



বিধি সংক্রান্ত প্রশ্নÑ স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকারদের শপথগ্রহণ সম্পর্কে

শেখ আবদুর রহমান : মাননীয় স্পীকার সাহেব, স্পীকার এবং ডেপুটি স্পীকার নির্বাচনের পরে স্পীকার এবং ডেপুটি স্পীকার হিসেবে শপথগ্রহণ করার কোনো রকম প্রয়োজন আছে কি?

জনাব স্পীকার : সদস্য হিসেবে একবার শপথ গ্রহণ করার পর স্পীকার বা ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হলে আর বিশেষভাবে শপথ গ্রহণ করার কোনো বিধান নাই।



স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কীয় প্রস্তাব

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার মাধ্যমে আমি আজ কয়েকটা বিষয় এখানে আলোচনা করতে চাই। আজ আমরা এখানে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বসবার সুযোগ পেয়েছি। আমরা আজকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পেরেছি এবং বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমরা যে আজ বাংলাদেশের সার্বভৌম গণপরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করতে পারছি, সে সুযোগ এ দেশের জনসাধারণ তাদের রক্ত দিয়ে এনে দিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনেক দিন থেকে শুরু হয়। জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার জানা আছে যে, ত্রিশ লক্ষ ভাই-বোনের রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। এই গণপরিষদের সদস্য হিসাবে নিশ্চয়ই তাঁদের আত্মত্যাগের কথা আমরা স্মরণ করব এবং মনে রাখব। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, সে রক্ত যেন বৃথা না যায়। রক্ত দিয়েছে এ দেশের লক্ষ লক্ষ ভাই-বোন, নিরীহ জনসাধারণ। রক্ত দিয়েছে এ দেশের কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবীরা, রক্ত দিয়েছে এ দেশের জনগণ, রক্ত দিয়েছে সামরিক বাহিনীর ভাইয়েরা, রক্ত দিয়েছে পুলিশ, রক্ত দিয়েছে ভূতপূর্ব ই পি আর, রক্ত দিয়েছে আনসাররা, মোজাহেদরা। রক্ত দিয়েছে প্রত্যেকটি বাঙ্গালী, এমনকি সরকারি কর্মচারীরাও রক্ত দিয়েছে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে। নিষ্ঠুর বর্বর ইয়াহিয়া খানের খান সেনারা যে অত্যাচার করেছে, জুলুম করেছে, তা থেকে বাংলাদেশের মা-বোনেরা পর্যন্ত নিস্তার পায়নি। লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে নির্যাতন করা হয়েছে। এই পশু সেনাদের আচরণের ইতিহাস দুনিয়ায় আর কোথাও নাই।

আজ তাদের কথা আমরা স্মরণ করছি, স্মরণ করতে হয় আমার সহকর্মী সভ্যবৃন্দের কথা, যাঁরা সেই গত নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁদের অনেককেই বন্দি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছেÑ তাঁদের নামও ঐ প্রস্তাবে রয়েছে যে প্রস্তাব আমি আপনার মাধ্যমে পরিষদে পেশ করেছি।

তাছাড়া এই দেশের জানা অজানা লক্ষ লক্ষ লোক, আওয়ামী লীগের লক্ষ লক্ষ কর্মী স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য যারা আমাদের এই সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন, দলমত নির্বিশেষে যারা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, তাদের ত্যাগের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে।

জনাব স্পীকার সাহেব, আজ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, এর সঙ্গে আমি চারটি স্তম্ভকে স্মরণ করতে চাই, যে স্তম্ভকে সামনে রেখে আমাদের দেশের সংবিধান তৈরি করতে হবে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আমরা গণতন্ত্র দিতে চাই এবং গণতন্ত্র দিতেই আজ আমরা এই পরিষদে বসেছি। কারণ, আজ আমরা যে সংবিধান দেব, তাতে মানুষের অধিকারের কথা লেখা থাকবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। এমন সংবিধানই জনগণের জন্য পেশ করতে হবে। আজ এখানে বসে চারটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এমন সংবিধান রচনা করতে হবে, যাতে তারা দুনিয়ার সভ্য দেশের মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। জনাব স্পীকার সাহেব, জাতির কাছে আমাদের একটা কর্তব্য রয়েছে, একটা বিরাট কর্তব্য আছে। আমি আমার বক্তৃতা বড় করতে চাই না। কিন্তু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য যারা সংগ্রাম করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তাদের সেই ইতিহাস আজ এখানে পর্যালোচনা না করলেও চলবে। কিন্তু বিশেষ কয়েকজন নেতার কথা স্মরণ করছি, যাঁরা গণতন্ত্রের পূজারী ছিলেন, যেমনÑ হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, শেরে-বাংলা এ কে ফজলুল হক, বর্বর পাক বাহিনীর হাতে নিহত ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। আর কলম দ্বারা সংগ্রাম করেছেন সেই জনাব তোফাজ্জল হোসেনÑ আমাদের মানিক ভাই। এদের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে আমরা স্মরণ করতে চাই। স্মরণ করি ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেকটি আন্দোলনের সময় যারা জীবন দিয়েছেন, যাঁরা কারাগারে জীবন কাটিয়েছেন। গণতন্ত্রকে এ দেশে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা সংগ্রাম করেছেন, তাঁদের কথা যদি স্মরণ না করি, তাঁদের ইতিহাস যদি না লেখা হয়, তবে ভবিষ্যৎ বংশধররা জানতে পারবে না এই সংগ্রামের পেছনে কারা ছিলেন।

গত বছর নির্বাচন হলো। সেই নির্বাচনের পূর্ব থেকেই আমাদের জানা ছিল যে, বাংলাদেশ জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকা সত্ত্বেও তারা আমাদেরকে কলোনি এবং বাজার করে রাখতে চায়। শুধু তাই নয়, তারা আমাদের সংস্কৃতি ও ভাষার ওপর আঘাত করেছিল, আমাদের নাগরিক অধিকারের ওপর আঘাত করে আমাদেরকে কলোনি করে রাখতে চেয়েছিল। আমাদের সংগ্রাম তখন থেকেই চলছিল। আমরা জানতাম সংগ্রামকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এভাবে সংগ্রাম এগিয়ে আজ চরম সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। ২৫ মার্চ তারিখের ইতিহাস আপনাদের জানা আছে। সেইদিন বর্বর পাক হানাদার বাহিনী কোনো আইনকানুন মানে নাই। কোনো সভ্য দেশে তাদের কাজের তুলনা পাওয়া যায় না। প্রত্যেক সভ্য দেশে যুদ্ধের একটা নিয়ম আছে। কোনোরূপ ওয়ার্নিং না দিয়ে অতর্কিত কাপুরুষের মতো বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দুধের বাচ্চাকে পর্যন্ত হত্যা করে তারা এক জঘন্য লীলায় মেতে উঠেছিল। অর্ডার দিয়েছিল আওয়ামী লীগের লোক, যাকে পাও, তাকেই হত্যা কর, কোনোরূপ দয়া-মায়া নেই। তাদের জঘন্য কাজকারবারের এমন সমস্ত ইতিহাস আমাদের হাতে আছে, যা দেখলে শিউরে উঠতে হয়। আমাদের হাতে একজন জেনারেলের দস্তখত করা কাগজ ধরা পড়েছে। তাতে আছে লুটপাট করা। এমনকি পাশবিক অত্যাচারের কথাও আছে। বর্বর ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীকে অসহায় ও নিরস্ত্র সাত কোটি বাঙ্গালীর ওপর কুকুরের মতো লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেনাবাহিনী যদি যুদ্ধ ঘোষণা করত, তবে আমরা সেই যুদ্ধের মোকাবেলা করতে পারতাম। কিন্তু তারা অতর্কিতে ২৫ মার্চ তারিখে আমাদের আক্রমণ করল। তখন আমরা বুঝতে পারলাম যে, আমাদের শেষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আমি ওয়্যারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এ খবর প্রত্যেককে পৌঁছিয়ে দেয়া হোক, যাতে প্রতিটি থানায়, মহকুমায়, জেলায় প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠতে পারে। সেই জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে আত্মসচেতন হতে হবে। দেশবাসী জানেন একই তারিখে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এটা হাওয়ার ওপর থেকে হয়নি। যদি কোনো নির্দেশ না থাকত, তবে কেমন করে একই সময়ে, একই মুহূর্তে সব জায়গায় সংগ্রাম শুরু হলো? এখন যদি আমি ভারত সরকারের বিষয়ে না বলি, তাহলে অন্যায় করা হবে। আমার দেশের জনসাধারণ যখন প্রাণভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে, ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে পায়ে হেঁটে ভারতবর্ষে যায়, তখন ভারতের জনসাধারণ তাদেরকে বুকে টেনে নেয়, ভারতের জনসাধারণ, পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং আসামের জনসাধারণ, বিশেষ করে, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। কারণ তারা আমাদের জনসাধারণকে বুকে টেনে নিয়েছেন। স্মরণ করি ভারতের সেনাবাহিনীর এসব জোয়ানদের, যাঁরা আমাদের মুক্তি যোদ্ধাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করেছেন। আমি স্মরণ করি রাশিয়ার জনসাধারণ ও সরকারকে, যাঁরা নিশ্চিতভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন। তাঁরা প্রকাশ্যে আমার গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন এবং বাংলাদেশে ধ্বংসলীলা করার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেছেন। স্মরণ করি গ্রেট ব্রিটেনের জনসাধারণকে, পশ্চিম জার্মানির জনসাধারণকে, জাপানের জনসাধারণকে, এমনকি আমেরিকার জনসাধারণকে, যাঁরা আমাদের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। যাঁরা যাঁরা সমর্থন করেছিলেন, তাঁদের সকলকে আমাদের এই গণপরিষদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। এমনকি জাতিসংঘে রাশিয়া তিনটি ভেটো দিয়েছিল; তা না হলে সেখানে যে ষড়যন্ত্র চলছিল, তাতে বাংলাদেশের অবস্থা কী হতো, তা বলতে পারি না। যেসব পূর্ব ইউরোপীয় দেশ আমাদেরকে সমর্থন দিয়েছিল, বিশেষ করে পোল্যান্ড, তাদের প্রত্যেককে এবং তাদের জনসাধারণকে আমি এ পরিষদের মাধ্যমে ধন্যবাদ জানাতে চাই এবং স্মরণ করতে চাই।

জনাব স্পীকার সাহেব, এসব কথা বলতে গেলে ভাষা আসে না, মানুষ ভাবপ্রবণ হয়ে যায়। সে জন্য এগুলো বলা আমাদের পক্ষেও কষ্টকর; কারণ, আমি ভাবপ্রবণ হয়ে যাই। আমরা দেখতে পাই আমাদের লক্ষ লক্ষ মা-বোনদের অত্যাচার করা হয়েছে এবং আমাদের হাজার হাজার ছেলে পঙ্গু অবস্থায় রয়েছে, তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। আমাদের বাংলার গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। আমাদের ধন-সম্পত্তি লুটপাট করে নিয়ে গেছে, রাস্তাঘাট ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, আমাদের কারেন্সি নোট জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ রকম কত নির্যাতনই না আমাদের লোককে সহ্য করতে হয়েছে এবং তাঁরা যে সহনশীলতা দেখিয়েছেন, সে জন্য তাঁদেরকে যদি আমরা মোবারকবাদ না জানাই তাহলে অন্যায় করা হবে। আর যেসব দল আমাকে সমর্থন করেছে তাঁদেরকেও আপনার মাধ্যমে ধন্যবাদ দিতে চাই এবং শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই।

জনাব স্পীকার সাহেব, আমাদের সামনে আজকে বিশেষ কর্তব্য হলো জাতিকে একটা সংবিধান দেয়া এবং যত তাড়াতাড়ি হয়, সেই সংবিধান দেয়ার চেষ্টা করা হবে। আমার সহকর্মী ভাইয়েরা, যাঁরা এখানে উপস্থিত আছেন, আপনার মাধ্যমে তাদের সবাইকে বলে দিতে চাই যে, আপনারা গাছতলায় বসে যুদ্ধ করেছেন, না খেয়ে যুদ্ধ করেছেন, পরনের কাপড়ও ছিল না। আমার সহকর্মীদের আত্মীয়স্বজনের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে; তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেম্বারদের যে অধিকার পাওয়ার আছে, সে অধিকার পুরোপুরি দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। যদি মাইক্রোফোন বিদেশ থেকে আনবার চেষ্টা করতাম, তাহলে তিন মাস সময় লাগত, অনেক দেরি হয়ে যেত। এ এসেম্বলি ভবন যে অবস্থায় ছিল, মাত্র ৩০০ মেম্বারের বসার জায়গা ছিল; আজকে সেখানে ৪৫০ জন বসেছেন। যদি এই এসেম্বলী ভবনও না থাকত, তবে গাছতলায় বসেও আমার মেম্বাররা সংবিধান রচনা করতেনÑ এই সুনিশ্চিত আশ্বাসটুকু দিতে পারি। আজকে আমাদের জনগণ কী অসুবিধায় আছে। তাদের থাকার মতো ঘর নেই; আমরা কিছু দিতে পারছি না; মানুষ কষ্ট করছে। হাজার হাজার লোক বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে; তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছি না। অর্থ নাই, জনসাধারণকে সুবিধা করে দিতে পারছি না। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনÑ আপনার কাছে আবার বলছিÑ যে, আমাদের সামনে কর্তব্য হলো সংবিধান তৈরি করা। আমরা প্রোগ্রাম অনুযায়ী আগামীকাল আবার বসব। শুধু যে আমাদের দলীয় সদস্য থেকে কমিটি করব তা নয়; দলমত নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে, জনগণকে যাতে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী একটা সুষ্ঠু সংবিধান দেয়া যায়, এই উদ্দেশ্যে সকলের মতামত চাইব। এই সংবিধানে মানবিক অধিকার থাকবে, যে অধিকার মানুষ চিরজীবন ভোগ করতে পারে। আমরা গত তেইশ বছরে কী রেখেছিÑ শাসনতন্ত্রের নামে অশাসনতন্ত্র, জনগণের নিরাপত্তার নামে মার্শাল ল, জনগণকে দাবি আদায়ের নামে প্রতারণা। আর বাংলাদেশের কথা উঠলেই ‘হিন্দুস্থানের দালাল’ এ ধরনের কথা সারা জীবন শুনে আসছি। সে সব যাতে এদেশ থেকে উঠে যায়, সে জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে এবং সে বিষয়ে সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।

জনাব স্পীকার সাহেব, আপনি এই পরিষদের স্পীকার হয়েছেন আবার আপনাকে জানাতে চাই যে, আমরা একটা গণমুখী সংবিধান তৈরি করতে চাই এবং সেই সঙ্গে এই আশ্বাস দিতে চাই যে, আপনি যতক্ষণ নিরপেক্ষ থাকবেন, আমাদের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন। আপনার কর্তব্যটুকু আইন ও আপনার বিবেক অনুযায়ী এবং পার্লামেন্টারি কনভেনশন মেনে নিয়ে পালন করবেন এই আশা করি। আপনি কোন্ দল বড়, কোন্ দল ছোট তা দেখবেন না; কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী বিচার ও ইনসাফ করবেন। আমার দলের পক্ষ থেকে আপনাকে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা জানাব।

এখানে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, নজরুল ইসলাম সাহেব তা পড়েছিলেন, আবার সংশোধন করে তা পেশ করা হবে। আপনার মাধ্যমে আমার সদস্য ভাইদেরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি এবং আপনাকেও ধন্যবাদ দিচ্ছি। তারপর এসেম্বলীর কর্মচারীরা রাতদিন পরিশ্রম করে এত তাড়াতাড়ি যে এই বন্দোবস্ত করতে পেরেছেন, সে জন্য তাঁদেরকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ, আমি জানি তাঁরা মাত্র কয়েক দিনের নোটিশে খুব পরিশ্রম করে এ বন্দোবস্ত করতে পেরেছেন। তারপর আমি ধন্যবাদ জানাই এই রিপোর্টারদেরকে, এখানে যাঁরা কাজ করছেন। তারা যেন পরিষ্কার সুন্দর করে রিপোর্ট তৈরী করেন, তাতে ভুলভ্রান্তি যেন না হয়; কারণ, এটা একটা ইতিহাস হয়ে থাকবে; এই ইতিহাস যেন নষ্ট না হয়। এই কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

জনাব স্পীকার : এই হাউসের সামনে যে প্রস্তাব ছিল তা সংশোধনের পরে যে আকারের হয়েছে, আমি তা পড়ে শোনাচ্ছি। সংশোধিত প্রস্তাব হচ্ছে :

“বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের যে বিপ্লবী জনতা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবী, বীরাঙ্গনা, প্রতিরক্ষা বিভাগের বাঙ্গালীরা, সাবেক ই. পি. আর পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। আজকের দিনে বাংলাদেশর জনগণের ভোটে যথাযথভাবে নির্বাচিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সশ্রদ্ধচিত্তে তাঁদের স্মরণ করছে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার যে ঘোষণা করেছিলেন এবং যে ঘোষণা মুজিব নগর থেকে ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়েছিল এই সঙ্গে এই গণপরিষদ তাতে একাত্মতা প্রকাশ করছে।

স্বাধীনতা সনদের মাধ্যমে যে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল আজ সে সনদের সঙ্গেও এ পরিষদ একাত্মতা ঘোষণা করছে।

এক্ষণে এই পরিষদ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার সেই সব মূর্ত আদর্শ, যথা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করছে।”

এই প্রস্তাবের পক্ষে যারা আছেন, তারা ‘হ্যাঁ’ বলবেন...

ডা. এ. এ. এম. মেসবাহুল হক : পরিষদের চিকিৎসক-সদস্য বন্ধুদের পক্ষ থেকে আমি বলতে চাই যে, চিকিৎসক সদস্যদেরও অনেক দান আছে; তাদের কথাও এখানে বলা দরকার।

জনাব স্পীকার : এটা যা হবার, তা ঠিক হয়ে গেছে এবং সংশোধিত আকারে এসেছে। এ প্রস্তাবের পক্ষে যারা আছেন, তারা ‘হ্যাঁ’ বলবেন এবং যাঁরা এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আছেন, তাঁরা ‘না’ বলবেন।

সদস্যগণ : (সমস্বরে) “হ্যাঁ”

(‘না’ কেহই বলেন নাই)

জনাব স্পীকার : এই প্রস্তাব গৃহীত হলো।

জনাব নুরুল হক : জনাব স্পীকার সাহেব, আমাদের ৪ লক্ষের ওপর বাঙ্গালী এখনও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরতে পারেনি। আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নিকট তাদের সম্বন্ধে জানতে চাই। আমি এই হাউসের মাধ্যমে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যাতে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙ্গালীরা অনতিবিলম্বে দেশে ফিরে আসতে পারে এবং সে সম্বন্ধে সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আমার অনুরোধ এ সম্বন্ধে এই হাউসে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হোক।

জনাব কে. এম. ওবায়দুর রহমান : জনাব স্পীকার সাহেব, আমরা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করি নাই। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালেই। সুতরাং ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত যাঁরা স্বাধীনতার জন্য মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদের আত্মার মাগফেরাতের জন্য একটি প্রস্তাব আনা উচিত বলে আমি মনে করি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জনাব স্পীকার সাহেব, নুরুল হক সাহেব যে কথা বলেছেন, তার উত্তরে আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন মনে করছি যে, পাকিস্তানে যে ৪ লক্ষের অধিক বাঙ্গালী আটকে পড়ে আছে, তাদের বিষয়ে আমরা সমস্ত দুনিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। জাতিসঙ্ঘের দৃষ্টিও আকর্ষণ করা হয়েছে এবং চেষ্টা করা হচ্ছে কী করে তাদের ফিরিয়ে আনা যায়। সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টার কোন ত্রুটি করা হচ্ছে না। আমরা বার বার বলছি, সভা-সমিতিতে বলছি। কারণ আইনের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে বলা হচ্ছে, জাতিসঙ্ঘকে জানানো হয়েছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের দৃষ্টিও এ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ করা হয়েছে। পাকিস্তান সরকারকেও বলা হয়েছে, আমাদের লোকদের ফিরিয়ে দাও, আর এ দেশে যারা থাকতে না চায়, তাদের ফিরিয়ে নাও, আমি তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছি। তবে যারা যুদ্ধ-অপরাধী, তাদের বিচার বাংলার মাটিতে হবে। আমাদের বাঙ্গালী, যারা পাকিস্তানে আটকে আছে, তারা সেখানে কাজ করতে গিয়েছিল, তারা কেউ যুদ্ধ-অপরাধী নয়। তাদের সঙ্গে আর কারো তুলনা করা যাবে না। সে জন্য আমরা দাবি করেছি যে, আমাদের লোক, যারা পাকিস্তানে আছে, তাঁদের ফিরিয়ে দাও, আর অন্য দেশের যারা বাংলাদেশে থাকতে চায় না, তাদের ফিরিয়ে নাও। তবে যারা জঘন্য যুদ্ধ-অপরাধী, যারা এ দেশে পাশবিক অত্যাচার করেছে, লুট করেছে, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে তাদের বিচার হবে যুদ্ধ-অপরাধী হিসেবে। আমি মাননীয় সদস্যদের আর একটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, কোন প্রস্তাব আনার আগে পার্টিতে তা আলোচনা করে তারপর তা পরিষদে উত্থাপন করবেন। তা না হলে এর দ্বারা পার্টির শৃঙ্খলা নষ্ট হবে। জনাব স্পীকার সাহেব, আমার মনে হয় আমাদের আজকের কার্যসূচী শেষ হয়েছে



মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে মে, ২০১০ বিকাল ৩:১৯

শেখ আমিনুল ইসলাম বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই।

২৯ শে মে, ২০১০ বিকাল ৩:২৩

াহো বলেছেন: সংশোধিত প্রস্তাব হচ্ছে :
“বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের যে বিপ্লবী জনতা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবী, বীরাঙ্গনা, প্রতিরক্ষা বিভাগের বাঙ্গালীরা, সাবেক ই. পি. আর পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। আজকের দিনে বাংলাদেশর জনগণের ভোটে যথাযথভাবে নির্বাচিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সশ্রদ্ধচিত্তে তাঁদের স্মরণ করছে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার যে ঘোষণা করেছিলেন এবং যে ঘোষণা মুজিব নগর থেকে ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়েছিল এই সঙ্গে এই গণপরিষদ তাতে একাত্মতা প্রকাশ করছে।
স্বাধীনতা সনদের মাধ্যমে যে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল আজ সে সনদের সঙ্গেও এ পরিষদ একাত্মতা ঘোষণা করছে।
এক্ষণে এই পরিষদ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার সেই সব মূর্ত আদর্শ, যথা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করছে।”
এই প্রস্তাবের পক্ষে যারা আছেন, তারা ‘হ্যাঁ’ বলবেন...

২| ২৯ শে মে, ২০১০ বিকাল ৩:৩২

বিপরীত স্রোত বলেছেন:
প্লাস

২৯ শে মে, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৪৮

াহো বলেছেন: স্মরণ করি ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেকটি আন্দোলনের সময় যারা জীবন দিয়েছেন, যাঁরা কারাগারে জীবন কাটিয়েছেন। গণতন্ত্রকে এ দেশে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা সংগ্রাম করেছেন, তাঁদের কথা যদি স্মরণ না করি, তাঁদের ইতিহাস যদি না লেখা হয়, তবে ভবিষ্যৎ বংশধররা জানতে পারবে না এই সংগ্রামের পেছনে কারা ছিলেন।

৩| ২৯ শে মে, ২০১০ বিকাল ৪:১৩

মোরশেদুল আজাদ পলাশ বলেছেন: বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষক এটা সারা দুনিয়ার মানুষ জানে, জানেনা শুধু বিএনপি-জামাতিরা।
+++ সহ প্রিয়তে।

৪| ২৯ শে মে, ২০১০ বিকাল ৫:০৯

আকাশের তারাগুলি বলেছেন: খুবই ভালো ইনফরমেশন, ভালো হয়েছে।
কাজে লাগবে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.