![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার সাথে মিসির আলির দেখা হয় গতকাল রাতে। ফুলার রোড ধরে একা একা অগোছালো ভাবে হাটছিলেন। গায়ে গোলাপি রঙের শার্ট আর পরনে হলুদ রঙের প্যান্ট। মুখের উপর বিভিন্ন রঙের কালি মাখানো। নাকের উপর সার্কাসের সঙদের মত একটা টিপ লাগানো। প্রথম দেখে চিনতে পারিনি। পাগল মনে করে একটু দূরত্ব নিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কানে একটা কথা এসে ঢুকলো- রেডিও টেলিপ্যাথি।
শব্দটা যতটা সাধারণভাবে জানি, তার থেকে বেশি পরিচিত মিসির আলি গল্পের কল্যাণে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই পেছনে ঘুরলাম। এইবার চিনলাম- মিসির আলি, সবার প্রিয় প্রায় অতি মানব মিসির আলি আমার পাশে পাগলের বেশে হাঁটছে আর একা একা কথা বলছে। ভাবলাম হয়তো কোন সমস্যার জট খুলতে এভাবে বেশ নিয়েছেন। তাই একটু কাছাকাছি গেলাম, কিছুটা আলাপ জমানোর আশায়-
- ক্যামন আছেন স্যার?
- হ্যাঁ, ভালো, আপনি কে?
- স্যার, আমি আপনার একজন ভক্ত, আপনাকে এভাবে দেখে একটু জানতে ইচ্ছে হলো...
- কী জানতে ইচ্ছে হলো?
- আপনি এমন সঙ সেজে আছেন কেন?
- হুম? কী বলেছেন?
- মানে স্যার, আপনার এমন পোশাক আর মুখের রঙের কথা জিজ্ঞেস করেছি...
- ও, জানি না।
- মানে বুঝলাম না স্যার...
- ঘুম থেকে উঠে দেখি এমন অবস্থা!
- কী বলেন?
- হুম, এক একবার ঘুম থেকে উঠে এক এক রকম পোশাক আর সাঁজ দেখি, চাইলেও পাল্টাতে পারি না।
- আজব তো! স্যার, আপনি সুস্থ আছেন তো? মানে শরীর ঠিক আছে তো?
- জানি না, কিছুদিন হলো ক্ষুধা লাগে না, আর যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ি।
- স্যার, আপনার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ।
- হুম, কি বলছেন?
- মানে স্যার, আপনার চিকিৎসা দরকার, আপনার শরীর মনে হয় ঠিক নেই...
- হুম, যাবো, যাবো। আচ্ছা, আপনি যেন কী সমস্যার জন্য এসেছিলেন?
- স্যার, আমি কোন সমস্যা নিয়ে আসিনি, আপনার সমস্যা নিয়ে কথা বলছিলাম...
- হুম, আমার অনেক সমস্যা। খাওয়া নেই, ঘুমের ঠিক নেই, কেউ আমার কাছে আর আসে না তাদের সমস্যা নিয়ে, আরও কত কী!
- বুঝেছি স্যার, দেখি, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি।
- হুম, দেখুন, দেখুন। আর হ্যাঁ, আমার বাসাটা কোথায় বলতে পারবেন? আমি এখন একটু ঘুমাবো।
- স্যার, আপনি আমার সাথে চলুন, আমার বাসায়।
- হুম, যাবো...
কথা বলতে বলতে কখন যে সিনেটের সামনে চলে এসেছি খেয়াল করিনি, দেখলাম- আমার কথার জবাব দিতে দিতেই মিসির আলি সাহেব সিনেটের গেটের উল্টা দিকের সবুজ ঘাসে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। দেখে মনে হচ্ছে কোন বেওয়ারিশ লাশ হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে।
বুঝলাম তাকে উঠানোর চেষ্টা করা এখন বৃথা। তাই নিজের পথে হাটা শুরু করলাম। মাথার ভিতর ঘুরতে লাগলো তার কথা। এমন যুক্তিবাদী মানুষ কেমন অগোছালো কথা বলছেন! কাজ-কর্মও কেমন অদ্ভুত হয়ে গেছে- অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মত!
তারাতারি বাসায় চলে এলাম। মাথায় একটাই চিন্তা- স্যার'র জন্য কিছু করতেই হবে। কিন্তু কীভাবে তা জানি না।
রাতের খাবার আর খাওয়া হলো না। শুয়ে শুয়ে ভাবছি- কীভাবে কী করা যায়! মিসির আলির বিভিন্ন গল্পগুলো তখন মাথার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে... ভাবতে ভাবতেই কখন যে রাত তিনটা বেজে গেলো- খেয়াল-ই করিনি! হঠাৎ দূরে কোথাও ঘণ্টার শব্দ শুনে ঘড়ির দিকে তাকালাম। তখন-ই দেখলাম। আর হঠাৎ করেই মাথায় সমস্যার সমাধান চলে এলো! গভীর রাতেই হয়তোবা আমাদের চিন্তার ফলাফলগুলো আমরা পেতে শুরু করি। খেয়াল করলাম, আমার দেয়ালে টানানো ঘড়ির কাটা গুলো অনবরত ঘুরছে, কোন শেষ নেই! ঘড়িটা ততক্ষণ এভাবে চলবে, যতক্ষণ তার পাওয়ার সাপ্লাই থাকবে। আর যখন-ই ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবে, এটা বন্ধ হয়ে যাবে। মিসির আলিও তেমন। সে একটা চরিত্র, যতক্ষণ তার ব্যাটারি- অর্থাৎ সমস্যার জট থাকবে; সে থাকবে তার মত। আর যখন সে সমস্যাহীন হয়ে যাবে, তখন অকেজো ঘড়ির মত সেও স্তব্ধ হয়ে যাবে। তার উপস্থিতি থাকবে কিন্তু কার্যকারিতা থাকবে না; যেমনটা ঘড়ির হয়। আর সে যেহেতু মানুষের সৃষ্টি চরিত্র, সেহেতু তার মরণ নেই, তাকে থাকতেই হবে। আর তাকে তার মত রাখতে হলে সমস্যার সৃষ্টি করতে হবে।
আমি এখন তার জন্য সমস্যার সৃষ্টি করবো। জানি, এতে হয়তো বেয়াদবি হবে, মিসির আলির স্রষ্টার সাথে স্পর্ধা দেখানো হবে। তবুও আমাকে এটা করতেই হবে। কারণ, আমি যতটা মিসির আলিকে ভালোবাসি, তার থেকে হাজারগুণ বেশি ভালোবাসি তার স্রষ্টাকে। আর সেই মহান ব্যক্তিটির আত্মার তৃপ্তির জন্য-ই তার সৃষ্টিকে আমি গতিশীল রাখবো। এতে সে নিশ্চয় আমাকে ক্ষমা করবে।
অনেক তথাকথিত লেখক এর-ই মাঝে মিসির আলিকে বিভিন্ন চরিত্রে সাজিয়েছে বলেই তার চেহারা আর পোশাকের এমন হাল! তারা মিসির আলিকে যেমন চরিত্র দিয়েছে, সে তেমন পোশাক পড়েছে, তারা কেউ মিসির আলিকে খেতে দেয়নি বলে সে আজ ক্ষুধার্ত, মিসির আলির ঠিকানা দেয়নি বলে আজ সে পথে থাকে, তার মুখে তারা রঙ মাখিয়েছে তাকে দিয়ে পাগলামি ধরণের সমস্যার সমাধানের চেষ্টার মাধ্যমে, তারা মিসির আলিকে সাধারণ মানুষের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত করেছে বলে সে আজ দিশেহারা। তাকে আজ তার নিজের চরিত্রে ফেরাতেই হবে- তার নিজের মত, নিজ ঠিকানায়, নিজ বৈশিষ্ট্যে।
.......................................ডীন সাহেবের নাম অধ্যাপক মুফসির তাকী। বেশ লম্বা-চওড়া, মেদ বহুল শরীর। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। এই গরমেও স্যুট-টাই পড়ে আছেন। মাথার সামনের অংশের চুল উঠে গিয়ে কপালটার সাইজ এখন আট আঙ্গুল হয়ে গেছে। সেই কপালে তিনি খুব সুন্দর পরিপাটি করে ভাঁজ ফেলে কথা বলেন। এখন বলছেন মিসির আলির সাথে... তার সামনের চেয়ারে বসে মিসির আলি সাহেব চা খাচ্ছেন। একটা কালো রঙের পুরনো কোট গায়ে, মুখের দুই পাশে বেশ কিছুদিন না কামানো দাড়ি। চুলগুলো এলোমেলো। বিশাল চেয়ারের মাঝে তার চিকন শরীরটা খুব-ই বেমানান মনে হচ্ছে। তবে তার চোখগুলো ভয়াবহ উজ্জ্বল আর প্রতিক্রিয়াশীল। যার দিকে তাকিয়ে কথা বলা বেশ কঠিন। ডীন সাহেব শুরু করলেন-
- আপনি আসলেই আবার এখানে জয়েন করতে চাচ্ছেন?
- জী স্যার
- কিন্তু আপনি তো...
- জী স্যার, আপনারাও আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন আর আমি নিজেও চলে গিয়েছিলাম।
- ওভাবে বলছেন কেন? আসলে আপনাকে তাড়িয়ে দেয়া হয় নি, ওটা একটা কমপ্লেক্স বিষয় ছিলো, যাই হোক- আপনার মত গুনীজনকে আমাদের মাঝে ফেরত পাওয়াটা অবশ্যই আনন্দের।
- তাহলে কি স্যার আমি চাকুরীটা পাচ্ছি?
- দেখুন, আমি কালকের মধ্যেই পার্ট-টাইমার হিসেবে আপনার জয়েনিং লেটার রেডি করে ফেলছি, আর আশা করি খুব দ্রুতই আপনাকে স্থায়ীভাবে নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে পারবো।
- আমার স্যার পার্ট-টাইম হলেই চলবে...
- না, এবার আর তা হতে দেবো না, আপনাকে এবার পাকাপাকিভাবেই চাই, আর হ্যাঁ, আপনার থাকার জায়গার কী অবস্থা?
- আজিমপুরে কলোনিতে একটা বাসা নিয়েছি...
- ভালো ভালো, আপনি তাহলে এখন লাঞ্চ সেরে নিন, তারপর আপনার সাথে আবার বসছি...
- জী স্যার, ধন্যবাদ।
মিসির আলি উঠে দরজা পর্যন্ত যেতেই পেছন থেকে ডীন সাহেব ডাক দিলেন-
- মিসির সাহেব, আপনি বরং আজ রেস্ট নিন, কাল একসাথে আসুন, আমি সব গুছিয়ে রাখবো, আর যদি একটু সময় নিয়ে আসেন তাহলে ভালো হয়...
- কেন স্যার?
- আসলে আমি অনেকদিন থেকে আপনাকে খুঁজছিলাম, আমার ছোট মেয়েটাকে নিয়ে একটু সমস্যায় আছি। তেরো বছর বয়স, বাচ্চা মেয়ে... আপনি যদি...
- অবশ্যই স্যার! আমি অবশ্যই সময় নিয়ে আসবো... আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
মিসির আলি ডীন অফিস থেকে বেড়িয়ে এলেন, মুখে মুচকি হাসি। অনেকদিন পর তার মুখে হাসির রেখা ফুটলো.................................
এভাবেই লেখা এগিয়ে যেতে থাকে, রাত জেগে লেখি, দিনে নিজের কাজ করি।
প্রায় পনেরো দিন হয়ে গেলো, লেখা অনেকটা এগিয়ে গেছে, মনটাও বেশ ফুরফুরে। আজ বিকেলে তাই একটু ঘুরতে বের হলাম। আমার প্রিয় জায়গা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। হাঁটছি, বসন্তের বিকেল, চমৎকার বাতাস। অল্পতেই মনে করুন সুর বেজে ওঠার জন্য যথেষ্ট। নিজেকে খুব চনমনে অথচ খুব দুঃখী মানুষ মনে হয়। অথচ, এই দুঃখী দুঃখী ভাবটার মাঝেও কেমন অফুরন্ত সুখ পাওয়া যায়। পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর সৃষ্টি যুবক-যুবতীদের কল কাকলী উপভোগ করতে করতে বটতলা পেরিয়ে ভিসি চত্তর পেছনে ফেলে ফুলার রোডে হাটতে থাকি। হঠাৎ দেখি মিসির আলি সাহেব আসছেন, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, দৃষ্টি নিচের দিকে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর গায়ে সেই পুরনো কালো কোট, কাঁধে তার বিখ্যাত ঝুলানো ব্যাগ। পাশ থেকে যাওয়ার সময় আমি সালাম দিলাম, কিন্তু শুনতে পেলেন বলে মনে হলো না, খুব চিন্তিত ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে চলে গেলেন। হয়তো ডীন সাহেবের মেয়ের সমস্যার সমাধান এখনো পাননি। কিন্তু আমি জানি তিনি পাবেন! আবার নতুন সমস্যা আসবে, তারও সমাধান পাবেন, আসবে আর একটি... কখনো হয়তো কোন সমস্যা তিনি সমাধান করতে পারবেন না, তখন সেটার জায়গা হবে তার অমীমাংসিত খাতায়... আমি যতদিন বেঁচে আছি, মিসির আলি থাকবেন তার মত- প্রায় কিংবা পুরোপুরি অতি মানব হয়ে......
১৫ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৯:২৭
সুপথকামী হাফিজ বলেছেন: ???
©somewhere in net ltd.
১|
১৫ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৮:৫৯
হাসান মাহবুব বলেছেন: +++