![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভাষাসৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম
New 0 0
॥ গাজী মুহাম্মদ শওকত আলী॥
পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোথাও কেউ কোনো ভাষার জন্য বিশেষ করে মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন করেছে, জীবন দিয়েছে, তার কোনো নজির নেই। প্রায় দুইশত বছর ব্রিটিশদের গোলামীর পর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ‘পূব পাকিস্তান’ নামে পূর্ব বঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়। বাংলাভাষা আন্দোলন মূলতঃ দুই পর্যায়ে হয়েছিল। প্রথম পর্যায় ছিল ১৯৪৭-১৯৪৮ সালে। এতে অংশগ্রহণ করেছিল ছাত্র, শিক্ষক, সচেতন শিক্ষিত সমাজ ও বুদ্ধিজীবীগণ, আর দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলন ছিল ১৯৫২ সালে। যাতে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণে গণআন্দোলন হয়েছিল। অধ্যাপক গোলাম আযম ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে গণআন্দোলন পর্যন্ত উভয়পর্যায়ের আন্দোলনেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ক্ষমতালিন্সুদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, সাম্প্রদায়িক বর্ণহিন্দু ও প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতায় ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর শুরু হয় এই অঞ্চলের মুসলিম জাতির গোলামীর জীবন। প্রায় দুইশত বছর ব্রিটিশদের গোলামী করার পর অনেক আন্দোলন আর সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ব্রিটিশ শাসিত পাক-ভারত উপমহাদেশে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের নিয়ে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামের দু‘টি প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট।
বর্তমান বাংলাদেশ ব্রিটিশ শাসিত ‘পূর্ব বঙ্গ’ আর পাকিস্তান শাসনামলের ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বিভিন্নভাবে শোষণ বঞ্চনা আর বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান অংশ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান নামের স্বাধীন অংশও পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা শাসিত শোষিত বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত হয়েছে। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের মায়ের ভাষাও কেড়ে নিতে চেয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করতে।
পাকিস্তানী শাসক ও শোষকদের এ অন্যায়ের প্রতিবাদে আর রাষ্ট্র ও মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে জেগে উঠেছিল এদেশের ছাত্র, শিক্ষক ও জনতা। তৎকালীন তমদ্দুন মজলিস নামের একটি সংগঠন এতে নেতৃত্ব দিয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র বিশেষ করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর জেনারেল সেক্রেটারি বা জি এস গোলাম আযম।
মূলত ভাষা আন্দোলনের বীজ বপণ করা হয় ১৯০০ সালে। এসময় ব্রিটিশ শাসিত যুক্তপ্রদেশের গভর্নর স্যার এন্টনী সরকারি দফতর থেকে উর্দু ভাষা ও বর্ণমালার পরিবর্তে দেবনাগরী অক্ষর প্রবর্তন করেন। যার ফলে মুসলিম জনগোষ্ঠী খুবই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তখন থেকেই উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের ভাষা বা লিংগুয়াফ্রাঙ্কা নিয়ে বিতর্ক চলে আসছিল। ১৯২০ সালে বাংলাকে ভারতের সাধারণ ভাষা করার দাবিতে শান্তি নিকেতনে কবিগুরু রবিন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষার স্বপক্ষে যুক্তিসহ প্রবন্ধ পাঠ করেন। যা তৎকালীন মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে হিন্দীকে রাষ্ট্র ভাষা করা হয়। যদিও কোনো কোনো প্রদেশ এতে সম্মত ছিল না। এদিকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিন্ধু প্রদেশের ডক্টর দাউদ পোতা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত ছিলেন না। তিনি ও পশতু ভাষার কবি খোশাল খান খটকের মতো মোগলদের বিরোধী ছিলেন। কারণ মোগল আমলেই মূলত উর্দু ভাষা বিকশিত হয়েছিল। উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যারা ছিলেন, তাদের যুক্তিছিল, যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের কাছে উর্দু সাধারণ ভাষা সেহেতু উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে কোনো আপত্তি থাকতে পারে না।
ব্রিটিশদের গোলামী থেকে সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিমদের নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান স্বাধীনতার পর পূর্ব পকিস্তান তথা পূর্ব বঙ্গ বা পূর্ব বাংলায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের নেতৃত্বে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মাওলানা আকরম খাঁ, ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদসহ আরো কিছু বুদ্ধিজীবী ও মনীষীগণের সার্বিক সহযোগতিায় তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গঠন করা হয়। তমদ্দুন মজলিসই সর্ব প্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সম্বলিত পুস্তক “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু”? প্রকাশ করে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে রাষ্টভাষা বাংলার পক্ষে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান কতৃক অগ্রাহ্য হলে এখানে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ তিনি ঢাকা রেসকোর্সে ইংরেজিতে বক্তৃতা করেন, এসময় তিনি বলেছিলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। জিন্নাহর এমন ঘোষণায় গোলাম আযম ‘নো’ ‘নো’ প্রতিবাদ করে হলে ফিরে যান।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একদল ছাত্র গোলাম আযমের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে পিকেটিং করতে গেলে ১০/১২ জন ছাত্র গ্রেফতার হন তার মধ্যে অধ্যাপক গোলাম আযম অন্যতম। ভাষা আন্দোলনে ঢাকার আদি অধিবাসীদের তেমন একটা সমর্থ ছিল না বললেই চলে। কারণ ঢাকার আদিবাসীদের ভাষা ছিল উর্দু মিশ্রিত। তা ছাড়াও পুরোনো ঢাকার মাওলানা দীন মুহাম্মদ, মাওলানা জাফর আহমদ ওসমানী ও মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (বা সদর হুজুর) সহ পুর্ব-পাক সাহিত্য সংসদের সক্রিয় সদস্য সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ ব্যক্তিদ্বয় ছাড়াও তৎকালীন আরো অনেক আলেম ওলামা উর্দু ভাষার পক্ষে ছিলেন। কারণ তখন কুরআন ও হাদিসের অধিকাংশ তাফসির ও তরজমা ছিল উর্দু ও ফার্সি ভাষায়। তাছাড়াও তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকার ভাষা আন্দোলনকে ভারতের উস্কানী ও হিন্দুদের আন্দোলন বলে প্রচার করায় জনমনে সন্দেহও সৃষ্টি হয়েছিল।
১৯৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ঐদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রদের একটি বিশাল র্যালি হয়। সে র্যালিতে অধ্যাপক গোলাম আযমসহ তৎকালীন ছাত্র নেতারা অংশগ্রহণ করেন। সেদিন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জিমনিসিয়ামে ছাত্রদের গণ জমায়েতে অংশগ্রহণ করেন। তখন অধ্যাপক গোলাম আযমই ছাত্র জনতার পক্ষ থেকে তৎকালীন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর নির্বাচিত জিএস হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার করার দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করেন ও তা পাঠ করে শোনান।
এটাই ছিল পাকিস্তানী শাসকদের কাছে আনুষ্ঠানিক ও লিখিত দাবি যা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর জিএস হিসেবে অধ্যাপক গোলাম আযম সর্বপ্রথম তুলে ধরেন খোদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এর নিকট। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সন্তোষজনক কোনো আশ্বাস না পাওয়াতে তমদ্দুন মজলিসসহ ছাত্রদের পক্ষ থেকে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচি চলাকালীন সময়ে ১৯৪৮ সালে তৎকালীন ছাত্র নেতা ডাকসুর জিএস অধ্যাপক গোলাম আযম গ্রেফতার হন। রাষ্ট্রভাষা মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন দীর্ঘ হতে থাকে। ইতোমধ্যে অধ্যাপক গোলাম আযম ছাত্র জীবনের ইতি টেনে ১৯৫০ সালে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কর্মজীবন কারমাইকেল কলেজে শিক্ষকতা করাকালীন সময়ে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। উক্ত আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে অধ্যাপক গোলাম আযম দীর্ঘ সময় কারাভোগ করেন।
অধ্যাপক গোলাম আযমের ভাষা আন্দোলনের এই কিংবদন্তী ও সোনালী সোপানকে ইতিহাস আজ উপেক্ষা করছে! কারণ অধ্যাপক গোলাম আযম শুধুমাত্র একজন মেধাবী ছাত্র, ফজলুল হক মুসলিম হলের জিএস ডাকসুর দুই দুই বারের জিএস আর একজন ভাষাসৈনিকই নন তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন পাকা মুসলমান ও আল্লাহর দ্বীনেরও অকুতোভয় একজন সৈনিক আর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপকার।
অধ্যাপক গোলাম আযমের জন্ম ৭ নভেম্বর ১৯২২ খৃষ্টাব্দে বা ৫ অগ্রাহায়ণ ১৩২৯ বঙ্গাব্দে ঢাকায়। তার গ্রামের বাড়ি বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার বীরগাঁও গ্রামে। ছোট বেলা থেকেই অধ্যাপক গোলাম আযম ছিলেন তুখোড় মেধাবী ও নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে জুনিয়র পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪২ সালে হাই মাদরাসা পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ১৩তম স্থান অধিকার করেন। অধ্যাপক গোলাম আযম ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে বিএ ও ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। একই বছর তিনি রংপুরের ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এখানেই শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
অধ্যাপক গোলাম আযম ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে ১৯৪৬ সালে ফজলূল হক মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত জেনারেল সেক্রেটারি বা জিএস ছিলেন। ১৯৪৭-১৯৪৮ শিক্ষাবর্ষে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসুর) নির্বাচিত জেনারেল সেক্রেটারি বা জিএস ছিলেন। অতঃপর ১৯৪৮-১৯৪৯ শিক্ষাবর্ষেও তিনি দ্বিতীয় বারের মতো আবারও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসুর) জেনারেল সেক্রেটারি জিএস নির্বাচিত হন। অধ্যাপক গোলাম আযম শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধে বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র তাকে উপেক্ষা করছে এমনকি ইতিহাস থেকে তার নাম পর্যন্ত মুছে দিতে চাচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক।
©somewhere in net ltd.