নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আরেকটা জীবন যদি পেতাম আমি নির্ঘাত কবি হতাম
বাবা দিবস উপলক্ষ্যে আমার পিতৃঋণ সিরিজ ১-১০ একসাথে দিলাম।সকল সন্তানের পক্ষ থেকে বাবার জন্য এই নিবেদন-
পিতৃঋণ-১
————
প্রথমে স্বপ্নে,
তারপর আধো জাগরণে-
ছিটকে পড়ল কিছু জল শরীরে আর মনের ভিতরে।
আশ্চর্য রকম শীতল
অথচ শরীর মন আগুন- পোড়া হাহাকারে ছটফট করে উঠল।
ঘুম ভেঙে যায় অস্বস্তিতে।
গভীর রাতে বাদুরের কামড়ানো চাঁদের আলোতে জানালা দিয়ে তাকাই,
দেখি ল্যাম্পপোস্টের নিচে একজন মানুষ
দাঁড়িয়ে।
মনে হলো মানুষটি আমার জানালার দিকেই তাকিয়ে আছে অনন্তকাল ধরে।
এতো দূর থেকেও মানুষটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
চমকে উঠলাম।
ঠিক মৃত বাবার মতো লাগছে,
আবার আমার মতোও লাগছে মাঝে মাঝে!!
মানুষটির সাথে দেখা করার লোভে
দৌড়ে রাস্তায় নেমে আসি সাথে সাথে।
আশ্চর্য,
ল্যাম্পপোস্টের নিচে কোন মানুষ দাড়িয়ে নেই।
শধু একটি ছায়া হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে।
আর পায়ে পড়ে আছে একজোড়া সত্যিকারের আসল স্যান্ডেল,
যেটি আমি আর বাবা মাঝে মাঝে
বদলিয়ে পরে বাজারে যেতাম।
আমি চলে এসেছিলাম তখনই।
শধু আমার ছায়াটি আর কখনোই ফিরেনি আমার সাথে।
আমার বিছানাটা যে যে রাতে ভিজে থাকে
শরীর আর মনের জলে-
সেসব রাতে জানালা খুললেই দেখি,
ল্যাম্পপোস্টের নিচে দুটি ছায়া গল্প করছে নিশ্চিন্তে।
আর কিছুক্ষণ পরপর তারা পায়ের স্যান্ডেল বদলিয়ে পরছে।
—————————————
পিতৃঋণ -২
———————
অনেকদিন আগে-
একবার চোখে ছলছল জল নিয়ে চৈত্রের সন্ধ্যা রাত্রিতে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়েছিলাম।
সেদিন মনে হয়েছিলো এই শহরে সব বৃষ্টিত ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে।
মোড়ের ট্রাফিক পুলিশটিকে চার্চের ফাদারের মতো লেগেছিলো।
দু’হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে ফুটপাত দিয়ে
হাটতে হাটতে বাবাকে আসতে দেখলাম সেদিনই,
গোপনে সংসারের খরচ বোধহয এই ভাবে কিছুটা বাঁচান তিনি প্রতিদিন।
আড়ালে দাঁড়িয়ে সেদিন,
আমি চোখে ছলছল জল নিয়ে বাবার হেটে যাওয়া দেখলাম।
পনেরো বছর আগে মরে গিয়েও
বাবা এইভাবে গোপনে সংসারের খরচ বাঁচিয়ে যাচ্ছেন সেদিনই আমি টের পেলাম।
তারপর থেকে প্রতিদিন আমি সন্ধ্যা রাত্রিতে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি বাবার জন্য,
বাজারের ব্যাগ দু’টো নিজে টানবো বলে।
অনেক রাত্রিতেও যখন বাবা আসেনা-
তখন প্রতিবার ট্রাফিক পুলিশের কাছে পাপ স্বীকার করে বলি,
বাবাকে দেখলে বলবেন-
“ আমরা এখন নিজের গাড়িতেই চড়ি,
আর এতো কষ্টের দরকার নেই,
একটা রিকশা নিয়ে যেনো তিনি বাড়ি ফিরে।”
————————————————
পিতৃঋণ -৩
—————
বাবার ব্যবহৃত অনেকগুলো পাঞ্জাবি স্বজনহারা হয়ে শুয়ে আছে আলমারিতে।
বাবা চলে যাওয়ার পর মাঝে মাঝে-
আমি আর মা দুজনেই লুকিয়ে গল্প করি তাদের সাথে।
শুক্রবার আসলেই এক অদ্ভুত সমস্যা হয়-
বাজার সদাই করে দেরি হয়ে যায় সব সময়।
তাড়াহুড়া করে মসজিদে দৌড়াই ছেলেকে নিয়ে জুম্মার নামাজ পড়ব বলে।
প্রতিবারই কিভাবে যেনো একই ভুল করে
ফেলি!!
বাবার কোন না কোন পাঞ্জাবি ঘুরে-ফিরে পরে ফেলি।
মা কখন যে আবার ধুয়ে আয়রন করে রেখে দেয় একই জায়গায়-
টেরও পাইনি কখনো।
মসজিদে নামাজ শেষে ছেলে একদিন বলল-
“বাবা তুমি ইচ্ছে করেই দাদুর পাঞ্জবিগুলো পরো-
যেনো তোমাকে দাদুর মতো দেখায়।”
মসজিদের দেয়ালে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললাম-
“তোকেও মাঝে মাঝে আমার মতো লাগে,
যখন তোর দাদুর পাঞ্জাবিগুলো পরি।”
নামাজ পড়ে যখন বাড়ি ফিরি-
মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সব সময়।
আমার মনে হয় মা আমার জন্য নয়
হয়তো বাবার জন্যই দাঁড়িয়ে থাকে-
প্রতি জুম্মার পর গত পনের বছর যাবত।
————————————————
পিতৃঋণ -৪
————————
ঘর থেকে বের হবার মুখে দরজার পাশেই একটা জুতার সেল্ফ।
সেখানে পনেরো বছরের পুরোনো বাটার একজোড়া কালো জুতা এখনো চকচক করে।
মা প্রতিদিন সকালে বাবার অফিসের জুতা ধুলো পরিষ্কার করে এখনো কালো রঙের পালিশে ঝকঝকে রাখেন-
যেন বাবা একটু পরই অফিসে যাবেন!!
মা বোধহয় ভুলে গেছেন,
-মৃত মানুষ কখনো অফিসে যায়না,
তাদের অফিসে বসার কোনো জায়গাও নেই,
তারা শুধু থাকে আপনজনেরই বুকে।
জুতার পালিশের রঙ ফুরিয়ে গেলেই
আমি বাটার দোকান থেকে আবারও কিনে এনে রেখে দেই মার জন্য।
আমার অফিসে যাবার সময় মা প্রায়ই বাবার জুতা জোড়া এগিয়ে দিয়ে বলেন-
“দেখতো তোর পায়ে এখন হয় কিনা?”
আমি মাকে বুঝাতেই পারিনা আমার পা আর বড় হবেনা,
আমি যতই বড় হইনা কেনো
-আমার পা বাবার পায়ের সমান কখনোই হবেনা!
———————————————
পিতৃঋণ -৫
————————
প্রচন্ড বৃষ্টির রাতে আমার প্রায়ই ঘুম ভেঙে যায়,
কে যেন আমার নাম ধরে ডাকে বজ্রকন্ঠে।
আশ্চর্য, আমি ছাড়া কেউই শুনতে পায়না এই ডাক!!
এক সময় প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়,
-থামতেই চায়না।
জল আর বাতাস ভাসিয়ে নিতে চায় পুরো শহর।
আমি ছাতা নিয়ে বের হয়ে যাই।
যাবার আগে শুধু ভীত ও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা স্ত্রী ও সন্তানদের বলে যাই,
“ বাবা ডাকছেন , বৃষ্টিতে বোধহয় কষ্ট হচ্ছে উনার, তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো”
রাস্তায় বের হতেই দেখি
গলির মাথায় বাবা দাঁড়িয়ে আছেন
- ঠিক ল্যাম্পপোস্টের নিচে।
পান্জাবীটা শরীরের সাথে লেপ্টে আছে
-সেই কখন থেকে বৃষ্টির জলে ভিজে ভিজে।
“তুই এতো দেরি করলি খোকা,
আমি সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে”
তারপর ছাতাটা খুলে উনার মাথায় ধরতেই ঝড়-বৃষ্টি সব থেমে যায় প্রতিবার।
আর মানুষটাও সাথে সাথে হারিয়ে যায়।
বৃষ্টির জলে ভেজা শরীর আর মন নিয়ে বাড়ি ফিরি,
প্রতিবারই দেখি স্ত্রী ও সন্তানরা না ঘুমিয়ে বসে আছে আমার জন্য।
ভেজা ছাতাটা রাখতে গিয়ে স্ত্রী সব সময়ই বলবে,
“বাবা মারা গেছেন পনেরো বছর হলো,
তুমি দয়া করে একজন মানসিক ডাক্তার দেখাও,
তোমার সন্তানরাও তোমার জন্য কাঁদে।”
আমি বিড়বিড় করে বলি,
যেন কেউ শুনতে না পায়-
“ বৃষ্টির রাতে বাসায় ফিরতে দেরি হলেই
বাবা সব সময় ছাতা নিয়ে আমার জন্য
ঐ ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতেন,
-যতো রাতই হোক না কেনো।”
———————————————
পিতৃঋণ -৬
————————
মানুষ করতে গিয়ে
আপনি অনেকবার আমাকে জানোয়ারের মতো পিটিয়েছেন লাঠি দিয়ে,
অল্পতেই প্রচুর বকাঝকা করেছেন।
শরীরে খুঁজলে এখনো লাঠির কালো ছোপ ছোপ দাগ দাগ পাওয়া যাবে।
আপনি যখন আমাকে মারতেন,
তখন আপনাকে ‘টারজান’ ছবিতে দেখা গরিলার মতো লাগতো আমার।
মনে মনে ভাবতাম বড় হয়ে একদিন আপনার এই অত্যাচারের প্রতিশোধ নিবো।
আবার বোকা হয়ে যেতাম যখন টের পেতাম
-আমি ঘুমিয়ে পড়লেই আপনার মতো গরিলা গোপনে আমার শরীরের ব্যাথার দাগে হাত বুলাতে বুলাতে বাচ্চাদের মতো কাঁদছেন।
আমি কখনো বুঝতে দিতাম না,
আমি যে তখন সজাগ ছিলাম।
আপনার কোনটি সত্যি ছিলো,
গরিলা মতো রাগ না বাচ্চাদের মতো কান্না
-তখন বুঝতাম না।
বাবা,
আপনি বেঁচে থাকতে কোনোদিন ঠিকমতো আকাশের দিকেও তাকাননি বোধহয়,
নিজের দিকেও তাকিয়েছেন কিনা আমার সন্দেহ।
আমাদের ভাই-বোনদের পিটিয়ে আর গোপনে কেঁদেই আপনার জীবন পার করলেন।
আমি বড় হওয়ার আগেই আপনি মরে গেলেন কোন কথাবার্তা ছাড়াই,
আমার আর প্রতিশোধ আর নেওয়া হয়নি এই জীবনে।
বাবা,
আমি আপনার মতো কখনোই এতো মায়া দিয়ে গোপনে কাঁদতেও পারবোনা,
তাই আমি আমার সন্তানদের শরীরে কখনো হাত তুলি না।
আমি এখনো বুঝতে পারিনা,
-শুধু আপনার কথা মনে পড়লেই কেন যে আমার মন খারাপ থাকে অনেক্ষণ!!
গভীর রাতে মাঝে মাঝে আপনার জন্য গোপনে কাঁদি তখন।
কষ্ট হয় আপনার জন্য--
আপনার লাঠিপেটা পুরোই বৃথা।
আমি বোধহয় পুরোপুরি মানুষ হতে পারিনি,
মানুষ হলে সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে আপনার জন্য কাঁদতে পারতাম।
বাবা,
আমি মানুষ হতে চাইনা,
আমি শুধু আপনার মতো গরিলা হতে চাই।
———————————————
পিতৃঋণ -৭
———————
কদম ফুলের গন্ধে কী এক রহস্য খেলা করে
আমি ঠিক বুঝতে পারিনা!
কদম ফুলের গন্ধে বোধহয় ঈশ্বরও পাগল হয়ে যান।
তার পাগলামীতে তখন মেঘের বুকেও গর্জন শুরু হয় কান্নার মতো শব্দে।
সেই গর্জন থামে যখন মেঘের বুকের কান্না ঝরে বৃষ্টি হয়ে।
আর আমার বুক থেকে জল ঝরে অপেক্ষা হয়ে।
বৃষ্টির দিন শুরু হলেই,
আমার অস্হিরতা বাড়ে-অপেক্ষা বাড়ে।
অফিস শেষে প্রায় দিনই শহরের শেষ মাথায় বারো মাইল গাড়ি চালিয়ে বাবার কবরের পাশে এসে দাঁড়াই।
অপেক্ষায় থাকি কবে ফুল ফুটবে,
-বাবার কবরে মাটিতে লাগানো কদম গাছ থেকে বাবারই প্রিয় কদম ফুল।
বর্ষাকাল আসলেই আমার বাবা প্রায় দিনই
অফিস শেষে মার জন্য কদম ফুল নিয়ে ঘরে ফিরতেন।
মনে হতো মা যেনো সারাদিন অপেক্ষায় থাকতেন এই কদম ফুলের জন্য।
কী এক অসহ্য মৌ মৌ গন্ধে ঘর ভরে যেতো।
আমার কিছুতেই সহ্য হতো না এই গন্ধ,
মাথা ঘুরতো আমার।
এই অসুখের কথা বাবাকে কখনোই বলতে পারিনি।
আমি টের পাই
বৃষ্টির দিনে এখনো মা অপেক্ষায় থাকেন
এই কদম ফুলের।
বাবা বেঁচে থাকতে জীবনের কোনো কিছুই দিতে পারিনি উনাকে।
উনার মৃত্যূর পর উনারই কবরে একটি কদমের চারা বুনেছিলাম।
এখন বর্ষা শুরুতে সেই কদম গাছ
থেকেই ঈশ্বরকেও পাগল করে অজস্র ভালোবাসা ফুটে
-বাবার কবর থেকেই- আমার মায়ের জন্য।
পনের বছর যাবত বৃষ্টির দিনে
আমার অপেক্ষায় মা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন,
কখন ফিরবো আমি অফিস থেকে।
যেদিন কদম ফুল নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারি সেদিন পুরো ঘর ভরে যায় কদমের মৌ মৌ গন্ধে।
রাত যত বাড়ে গন্ধ ততই বাড়তে থাকে মা'র ঘর থেকে।
বাবার ভালোবাসার কাছে মরণও পারেনি তার সুন্দর এই পাগলামী বৃষ্টির জলে ধুয়ে মুছে দিতে।
কেউ বুঝে না আমি ঠিকই টের পাই,
-কদমের গন্ধ নয়, সারা ঘর জুড়ে ভেসে বেড়ায় মা'র চোখের জল,
বাবার শরীরের গন্ধ,
আর আমার দীর্ঘশ্বাস।
"বাবা,
-কদম ফুলের গন্ধে এখন আর আমার মাথা ঘুরায় না।”
————————————————
পিতৃঋণ -৮
———————
একটি অদৃশ্য ভগ্নস্তুপে দীর্ঘকাল দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে,
একটি কথা বুকে পেরেকের মতে গেঁথে গেছে--
-“আমার, তোমাকে এখন ভীষণ দরকার।”
'দরকার' এমন একটি শব্দ যা স্থান কাল ভেদে বদলে যায়।
বাজার করতে গেলেই অল্পবয়স্ক মাছওয়ালারা আমাকে কীভাবে যেনো পঁচা মাছ গছিয়ে দেয় সব সময়।
অথচ বাবার পরিচিত মাছওয়ালারা থাকলে ডেকে টাটকা মাছ দিয়ে দামও কম রাখেন।
তারা প্রায়ই বলেন,
" আপনার আব্বা খুব ভালো মানুষ ছিলেন।”
'দরকার' শব্দটি আমার কাছে এখন বিশাল প্রার্থনা।
সামান্য মাছের বাজারেও এর অভাব আমাকে
সৃষ্টিকর্তার কথা স্মরণ করিয়ে
-পুরোপুরি আস্তিক বানিয়ে দেয়।
যখনই খুব শক্ত একটা হাতের অভাব বোধ হয়
-ঠিক তখনই 'দরকার' শব্দটি একটা বিশাল শূন্যতা, হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসের হাওরে ডুবে আর ভাসে।
এই 'দরকার' শব্দটি পনেরো বছর যাবত শুধু
-ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো বুকে গুতো মারে সময় অসময়।
এই ব্যস্ত শহরে হঠাৎ হঠাৎ দীর্ঘশ্বাসের যে
গরম বাতাস টের পাওয়া যায়,
সেখানে প্রায়ই ছেড়া ঘুড়ির মতো বাতাসে একটি চিঠি উড়তে থাকে-
যেখানে লেখা থাকে, “ বাবা, তোমাকে আমার এখন ভীষণ দরকার।”
আর আমি মন খারাপ করে পনেরো বছর যাবত সেই সময় দীর্ঘশ্বাসের গরম বাতাসে পুড়তে পুড়তে খোদার কাছে প্রার্থনা করি
- ‘যেখানেই রাখো, আমার বাবা যেনো খুশি থাকেন’।
——————————
পিতৃঋণ -৯
————————
অনেকদিন ধরেই সকালে পত্রিকা পড়তে গেলে হঠাৎ হঠাৎ চশমাটা খুঁজে পাইনা!
সেদিন মা যেন নিশ্চিতভাবেই জানেন আজ আমি চশমা খুঁজে পাবোনা।
সাথে সাথে আলমারি খুলে অতি যত্ন করে মখমল কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা একটা চশমা বের করে দেন।
অনেক পুরোনো কালো ফ্রেমের একটি চশমা,
আমার বাবার চশমা।
আমি সেই চশমা দিয়ে চোখে প্রায় কিছুই দেখিনা,
সব কেমন যেন অস্পষ্ট ছায়ার মতো মনে হয়।
তবুও প্রায় আধাঘন্টা যাবত খুব মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ি
-সব পাতা উল্টে পাল্টে।
আসলে পড়ি না,
পড়ার অভিনয় করি।
মা পাশে বসে থেকে আমার পত্রিকা পড়া দেখেন খুব মনোযোগ দিয়ে,
আর পাহারা দেন যাতে আমার ভুলে বাবার চশমার কোনো ক্ষতি না হয়।
আমি জানি সেই সময় মায়ের চোখ ছলছল থাকে।
পত্রিকা পড়ার পর চশমাটা ফিরিয়ে দিলে
-তখনই তা খুব যত্নে সেই মখমলের কাপড়ে জড়িয়ে আগের জায়গায় রেখে দেন।
বাবা মারা যাবার পর গত পনেরো বছর যাবত প্রায়ই মা আমার পড়ার চশমাটা সকালে কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে রাখেন,
মাঝে মাঝে আমিও ইচ্ছে করে মাকে ডেকে বলি,
-“মা, আমার চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না,
বাবার চশমটা একটু বের করে দাও।”
তখনই ছলছল চোখে এক অদ্ভুত উৎসাহে আমার মা তার মৃত স্বামীর চশমাটা বের করে দেন।
হয়তো, দেখতে চান সন্তানের চোখে সেই চশমাটা কেমন দেখায়!
বেধহয় বাবার ছায়া খোঁজে সেই চশমায়।
প্রতিবারই চশমাটা চোখ থেকে খুললে
আমার চোখ থেকে কেনো যে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ে, বুঝিনা!
বুকটাও খালি খালি লাগে সেই সময়!
আমি সেই জল মায়ের চোখ থেকে লুকিয়ে রাখি খুব স্মার্টভাবে,
শুধু বুকের ভিতরে চিৎকার করে নিঃশব্দে বলি,
-“বাবা আপনার চশমা আমাকে অভিনয় শিখিয়েছে!”
——————————
পিতৃঋণ-১০
————-
অ-কবিতার দিনে অ-ঘুম আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।
এমন সব অ-ঘুমের রাতে ভোরের দিকে ড্রইং রুম হতে পরিচিত মানুষের হাটার শব্দ আর কন্ঠ ভেসে আসে।
খুব অস্থিরতা নিয়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকলেই দেখি-
বাবা ধীরলয়ে হাঁটতে হাঁটতে
আমার লেখা কবিতার বই পড়ছেন।
একই ভরাট কন্ঠের সেই চওড়া বুকের টানটান ছয় ফুটের লম্বা শরীর,
সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা, কলপ দেওয়া কালো চুল- দাড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, বা’হাতে সেই পরিচিত সিকো ঘড়ি।
আমাকে দেখলেই হাসি মুখে তিনি একেকবার একেক কথা বলেন।
কখনো বলেন,
“ভুল হয়েছেরে, মস্ত বড় ভুল।
তোর ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়লেই শুধু শুধু বকতাম।
অথচ এসব বই পড়ে তুই কত্তো কিছু শিখেছিস,
আজকাল সুন্দর করে কবিতা লিখিস,
মানুষের জন্য লিখিস,
মাঝেমাঝে আমার কথাও থাকে।
আরকি জানিস?
সব বাবাদেরই একটা বড় দোষ,
তারা মনে করেন তারাই সংসারে সবচেয়ে বেশি জানেন।
নয়তো বলবেন,
কিসব আজেবাজে কবিতা লিখিস!
হয়তোবা বলেন,
এতো মন খারাপের কী আছে! আরেকদিন লিখিস, ঘুমোতে যা।"
এসব বলেই হাসতে থাকেন তিনি প্রতিবার।
এই হাসির শব্দ বুকে বাজতে বাজতে দূর মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসে।
আজানের শব্দে হঠাৎ করেই বুকে ধাক্কা দিয়ে
-বাবা হাওয়ায় মিলিয়ে যান।
তখন মন খারাপ করে বারান্দায় গিয়ে বসে থাকি।
ভোরের বিরহী আকাশের দিকে তাকিয়ে
হঠাৎ দেখি অস্হির কিছু রঙবেরঙের শব্দ ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাওয়ায় ভাসছে।
সেখান থেকে যখন যেটা দরকার টেনে নিই বুকে-
অ-কবিতার দিনে বুকে বাসা বাধে এক একটা পলাতক কবিতা।
সবাই বলে মৃত মানুষ ফিরে না!
আমার কেন যেন মনে হয়,
আমরা অনেক কিছুই জানিনা।
গত পনেরো বছর ধরে আমার মৃত বাবা আমার অ-সময়ে প্রতিবারই আমাকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দেন।
যেদিনগুলোতে বাবার সাথে দেখা হয়
সেইদিনগুলোতে ফজরের নামাজের সময় খোদার কাছে প্রার্থনার সময় বলি,
-“খোদা, সকল বাবার কথা আমি জানিনা,
তবে আমার বাবা,
-সব কিছুই আমার চেয়ে বেশি জানতেন।”
——————————
রশিদ হারুন
২১ শে জুন, ২০২০ বিকাল ৪:০৪
জিএম হারুন -অর -রশিদ বলেছেন: ধন্যবাদ
২| ২১ শে জুন, ২০২০ রাত ৯:২৫
নেওয়াজ আলি বলেছেন: খুবই ভালো লিখেছেন । চমৎকার
২২ শে জুন, ২০২০ বিকাল ৫:৩৬
জিএম হারুন -অর -রশিদ বলেছেন: ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১| ২১ শে জুন, ২০২০ বিকাল ৩:৩৮
রাজীব নুর বলেছেন: জাস্ট গ্রেট।