নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

humanchorcha

writer

সাইফুল ইসলাম গাজী

writer and translator of Bangladesh

সাইফুল ইসলাম গাজী › বিস্তারিত পোস্টঃ

কবীর চৌধুরী অনূদিত নাগিব মাহ্‌ফুজের উপন্যাস আখেনাতেন

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ৯:০৫

গাজী সাইফুল ইসলাম[/sb


নাগিব মাজফুজ নোবেল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮) বিজয়ী মিসরীয় ঔপন্যাসিক। তাঁর রচিত সেরা উপন্যাসগুলোর মধ্যে আখেনাতেন: ডয়েলার ইন ট্রুথ-এর স্থান তিন-চার নাম্বারে| কবীর চৌধুরী এটির অনুবাদ করেছেন আখেনাতেন: সত্যে বসবাসকারী নামে। উপন্যাসটির একটি বিশেষত হলো, এর রচনা শৈলী। ১৪৪ পৃষ্ঠার এ উপন্যাস জুড়ে শুধু একজন লোক সম্পর্কেই প্রশ্ন করে গেছেন সত্যানুসন্ধানী মেরিয়ামুন। মেরিয়ামুন আসলে এ উপন্যাসের কথক। এ উপন্যাসের কোনও চরিত্রই সরাসরি গল্পে অংশ গ্রহণ করে না। মূল চরিত্র খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের ফারাও সম্রাট আখেনাতেন, যিনি ফারাও সম্রাট তৃতীয় আমেনহোতেপের দ্বিতীয় পুত্র। সম্রাটের প্রথম পুত্রের মৃত্যু হলে তিনি রাজ্যের সম্রাট হওয়ার উত্তরাধিকারী হন। উপন্যাসটিতে তাকেই আমরা পেয়েছি নায়ক হিসেবে। তাঁর সম্পর্কে অপরাপর চরিত্রগুলোর বক্তব্যই হলো এ উপন্যাসের টোটাল বক্তব্য। নিজেদের চিন্তা ও অভিজ্ঞতা মতো তারা এক একজন এক একরকম কথা বলেছেন। আর তাদের বক্তব্য থেকেই আমারা বুঝতে পারি কে কতটা সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী। কার চরিত্র কেমন।
উপন্যাসটির মূল কাহিনী এরূপ: সম্রাট আখেনাতেন তার ছেলে বেলা থেকেই ভিন্ন প্রকৃতির। রাজ-রাজাদের যে অহঙ্কারী ভোগ-বিলাসি লাম্পট্যপূর্ণ চরিত্র থাকে, আখেনাতেন তেমন না। তিনি বরং তাদের বিপরীত। প্রাচীন রাজসভাগুলোতে জড়ো হওয়া চাটুকারদের তিনি সহ্য করতে পারতেন না। সাধারণ মানুষেরা যে রাজা এবং রাজার লোকদের দ্বারা নানান কারণে অহরহ নির্যাতিত হতো তিনি ছিলেন এমন নির্যাতনের ঘোর বিরোধী। বিশেষ করে ফারাও রাজারা নিজেদের শুধু রাজ্যের একছত্র অধিপতিই ভাবতেন না তারা নিজেদের দেবতার সবচেয়ে অনুগ্রহভাজন সেবকও ভাবতেন। আর রাষ্ট্রের পোষা পুরোহিততন্ত্র সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করত নিজেদের স্বার্থে। আখেনাতেন ক্ষমতায় আসার আগেই এসব অনাচারের বিরুদ্ধে লড়ার মানসিকতা লাভ করেন। এমনই একদিন তিনি এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের ডাক শুনতে পান। এবং ক্ষমতা গ্রহণের পর পিতৃপুরুষদের বহু বছরের লালিত দেবতাতন্ত্রের পথ পরিহার করে একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রচার শুরু করেন। এতে তাকে অবিশ্বাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে রাজ্যের সুবিধাভোগী, অত্যাচারী একটা শ্রেণী, যদিও বেশিরভাগ মানুষ তাকে শ্রদ্ধারে গ্রহণ করল। কিন্তু সম্রাট শুধু তার নিজের ধর্মই প্রচার করলেন না তিনি সব শাস্তির বিধান বিলোপ ঘোষণা করলেন। একই সঙ্গে সব রকম রক্তপাত বন্ধের নির্দেশও দান করলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন, শাস্তি নয় ভালোবাসা দিয়েই জয় করতে হবে সব রকম প্রতিকূলতা, হিংসা আর শত্রুতা। কিন্তু সম্রাটের শেষের সিদ্ধান্তগুলো ছিল ভুল। ওসবের সঙ্গে আরও দুটি ভুল যোগ হলো, যখন তিনি সকল ধর্মের স্বাধীনতা খর্ব করলেন। মন্দিরগুলো বন্ধ করে দিলেন। অবশ্য মন্দির থেকে বাজেয়াপ্ত করা সকল অর্থ-সম্পদ তিনি দেশের গরীবদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। সম্রাটের এ রকম শাস্তি বিলোপ নীতি গ্রহণের সুযোগে ক্ষমতালোভী দুষ্টুলোকেরা দ্রুত মাথা চাড়া দিয়ে ওঠল। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে রাজার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলো। তারা রাজাকে ধর্মদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করল। এভাবেই চতুর্থ ফারাও সম্রাট আখেনাতেনের রাজত্বে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলো যা শেষত রূপ নিলো গৃহযুদ্ধের। প্রাসাদে বন্দী হলেন আখেনাতেন। তাঁর স্ত্রী নেফারতিতি তাঁকে ত্যাগ করে চলে গেলেন। এভাবে কবছর বন্দি থাকার পর ক্ষমতাসীনরা ঘোষণা করল যে, সম্রাট আখেনাতেনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ তা বিশ্বাস করল না। তারা ধরে নিলো, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। যদিও লোক চক্ষুর অন্তরালে সমাহিত করা হলো তাঁকে, দেয়া হলো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা।
উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মেরিয়ামুন পনেরো জন লোকের সঙ্গে কথা বলে তাদের অভিমত নিরপেক্ষভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। এ পনেরো জনের মধ্যে কেউ আখেনাতেনের ছেলেবেলার বন্ধু (কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজকর্মচারী), কেউ শিক্ষাগুরু (এবং পরে রাজনৈতিক উপদেষ্টা), কেউ মাতৃতুল্য নারী, কেউ মন্ত্রী, কেউ সেনাবাহিনীর প্রধান। কেউ আবার পুলিশের প্রধান থেকে চাকরিচ্যুত। কিন্তু তারা সকলেই বিভিন্ন সময় কোনো না কোনো যোগসূত্রে আখেনাতেনের খুব কাছাকাছি ছিলেন।
কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এ সব লোকেরাই আখেনাতেন সম্পর্কে অসংখ্য পরস্পর বিরোধী বক্তব্য প্রদান করল। একজনের বক্তব্যের সঙ্গে আরেকজনের বক্তব্য খুব একটা মিলে না। একটু আগে একজন হয়তো বললেন, তাঁর চেহারায় একটা মেয়েলি দুর্বলতার ছাপ দেখা গেলেও দুর্বল চিত্তের মানুষ তিনি ছিলেন না। প্রচলিত পুরোহিততন্ত্রকে ভণ্ডামি আখ্যায়িত করে তিনি একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। কিন্তু কিছু ভুলের কারণে তিনি সফল হতে পারেন নি। তিনিই প্রথম ফারাও সম্রাট যিনি সিংহাসন থেকে মাটিতে নেমে এসেছিলেন, মানুষের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন রাজসভাকে। তিনিই মানুষে মানুষে সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শাস্তি দানের নীতি বাতিল করে ভালোবাসার শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই হয়তো আরেকজন বলল, আখেনাতেন ছিলেন ভণ্ড, ফারাওদের উত্তরাধিকারী হওয়ার সম্পূর্ণ অযোগ্য। তিনি নিজের দুর্বলতা লুকোতে এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের ধর্ম প্রচারের নামে সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করেছেন।
এমনই পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায় আখেনাতেনের সুন্দরী স্ত্রী নেফারতিতি সম্পর্কেও। সারা উপন্যাসে একদল মানুষ তাঁকে চিত্রিত করেছে বহু-পুরুষের বাহুলগ্না রূপে, বলেছে তাঁর ছটি সন্তান ভিন্ন ভিন্ন পুরুষের। আবার একদল মানুষ তাঁকে চিত্রিত করেছে বিদুষী, ধার্মিক, স্বামী অনুরাগী স্ত্রী এবং রাজ্য পরিচালনায় পারদর্শী নারী হিসেবে। উপন্যাসের শেষে দেখা গেল তিনি তাঁর স্বামীকে ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকের কাছে ওটা বড় রহস্য। কেউ বলেছেন পাপিষ্ঠা, পর পুরুষের সঙ্গ লাভ করার উদ্দেশ্যেই নপুংসক স্বামীকে ত্যাগ করেছেন। কিন্তু আসলে তিনি তাঁর স্বামীকে বাঁচানোর জন্যই তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। পরে যখন বুঝতে পারলেন যে কাজটি ঠিক হয়নি, সর্বাবস্থাতেই স্বামীর সঙ্গে থাকা উচিত ছিল, তিনি প্রাসাদের ফিরতে চেয়েছেন, কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শক্তি তাঁকে সে সুযোগ দেয় নি।
এবার আখেনাতেন ও নেফারতিতি সম্পর্কে আমরা এমন দুজন মানুষের কথা শুনব যাদের পরিচয় এ উপন্যাসের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন তে, আখেনাতেনের শাশুড়ি, অর্থাৎ নেফারতিতির সৎ মা, প্রাজ্ঞ আই-এর ৭০ বছর বয়স্ক স্ত্রী। আর আই আখেনাতেনের শিক্ষাগুরু। নেফারতিতি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ও ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমতি এক তরুণী, প্রাণবন্ত এবং আবেগদীপ্ত সৌন্দর্য দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং ধর্মে মরমীয়া দিকগুলোর দ্বারা গভীরভাবে আকৃষ্ট। বয়সের তুলনায় তাঁকে এত বেশি পরিপক্ক মনে হত যে আমি একদিন আইকে বলি যে, তোমার এই মেয়ে যাজিকা হবে। তে-এর সততার আরও প্রমাণ মিলে দুবোন সম্পর্কে তার বক্তব্য থেকে। নেফারতিতি আর মুতনেজমেট কখনো কখনো জগড়াঝাটি করত, বোনেরা যেমন করে। তবে নেফরাতিতির অবস্থানই সব সময় সঠিক হতো।... সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে মুতনেজমনেটের সঙ্গে তার ঝগড়া মিটিয়ে ফেলত, বড়ো বোন হিসেবে যা তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত ছিল। এখানে বলে রাখা আবশ্যক যে, পুরোহিত আই যখন তে-কে বিয়ে করেন নেফারতিতি তখন দুবছরের মেয়ে মাত্র। কিন্তু প্রচলিত বিমাতাদের মতো নেফারতিতির সঙ্গে তিনি কখনোই বিমাতাসুলভ আচরণ করেন নি। কিন্তু তারই ঔরসজাত সন্তান মুতনেজমেট, নেফারতিতি এবং আখেনাতেন সম্পর্কে তার মনোভাব সম্পূর্ণ বিপরীত। এক সঙ্গে এ দুজন সম্পর্কে তার বক্তব্য আমরা পাই। মেরিয়ামুনকে সে তার বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছে, আমার স্বীকার করতেই যে হবে যে, আখেনাতেন ছিলেন উন্মাদ, আমাদের সকলের দুর্ভাগ্য যে তিনি মিসরের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন। এবং অসুস্থ প্রণোদনাসমূহ চরিতার্থ করার জন্য তাঁর ক্ষমতাকে ব্যবহার করেন। আমি বেশি দোষ দিই নেফারতিতিকে, কারণ, তাঁর মধ্যে বুদ্ধ-যুক্তির অভাব ছিল না। কিন্তু ও সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে ওর উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং অধিকতর ক্ষমতা প্রয়োগ নিয়ে। আখেনাতেনের ক্ষমতা ও গৌরব মিলিয়ে যেতে না যেতেই সে তাঁকে ত্যাগ করে চলে যায়। সে তাঁর বিরোধীদের সঙ্গে যোগদানের চেষ্টাও করে।... সেও তার ধর্মদ্রোহী, নিষ্কর্মা স্বামীর মতোই নির্বোধ।
উপন্যাসের শেষ পর্বে মেরিয়ামুন কথা বলেন নেফারতিতির সঙ্গে। হয়তো শেষ কথাটা শুনার জন্য। নেফারতিতি সম্পর্কে লোকমুখে যে সব কথা তিনি শুনে আসছিলেন, সে সব সম্পর্কে চূড়ান্ত একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য। হ্যাঁ, পাঠককে নেফারতিতির সব কথা শোনানোর পর তিনি কোনো মন্তব্য ছাড়াই ইতি টানেন তাঁর গবেষণা বা সাক্ষাতকার গ্রহণপর্বের। এ উপন্যাসের পাঠক হিসেবে আমরাও একটা ধারণায় পৌঁছতে পারি যে, সুন্দরী নেফারতিতি সম্পর্কে পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে যে সব মিথ্যাচার ছড়ানো আছে নাগিব মাহফুজের এ উপন্যাস পাঠের পর সে সব বিভ্রান্তির অবসান ঘটবে। মি. মাহফুজও হয়তো এই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই এমন চমৎকার একটি শৈলীতে এ কাহিনীটিকে উপস্থাপন করেছেন। যাতে উপন্যাসটি সব ধরনের পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। হয়তো এর মাধ্যমে তিনি আখেনাতেন ও নেফারতিতি সম্পর্কে শেষ বার্তাটি বিশ্ববাসীকে দিতে চেয়েছেন।
এখন আমরা আখেনাতেন: সত্যে বসবাসকারী উপন্যাসের মূল বার্তাগুলো খুঁজে দেখব।
অসত্য ও অধর্মের যেখানে জয়জয়কার, যেখানে তারা রাজত্ব করে অপ্রতিদ্বন্দ্বিরূপে সেখানে অসত্যই সত্য আর অধর্মই গভীর বিশ্বাসরূপে মগজে মগজে প্রোথিত হয়। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে সত্য আর প্রকৃত ধর্মের বাণী যত উত্তমরূপেই পরিবেশিত হোক কেউ তা গ্রহণ করে না, করতে চায় না। সাধারণ মানুষ তখন প্রকৃত সত্যকে সন্দেহের চোখে দেখে, আর তার প্রচারকারীকে পাগল বলে বিদ্রুপ করে। এটা শুধু সত্য আর ধর্মের ক্ষেত্রেই নয় বিশ্বর তাবৎ প্রচলিত ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রচলিত মতে বিশ্বাসী পুরোহিত বা যাজকদের সংখ্যা যেখানে যত বেশি হবে সেখানে সত্যের বা প্রকৃত ধর্মের প্রতিষ্ঠা তত কঠিন হবে। নাগিব মাহ্‌ফুজের এই উপন্যাস প্রথমত যে বার্তাট সবচেয়ে জোরালোভাবে তুলে ধরে, তাহলো, প্রচলিত মতের বিশ্বাস যত বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল থাকবে, সে বিশ্বাসকে ভাঙতে গেলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধটাও করতে হয় তত বিধ্বংসী। একজন রাজার পক্ষেও তখন সে যুদ্ধে জয় লাভ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর জন্য দুর্দর্শী চিন্তার সঙ্গে প্রয়োজন হয় শক্তির, কারণ সুযোগ সন্ধানীদের মোকাবিলার জন্য শক্তিই সবচেয়ে বড় নিয়ামক। মিথ্যে প্রচারণার দ্বারা তারা ভালোবাসার সুললিত বাণীসমূহকে অর্থহীন তামাশায় পরিণত করে। আর তখন তাদের কাছে নতুন কোনো সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে যাওয়া আত্মঘাতী আচরণ ছাড়া আর কিছু না। তরুণ ফারাও সম্রাট আখেনাতেনের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে আমাদের মনে কোনো সন্দেহ নেই, ছিল না মিসরের সাধারণ শান্তিকামী মানুষেরও। কিন্তু তবু তাঁর একটা ভুল হয়েছিল। সেটা তাঁর বয়সের কারণেই হোক, জীবন সম্পর্কে তীব্র ধারণার অভাবেই হোক কিংবা তাঁর সিংহাসন বিরোধী মনোভাবের কারণেই হোক। না হলে দুষ্টের দমনের জন্য শাস্তির বিধান করতে হয়, এই চরম সত্য ভুলে তিনি বোধহয় ভুলে বসতেন না। তিনি যদি তাঁর শাসনকার্য মাত্র দুটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন তাহলেই মিসরের ইতিহাসে তিনি হতেন সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্রাট। পদক্ষেপ দুটি হলো, অপর ধর্ম পালনের স্বাধীনতা প্রদান আর অপরাধীদের জন্য কঠোর শাস্তি বিধান।
আখেনাতেন: ডয়েলারস ইন ট্রুথ কোন শ্রেণীর উপন্যাস-এমন একটা প্রশ্ন অনেক পাঠকের মধ্যেই জাগতে পারে। এর উত্তর দেয়ার জন্য আমি সালমান রুশদির সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যকে টেনে আনতে চাই। একটি বই শুধু থ্রিলার হবে না, অথবা হবে না কমেডি, অথবা ঠিক একটি মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। এটা একই সঙ্গে হবে অনেক চিন্তার সমন্বিত রূপ। এ বক্তব্য দেয়ার পর রুশদি স্বীকার করেছেন যে, এ শিক্ষাটা তিনি পেয়ছেন শেকস্‌পিয়ার থেকে। নাগিব মাহ্‌ফুজের এ উপন্যাসও এমনই জটিল ছাঁচের উপন্যাস। প্রথমেই এটাকে একটি রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কারণ এর পুরো আলোচনাটাই রাজনৈতিক। আবার পুরো গল্পটা যেহেতু ইতিহাসের কাজেই এটাকে ঐতিহাসিক উপন্যাসও বলা যায়। কিন্তু এর বিশাল আকাশ ছেয়ে আছে দর্শনের জটিল ছেঁড়া মেঘে। একই সঙ্গে এটা একটা রহস্য উপন্যাসও। কারণ কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর শেষ পর্যন্তই মিলে না। যেমন, আখেনাতেনের মৃত্যুর পর যখন তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যুর ঘোষণা প্রচার করা হলো অনেকেই তা বিশ্বাস করল না। এমনকি, তাঁর স্ত্রী নেফারতিতি নিজেও। উপন্যাসের একেবারে শেষ পৃষ্ঠায় আমরা এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য পাই। আমি ওদের একটা কথাও বিশ্বাস করি নি। আমার প্রিয়তম রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন নি। নিশ্চিন্তভাবে ওরা তাঁকে হত্যা করেছে। এ বক্তব্যের প্রতিধ্বনি আমরা উপন্যাসের বহুজায়গায় অপরাপর চরিত্রদের কাছ থেকে পেয়েছি। ওই একই প্রশ্ন আমাদের মনেও জাগে। কী হয়েছিল আখেনাতেনের? তাঁকে কি হত্যা করা হয়েছিল? কারা হত্যা করেছিল? উত্তর পাওয়া যায় না-এমন আরও অসংখ্য প্রশ্ন এ উপন্যাসে রয়েছে যেগুলো পাঠক হৃদয়কে আলোড়িত করে।
উপন্যাসটির মাধ্যমে মি. মাহ্‌ফুজ আরও দুটি জোরালো দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। দুটি প্রশ্নেই চিরন্তনের সুর শুনতে পাওয়া যায়। মানুষের বিশ্বাস কি ভেঙে যায় কখনো? ভেঙে যাওয়া বিশ্বাসের স্থান কি নতুন কোনো বিশ্বাস দ্বারা পূরণ হয়? আবার সেই নতুন বিশ্বাসও কি কোনো কারণে ভেঙে যায় না? না যেতে পারে?
বার বার বিশ্বাস ভেঙে যাওয়া মানুষেরা যখন একটি সত্যে উপনীত হয়, তখন তারা সম্ভাব্য দুটি অবস্থার মধ্যে যে কোনো একটিকে গ্রহণ করে। হয় তারা অবিশ্বাসীতে পরিণত হয়, অথবা মৃত্যু পর্যন্ত নিজের বিশ্বাসে অটল থাকে। তবে চরম পথটাই বেশির ভাগ মানুষ বেছে নেয়। আর তা হলো, কোনো কিছুতেই বিশ্বাস না রাখা। কিন্তু তাই বলে এই অবিশ্বাসী হয়ে উঠাটাও বিশ্বাসী হয়ে টিকে থাকার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আবার বার বার বিশ্বাস ভেঙে যাওয়া মানুষ যে পরম অভিজ্ঞতা লাভ করে তা পাথরের মতো শক্ত হলেও হতে পারে কিন্তু তা কখনো পাথরের মতো নিরেট হয় না। কিছু না কিছু সত্যের দ্যুতি ওখান থেকে উৎসারিত হয়। যেমন মেরিয়ামুন যখন আখেনাতেনের শাসন আমলের প্রধান পুলিশ কর্মকর্তার কাছে যান, তার সঙ্গে কথা বলেন, এক পর্যায়ে বড় বিভ্রান্ত পড়েন তিনি। তিনি জানতে চাইলেন, নেফারতিতি কেন রাজাকে একা প্রাসাদে রেখে চলে গেলেন?
মাহো উত্তরে বললেন, এ রহস্য আমি উদ্ধার করতে পারিনি।
:আমার মনে হয় আপনি এখন আর আপনার রাজার দেবতাকে বিশ্বাস করেন না?
:এখন আমি কোনো দেবতাকেই বিশ্বাস করি না।
মাহোর এ বক্তব্যই আমার উপর্যুক্ত বক্তব্যকে সমর্থন করে। তাই বলা যায়, সেই প্রাচীনকালের ফারাও সম্রাট আখেনাতেনের পরিণতি থেকে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের অনেককিছু শেখার আছে। হাজার হাজার বছর আগের মতোই এখনো এ উপন্যাসের পাঠ সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
আখেনাতেন: ডয়েলার ইন ট্রুথ আরবি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় কায়রো থেকে ১৯৮৫ সালে, লেখক নিজে প্রকাশ করেছিলেন। পরে তাগ্রিদ আবু-হাসাবোর অনুবাদে ১৯৯৮ সালে, কায়রোর আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়। পরে ২০০০ সালে একই অনুবাদকের অনুবাদে তা প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক থেকে। কবীর চৌধুরী এ বাংলা অনুবাদটি করেছেন অনুবাদকের ১৯৯৮ সালের সংস্করণ থেকে। প্রকাশকের অসতর্কতার দরুণ বইটিতে শব্দগত কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে। এ ব্যাপারটা পীড়াদায়ক বটে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকদের আরও সতর্কতা অবশ্য বাঞ্ছনীয়।


আখেনাতেন : সত্যে বসবাসকারী ॥
মূল-নাগিব মাহ্‌ফুজ ॥
আখেনাতেন : সত্যে বসাবাসকারী ॥
মূল-নাগিব মাহ্‌ফুজ ॥
ঢাকা ॥
মূল্য-১৪০ টাকা ॥
সূত্র : দার্শিনক
জানুয়ারি/২০০৮

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ৯:৩২

শামসুদ্দীন হাবিব বলেছেন: ভালো লাগল

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.