নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাব আসে; ছন্দ আসে না

হাবীব কাইউম

পোস্ট পড়িবার পূর্বে হাবীব কাইউমের ১ নম্বর ব্লগ দেখিয়া লইবেন

হাবীব কাইউম › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প::বন্ধ নিশ্বাস

১৫ ই এপ্রিল, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০৪

গল্পের আগে কিছু ছবি দেখে নিই, আসুন।





অস্ট্রেলিয়ার একটি ফ্যাশন শো





উত্তর কোরিয়ার যুদ্ধপ্রস্তুতি





মিয়ানমারের পাংকু বাবু[এবং বাবুনী]রা



বহুদিন ধরে কিছু লিখি না; বিশেষ করে এই ব্লগে। গালিশিল্পের যেরকম অভূতপূর্ণ উন্নতি সাধিত হচ্ছে ব্লগে, তাতে আমরা বিশ্ববাজারে বেশ দক্ষ গালিবাজ সরবরাহ করতে পারবো। গালিশিল্প নিয়ে সেই পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত বই 'লতিকা রানী' পড়ে দেখতে পারেন [লেখকের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।]।



এবার আসুন গল্প শুরু করি। মূল কাহিনী সত্য। চরিত্র, স্থান এবং ঘটনা কল্পিত।



তোতা নামটা উচ্চারণ করলেই সবাই বুঝে ফেলে, কার কথা বলা হচ্ছে। আড়াইহাজারের কোনো বালকের সামনেও যদি নামটা উচ্চারণ করা হয়, চোখের সামনে মনে হয় তার চেহারাটা ভেসে ওঠে। আড়াইহাজারের কথা যেমন ওরা জানে—ঈশা খাঁ তার আড়াই হাজার সৈন্য নিয়ে এক অভিযানে যাওয়ার সময় এখানে থেমেছিলেন বলে এখানকার নাম আড়াইহাজার, তেমনি তোতা মিয়ার বৃত্তান্তও তারা জানে। দুষ্ট তরুণরা বলে, ঐ তোতা মিয়া? য্যার কোনো রাইফেলই অহন আর কাম করে না? নিজেও ভোঁতা ঐয়া পইড়া রইছে, হেই বুইট্টা তোতা?



তার সাথে কারো দেখা হলে তোতা মিয়া ডাকটা সে পায়। ঘনিষ্ঠজনরাও তাকে তোতা মিয়া বলে। কিন্তু তার নাম যেটা উঠে গেছে, সেটা হলো বুইট্টা তোতা। বেঁটে হওয়ার কারণে তার এই উপাধি। বুইট্টা তোতার নাম শুনলে মেয়েদের মুখটা তিতা হয়ে যায়। তোতার সাথে তিতার একটা মিলও আছে। তখন তাদের গল্প করতে আর ভালো লাগে না। পুরুষরা তার নাম শুনলে যে তার নাম উচ্চারণ করে, তার দিকে তাকাতো—নতুন কোনো অঘটন ঘটলো কি না সেই আশঙ্কায়। এখন আর বুইট্টা তোতার তিক্ততা নেই। কিন্তু তিক্ত স্মৃতিকে কি কখনো মিষ্টি বানানো সম্ভব? নামটা শোনার সাথে সাথেই যে স্মৃতিগুলো জেগে ওঠে!



তহর আলী যে অস্ত্রের কারণে মানুষের কাছে সম্মানের পাত্র, সেই একই অস্ত্র দিয়ে তার ভাতিজা কামিয়েছে মানুষের ঘৃণা আর অভিশাপ।



মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র আর জমা দেননি তহর আলী। মাচার ওপর তুষের মটকিতে রেখেছিলেন লুকিয়ে। প্রথম প্রথম তোতা সেটা এক ফাঁকে নিয়ে কাজ সেরে আবার জায়গামতো রেখে যেতো। চাচা বেঁচে থাকতে যেভাবে নিয়মিত অস্ত্রটার অস্তিত্ব পরীক্ষা করতেন, চাচীর সেই গরজ ছিলো না। সেটা তখন পুরোপুরিই তোতার দখলে।



অস্ত্রের কারণে তোতা খারাপ হয়েছে, সেটা বলা ঠিক হবে না। অস্ত্রটা তার খারাবির পথে আরো এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে মাত্র। সে খারাপ হয়েছিলো আগেই। পারিবারিক ঐতিহ্য গ্রে কাপড়ের ব্যবসা চালানোর জন্য তোতার সময় দেয়ার দরকার ছিলো না। কারণ সেটা তখনো তোতার বাপ মোহর আলী দেখাশোনা করে। গ্রে কাপড়ের ব্যবসার জন্য কোনো চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাতে হয় না। এটা ছাপা কাপড়ের ব্যবসা না যে, বাজারে টিকে থাকার জন্য নিত্য নতুন ডিজাইনের চিন্তা করতে হবে।



তোতাকে তার বাপ স্কুলে যে পাঠায়নি, এমনটা না। কিন্তু সে স্কুলে না গেলে তার মায়ের অত সময় ছিলো না, যেমনটা আজকালকার শহরের মায়েদের আছে। মেঘনা নদীর পাড়ে ডাকাতের গ্রামে তোতার বন্ধু জুটে গিয়েছিলো, তারাই তোতাকে দুর্ধর্ষ বানিয়ে তোলে। ডাকাতের গ্রামের ডাকাতরা ডাকাতি করে পেটের দায়ে। কিন্তু তোতার টাকা-পয়সার কোনো সমস্যা ছিলো না। তোতা যেতো বন্ধুদেরকে সাহায্য করার জন্য।



ডাকাতির সাথে তোতা যে কাজটা যোগ করে, তা কখনো কল্পনা করেনি তার বন্ধুরা। কারণ বন্ধুদের এলাকার মেয়েরাও তাদেরই গোত্রের; তাদের এলাকার; তাদের মতোই সাহসী। ছেলেদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিলো কবুতর নিয়ে। সেটা যখন ডাকাতদের গ্রামের মায়েদের পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তারা দা দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলে কবুতরের মালিকানা দাবিকারী অন্য এলাকার ছেলেকে। সে দা আজকালকার ইউনিভার্সিটির ছেলেরা যে রামদা ব্যবহার করে, সেরকম কোনো দা ছিলো না; গাছের ডালপালা কাটার সামান্য দা ছিলো। সুতরাং রাতে কাম করতে গিয়ে আকাম করে এলে যে তাদের স্ত্রীরা বুঝবে না, আর বুঝতে পারলে যে গাছের ডাল কেটে ফেলার মতো এক কোপে স্বামীর পুরুষত্বও চিরদিনের মতো শেষ করে দিতে যে সামান্য দ্বিধা করবে না, সে ব্যাপারে তারা সজাগ ছিলো। তাই বড়লোকদের বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে তাদের থলথলে স্ত্রীদের প্রতি ততটা আকর্ষণবোধ না করলেও মাঝেমধ্যে তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসা কিছু মেহমান মেয়ে হয়তো আকর্ষণ করেছে তাদেরকে; কিন্তু সজাগ চিন্তাটার কারণে তারা সামনে এগোয়নি। বুইট্টা তোতাই সেই রীতি প্রথম ভাঙলো। বন্ধুরা ডাকাতি করতো ঘরের সম্পদ; তখন তোতা লুট করতে থাকতো ঘরণীর সম্পত্তি।



তোতার বয়স তখন তিরিশ পেরিয়ে তেত্তিরিশ। কিন্তু ওর মধ্যে বিয়ের কোনো চিন্তাভাবনা দেখা গেলো না। ওর মা একে-ওকে বলে; কিন্তু ততদিনে তার পুত্র যে নাম কামিয়েছে, তাতে এ তল্লাটে মেয়ে পাওয়া কোনোমতেই সম্ভব ছিলো না। মেয়ে খুঁজতে যেতে হবে নদীর ওপার। সেই কাজটা কে করে? তোতার বাপও ততদিনে নেই; ব্যবসা ধরেছে তার ছোট দুই ভাই। দুজনই বিয়ে করে ফেলেছে; মেঝটার দুটো বাচ্চাও হয়েছে। ছোট দুই ভাই বড় ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে মোটেও আগ্রহী নয়।



বিয়ে শেষ পর্যন্ত হয়েছিলো বুইট্টা তোতার। তার ডাকাত বন্ধুরাই বিয়ের আয়োজন করলো। আয়োজনটা এমনিতে হয়নি। বুইট্টার কারণে সেদিন প্রায় ধরা পড়তে গিয়েছিলো তারা। ডাকাতি শেষ; কিন্তু বুইট্টা তখনো শেষ করতে পারেনি। মেয়েটা এমন চিৎকার করছিলো, লোকজন জড়ো হয়ে চলে এসেছিলো বাড়ির কাছে। তোতা যখন ব্যস্ত হয়ে পড়তো, ওর অস্ত্রটা হাতে নিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতো মশু। সেদিনও মশু দাঁড়িয়ে ছিলো; তোতাকে বারবার তাড়া দিচ্ছিলো, তোতা, শ্যাষ কর। কিন্তু তোতা শেষ করতে পারছিলো না। বাকিরা মালপত্র গুছিয়ে বাইরে গিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে। লোকজন যখন হৈ হৈ করে কাছাকাছি চলে এলো, বাইরে থেকে বদু এসে তোতাকে জাগিয়ে তুলে নিলো। কাঁধে তুলে নিয়েই লাগালো দৌড়। তোতার রাইফেলের তিনটা গুলি সেদিন শেষ করতে হয়েছিলো গ্রামের এগিয়ে আসা লোকজনকে ভয় দেখানোর জন্য।



পরদিনই তোতাকে নিয়ে বসে বন্ধুরা। বদু বলে, তোতা, তুই যেই মাইয়ারে কইবি, হেই মাইয়ারে তর লাইগা আইনা দিমু। কিন্তু এই কাম আর করন যাইবো না। আইজকা তরে তুইল্লা না আনলে ধরা খাইতাম নিশ্চিৎ।

তোতা জানিয়ে দেয়, মোকাররম আলীর ছটফটে মেয়েটাকে তার খুব পছন্দ। এবং সেদিনই রাতে সেই ছটফটে মেয়ে নিলুফাকে তুলে নিয়ে এলো তোতার বন্ধুরা; বিয়ে হলো মেঘনা নদীতে একটা ট্রলারের মধ্যে। তোতার বয়স তখন ছত্রিশে পড়েছে; নিলুফার বয়স কাবিননামায় আঠারো লেখা হলেও তোতার বন্ধুরা বলেছিলো, মাইয়ার বয়স আরো কম।

বিয়ের পর মোকাররম আলীর স্ত্রী গোপনে তার মেয়ের সাথে দেখা করতে এলেও নিলুফার কোনো আত্মীয়স্বজন তোতার বাড়িতে আসেনি। নিলুফার মা এসে তার মেয়ের জন্য কান্নাকাটি করলেও মেয়ে আরো কঠিন সুরে তাকে জানিয়ে দিতো, মা আমার কোনো কষ্ট নাই। তুমি খালি আমার লাইগা দোয়া কইরো।



বিয়ের সাড়ে চার মাসের মাথায় তোতা বা তোতা ওরফে বুইট্টা তোতা বিছানায় পড়লো। তার দুটো পা-ই অবশ হয়ে গেলো কোমর পর্যন্ত। কেউ বলে, ও যত মেয়ের অভিশাপ নিয়েছে মাথায়, সেই অভিশাপ ফলেছে; কেউ বা বলে নিলুফা কিছু একটা করে তোতার পা অবশ করে ফেলেছে; মুরুব্বিরা আরেকটা কথা শোনায়, ছোটবেলা সাপের সাথে বাঁদরামি করতে গিয়ে সাপ ওর পা পেঁচিয়ে ধরেছিলো, ধীরে ধীরে এতদিন পর সেটার ফল পাচ্ছে ও। সে যা-ই হোক, তোতার পছন্দের ছটফটে নিলুফার সারাদিন ঘরে বসে থাকার কোনো দরকার ছিলো না। অবশ হওয়ার কারণে তোতার খাওয়া-নাওয়া সবই হয়ে পড়লো রুটিনমাফিক। সেজন্য তার পেশাব-পায়খানাও হয় ঠিক সময়মতো। সেই সময়ে এসে নিলুফা তাকে বসিয়ে দেয়।



পায়ের সাথে সাথে হাতেও খুব একটা জোর পায় না তোতা। অবশ হওয়ার পরপরই তার চাচী আবার রাইফেলটা জাদুঘরে জমা দিয়ে আসে। থানায় দেয়নি, কারণ প্রতিবেশীরা তাকে জানিয়েছে, থানায় গেলে পুলিশ আরো উল্টো তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র রাখার দায়ে মামলা দিয়ে দেবে; তুমি যে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী, সেটা ওরা জানতেও চাইবে না।



ছটফটে নিলুফা দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাইরে থাকে। সে কই যায়, তোতা জানে না; জানতে চায়ও না। ওদের বাড়িতে বিয়ের পর প্রত্যেকের ঘর আলাদা হয়ে যায়। তোতারও আলাদা ঘর; দুই কোঠা মিলে ওর ঘর। ও শুয়ে থাকে সামনের কোঠায়; এটা একটু খোলামেলা; শুয়ে থাকলে উঠানের দিকে নজর যায়। আকাশও দেখা যায় কিছুটা; দিন-রাত বোঝা যায়। ভেতরের কোঠাটা ছিলো শোয়ার ঘর; সেখানে ও সাড়ে চার মাস শুতে পেরেছিলো।



নিলুফা এখনো সেই কোঠায় শোয়; তোতা এই কোঠা থেকে তার ঘন নিশ্বাসের আওয়াজ পায়। তোতার চোখে পড়া আলো প্রতিদিনই একটা সময় একটা ছায়া এসে ঢেকে দেয়। প্রতিদিন যে একই ছায়া আসে, এমনটা নয়। বিভিন্ন ছায়া আসে। ও চোখ বুজেই সেটা টের পায়। নিলুফার ঘন নিশ্বাসের সাথে আরো একটি নিশ্বাসের আওয়াজ পায় সে। মৃদু কিছু কথাবার্তাও থাকে সেই নিশ্বাসের সাথে। থাকে কিছু হাসি। চোখ বন্ধ করে থাকলেও তোতা কান বন্ধ করতে পারে না। তার কানে সেসব আসে। দাঁতে দাঁত কামড়ে সে নিশ্বাস বন্ধ করে রাখে। কিন্তু তার নিশ্বাস বন্ধ হয় না। আরো একটা আওয়াজ তার কানে আসে। যখনি তার ঘরে ছায়া ঢোকে, কিছু ছেলে রাস্তা থেকে বলতে বলতে দৌড়ে যায় : তোতা মিয়া, ভোঁতা মিয়া; তোতা মিয়া ভোঁতা মিয়া; তোতা মিয়া, ভোঁতা মিয়া।



আমার নিজস্ব ব্লগ ঘুরে আসতে পারেন কেউ চাইলে। সবাইকে ধন্যবাদ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৮:০৮

জাহাঙ্গীর জান বলেছেন: সুন্দর হয়েছে +++++

১৫ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৮:১১

হাবীব কাইউম বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.