![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাংবাদিক, শিক্ষক, ফিচার ও প্রবন্ধ লেখক।
মুসলিম জীবনে ঈদুল আজহা আসে ত্যাগের শিক্ষা নিয়ে। ঈদুল আজহা অর্থ হল পশু জবাইয়ের ঈদ, উৎসর্গের ঈদ, কোরবানির ঈদ। ঈদুল আজহাকে সংক্ষেপে কোরবানিও বলা হয়। কোরবানি শব্দটি ‘কুরবুন’ মূলধাতু থেকে এসেছে। অর্থ হল নৈকট্য লাভ করা, সান্নিধ্য অর্জন করা, প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জন করা। শরীয়তের পরিভাষায়- নির্দিষ্ট জন্তুকে একমাত্র আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত নিয়মে মহান আল্লাহ পাকের নামে জবেহ করাই হল কোরবানি।
কোরবানির ইতিবৃত্ত
কোরবানির প্রথম প্রচলন শুরু হয় মানবগোষ্ঠীর আদি পিতা হযরত আদম (আ.) হতে। তার পুত্র হাবিল ও কাবিলের মাঝে বোন আকলিমাকে বিবাহ করা নিয়ে কলহ বিবাদ দেখা দিলে হযরত আদম (আ.) আল্লাহ পাকের নির্দেশক্রমে এখলাসের সাথে কোরবানি করতে আদেশ দেন এবং বলেন, তোমাদের মধ্যে যার কোরবানি গৃহিত হবে তার সাথেই আকলিমার বিবাহ হবে। এভাবেই কোরবানির প্রথা শুরু হয়। তবে আমরা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর স্মরণে কোরবানি করে থাকি। এ প্রসঙ্গে ইবনে মাজাহ শরীফে এসেছে, হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) হতে বর্ণিত, ‘কতিপয় সাহাবী প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (স.)! কোরবানি কি? হযরত রাসূলে মকবুল (স.) বললেন, তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর সুন্নাত।’ যদিও পরে স্বতন্ত্রভাবে আমাদের ওপর কোরবানির নির্দেশ এসেছে, তবে সে নির্দেশ হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর অনুসরণেই প্রদান করা হয়েছে। তাই আমরা শরীয়তে মুহাম্মাদীর এই নির্দেশ সুন্নাতে ইব্রাহীম (আ.)-এর স্মরণে পালন করে থাকি।
কোরবানির কারণ
হযরত ইব্রাহীম (আ.) কর্তৃক হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি দেওয়ার কারণ সম্পর্কে ‘দুররাতুন নাসিহীন’ কিতাবের ২৩১ নং পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে, একদা হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির উদ্দেশে একহাজার বকরী, তিন’শ গরু ও এক’শ উট কোরবানি করেন। এতে মানবমন্ডলী ও ফেরেশতাকুল খুবই আশ্চর্য হয়। হযরত ইব্রাহীম (আ.) বলেন, আমার কাছে আল্লাহর নামে কোরবানি করার মত আর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। আল্লাহর কসম! এই মূহুর্তে আমার যদি কোন সন্তানও থাকত, তা-ও আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে কোরবানি করে দিতাম। বহুদিন অতিবাহিত হবার পর তিনি স্বীয় পুত্র কোরবানি করার এ কসমের কথা ভুলে যান।
অতঃপর হযরত ইব্রাহীম (আ.) সন্তান লাভের আশায় বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলেন। ফলে আল্লাহ পাক তাকে একটি পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলেন। আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি ইব্রাহীমকে সুসংবাদ দিলাম অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল ভদ্র, গম্ভীর, মর্যাবান সন্তানের’ (সূরা-সফফাত, আয়াত-১০১)। বার্ধক্য বয়সে সন্তান লাভ করে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত। সন্তান দুনিয়াতে এসেছে। সন্তানের নাম রাখলেন ইসমাঈল। তিনি আল্লাহ পাকের দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন। আর স্বাভাবিক কারণে সন্তানের প্রতি তার মন ছিল খুবই দয়াপ্রবণ। মনের সব আদর, মায়া, মমতা, ভালবাসা তিনি সন্তানের প্রতি উজাড় করে দিলেন।
আল্লাহর পরীক্ষা
এবার শুরু হল পরীক্ষার পালা। বাচ্চা এবার বাবার সাথে হাটতে শুরু করল। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যখন তিনি পিতার সাথে চলাফেরার বয়সে উপনীত হলেন’ (সূরা-সফফাত, আয়াত-১০২)। অর্থাৎ যখন তার সাত কিংবা নয় বছর হল। আর এ সময়টা পিতা কর্তৃক পুত্রকে আদর করার উপযুক্ত সময়। ঠিক তখনই আল্লাহ পাক হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে পরীক্ষা করলেন।
‘মিশকাতুল আনওয়ার’ নামক কিতাবে বর্ণিত আছে, আল্লাহ পাক তাকে স্বপ্নে দেখালেন, হে ইব্রাহীম! তুমি তোমার মানতকে (পূর্ব প্রতিশ্রুতি) পূর্ণ কর। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ইয়াওমুত তারবিয়াহ’ তথা চিন্তা ভাবনার দিন হযরত ইব্রাহীম (আ.) ঘুমালেন। স্বপ্নে দেখেন, কে যেন তাকে বলছেন- হে ইব্রাহীম! তুমি তোমার মানত পূর্ণ কর। সকাল বেলা তিনি চিন্তা করলেন, স্বপ্নটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাকি শয়তানের পক্ষ থেকে? এজন্যই ঐ দিনকে ইয়াওমে তারবিয়াহ’ বা চিন্তা-ভাবনার দিন বলা হয়। এ দিনটি ছিল জিলহজ্জ মাসের আট তারিখ। পরবর্তী রাতে তিনি আবারও একই স্বপ্ন দেখলেন। সকাল বেলা তিনি বুঝতে পারলেন, স্বপ্নের নির্দেশটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। এজন্য ঐ দিনকে ‘ইয়াওমুল আরাফাহ’ বা পরিচয় লাভের দিন বলা হয়। এ দিনটি ছিল জিলহজ্জ মাসের নয় তারিখ। এ কারণে ঐ স্থানের নামকরণ হয় আরাফাত নামে। অতঃপর তৃতীয় রাতে তিনি অনুরূপ স্বপ্ন দেখেন। এবার তিনি বুঝতে পারলেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে ইহা পুত্র কোরবানির নির্দেশ। এ দিনটি ছিল জিলহজ্জ মাসের দশ তারিখ। এই দিনে হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে জবেহ করতে মিনা প্রান্তরে নিয়ে গেলেন। এজন্য এইদিনকে ‘ইয়াওমুন নহর’ বা জবেহের দিন বলা হয়।
মাজালিসুল আবরার কিতাবে বর্ণিত আছে, প্রথম রাতে স্বপ্ন দেখে হযরত ইব্রাহীম (আ.) সকাল বেলা উঠে মোটাতাজা একশ বকরী জবেহ করলেন। অতঃপর কিছু আগুন এসে তা খেয়ে ফেলল। এতে তিনি মনে করলেন, তার মানত পূর্ণ হয়েছে। অতঃপর যখন তিনি দ্বিতীয় রাতে আবার স্বপ্ন দেখেন তখন তিনি বুঝতে পারলেন, এই স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাই তিনি মোটাতাজা একশ উট কুরবানি করলেন। অতঃপর আগুন এসে তা-ও খেয়ে ফেললে তিনি মনে করলেন, মানত পূর্ণ হয়েছে। অতঃপর তৃতীয় রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন, কে যেন বলছেন, আল্লাহ আপনাকে আপনার পুত্র ইসমাঈলকে জবেহ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অতঃপর স্বপ্নের মধ্যেই তিনি পুত্রকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন এবং কেঁদে উঠলেন, এমনকি এ অবস্থায় সকাল হয়ে গেল।
আর জ্ঞাতব্য বিষয় হল, নবীদের স্বপ্ন মিথ্যা হতে পারেনা, তা সত্য এবং অহী, তা শয়তানের কুমন্ত্রণা নয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে এটা ছিল নির্দেশ। এই নির্দেশটি সরাসরি কোন ফেরেশতার মাধ্যমেও করা যেত, কিন্তু স্বপ্নে দেখানোর তাৎপর্য হল হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর আনুগত্য পূর্ণরূপে প্রকাশ পাওয়া। স্বপ্নের মাধ্যমে প্রদত্ত নির্দেশে মানব মনের পক্ষে ভিন্ন অর্থ করার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.) ভিন্ন অর্থের পথ পরিহার করে আল্লাহ পাকের নির্দেশের সামনে মাথা নত করে দেন। (তাফসীরে কবীরী)
মিনা প্রান্তরে গমন
হযরত ইব্রাহীম (আ.) এবার পুত্রকে জবেহের উদ্দেশে মিনা প্রান্তরে নিয়ে চললেন। স্ত্রী হাজেরা (আ.)-কে বললেন, তোমার পুত্রকে সুন্দর পোশাক পরিয়ে দাও। তাকে একটি দাওয়াতে নিয়ে যাব। মা হাজেরা (আ.) পুত্রকে সুন্দর জামা পরিয়ে দিলেন, তার শরীরে তৈল মেখে দিলেন এবং চুল আঁচড়িয়ে তাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে দিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) সাথে একটি ছুরি ও রশি নিয়ে পুত্রসহ মিনা প্রান্তরে চললেন। শয়তান ঐ দিন সুযোগ বুঝে প্রতারণার প্রস্তুতি নিল। শয়তান ঐ দিন ধোঁকা দিতে এত অধিক ব্যস্ত হয়ে পড়ল, যা সে সারা জীবনে অন্য কাউকে ধোঁকা দিতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েনি। শিশু ইসমাঈল (আ.) পিতার সামনে সামনে আনন্দে দৌড়-ঝাপ করতে লাগলেন। এমনি সময় শয়তান এসে পিতা ইব্রাহীম (আ.)-কে বলল, দেখনা কত সুন্দর তার মাঝারি গড়ন, সুন্দর গোলগাল চেহারা, কত ন¤্র-ভদ্র আচরণ! এরকম আদরের সন্তানকে জবেহ করতে তোমার একটুও মায়া লাগেনা? হযরত ইব্রাহীম (আ.) বললেন, হ্যাঁ (তোমার কথা ঠিক), তবে আমি এ ব্যাপারে আদিষ্ট হয়েছি। অতঃপর শয়তান প্রতারণায় ব্যর্থ হয়ে মা হাজেরা (আ.)-এর নিকট গেল এবং তাকে বলল, ইব্রাহীম তোমার পুত্রকে জবেহ করতে নিয়ে যাচ্ছে আর তুমি ঘরে বসে আছ! মা হাজেরা (আ.) বললেন, তুমি মিথ্যা বলেছো; কোন পিতা কি স্বীয় সন্তানকে জবেহ করতে পারে? তাছাড়া তিনি একজন নবী ও দয়াবান পিতা। আল্লাহর কাছে কত ফরিয়াদ করে তিনি এই সন্তান চেয়ে নিয়েছেন, আবার তিনিই জবেহ করে দিবেন এটাতো অসম্ভব ব্যাপার। শয়তান বলল, এজন্যই তো সে ছুরি ও রশি সাথে করে নিয়ে গেছে। তোমাকে মূলত ব্যাপারটি জানতে দেয়া হয়নি। মা হাজেরা (আ.) বললেন, কোন্ উদ্দেশ্যে তিনি আদরের সন্তানকে জবেহ করবেন? শয়তান বলল, ইব্রাহীম (আ.) ধারণা করেছেন, আল্লাহই নাকি তাকে সন্তান জবেহ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। মা হাজেরা (আ.) বললেন, যে আল্লাহ সন্তান দিয়েছেন তিনি যদি জবেহ করতে নির্দেশ করেন তাহলে তো অবশ্যই তা পালন করতে হবে। যেহেতু কোন নবীকে অন্যায় কাজে নির্দেশ দেয়া হয় না। তাই আমার ছেলে তো ভাল কথা, আমি নিজেও আল্লাহর নির্দেশকে পালন করতে জীবন দেওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত। (মিশকাতুল আনওয়ার)
শয়তান এবার মা হাজেরা (আ.) এর কাছে সুযোগ না পেয়ে স্বীয় সন্তান ইসমাঈল (আ.)-এর কাছে আসল এবং বলল, হে ইসমাঈল! তুমি কত আনন্দ-ফূর্তি করছ, খেলছ। অথচ তুমি কি জান তোমার পিতা তোমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? শিশু ইসমাঈল (আ.) বললেন, আমি আব্বার সাথে দাওয়াতে যাচ্ছি। শয়তান বলল, আসলে তুমি ব্যাপারটি জান না। তোমাকে তোমার আব্বা জবেহ করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। দেখ তোমার আব্বার সাথে রশি ও ধারালো ছুরি রয়েছে। রশি দিয়ে তোমাকে বেঁধে জবেহ করবে। শিশু ইসমাঈল (আ.) বললেন, তুমি মিথ্যা বলেছো। তিনি আমাকে কেন জবেহ করবেন? শয়তান বলল, তোমার পিতার ধারণা, আল্লাহ নাকি তোমাকে জবেহ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ঈমানী পরিবেশে গড়ে উঠা পরিবার ছিল হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পরিবার। ঈমানের ভিত্তিতে যে সংসার বিকশিত হয়েছে, তার সদস্যের আস্থা ছিল সুদৃঢ় ও মজবুত। শিশু ইসমাঈল (আ.) ঈমানী চেতনায় কত সুন্দর জবাব দিলেন, আল্লাহ পাকের নির্দেশের কাছে আমি মাথা নত করে দিলাম। এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কি হতে পারে যে জীবন আল্লাহ কবুল করেছেন। তারপর শয়তান যখন পরবর্তী কথা বলার ইচ্ছা করল তখনই শিশু ইসমাঈল (আ.) মাটি থেকে একখানা পাথর উঠিয়ে শয়তানের দিকে নিক্ষেপ করলেন, এতে শয়তানের বাম চক্ষু উপড়ে গেল। ফলে শয়তান ব্যর্থ ও নৈরাশ হয়ে ফিরে গেল। মহান আল্লাহ পাক শয়তানকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য হযরত ইসমাঈল (আ.) এর অনুসরণে আমাদের উপরও হজ্জের সময় ঐ স্থানে কংকর নিক্ষেপ ওয়াজিব করে দিয়েছেন। (মিশকাতুল আনওয়ার)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (আ.)-এর বর্ণনায় পাওয়া যায়, শয়তান হযরত ঈব্রাহীম (আ.) কে তিনবার প্রতারণায় ফেলতে চেষ্টা করেছিল। প্রথমে জামরায় উকবা’র নিকট বন্ধুর বেশে প্রতারণার চেষ্টা করলে হযরত ইব্রাহীম (আ.) মতান্তরে পিতা-পুত্র উভয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করেন। অদ্যাবধি এই প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতি হিসেবে মিনায় তিনবার কংকর নিক্ষেপের বিধান চালু আছে; যা শরীয়তে ওয়াজিব হিসেবে সাব্যস্ত আছে। শয়তান সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে জামরায় উসতার নিকট বাধা প্রদান করে। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.) সেখানেও সাতটি কংকর নিক্ষেপ করে শয়তানকে তাড়িয়ে দেন। অবশেষে শয়তান ব্যর্থ হয়ে তৃতীয় বার জামরায়ে উলার পথ বন্ধ করে দাঁড়ায়। সেখানেও তিনি ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করে চির অভিশপ্ত শয়তানকে বিতাড়িত করেন। অবশেষে পিতা-পুত্র উভয়েই আল্লাহর রহমতে শয়তানের বেড়াজাল ছিন্ন করে কোরবানির স্থান মিনায় পৌছতে সক্ষম হলেন। (তরীকুল ইসলাম)
পুত্রের কাছে পিতার অভিব্যক্তি
এবার হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে আসল ব্যাপারটি খুলে বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! ‘স্বপ্নে আমি যেন দেখছি, আমি তোমাকে জবেহ করছি’ (সূরা-সফফাত, আয়াত-১০২) । এখানে বলা দরকার ছিল অতীতকালের শব্দ অর্থাৎ গতকাল রাতে আমি দেখেছি। কিন্তু তিনি তা না বলে বর্তমানকালের শব্দ ব্যবহার করেছেন (আমি দেখছি)। ইহা দ্বারা উদ্দেশ্য হল এই স্বপ্ন সুস্পষ্ট, এটা দেখা হয়ে যায়নি, এখনো আমার চোখের উপর স্বপ্নটি ভাসছে। আমি এখনো দেখতে পাচ্ছি। স্বপ্নে আমি দেখছি, আমি তোমাকে জবেহ করছি, সন্তানকে সরাসরি বলে দিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্রের অভিমত জানতে তাকে বললেন, তুমি কি মনে কর? তোমার মতামত কি? (সূরা-সফফাত, আয়াত-১০২), এখানে একটি প্রশ্ন জাগে- আল্লাহ তো নির্দেশ দিয়েছেন, আবার সন্তানের মতামত নেওয়ার কি দরকার। আল্লাহর নির্দেশ তো অবশ্যই পালন করতে হবে। সন্তান থেকে আবার মতামত নেওয়ার কারণ কি? এর বড় এক কারণ হল, এটা সন্তানের জন্যেও আল্লাহর পরীক্ষা ছিল, শুধু পিতার জন্য নয়। সন্তান কি মতামত পেশ করে আল্লাহ তা জানতে চান। এজন্য সন্তানকে হযরত ইব্রাহীম (আ.) জিজ্ঞেস করলেন। সন্তানও সাথে সাথে বলে দিলেন, يا أبت افعل ما تؤمر হে আমার পিতা! যা কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেটাই আপনি পালন করুন (সূরা-সফফাত, আয়াত-১০২)। অর্থাৎ বিনা দ্বিধায় আপনি আমাকে জবেহ করুন। শিশু ইসমাঈল (আ.) পিতাকে আরো চমৎকার সহযোগিতা করে বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীলদের অন্তর্ভূক্ত পাবেন’ (সূরা-সফফাত, আয়াত-১০২)। প্রিয় পুত্রের মুখে এত সুন্দর কথা শুনে হযরত ইব্রাহীম (আ.) বুঝতে পারলেন তার সেই দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন, যখন তিনি দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে একটি নেক সন্তান দান করুন’ (সূরা-সফফাত, আয়াত-১০০)। হযরত ইব্রাহীম (আ.) তখন আল্লাহর দরবারে অশেষ শোকরিয়া আদায় করেন। (মিম্বরের ধ্বনি)
পিতার কাছে পুত্রের মিনতি
অতঃপর শিশু ইসমাঈল (আ.) কালবিলম্ব না করে পিতাকে বললেন, আর দেরি নয়, এখনই বিসমিল্লাহ বলে আমার গলায় ছুরি চালিয়ে দিন। তবে ইহধাম ত্যাগ করার পূর্বে আপনি আমার এই মিনতি গুলো মঞ্জুর করে নিন।
এক. আমাকে আপনি শক্ত করে বেঁধে নিন, যেন আমি ছটফট করতে না পারি। নতুবা আপনার গায়ে আমার হাত-পায়ের আঘাত লেগে আপনি কষ্ট পেতে পারেন এবং ইহা চরম বে-আদবীও বটে।
দুই. আমার চেহারাকে জমিনের দিকে মুখ করে রাখবেন, যেন আপনি আমার চেহারা দেখতে না পারেন। নতুবা আমার প্রতি আপনার মায়া আসতে পারে।
তিন. আপনার পরিধেয় বস্ত্র সামলিয়ে নিন, যেন আমার রক্তের ছিটা তাতে লাগতে না পারে। নতুবা আমার প্রতিদান কমে যেতে পারে এবং রক্তের ছিটা দেখে আমার মা কষ্ট পেতে পারেন।
চার. আপনার ছুরিটা ভাল করে ধার দিয়ে নিন এবং আমার গলায় তা দ্রুত চালাবেন, যেন আমার প্রাণ সহজেই বের হয়ে যায়। কারণ, মৃত্যুর জ্বালা বড় কঠিন।
পাঁচ. আপনি যখন বাড়ি তাশরীফ নিবেন তখন আমার রক্তমাখা জামাটা আমার জনম দুঃখিনী মাকে দিবেন, হয়ত এতে তিনি কিছুটা সান্তনা পাবেন।
ছয়. জনম দুঃখিনী মাকে আমার সালাম জানাবেন এবং আল্লাহর নির্দেশের ওপর সবর করতে বলবেন।
সাত. যেভাবে আপনি আমাকে রশি দিয়ে বাঁধবেন এবং জবেহ করবেন তা আমার মাকে জানাবেন না এবং ছোট ছোট শিশুরা যেন আমার মায়ের কাছে দৌড়াদৌড়ি বা আসা-যাওয়া না করে। কারণ, এতে আমার ওপর মায়ের বিরহ-বেদনা বারংবার জেগে উঠতে পারে।
আট. আপনি যখন আমার মত কোন শিশুকে দেখতে পাবেন তখন তার দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। কারণ এতে আপনি আমার বিরহ ব্যথায় অস্থির হয়ে পড়তে পারেন। (মিশকাতুল আনওয়ার)
ছুরি চালনায় ব্যর্থতা
একমাত্র পুত্রের মুখে এ সমস্ত কথা শুনে পিতার মানসিক অবস্থা কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.) দৃঢ়তার পাহাড় হয়ে পুত্রকে বললেন, আল্লাহর নির্দেশ পালনে তুমি আমাকে চমৎকার সহযোগিতা করেছো। অতঃপর তিনি পুত্রকে ¯েœহের চুম্বন করলেন এবং অশ্রুপূর্ণ নেত্রে তাকে বেঁধে নিলেন। আল্লাহ পাক বলেন, ‘অতঃপর যখন তারা (পিতা-পুত্র) দু’জনই (আল্লাহ পাকের ইচ্ছার সামনে) আত্নসমর্পণ করল এবং তিনি তাকে (জবেহ করার উদ্দেশ্যে) কাত করে শুইয়ে দিলেন’ (সূরা-সফফাত, আয়াত-১০৩)। বর্ণিত আছে, হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিলেন, যেন পুত্রের চেহারা তিনি দেখতে না পারেন। কারণ, পুত্রের চেহারার দিকে নজর পড়লে পুত্রের প্রতি মহব্বত জেগে উঠতে পারে। ফলে আল্লাহর নির্দেশ পালনে তা প্রতিবন্ধক হতে পারে (মিশকাতুল আনওয়ার)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, শুরুতে হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাকে সোজা করে শুইয়ে দিলেন, কিন্তু বার-বার ছুরি চালানো সত্ত্বেও গলা কাটে না। কেননা আল্লাহ পাক স্বীয় কুদরতে পিতলের একটা টুকরা মধ্যখানে অন্তরায় করে দিলেন। তখন পুত্র নিজেই আবদার করে বললেন, হে আব্বা! আমাকে কাত করে শুইয়ে দিন। কারণ, আমার চেহারা দেখে আপনার পৈতৃক ¯েœহ জেগে উঠে। ফলে গলা সম্পূর্ণরূপে কাটা হয় না, তা ছাড়া ছুরি দেখে আমি নিজেও ঘাবড়ে যাই। সে মতে হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাকে কাত করে শুইয়ে দিলেন (তাফসীরে মাজহারী)।
ফেরেশতার কাছে আল্লাহর গৌরব
বর্ণিত আছে, মিনা প্রান্তরে একটি পাথরের কাছে এ জবেহের ঘটনা ঘটে। পুনরায় হযরত ইব্রাহীম (আ.) তার গলায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ছুরি চালাতে লাগলেন, কিন্তু তিনি গলা কাটতে সক্ষম হলেন না। আর আল্লাহ পাক আসমান ও জমিনের সকল ফেরেশতার চোখের পর্দা খুলে দিলেন, ফলে তারা যখন দেখতে পেলেন, হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্রকে জবেহ করছেন তখন তারা সেজদায় লুটিয়ে পরলেন। অতঃপর আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের বলেন, দেখ! আমার বন্ধু আমার মহব্বতে আদরের সন্তানের গলায় কিভাবে ছুরি চালাচ্ছে, অথচ তোমরা আমাকে বলেছিলে যখন আমি বলেছিলাম, আমি পৃথিবীতে (আমার) খলীফা বানাতে চাই। তোমরা বলেছিলে, আপনি সেখানে এমন কাউকে (খলীফা) বানাতে চান যে সেখানে (বিশৃঙখলা ও) বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং (স্বার্থের জন্য) রক্তপাত করবে, আমরাই তো আপনার প্রশংসা সহকারে তাসবীহ পাঠ করছি এবং (প্রতিনিয়ত) আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি’।
দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় ব্যর্থতা
অতঃপর হযরত ইসমাঈল (আ.) পিতাকে বললেন, হে আমার পিতা! আপনি আমার হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে দিন, যেন আল্লাহ আমাকে এ অবস্থায় দেখতে পান যে, আমি নিজেই জবেহের জন্য স্বেচ্ছায় প্রস্তুত এবং আমাকে জবেহের জন্য বাধ্য করা হয়নি। তাই আমার ঘাড়ের উপর ছুরি চালাতে থাকেন, যেন ফেরেশতাগণ দেখে বুঝতে পারেন যে, আল্লাহর বন্ধুর পুত্র আল্লাহ ও আল্লাহর নির্দেশের সামনে স্বেচ্ছায় নিবেদিত প্রাণ। অতঃপর হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্রের হাত ও পায়ের বন্ধন মুক্ত করে দিলেন এবং তার চেহারাকে জমিনের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। এবার তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ছুরি চালাতে লাগলেন। এবারও ছুরি কিছুই কাটতে সক্ষম হল না, বরং তা পিচলে সরে গেল। অতঃপর শিশু ইসমাঈল (আ.) পিতাকে বললেন, হে আমার শ্রদ্ধেয় পিতা! আমার প্রতি আপনার মহব্বতের কারণে আপনার শক্তি দুর্বল হয়ে গেছে, ফলে আপনি কাটতে সক্ষম হন না।
পাথরে ছুরি নিক্ষেপ
অতঃপর হযরত ইব্রাহীম (আ.) ব্যর্থ হয়ে ছুরিটাকে একটা পাথরের উপর ছুরে মারলেন, ফলে পাথরটা দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। হযরত ইব্রাহীম (আ.) ছুরিকে লক্ষ্য করে বললেন, হে ছুরি! পাথরের উপর আঘাত করা মাত্রই শক্ত পাথর কেটে ফেলেছো, কিন্তু গলায় বারংবার চালনার পরও গলার নরম চামড়া কাটতে সক্ষম হলে না কেন? আল্লাহর কুদরতে ছুরি এবার কথা বলতে শুরু করল। ছুরি তাকে বলল, হে নবী ইব্রাহীম (আ.)! আপনি আমাকে কাটতে বলেন আর আল্লাহ আমাকে কাটতে নিষেধ করেন, আল্লাহর নির্দেশকে অমান্য করে কিভাবে আমি আপনার নির্দেশকে পালন করি!
দুম্বা জবেহ ও কোরবানি কবুল
অতঃপর আল্লাহ পাক বললেন, ‘তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইব্রাহীম! তুমি (আমার দেখানো) স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছো’। অর্থাৎ তুমি তোমার পুত্রের মহব্বতের উপরে আমার সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়েছো, এতে তোমরা উভয়ই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছো। আল্লাহ পাক বলেন ‘(আমি তোমাদের উভয়কেই মর্যাবান করবো, মূলত) আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কার দিয়ে থাকি’। আল্লাহ পাক আরো বলেন, ‘এটা ছিল (তাদের উভয়ের জন্য) একটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা মাত্র, এ কারণেই আমি তার (পুত্রের) পরিবর্তে (আমার নিজের পক্ষ থেকে) একটা বড় কোরবানির (জন্তু দুম্বা) দান করলাম’। এখানে আল্লাহ পাকের পরীক্ষা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, দীনের জন্য প্রকৃতপক্ষে কে মোখলেস (একনিষ্ঠ) আর কে মোখলেস নয় তা নির্ণয় করা। আর এ পরীক্ষায় হযরত ইব্রাহীম (আ.) পূর্ণরূপে উত্তীর্ণ হয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আল্লাহ পাক শিশুনবী ইসমাঈল (আ.) এর মাথা ও রক্ত চাননি, বরং উভয়ের মন চেয়েছেন। আর আল্লাহ পাকও উভয়ের মন পেয়েছেন। যেহেতু আল্লাহ পাক বলেন,
কোরবানির গোশত ও রক্ত আল্লাহ পাকের কাছে পৌঁছেনা; বরং এর মধ্য দিয়ে তোমাদের তাকওয়া বা খোদাভীতি আল্লাহর কাছে পৌঁছে। (সূরা হজ্জ-৩৭)
তাই আল্লাহ পাক শিশুনবী ইসমাঈল (আ.)-এর পরিবর্তে তদস্থলে জান্নাত থেকে সেই দুম্বা কোরবানির ব্যবস্থা করেছেন যে দুম্বাটি হযরত আদম (আ.)-এর পুত্র হাবিল কোরবানি করেছিলেন এবং তা আল্লাহ পাকের নিকট কবুল হয়েছিল। আর এই দুম্বাটি ছিল খুবই মোটাতাজা নাদুস-নুদুস; যা জান্নাতে শত-শত বছর যাবত জীবিত ছিল। যখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) প্রিয় পুত্রের গলায় বারংবার ছুরি চালাচ্ছিলেন, তখন এ অবস্থা দেখতে দেখতে হযরত জিব্রাঈল (আ.) সেই দুম্বাটি নিয়ে হাযির হলেন এবং হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর এই মহান কাজে আশ্চর্য হয়ে ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি উচ্চারণ করলেন। (মিশকাতুল আনওয়ার)
বড় দানশীল কে
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, (জবেহের ঘটনার কিছুদিন পর) হযরত ইসমাঈল (আ.) পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে বললেন, বড় দানশীল কে, আমি না আপনি? হযরত ইব্রাহীম (আ.) বললেন, আমি (বড় দানশীল)। হযরত ইসমাঈল (আ.) বললেন, না; বরং আমি (বড় দানশীল)। কারণ, আমার প্রাণ তো একটা, সেটাই আমি আল্লাহর জন্য কোরবান করে দিয়েছি। আর আপনার পুত্র ইসমাঈল চলে গেলে আপনার তো অন্য পুত্র ইসহাক আছে। (এবার ভেবে দেখুন কে বড় দানশীল)। (পিতা-পুত্রের এই খোশালাপ শুনে) আল্লাহ পাক বললেন, আমি তোমাদের উভয়ের চেয়ে বড় দানশীল। কারণ, ইসমাঈলের জবেহের পরিবর্তে আমি বেহেশতী দুম্বা ফিদিয়া দিয়েছি এবং তোমাদেরকে জবেহের যন্ত্রণা হতে পরিত্রাণ দিয়েছি। (মিশকাতুল আনওয়ার)
ফেরেশতাদের বিস্ময়
অপর এক বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ পাক হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর পরিবর্তে জান্নাত হতে একটা দুম্বা হযরত জিব্রাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলেন, আল্লাহ পাকের কাছে হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর এই বিশেষ কারামত বা সম্মানের কারণে ফেরেশতাকুল তাজ্জব হলেন। আল্লাহ পাক তখন বললেন, আমার ইজ্জত ও মহত্বের কসম! সকল ফেরেশতা মিলে যদি তাদের ঘাড়ে সেই ফিদিয়া বহন করে, তবুও তা ইসমাঈলের ঐ কথার মর্যাদার সমতুল্য হবে না যে কথা তিনি তার পিতাকে বলেছিলেন যে, হে আমার পিতা! যা কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেটাই আপনি পালন করুন। অর্থাৎ বিনা দ্বিধায় আপনি আমাকে জবেহ করুন।
কোরবানির ঘটনায় আমাদের শিক্ষা
কোরবানির এই ঐতিহাসিক ঘটনা যুগ-যুগ ধরে আমাদের জন্য শিক্ষনীয় নিদর্শন হিসেবে চির স্মরণীয় হয়ে রয়েছে ও থাকবে। আমরা এ ঘটনা থেকে অনেক শিক্ষা পাই; যা আমাদের জীবনে প্রতিপালন করলে আমরাও চির ধন্য হতে পারি। কোরবানির ঘটনায় আমরা যে শিক্ষা পাই, তা হল-
১. আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সর্বোৎকৃষ্ট বস্তু উৎসর্গ করা কর্তব্য। যেমন- হযরত ইব্রাহীম (আ.) কলিজার টুকরা প্রিয় পুত্রকে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জবেহ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন।
২. শিশুকাল হতেই দীনের জন্য নিবেদিত প্রাণ হওয়া উচিত। যেমন- হযরত ইসমাঈল (আ.) শিশুকালেই দীনের জন্য বিনা দ্বিধায় প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন।
৩. ন্যায় কাজ সিদ্ধ করতে অনেক সময় এমন কথা বলা জায়েয আছে যে কথাটি প্রকাশ্যে মিথ্যা বলে মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কথাটি মিথ্যা নয়; বরং সত্য। যেমন- হযরত ইব্রাহীম (আ.) স্ত্রী হাজেরা (আ.)-কে বলেছিলেন, ‘তোমার পুত্রকে সুন্দর পোশাক পরিয়ে দাও, তাকে একটি দাওয়াতে নিয়ে যাব’। এখানে হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর কথাটি মিথ্যা বলে মনে হয়; কিন্তু আসলে কথাটি মিথ্যা ছিল না। কারণ, তিনি তো তাকে দাওয়াতেই নিয়ে যাচ্ছিলেন। আর এ দাওয়াত ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রিয় পুত্রকে কোরবানি করার সুমহান ‘দাওয়াত’ বা আহবান।
৪. আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে কোন পরীক্ষা উপস্থিত হলে কালবিলম্ব না করে তাতে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সচেষ্ট হওয়া কর্তব্য। যেমন- হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্র জবেহের নির্দেশ নিশ্চিত হয়ে কালবিলম্ব না করে পুত্রকে মিনা প্রান্তরে নিয়ে গেলেন এবং হযরত ইসমাঈল (আ.)ও কালবিলম্ব না করে পিতাকে জবেহ করার জন্য অনুরোধ করলেন।
৫. ন্যায় পথে থাকলে শয়তানের ধোঁকা বার-বার আসতে পারে, তবুও এক চুল পরিমাণ পিছপা হওয়া উচিত নয়। যেমন- হযরত ইব্রাহীম (আ.), তার স্ত্রী ও পুত্রকে শয়তান বার-বার ধোঁকা দেওয়া সত্ত্বেও তারা চুল পরিমাণ পিছপা হন নি, বরং তারা আরো মজবুত হয়েছিলেন।
৬. প্রয়োজনে জীবন দিয়ে হলেও দীনকে রক্ষা করা কর্তব্য। যেমন- হযরত ইসমাঈল (আ.) দীনের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে একটুও দ্বিধাবোধ করেন নি।
৭. সৎকর্মশীল লোকের প্রতি সুধারণা রাখাই বাঞ্চনীয়। যেমন- হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে শয়তান বলেছিল, তোমার পিতা তোমাকে জবেহ করতে নিয়ে যাচ্ছে। হযরত ইসমাঈল (আ.) পিতার প্রতি সুধারণা রেখে শয়তানকে বললেন, তুমি মিথ্যা বলেছো; আমাকে তিনি কখনোই (অন্যায়ভাবে) জবেহ করতে পারেন না। (যদি করেন তবে তা ন্যায়সংগতভাবেই করবেন)
৮. সর্বশক্তি প্রয়োগ করে শয়তানের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করা কর্তব্য। যেমন- হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও পুত্র ইসমাঈল (আ.) ন্যায় কাজে বাঁধা দেওয়ার কারণে শয়তান কে বিতাড়িত করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কংকর নিক্ষেপ করেছিলেন।
৯. আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জনের স্বার্থে বিপদ-আপদ খুশির সাথে বরণ করতে হয়। যেমন- হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্র জবেহের ব্যাপারে মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত হলেও আল্লাহ পাকের নির্দেশ পালন করতে পেরে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন।
১০. নিজের ওপর কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও দীনের কাজে অপরকে সর্বাত্নক সহযোগিতা করা উচিত। যেমন- হযরত ইসমাঈল (আ.) নিজে কোরবান হয়ে যাবেন বুঝতে পেরেও পিতার হাতে নিজকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করলেন।
১১. ন্যায় কাজে অপরের সহযোগিতা পেতে হলে ¯েœহ কিংবা সম্মানসূচক সম্বোধন করে আগে তার ব্যক্তিগত অভিমত ব্যক্ত করতে সুযোগ দেওয়া উচিত, যেন সে-ও এ ন্যায় কাজে সম্মত ও প্রস্তুত আছে কিনা তা উপলব্ধি করা সম্ভব হয়। যেমন- হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্রকে জবেহ করার পূর্বে তার অভিমত জানতে স¯েœহে বলেছিলেন, হে প্রিয় পুত্র! জবেহের ব্যাপারে তোমার কি অভিমত? হযরত ইসমাঈল (আ.) বললেন, ‘আপনাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন করুন’ (সূরা-সফফাত, আয়াত-১০২)। এখানে পুত্রের নিকট অভিমত জানতে চাওয়ার উদ্দেশ্য হল, পুত্রও এ ন্যায় কাজে সম্মত ও প্রস্তুত আছে কিনা তা উপলব্ধি করা।
১২. আল্লাহ পাক কোন পরীক্ষার দ্বারা কারো জান ও মাল চান না, বরং ব্যক্তির মনকে চান। যেমন- আল্লাহর নির্দেশ পালনে যখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্রকে জবেহ করতে গলায় ছুরি চালাতে লাগলেন, তখন তদস্থলে একটা দুম্বা কুরবানি হয়ে গেল। এ কাজের দ্বারা আল্লাহ তা’আলা উভয়ের মন পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন; হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর মাথা ও রক্ত আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্য ছিল না।
১৩. আল্লাহ পাকের দেওয়া কোন পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হলে প্রাণ ভরে শোকরিয়া আদায় করতে হয়। যেমন- হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্র জবেহের পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে শোকরিয়া স্বরূপ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’ এই তাসবীহ পাঠ করেছিলেন।
১৪. যে ব্যক্তি আল্লাহ পাকের জন্য নিজকে উৎসর্গিত করে, আল্লাহ তার সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করে দুনিয়া ও আখেরাতে তাকে চির স্মরনীয় করে রাখেন। যেমন- হযরত ইসমাঈল (আ.) আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জীবনকে বিসর্জন দিতে পিতার হাতে নিজকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করলেন, ফলে আল্লাহ তা’আলা উভয়ের মর্যাদা বৃদ্ধি করলেন এবং এই ঘটনাকে স্মরনীয় রাখার জন্য কেয়ামত পর্যন্ত মুসলিম জাতির ওপর কোরবানিকে ওয়াজিব করে দিলেন।
শেষ কথা
পরিশেষে, কোরবানির শিক্ষাকে আমাদের জীবনে বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়ে আমরাও হতে পারি চির স্মরণীয়। কোরবানি প্রতি বছর মুসলিম জাতিকে হযরত ইব্রাহীম (আ.) কর্তৃক পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে জবেহ করার ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যা অনন্তকাল সুন্নাতে ইব্রাহীম হিসেবে বিশ্ব মানবতার কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক-
সহকারি সম্পাদক,
মাসিক উজ্জীবন
২| ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৮:২৮
সনেট কবি বলেছেন: আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন।
১১ ই অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩১
মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ্ বলেছেন: আপনারও
©somewhere in net ltd.
১|
০৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৫:৪০
এ.এস বাশার বলেছেন: ব্লগে স্বাগতম! সুন্দর পোস্ট। খুব শিক্ষনীয়। একদিনে এত পোস্ট না দিয়ে দিনে দিনে পোস্ট করুন। অন্যদের পোস্টে গঠনমূলক মন্তব্য করুন (যে লেখা আপনার ভালো লাগে)। মন্তব্যের প্রতিত্তর দিন। আশা করি সেফ হতে সময় লাগবে না।