নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সবার জন্য ভালোবাসা।

গেছো দাদা

গেছো দাদা › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প : আমি নিজেই ভুত

১৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১২:৫৫


এই মাত্র আমি মারা গেলাম। শালা কি কুক্ষণেই চিংড়ির মালাইকারি খেয়েছিলাম। পেটে সহ্য হয় না, কিন্তু লোভ বড় জিনিষ। একেই বলে প্রবাদ, ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু।’ কোমরে একটা মারাত্মক ব্যাথা ছিল। এখন বেশ আরাম লাগছে। ব্যাথা-টাথা কিছুই নেই। শরীরটাও ফুরফুরে হয়ে গেছে। ওই যে আমার লোভ-লালসার শরীরটা নিঃশব্দে পড়ে রয়েছে খাটে। উফ, বউটাকে দেখো, কেঁদে মরছে। সব জানি, সাজানো ঘুঁটি। প্রতিবেশীরাও বাড়িতে এসে গেছে। কি সব বলছে রে বাবা! আমি খুব ভালো লোক ছিলাম। ওই শালা ভোলা ব্যাটাও এসেছে। আমার পাঁচিলের গায়ে পাঁচিল তুলেছিল। বলেছিলাম বলে থানা পুলিশ করেছিল। আমিও দিলুম গুঁজে, চালাকি? ওপর মহলে চেনাজানা ছিল। ব্যস, সব চুপচাপ। তারপর থেকে মুখ দেখত না হারামজাদা। এখন দেখো, কত আমার প্রশংসা করছে। ইনিয়ে বিনিয়ে কত কিছু বলছে রে বাবা!
এ্যাই মরেছে, পাড়ার রাজনৈতিক নেতাটা আবার কেন হাজির হল, কি উদ্দেশ্য? ওরে বাবা, কত্তো বড় মালা এনেছে। আমার শরীরে ফেলে দিল। জানি না কোন প্রোমোটারের সঙ্গে ঝাড়লো। ও ব্যাটাকে ভালোই চিনি। আমার সঙ্গে ১০হাজার টাকা চাঁদা চেয়েছিল। দিইনি বলে শাঁসিয়েছিল খুব। আরে আমার কি করতে পারলি? কচু। যাক গে রাজনীতি এসে গেলে মুশকিল। ওরে বাবা রে কি সৌভাগ্য আমার। বড়ছেলে আর বউমা হাজির হয়েছে। খারাপ নয়। ত্যাদর হচ্ছে ছেলেটা। ভালো চাকরি করত বলে বিয়ের মাসখানেক পরই বউকে নিয়ে পিটটান। শ্বশুরকে বাবা বলে ডাকে, শাশুড়িকে মা মা বলে গলে যায়। নিজের মা আর বাবা যেন বানের জলে ভেসে এসেছে। এখন কত ভালো ভালো কথা বলছে। নিশ্চয় কিছু ধান্দা আছে। আমার টাকাকড়ি, সম্পত্তির ভাগ নিয়ে ভাবছে বোধহয়। কিন্তু আমার ছোট ছেলেটা কোথায়? গোবেচারা পানু?
ও মা, এ কি দেখছি গো। আমার বউটাকে দেখ, কান্না ভুলে গেছে কখন, চোখমুখ কি উজ্জ্বল। ও বাব্বা, এই জন্যেই বলে, নারি মন দেবতারাও বুঝতে পারেন না। আলমারি থেকে আমার ব্যাঙ্কের বই সরাচ্ছে, ভালো রকম টাকাকড়ি তুলে রাখতাম বাড়িতে। বলা যায় না বয়স বাড়ছে কখন কি হবে। দেখো কাণ্ড, সে গুলোও চুপিচুপি সরিয়ে ফেলছে। এই দেখো, আমার সব খবরই রাখে দেখছি। বিছানার তলায় দুটো পাসবই আলাদা ভাবে রেখেছিলাম। ঠিক সন্ধান জানত, এখন বার করে নিচ্ছে। তা নিক গে। সবই তো ওর জন্যই ছিল। আরে বড়ছেলে মায়ের কাছে খুব করুণা দেখাচ্ছে দেখছি। শুনি তো কি বলছে।
কান পাতলাম আমি। বড়ছেলে মাকে বলছে। মন খারাপ করো না মা, আমি আছি তো। হারামজাদার কথা শোনো। নির্ঘাত কোনো ধান্দা আছে। হ্যাঁ, ওই তো টাকা কড়ির কথা জিগ্যেস করছে। আরে বাবা, যেমন কুকুর তেমন মগুর। তোর মাকে তুই চিনিস না ঝন্টু। আমি চিনি। সারা জীবন আমার নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে। তুই তো ওর পেটে হয়েছিস। কেমন দিল? কেঁদেরেঁধে বলে দিল, ভাড়ার শূন্য। এখন বোঝ ঠ্যালা। এই রে বড় শালী এসে গেছে। সঙ্গে ওর বর বিপ্লব। শালী আরেক যন্তর। ওই দেখো শালীর কাণ্ড। সারা জীবন রূপ নিয়ে মরল। দেখো দেখো, উঠানের একপাশে গিয়ে ছোট্ট আয়না বার করে মেকআপ ঠিক করে নিচ্ছে। আমি জানি এক্ষুণি সুর তুলে কাঁদতে আরম্ভ করবে। বিপ্লবটা সারা জীবন ওই বউ নিয়ে জ্বলে মরলো। সপ্তাহে পাঁচ দিনই বিউটি পার্লারে বসে থাকে।
ওই তো আমার ছোটছেলে পানুরাম। আহা বড্ড ভালো। কত করে বললুম, ও পানু আমি টাকা দিচ্ছি বাবা, ভালো করে একটা ব্যবসা কর। তা বলে কি, না বাবা পারব না। যদি তোমার কষ্টের টাকা নষ্ট হয়। আমি বলেছিলুম, হয় হবে। তোর কি। তা কথা শুনলো না। টিউশনি করে। ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না, এতে কোনও ভবিষ্যত নেই রে। পরের ছেলে মানুষ করে তোর কি লাভ হারামজাদা। আমার বুকটা ভেঙে যায় ওই পানুর জন্য। নিজের স্বার্থটা কোনওদিন বুঝল না। আর মাকেও খুব ভালোবাসে।
এ্যাই দেখ, আরেক নেতা এসে হাজির। জীবনে আমি পার্টি করিনি। কেন যে আসছে। কি বলছে ও বড় ছেলেকে? যাক গে শুনব না। মেজাজ খারাপ করব না। জীবনে অনেক মেজাজ খারাপ করেছি। মৃত্যু হয়েছে এখন। মোটেও মেজাজ খারাপ করব না। খোস মেজাজে থাকব। ডুবে যাক তরী ভেসে যাক প্রাণ। ওই যে কাঁধে উঠলাম আমি। বড় ছেলেটা কি বদমাশ। বলছে কাঁধ দিতে পারবে না ব্যাথা আছে। হারামজাদা, যখন অন্য কারোর মোট বস। পানুটা কাঁধ দিয়েছে। ও পানু, এক ভাবে দিস না বাবা। ব্যাথা হতে পারে।
ওদিকে বউয়ের কাণ্ড দেখ। একটু পরেই শাখা সিঁন্দুর সব যাবে। বাবু এখন শালীর সঙ্গে সিরিয়ালের গল্প জুড়ল। হায় রে কপাল, একেই বলে সংসার। আহা কি লেখেছিলেন সাধক মহাশয় ‘দণ্ড দু’চার কান্নাকাটি শেষে দেবে গোবর ছড়া।’
এই যে শ্মশানে ইলেকট্রিক চুল্লির কাছে শুয়ে আছি আমি। আমার মুখটা দেখো, প্রশান্তিতে ভরে আছে। ওরে ব্যাটা জীবন হারালি সে খেয়াল নেই? যাক ঢুকে গেছি। বেশি লাইন পড়েনি। ছাই হচ্ছে আমার দেহ। আর আমি হাসছি। বহুত ঝামেলা মিটলো। শালা একেই বলে নাকে দড়ি দিয়ে সংসার কামারশালে পেটাই করা।
এখন বেশ রাত হয়ে গেছে। আমি একাকি শ্মশানে বসেছিলাম। হঠাৎ মনে হল, যাই বাড়িতে একবার যাই। দেখি আসি পরিস্থিতিটা। হুস করে চলে এলাম। দেখলাম আমার ঘরে বউ পা ছড়িয়ে বসে গল্প করছে। মুখ দেখে কে বলবে, কয়েক ঘন্টা আগে আমি মারা গেছি। স্বার্থে বাধা সংসার। ভালোলাগে না। কিন্তু পানুটা কোথায়?
আমি ছাদে হুস করে চলে গেলাম। ঠিক, যা ভেবেছি তাই। মন খারাপ করে একা একা দাঁড়িয়ে আছে। হুম, আমার কথাই ভাবছে। উফ, কি করি, ছেলেটা কাঁদছে একা একা। আমি এগিয়ে গেলাম। এখন আমার কিছুই করার ক্ষমতা নেই। তবে দেখা দিতে পারি। আমি আবছায়া হয়ে ওর চোখের সামনে ফুটে উঠলাম। আরে, একটুও ভয় পেল না! বলল, বাবা তুমি? আমি ঈশারায় বললাম, ভালো করে থাকিস বাবা। ও বলছে শুনতে পাচ্ছি। বাবা, তুমি আর এসো না। স্বার্থবাদীদের দেখলে দুঃখ পাবে। আমি পানুর কথা রাখলাম। মিলিয়ে গেলাম।
পানু বলতেই আমি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলাম। একেই বলে মন না মতিভ্রম। এমন সময় মনে পড়ে গেল সুপর্ণাকে। আমার প্রথম ভালোবাসা। নচি’দার গানটা মনে পড়ে গেল। ‘সে আমার প্রথম ভালোবাসা নীলাঞ্জনা।’ তবে না নীলাঞ্জনা নয়, সুপর্ণা। আমার প্রথম ভালোবাসা। এখন আমি সব পারি। যেখানে সেখানে যেতে পারি। মনে পড়ে গেল সব। আমার বাড়ির দুটো বাড়ি পরে থাকতো সুপর্ণা। আমাদের ছাদ থেকে ক্লিয়ার ওদের ছাদ দেখা যেত। কোনওদিন চোখ তুলে তাকাইনি কিন্তু হঠাৎ ওকে আবিস্কার করলাম একদিন। দারুণ দেখতে। কি সাংঘাতিক সুন্দর মুখটা। একই স্যরের কাছে রোজ রাতে পড়তে যাই অথচ চোখ তুলে দেখা হয়নি। হঠাৎ করে একদিন বিকালে ওকে ছাদে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম, কেন বিকাল হলেই পাড়ার ছেলেগুলো দূরে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। হাঁ করে কেন চেয়ে থাকত সুপর্ণার বাড়ির ছাদের দিকে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম। আর নয়, তোরা সব ভো কাট্টা। আমার চাই সুপর্ণাকে।
তখন বিকেল ছিল। সুপর্ণা ছাদে ঘুরছিল। আমি ছাদ থেকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। ছাদ থেকে ওর দিকে চাইলাম। সুপর্ণাও চাইল। চোখাচোখি হতেই হাসল। আমি ফেঁসে গেলাম ওর হাসিতে। মনে মনে বললাম, তোমায় আমার চাই। তুমি সোনার হরিণ। মনে মনে ঠিক করলাম, যা হয় হবে আজই চিরকুট দেব ওকে। সেদিন চৈত্র মাস ছিল। কোনওদিন রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত ছিলাম না। এই বিকালে চৈত্রের মৃদুমন্দ পবনে কোথা থেকে ভেসে এল দেবব্রত বিশ্বাসের উদাত্ত কন্ঠে ‘ চৈত্র পবনে মম চিত্ত ....’। মনটাকে আরো পাগল করে দিল। ভালোলেগে গেল গানটা। মানে খুঁজে পেলাম গানের। আমি দ্রুত নিচে নেমে একটা কাগজের চিরকুট টেনে পরিস্কার বাংলায় লিখলাম ‘আমি তোমায় ভালোবাসি সুপর্ণা’। তারপর একটা ইটের টুকরো যোগাড় করে রঙিন সুতো দিয়ে কাগজটা বেঁধে ছাদে উঠে এলাম। তখনও ছাদে পায়চারী করছে সুপর্ণা। আমি ছুঁড়ে দিলাম কাগজটা। শালা একেই বলে ভাগ্য। ঠিক সেই সময় সুপর্ণার মা ছাদে উঠতেই তার গায়ে ঢিলটা লাগল। তিনি সুপর্ণাকে জিজ্ঞেস করছেন, কে ঢিল ছুঁড়ছে? ক্লাস এইটের ছাত্রী তখন ও। ক্ষিপ্র গতিতে কাগজ সমেত ইটের টুকরোটা ফ্রকের ভিতর চালান করে দিয়ে বলল, কেউ নয় তো। আমি ছাদে জলের ট্যাঙ্কের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। সুপর্ণা ওর মাকে বলছে, পায়রা, পায়রা। আকাশে তখন এক ঝাঁক পায়রা উড়ে যাচ্ছিল। কেন জানি না ট্যাঙ্কের পিছনে লুকিয়ে আমার সেই গানটার কথা মনে পড়ে গেল। তবে মা নয় দিদি, দিদি পায়রা পায়রা....। কি সাংঘাতিক চুতুর মেয়ে, মাকে বলছে, ওই দেখ পায়রা আকাশে। কি সুন্দর লাগছে দেখো মা। ওর মা কি বুঝলেন কি জানে। তিনি বললেন, ছাদে বেশিক্ষণ থেকো না। সন্ধ্যায় পড়া আছে, যেতে হবে। ওর মা নেমে যেতেই আমি আড়াল থেকে বেরিয়ে সুপর্ণার দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে কটমট করে তাকাল। ভয়ে আমার বুক উড়ে গেল যেন। তারপর হঠাৎ মুখ ভেংচে, চড় দেখিয়ে নেমে গেল। এর মানে কি? আমি সমবয়সী তিনটি বন্ধু কাছে ছুটলাম। তৃতীয়জন হল বাবলু। পাক্কা ছেলে। সেই মানেটা বলতে পারল। বলল, এর মানে ও ফেঁসেছে। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, এখন কি হবে? বাবলু বলল, কাগজ ছোঁড়ার আগে মনে ছিল না হতভাগা? যা এখন। আমি বাড়ি ফিরে এলাম।
ঠিক করলাম পড়তে যাব না। স্যরকে বলে দিলে কেলেঙ্কারি। তাছাড়া যদি কিছু বলে ও। সন্ধ্যা নেমে এল। মা বলল, কি রে পড়তে যাবি না? রেডি হ’। আমি বললাম, শরীর ভালো নেই। মা বলল, ও সব বললে হবে না, যা পড়তে। আমি বাধ্য হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে ঘুরে কাটাব উপায় নেই। না গেলে আবার স্যর বাড়িতে বলে দিলে মুশকিল। আমি মনে জোর আনলাম। ভয় কি রে পাগল। আমি কি কমতি আছি। এই বয়সেই অঙ্কে সাংঘাতিক ভালো। ফটাফটরে নাগাড়ে ইংরাজি বলে যেতে পারি। বাবা শিখিয়েছেন। তবে ইলিশ মিডিয়াম তিনি পছন্দ করতেন না। তাই বাংলা মিডিয়ামেই ভর্তি করেছিলেন। সুদেব স্যরও ইংরাজিতে চিঠি লিখলে আমায় দিয়ে পড়িয়ে নেন। মোটকথা মেধাবী ছাত্র আমি। কমতি নেই অন্য কিছুতেও। বাবা বড় পোস্টে চাকরি করতেন। মা শিক্ষিকা ছিলেন। আমাদের বাড়ির যথেষ্ট সুনাম আছে। আমাকে দেখতেও খারাপ নয় বলে অনেকে। বুক ফুলিয়ে সুদেব স্যরের বাড়ি চলে গেলাম।
ওই তো সুপর্ণা হেঁট হয়ে বসে অঙ্ক করছে। এক ঢাল চুল তার পিঠে আপনমনে পড়ে আছে। কি ভালো যে লাগছে। আমি সুড়সুড় করে স্যরের ক্লাসে গিয়ে বসে পড়লাম। স্যর কয়েকটা অঙ্ক দিয়ে বললেন, তোরা সবাই কর আমি আসছি। আমি আড় চোখে ওর দিকে চাইলাম। মুখটা কি অদ্ভুৎ। কি সুন্দর দেখতে। তারপরই বুকটা ছ্যাঁক করে উঠলো। স্যরকে বলে দেয়নি তো? এক সময় পড়া শেষ হল। আমি অপেক্ষা করছিলাম, ও বেরিয়ে গেলে যাব। সুপর্ণাও অপেক্ষা করছে। শেষকালে যাবার সময় পিঠে রাম চিমটি কেটে গেল। আমি পিছু নিলাম ওর। সবাই চলে যাবার পর একই রাস্তায় হাঁটছি। হঠাৎ কাছে এগিয়ে এসে বলল, এত বোকা কেন? ওভাবে কেউ কাগজ ছোঁড়ে! যদি মা দেখে ফেলত! এখানে দিলেই তো হত। তারপর হাওয়ার বেগে বেরিয়ে গেল। আমি বুঝে গেলাম, ও রাজি। চিৎকার করে উঠলাম, মার দিয়া কেল্লা।
স্কুল থেকে কলেজ। জমাটি প্রেম চলছে। ওকে ছাড়া বাঁচতেই পারব না এমনই অবস্থা আমার। এমন সময় একদিন ম্লান মুখে আমায় বলল, হল না। আমি বললাম কি? ও বলল, মা-বাবা জেনে গেছে সব। বাবা রেগেমেগে বলেছে, এত কাছে মেয়ের বিয়ে দেব না। আমি পাত্র খুঁজছি।
একদিন সুপর্ণার বাড়িতে সানাই বেজে উঠলো। আমার বুক ভেঙে যেতে লাগল। আমি খুঁজতে লাগলাম যত বিরহের গান। একদিন মনকে আবার ফিরে পেলাম। সময় সব কিছু অনেকটাই ঠিক করে দেয়। প্রতিজ্ঞা করলাম। ভালো, খুব ভালো একটা চাকরি চাই। আমার মেধা আছে। আমি তীব্র লড়াই শুরু করলাম। পেয়ে গেলাম। দারুণ চাকরি। তারপর একদিন আমারও বিয়ে হল। সুপর্ণার সঙ্গে একবার দেখা হতে বলল, তোমার বউটি তো বেশ। কি বলব? আমি শুধু হাসলাম।
এখন আমি সুপর্ণার বাড়ি যাব। ও আমায় ঠিক চিনতে পারবে। না না, আমার সঙ্গে ওর কোনও স্বার্থের সম্পর্ক নেই। আমি গুপী গায়েন বাঘা বায়েনের মত দুহাতে তালি দিয়ে বলালাম, সুপর্ণা ব্যানার্জি। নিমেষে সুপর্ণার বাড়িতে হাজির হয়ে গেলাম।
কি বড় বাড়িরে বাবা। কোথায় খুঁজি! পেয়ে গেলাম দোতলার ঘরে। পর্দা ফাঁক করতেই দেখলাম, সুপর্ণা বসে আছে। রাজরানীর মত লাগছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রূপে যেন আরো মাধুর্য লেগেছে। কি যে লাগছে! ওমা ওরা কারা? নিশ্চয় নাতি নাতনি হবে। চারটে ফুটফুটে বাচ্চা ওকে ঘিরে রেখেছে। এমন সময় অদ্ভুৎ একটা সুন্দর গন্ধ পেলাম। পারফিউমের কি! না না, আমার প্রথম ভালোবাসার গন্ধ। রিয়েলি কি সুবাস, কি পবিত্র। আমি ডাকলাম, সুপর্ণা, সুপর্ণা। শুনতে পাচ্ছে না। না পাবারই কথা। আমার ডাক তো পরলোকে পৌঁচ্ছাছে। আমি ঠিক করলাম, ওকে দেখা দেব। আমার প্রথম ভালোবাসা ও। আহা, সেই সব দিন। কিন্তু ও কি বলছে নাতি নাতনিদের! কার গল্প বলছে? ওমা কান পেতে শুনি ঠাকুমার ঝুলি, দাদামশাইয়ের থলে থেকে গল্প বলছে। এখনও এসব আছে! কি জানি।
আমার নিজের ঠাকুমার কথা মনে পড়ে গেল। সেই গ্রাম, সেই স্তব্ধ রাত। আমরা কয়েকজন ঠাকুমাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতাম। ঠাকুমা ব্যঙ্গমা আর ব্যঙ্গমীর গল্প বলত। সেই রাজকন্য, সেই পঙ্খীরাজ। ঠাকুমার গল্প বলার স্টাইল ছিল অসাধারণ। শোবার ঘরে বড় খাটে আমরা সবাই। সামনে বিশাল বড় জানালা খোলা। দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ। আকাশে ঝাঁক ঝাঁক তারার দল। গল্প শুনতে শুনতে ভয়ে ভয়ে জানালার দিকে তাকাতাম। গল্প বলার ধরনে মনে হত পঙ্খীরাজ জানালা দিয়ে এক্ষুণি ঘরে ঢুকবে। হায় সে সব দিন। আমার কান্না পেয়ে গেল। কিন্তু এখন কাঁদলে চলবে না। সুপর্ণার সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমি আবার ডাকলাম নাম ধরে। ও খেয়ালই করছে না। এবার আবছায়া হয়ে ওর কাছাকাছি দাঁড়ালাম। কি আশ্চর্য, দেখতেই পাচ্ছে না আমায়। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। তাহলে কি ও আরো উন্নত স্তরের! আমি ওর দৃষ্টিগোচর হচ্ছি না কেন? অনেকবার চেষ্টা করেও পারলাম না। শেষে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ভালো থাকো তুমি নাতি নাতনিদের নিয়ে। ভালো থাক। বিদায়।
আমি দোতলা থেকে বাইরে আসতেই সুদেব স্যরের কথা মনে পড়ে গেল। ঠিক করলাম, দেখা করব। স্যর আমায় অনেক হেল্প করেছিলেন। এই সব যখন ভাবছি কে যেন আমার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে বলল, শালা, ধরেছি। কয়েকঘন্টা আগে মারা গেছে। সেই থেকে চরকি নাচন নাচাচ্ছে আমায়। এই চল তো। আমি অবাক হয়ে বললুম, কে গো তুমি? সে বলল, তোর বাপের বাপ। আমি বললুম, তার মানে।
আরে বুঝলি না, আমি হলাম গিয়ে যমরাজের দূত। তোকে নিতে এসেছি। তখন থেকে তোর পিছনে ছুটছি। এখান সেখান করছিলিস। চল চল, সগ্গে যাবি চল। আমি বললুম, ওখানে নিয়ে গিয়ে কি করবে গো। দূত বলল, তোর হিসাব হবে। যা পাপ করেছিস ফল দেওয়া হবে। আমি বললুম, আমি তো পাপ করিনি। কোনদিন কাউকে ঠকায়নি। ঘুষ নিইনি। আমার চরিত্রও ঠিক আছে।
চুপ বদমাশ। চরিত্র ঠিক আছে মানে? মনে করে দেখ, কত সুন্দরীকে তুই মনে মনে চুমু খেয়েছিস, পাবার আশা করেছিস। পাশের সহকর্মীটাকে একা পেয়ে ক্যান্টিনে চুমু খাসনি? আমি অবাক হয়ে বললুম, তখন তো কেউ ছিল না। তুমি জানলে কি করে? দূত বলল, আমরা সব জানি। তোরা ভাবিস কেউ দেখছে না। এই তো উঁকি মেরে পরস্ত্রীকে দেখছিলি। মরে গিয়েও শান্তি নেই? আমি বললুম, কি যা তা বলছো? ও পরস্ত্রী হতে যাবে কেন? ও তো আমার ভালোবাসা। ছাই বাসা। চল। বলেই হেঁচকা টান মারল দূত।
ভেসে চলেছি সোঁ সোঁ করে। চারিদিকে প্রবল অন্ধকার। আমি বললুম, কোথায় চলেছি গো? দূত বলল, যমের দক্ষিণ দুয়ারে। বেশ খানিকক্ষণ চলার পর বলল, ওই দেখ প্রোটেক্টেট এরিয়া। আর কোনও কথা বলবি না। যমরাজ কোন কোন আত্মাকে তুলে নেবেন সেই ধ্যানে আছেন। ধ্যান যেন না ভাঙে।
আমি বললুম, আমাকে তুমি বাঁচাও না গো। দূত বলল, আরো অনেক পাপ আছে তোর। যা মাইনে পেতিস সত্যিটা বলিসনি বউকে। টাকা লুকিয়ে রাখতিস। আমি বললুম, সে তো ওদের জন্যই। দূত বলল, তা জানি না। চল দেখি চিত্রগুপ্ত স্যর কি বলেন। আমি বললুম, ওকে ঘুষ দেওয়া যায়? দূত বলল, ওকে দেবার আগে আমাকে দিতে হয় বাবা। তাহলে তোর জন্য কিছু করতে পারি। প্রোটেক্টেট এরিয়ায় পড়তেই হঠাৎ একটা হেঁচকা টান অনুভব করলুম, আমি চমকে দূতকে বললাম, কিসের টান গো? দূত বিড়ি ধরিয়ে বলল, পার্থিব টান চলে গেল রে তোর। বেঁচে গেলি।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ২:২৩

আকতার আর হোসাইন বলেছেন: বেশ লম্বা গল্প। তাই পড়িনি এখন। তাছাড়া এখন গভীর রাত। যদি আবার ভয় পেয়ে যায়...?? আসব আবার। শুভ রাত্রি।

২| ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৩:৫৮

রডারিক বলেছেন: অসাধারণ লিখেছন দাদা। গল্পের মাধ্যমে জীবনের অনেক সত্য কথা তুলে ধরলেন। অনেক ধন্যবাদ।

৩| ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ ভোর ৪:০১

রডারিক বলেছেন: অসাধারণ লিখেছেন দাদা। গল্পের মাধ্যমে জীবনের অনেক সত্য কথা তুলে ধরলেন। অনেক ধন্যবাদ।

৪| ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৯:২৫

রাজীব নুর বলেছেন: ভীষন মজার।

৫| ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১১:৪০

গিয়াস উদ্দিন লিটন বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন দাদা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.