![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে দুঃখ কতো লুকিয়ে থাকে কেউ তো জানে না....
অফিস থেকে বের হয়ে গাড়ি-ঘোড়া না পেয়ে চির চেনা সেই ফুটপাত ধরে আপন মনে হাঁটতে লাগলাম।
চৈত্রের ঝলমলে রোদ বিকেলের দিকে অনেকটাই মরে এসেছে, রোদ থাকলেও তার উত্তাপ নেই।
প্রায় কিলো দেড়েক হাঁটার পর ফুটপাতের কোল-ঘেঁষে গড়ে ওঠা ছোট্ট একটা চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। শরীর ক্লান্ত লাগছে এক কাপ চা খাওয়া দরকার।
"রঙ-চা আছে?" পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখমন্ডলখানা মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলাম।
কোনো জবাব নেই দোকানির। উদোম গায়ে বসে বসে ঝিমুচ্ছেন তিনি।
"কি চাচা রঙ-চা নাই?" একটু জোর দিয়েই বললাম এবার।
" হ আছে, চায়ের দোকানে রঙ-চা থাকবো না তয় মধু থাকবো নি?" নিরস বদনে খানিকটা কর্কশ কণ্ঠে জবাব দিলেন দোকানি। মনে হলো আমার উপস্থিতিতে অনেকটা বিরক্ত তিনি। তার কঙ্কালসার দেহ আর চোখে-মুখে সেই বিরক্তিভাব অনেকটাই ফুটে উঠেছে।
"চাচা কি আমার উপর রাগ করলেন?" খানিকটা ম্লান হেসে বললাম আমি।
"না বাবা আফনের উপর রাগ করুম ক্যান? আফনে আমার কাস্টমার, আর কাস্টমার হইছে লক্ষী।"
"আদা লেবু দিয়া এক-কাপ চা দেন। চিনি একটু বাড়িয়ে দিয়েন।" বলে পাশের ছোট্ট টুলটিতে বসলাম আমি।
" কি নাম আপনার চাচা?"
"নাম দিয়া কী করবেন?"
" না এম্নি জানতে চাইলাম আর কি।"
"খবির উদ্দিন।" স্টবের আগুনটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে অনাগ্রহের সাথে বললেন তিনি।
মিনিট চার-পাঁচেক পর আমার সম্মুখে চায়ের কাপ বাড়িয়ে ধরলেন খবিরউদ্দিন। চা তৈরী হয়ে গেছে। লেবু রসের মিষ্টি ঘ্রাণ এসে নাকে লাগছে।
চা বানানো শেষে আবার ঝিমুতে লাগলেন খবির উদ্দিন।
"চাচার শরীরটা কি খারাপ?"
"নাহ্।" চোখ বন্ধ রেখেই বিরক্তির সাথে জবাব দিলেন তিনি।
"কিছু মনে করবেন না। দেখে মনে হচ্ছে আপনার শরীরটা খুব খারাপ।"
চোখ মেললেন খবির উদ্দিন। চারদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন তিনি। একটা হাড়-কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুকের গহিন থেকে। খানিকটা অন্যমনস্কভাবে বললেন, " না বাবা, শরীল না, আমার মনডা বেশ খারাপ।"
"মন খারাপ?"
"হ বাবা, মনডা বড় খারাপ। আইজ কয়দিন অইলো কোনো বেচা-বিক্রি নাই, হরতাল মরতালে আমাগো জীবনডা শেষ বাবা। আইজ সারাদিন মাত্র কুড়ি টাকা বেচছি। বিশ্বাস করবেন?"
আমাকে বিশ্বাস করানোর জন্য ভাংতি কুড়ি টাকা ক্যাশ থেকে বের করে দেখালেন খবির উদ্দিন।
আমার চা খাওয়া প্রায় শেষ। মানিব্যাগে ভাংতি টাকা খুঁজতে লাগলাম।
আবার বলতে লাগলেন খবির উদ্দিন, "চাইর দিন ধইরা ঘরে চাইল নাই বাবা। এই যে দ্যাখেন, না খাইতে খাইতে পেডের চামড়া পিডের লগে লাইগা গেছে।" বলে পেটের চামড়া টেনে ধরে দেখাতে লাগলেন আমায়। তার গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখ দুটো টলমল করছে।
"বাবা, সরকার আর বিরুধি পাটির এই ঠ্যালা-ঠেলিতে আমাগো খবর কেউ রাখে না। আমরা কাঙ্গালির জাত, না খাইয়া মরলেও কারুরই কিছু যায় আসে না। বেচা-বিক্রি যা হয় তা দিয়া পেডেরে ভাত দিতে পারি না বাবা, আইজ চাইর দিন এক বেলা কইরা বন রুডি খাইয়া বাইচা আছি। পানি দিয়া ভিজাইয়া ভিজাইয়া বন রুডি খাই। বাসায় গেলে ছোড মাইয়াডায় জিগায়,-বাবা চাইল আনছ নি ? আমি জবাব দিবার পারি না।"
দুচোখের কোণ বেয়ে দর দর করে জল গড়িয়ে পড়ছে মানুষটির । অবোধ শিশুর মতো ফোত ফোত করে কাঁদছেন খবির উদ্দিন।
তার চোখের জল দেখে আমার পোড়া চোখ দুটোও কেমন যেন জ্বালা করতে শুরু করলো। পয়সা মিটিয়ে দিয়ে দ্রুতপায়ে খবির উদ্দিনের সম্মুখ ত্যাগ করলাম।
পাশ দিয়ে টুং টাং বেল বাজিয়ে দুয়েকটি রিক্সা গন্তব্যের দিকে ছুটে চলছে। সূর্যটা ক্রমশ পশ্চিমের বড় বড় দালানগুলোর আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। একদল পিকেটার দৌড়ে গিয়ে যাত্রিসমতে একটা রিক্সা উল্টে দিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দিল। হতভাগা চালক অদূরে দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তার পুরে যাওয়া ভাগ্য-দেবীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। রিক্সা নয় যেন তার নিজ দেহখানা-ই পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।
আমার হাঁটার গতি বেড়ে গেল। দ্রুতপায়ে হেঁটে চললাম আমি। চারদিকে ফুর ফুরে বাসন্তী হাওয়া বইছে । মৃদুমন্দ বাসন্তী হাওয়া।
চলতে চলতে কেন যেন মনে হলো কোথাও ভুল হচ্ছে আমার, নাহ্ এ বাসন্তী হাওয়া নয়, এ যে কালবৈশাখী ঝড় ! শুধু্ই কালবৈশাখি ঝড়!.......
©somewhere in net ltd.