![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রাজা দুর্জয় প্রাণ তার আসনে বসে স্নিগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছেন, তার ডানে বামে দুই ধারে সারিবদ্ধ আসনে রাজ্যের সকল সভাসদরা নীরবে মাথা নিচু করে বসা। কারো মুখে কোন শব্দ নেই, যেন পাতালপুরীর কোন অংশ উঠিয়ে নিয়ে এসে এখানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। বেশ কিছু সময় রাজা চুপ থেকে শেষে কথা শুরু করলেন-
- কী হয়েছে সবার? আপনাদের সকলের-ই কি নিকটাত্মীয় মারা গেছেন?
কেউ কোন জবাব দেন না, সবাই এখনো চুপ! রাজা আবার বললেন-
- কেউ কি জবাব দিবেন না? নাকি আমি বুঝে নেবো আপনারা সকলেই একসাথে শ্রবণ এখন বাচন শক্তি হারিয়েছেন?
এবার প্রধানমন্ত্রী কথা বলে ওঠেন-
- আসলে রাজা মশাই, আমাদের গতকালের পরাজয়ে সকলেই মুষড়ে পড়েছেন, কেউ লজ্জায় কথা বলছেন না।
- ও! সবাই লজ্জায় মুষড়ে পড়েছেন? ভালো কথা। তা, মন্ত্রী সাহেব কি লজ্জা পাননি? আপনি যে কথা বলে ফেললেন?
- আসলে আমি শুধু আপনার কথার জবাব দেয়ার জন্য-ই......
- ও! তার মানে আপনি যে কথা বলেছেন তা নিয়ে আপনি লজ্জিত?
- আসলে রাজা মশাই, আমি কথা বলার কারণে লজ্জিত না, তবে পরাজয় বরণ করেছি বলে লজ্জিত।
- বেশ বেশ! পরাজিত হলে লজ্জিত হওয়াই উচিৎ! কিন্তু তাই বলে সবাই চুপ করে থাকবেন? নাকি লজ্জা নিবারণের জন্য পরবর্তী করনীয় করবেন?
- অবশ্যই করনীয় করবো!
- হুম, ঠিক আছে। কিন্তু কথা হলো- এখন সবাই বেশ লজ্জা পাচ্ছেন, সবার মাথা হেট হয়ে আছে, সবাই নিজেদের ভবিষ্যৎ করনীয় নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন! অথচ, গতকাল আমাদের পরাজয় ঘটে যাওয়ার পরে তো কাউকে দরবারে আসতে দেখলাম না, কাউকে লজ্জিত হতেও দেখলাম না। সবাই বেশ হাসিমুখেই ঘরে ফিরেছিলেন বলেই আমি খবর পেয়েছিলাম! সবাইকে ধমকি সমেত দরবারে আসার হুকুম দেয়ার পরেই না সবার লজ্জা উথলে উঠলো!
এবার ডান সারির প্রথম আসন থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন।
- অভয় দিলে একটা কথা বলার ছিলো রাজা মশাই।
- বলুন কী বলতে চান।
- আসলে গতকাল হয়তো আমরা হেরেছি, কিন্তু এটাতো কোন গুরুত্বপূর্ণ লড়াই ছিলো না। আমরা সামান্য কিছু সৈন্য নিয়ে একদল বনদস্যু নিধন করতে গিয়েছিলাম আর তাতে পরাজিত হয়েছি। ওখানে আমাদের তুলনায় ওদের সংখ্যা বেশি ছিলো বলে আমরা পারিনি, আর তাছাড়া ওরা তো আমাদের সীমান্তের জন্যও কোনো হুমকি নয়! আর আমরা চাইলে আরও বেশি সৈন্য নিয়ে গিয়ে ওদের পরাজিত করতে পারবো। আর সর্বশেষ কথা হলো ওরা তো আসলে আমাদের সীমায় লুট করে না। তাই, ব্যাপারটি নিয়ে আমরা অত বেশি বিচলিত হইনি।
- আপনার বলা শেষ হয়েছে?
- জী হুজুর!
- বেশ! আমি এখন আপনাকে কোন কথার জবাব দিতে চাই না, তবে চাক্ষুস দেখাতে চাই যে কালকের পরাজয় আমাদের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ। কেন আমাদের আরও শক্তি নিয়ে ওখানে যাওয়া উচিৎ ছিলো আর কেন আমাদের এই ছোট্ট পরাজয়েও বিচলিত হওয়া দরকার ছিলো।
রাজা মশাই এবার নিজের আসন ছেড়ে উঠে হেঁটে সমতলে চলে এলেন। দুই দিকে সারিবদ্ধ সভাসদদের মাঝে হেঁটে হেঁটে কয়েকজনকে ডেকে সামনে নিয়ে এলেন।
- আপনারা ক'জন আজ বিদেশ ভ্রমনে বের হবেন। আপনাদের সাথে আমি পথপ্রদশক দিয়ে দেবো, সে আপনাদের এক অচেনা দেশে পৌঁছে দিয়ে আসবেন। তারপর আপনারা পরবর্তী তিরিশ দিন পদব্রজে সেই দেশ ভ্রমন করবেন। দেশের প্রাকৃতিক সচ্ছলতা, মানুষদের জীবন-মান, তাঁদের ব্যবহার- সর্বোপরি সেখানকার পরিবেশ সম্পর্কে যা দেখবেন সবকিছুই লিপিবদ্ধ করে নিয়ে আসবেন। আপাতত এটাই আপনাদের করনীয়।
রাজা মশাই একজন পথপ্রদর্শক নিযুক্ত করে দিয়ে আর তাঁদের গন্তব্য বুঝিয়ে দিয়ে দরবার ভেঙে দিলেন। সাথে জানিয়ে দিলেন, তাঁদের ফেরার পূর্বে আর দরবার বসবে না। যেদিন সবাই ফিরে আসবেন, সেদিন একসাথে খোলা মাঠে দেশের সকল জনতার উপস্থিতিতে দরবার বসবে।
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেলো, দুই একদিনের মাঝেই অভিযাত্রীদের প্রত্যাবর্তনের কথা। পুরো দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে রাজার পূর্বঘোষিত খোলা ময়দানের সভা দেখার জন্য। তাঁরা এখন নিজেদের মাঝে অনুমানে ব্যস্ত ভ্রমণে থাকা অভিযাত্রীদের কোন ধরণের অভিজ্ঞতা অর্জনের উদ্দেশ্যে রাজা ওই দেশে পাঠিয়েছেন। কেউ বলছেন, রাজা মশাই সভাসদদের মূলত যুদ্ধবিদ্যা শিখতে পাঠিয়েছেন। কারো ধারণা, রুপকথার মত সুন্দর দেশটি রাজা মশাই দখল করতে চান- তাই তার নিরাপত্তা দেখতে পাঠিয়েছেন। আবার কেউ ভাবছেন, সেই দেশের সাথে মিত্র হয়ে রাজা মশাই নিজেদের দেশের শক্তি বৃদ্ধির চিন্তা করছেন বলে ওই দেশের শক্তি জানতে চেয়েছেন। আবার কারো ধারণা, আসলে এর সবকিছুর মূলেই রাজকার্য আরও সুন্দর করার চেষ্টা! যেহেতু ওই দেশ অনেক সুন্দর আর সুখী, তাই রাজামশাই তাঁদের শাসনকার্য অনুকরণ করার জন্যই বিস্তারিত জানতে এমন উদ্যোগ নিয়েছেন। এতসব ভাবতে ভাবতেই সবাই একদিন ঘোষণা শুনতে পেলো- পরবর্তী সকালে সবাই যেন মাঠে উপস্থিত থাকেন, কারণ- সেখানে আগামী রাজসভা বসবে।
পরবর্তী দিন আলো ফুটতে না ফুটতেই মাঠ লোকারণ্য হয়ে যায়। শুধু রাজধানী নয়, পুরো দেশ থেকেই মানুষের যেন ঢল নেমেছে। সবাই উৎসুক হয়ে রাজার আগমনের অপেক্ষা করতে থাকে খোলা মাঠের এই দরবারকে ঘিরে। অবশেষে রাজা মশাই তার সভাসদদের নিয়ে মাঠে তাঁদের নির্ধারিত আসন গ্রহণ করেন। সামান্য অপেক্ষার পরে ঘোষণা দিয়ে শুরু হয় ব্যতিক্রমী এই রাজসভার কার্যক্রম।
সাধারণ আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাজা কথা শুরু করেন-
- সম্মানিত অভিযাত্রীগণ! আপনারা সবার সামনে আসুন আর নিজ নিজ অভিজ্ঞতার কথা সবার সামনে নিজের মুখে বর্ণনা করুন।
অভিযাত্রীদের মাঝে সবথেকে ক্ষমতাশালী সভাসদ সবার আগে সামনে আসেন, রাজাকে কুর্ণিশ করে সে তার ঝোলা থেকে নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা লিখে রাখা দস্তাবেজ হাতে নিয়ে বলতে আরম্ভ করেন-
- আমরা যে দেশে গিয়েছিলাম, সেটি একটি সাগর পার্শ্ববর্তী উর্বর ভূমির দেশ। যেই দেশের প্রায় সর্বত্রই ফসল ফলে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বলতে যা বুঝায় তার সবকিছুই এই দেশে আছে। দেশটি আর্থিক সম্পদের দিক থেকেও বেশ সমৃদ্ধশালী বলা যায়। বিশাল উচু উচু অট্টালিকায় রাজধানীটাকে ঘিরে রেখেছে। অন্যান্য অঞ্চল সমূহও বেশ উন্নত।
- আপনি বরং দেশটির মানুষদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
- রাজা মশাই, আমি আমার এই এক মাসের ভ্রমণকালে যা উপলব্ধি করেছি, তাতে বলা যায়- দেশটির মানুষগুলো বেশ শান্ত। তাঁরা কোন হাঙ্গামা পছন্দ করে না। বেশ শান্তিপ্রিয় একটা মনোভাব তাঁদের মাঝে দেখা যায়।
- আর কিছু দেখেননি? আমরা ওই দেশের মানুষদের থেকে কিছু শিখতে পারি কি?
- জী, আসলে আমরা তাঁদের থেকে উন্নতি শিখতে পারি। তাঁদের ভিন্ন ধরণের কৃষ্টি, তাঁদের স্থাপত্য- এইসব আর কী।
- ঠিক আছে, আপনি চলে যান। এবারে অন্য কেউ সামনে আসুন। আর হ্যাঁ, দেশটির সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়ার দরকার নেই, শুধু সেখানকার মানুষদের আচরণগত বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করলেই হবে।
এবার দলের মধ্য থেকে বেশ সুদর্শন দেখতে এক যুবক বয়সী সভাসদ সামনে চলে আসেন তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে। রাজা মশাইকে কুর্ণিশ করে তাঁর বর্ণনা শুরু করলেন তিনি-
- রাজা মশাই, দেশটি অনেক সুন্দর সত্য, তবে মানুষদের মাঝে কী যেন এক সমস্যা আছে। তাঁরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। তাছাড়া, দেশটিতে প্রচুর অট্টালিকা যেমন আছে, তেমনি সেই অট্টালিকার পাশেই আবার অনেক গৃহহীন মানুষের বসবাস দেখা যায়। তবে ভাবতে অবাক লাগে, এতে তাঁরা ক্ষিপ্ত বা প্রতিবাদী হয়ে ওঠেনি; বরং তাঁরা নিজেদের সামর্থ্যের মধ্যেই সুখে থাকার চেষ্টা করে।
- আপনি কি এর কোন কারণ অনুসন্ধান করেছেন?
- জী না রাজা মশাই।
- ঠিক আছে, আপনি আসুন। এবার আপনাদের মধ্য থেকে কেউ কি আমাকে আরও ভালো করে সেই দেশের মানুষদের আচরন কেমন আর তার কারণ কী ব্যাখ্যা করতে পারবেন?
এবারে দলের সবথেকে বয়স্ক ব্যক্তিটি ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এলেন। সাদা চুল দাড়িতে তাঁর দীর্ঘ পথ ভ্রমণের ক্লান্তি নিয়েই তিনি রাজা সাহেবকে কুর্ণিশ করে একটু বসে কথা বলার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। অবশেষে রাজার অনুমতি সাপেক্ষে একটি কুরসিতে বসে তিনি তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন-
- রাজা মশাই, আসলে আমার মনে হয় ওই দেশের মানুষের মাঝে সুখ নেই, তাঁরা শুধু বাঁচার জন্য বাঁচে। আর আমার মনে হয় তাঁদের প্রধান সমস্যা হলো মানসিক পরাজয়।
রাজা দুর্জয় প্রাণ সামান্য মুচকি হাসি দিয়ে বললেন-
- আপনি কি একটু এই মানসিক পরাজয়ের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করবেন?
- জী অবশ্যই। আসলে রাজা মশাই, আমরা যখন প্রথমে ওই রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হই, তখন দেশটিতে একটি উৎসব চলছিলো। পুরো দেশ বিভিন্ন রঙে, বিভিন্ন ঢঙে সাজানো। আমরা গিয়ে যেই সরাইখানায় উঠি, সেখানেও বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছিলো। তো, আমরা যখন রাতের খাওয়া শেষে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ সরাইখানার বাহিরে সামান্য গোলযোগের শব্দ শুনতে পাই। অচিন দেশ, তাই তড়িঘড়ি না করে ধীরে ধীরে সেখানে উপস্থিত হই, আর দেখি- কয়েকজন মানুষ একজন পথচারীকে আগলে চ্যাঁচামেচি করছে। দূরে পাহারাদার দাড়িয়ে তামাশা দেখছে। আর আশেপাশে কোন মানুষ দেখা যাচ্ছে না। অথচ, চ্যাঁচামেচি বেশ উচ্চস্বরেই হচ্ছিলো আর তাতে আশেপাশের মানুষদের টের পাওয়ার কথা। আমরা ভাবলাম, যেহেতু কেউ এগিয়ে আসছে না, তাহলে হয়তো ওই পথচারী কোন অপরাধী হবে যাকে সেপাইরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর আমরা নিজেদের ঘরে চলে আসি। পরেরদিন সকালে আমি সরাইখানার মালিকের কাছে গিয়ে গতরাতের ঘটনা জানতে চাইলে সে আমাকে যা বললো তাতে আমি অবাক হয়ে যাই।
- কী বললেন তিনি?
- তিনি বললেন, ওখানে কোন অপরাধিকে ধরা হয়নি, আক্রমণকারী মানুষগুলো আসলে দস্যু! তাঁরা ওই পথচারীর সর্বস্ব লুটে নিচ্ছিলো।
- হ্যাঁ, তা তো হতেই পারে। আমাদের দেশেও ডাকাতি হয়-
- জী, তা হয়। কিন্তু জনসম্মুখে নির্বিঘ্নে হয় না। সব মানুষগুলো লুকিয়ে দেখছিলো, কিন্তু কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি! আর সরাইখানার মালিকের মতে আসলে ওই পথচারি-ই দায়ী, কারণ, উৎসবের সময়ে সে রাত বিরেতে সাথে অর্থকড়ি নিয়ে পথে নেমেছিলো কেন! হ্যা, পথে ডাকাতি হতে পারে, কিন্তু তাই বলে দোষ যে লুণ্ঠিত হয়েছে তাঁর? পরবর্তী সন্ধায় লক্ষ্য করলাম, আক্রমণকারীদের একজন দিনের বেলা সবার সাথে বেশ হাস্যজ্জল মুখে কথা বলছে! সবাই তাকে বেশ তোয়াজ করছে! আমি অবাক হয়ে গেলাম তাঁদের এমন আচরন দেখে। তাঁরা গতরাতের এই লোকের করা অপরাধের সময় কোন বাঁধা দেয়নি, সেটাও না হয় মেনে নিলাম কিন্তু সেই ব্যক্তি যে সাধারণ মানুষের সম্পদ শক্তির জোরে কেড়ে নেয়, তাকেই আবার সাধারণ মানুষের সম্মান প্রদর্শন! একটু ঘৃণা পর্যন্ত নেই!
এরপর আমরা সেখানে মাত্র এক রাত থেকে পদব্রজে দেশ ভ্রমণে বের হই। ঘুরতে ঘুরতে একসময় আমরা সেই দেশটির সবথেকে বড় বিদ্যাপীঠে হাজির হই। সেখানে ঘুরে ঘুরে সব দেখতে দেখতে আমি একসময় লক্ষ্য করি, একটি গাছের নিচে কয়েকজন তরুন বেশ ক্ষিপ্তভাবে একে অপরের সাথে কথা বলছে। তবে তাঁদের মাঝে কোন হিংস্রতা দেখা যাচ্ছে না। দেখে বোঝা যায় দূরের কারো উপরে তাঁরা ক্ষিপ্ত। আমি তাঁদের কাছে একটু কথা বলার জন্য এগিয়ে যাই। নিজের পরিচয় এবং তাঁদের দেশে আসার কারন উল্লেখ করে তাঁদের ক্ষিপ্ত মনভাবের কারন জানতে চাই। প্রথমে তাঁদের একজন কথাটাকে উড়িয়ে দেয়, বলে- ও কিছু না। আমরা এমনিতেই একটা বিষয় নিয়ে নিজেদের মাঝে তর্ক করছিলাম।
আমি তাঁদের বলি যে, তাঁদের আপত্তি না থাকলে তাঁরা আমাকে ব্যাপারটি খুলে বলতে পারে। এতে তাঁদের কোন ক্ষতি হবে না, উপরন্তু আমি হয়তো তাঁদের কোন উপকার করতে পারবো। শেষে তাঁদের মধ্য থেকে যে সবথেকে বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ছিলো সে আমাকে জানায়, তাঁরা কয়জন এই বিদ্যাপীঠ থেকে তাঁদের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করেছে। তাঁদের সবার-ই ফলাফল খুব ভালো। কিন্তু আজ তাঁরা সরকারি দপ্তরে কাজের খোঁজে গিয়েছিলো আর সবাই ব্যর্থ হয়ে ফিরেছে। আমি বললাম, ব্যর্থ হওয়ার সাথে ক্ষিপ্ত হওয়ার সম্পর্ক কী? তাঁদের মাঝে একজন বললো, তাঁদের সাথে চাকুরীদাতার আগেই রফা হয়েছিলো, কিন্তু সে তাঁদের ফিরিয়ে দিলো কেন?
রাজা মশাই, আমি আবার অবাক হলাম। একটা দেশে দুর্নীতি থাকতে পারে, কিছু সভাসদ বা ক্ষমতাবান দুর্নীতি করতেই পারে, কিন্তু সেটা সবাই স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় কী করে? দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের শ্রেষ্ঠ সন্তান তাঁরা, অথচ, দুর্নীতি করে বিফল হয়েছে বলে মনে ক্ষোভ! কিন্তু তাঁদের তো ক্ষোভ থাকার কথা এই দুর্নীতিগ্রস্থ পদ্ধতির উপরে! দেশের সেরা মেধাবীদের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে ভাবুন সাধারণ জনগনের কী অবস্থা?
আমি কিছু না বলে তাঁদের কাছ থেকে উঠে আসতে গিয়ে শুনলাম, তাঁদের একজন অন্যজনকে বলছে- "একজন বিদেশীর কাছে নিজেদের ছোট করার কী দরকার ছিলো?" আমি হেঁটে চলে আসি, আর ভাবতে থাকি- তাঁরা দুরবস্থার মধ্যে আছে, অথচ তাঁরা তাঁদের এই অবস্থা নিয়ে সুখী! অন্যের কাছে তাঁরা তাঁদের দুরবস্থা লুকিয়ে রেখে তৃপ্তি পেতে চায়।
রাজা মশাই শুনছেন?
- হ্যাঁ বলুন, শুনছি-
- এরপর আমরা যখন দেশটির রাজধানীতে ঘুরতে বের হই, তখন তাঁদের আলিশান মহল, নয়নাভিরাম সৃষ্টিগুলো দেখে যখন আপ্লূত হচ্ছিলাম, তখন খেয়াল করি, ভর দুপুরে ভয়াবহ রোদের মাঝে বিশাল বিশাল অট্টালিকার যে ছায়া সৃষ্টি হয়, তাতে কয়েকজন মানুষ বেশ শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। কিছু না বলে তাঁদের পাশে গিয়ে দেখতে থাকি। ধুলো মাখা শরীরে ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ নিয়ে কয়েকজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে। আর তাঁর পাশে জীর্ণ পোশাকে এক মহিলা দুটো বাচ্চাকে খাইয়ে দিচ্ছে। আর বাচ্চাদের মাঝে যেটা একটু বড়, সেটা বলছে, "মা, আজকে যদি আমাদের ভাগিয়ে দেয়? তাহলে ঘুমাবো কোথায়?" আর মায়ের উত্তর ছিলো "না মা, ভাগাবে না, প্রহরীটা খুব ভালো, কটা পয়সা দিলেই আর কিছু বলবে না"
লজ্জার কথা হলো, একটা দেশ, প্রাকৃতিক বা জাগতিক- সকল দিক থেকেই উন্নত। সম্পদের কোন অভাব নেই! অথচ, সেখানে প্রচুর মানুষ আছে, যাদের থাকার জায়গা তো দূরের কথা, একটা নির্দিষ্ট গাছতলাও নেই। দেশের কিছু মানুষের বৈভবের স্বাক্ষর হিসেবে গড়ে ওঠা অট্টালিকার ভিড়ে অজস্র গৃহহীন মানুষ ঢেকে আছে। তাও না হয় মানা সম্ভব। কিন্তু তাই বলে ভুক্তভুগীরা সেটা মন থেকেই মেনে নিবে? অর্থের বিনিময়ে প্রহরী তাঁদের রাস্তায় থাকতে দিবে বলে তাঁরা সেই প্রহরীকে ভালো জ্ঞান করছে?
এতক্ষণ পরে রাজা মশাই কথা বললেন-
- তাহলে আপনি এর কারন হিসেবে কাকে দায়ী করছেন?
- আমি শুধু সেই মানুষগুলোকেই দায়ী করছি। রাজা মশাই, আমি একটি উদাহরণ দিতে চাই। ধরুন, আমার ছোট্ট একটি বাগান আছে, যাতে অনেক অনেক ফুলের গাছ লাগানো। আর সাধারনভাবেই বাগানে আগাছা জন্মাবে আর আমাকে সেই আগাছাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। কিন্তু রাজা মশাই, আমি যদি আগাছাগুলোকে হিসেবে না নিয়ে অন্যদিকে মনোযোগী থাকি, সেক্ষেত্রে বেশ কিছুদিন পরে আমি কী দেখতে পাবো?
- সেখানে কোন বাগান থাকবে না, শুধু আগাছায় পূর্ণ থাকবে। কারণ, আগাছা দ্রুত এবং অগোছালোভাবে বৃদ্ধি পায়।
- জী, আমিও তাই বলছি... আপনি যখন পরাজিত, বা নিগৃহীত কিংবা নিপীড়িত হবেন, আর সেটা মানতে শুরু করবেন বা গুরুত্ব দিবেন না, তখন সেই পরাজয় বা অত্যাচার আপনার উপরে বারবার আসবে। আর বারবার পরাজিত হতে হতে একসময় আপনি হয়ে উঠবেন পরাজয়ের প্রতিক। একটা সময়ে আপনি বিশ্বাস করবেন, পরাজয়-ই শুধু আপনার জন্য নির্ধারিত, বিজয়ের চিন্তাও আপনার পাপ! আবার আপনি হয়তো বিজয় কী তাই ভুলে যাবেন।
আমার মতামত হলো, ওই দেশের মানুষগুলো বঞ্চিত হওয়াটাকে এক সময় গুরুত্ব দেয়নি, হয়তো সেটা নিজের গায়ে লাগেনি বলে। কিন্তু যখন একে একে ধাপে ধাপে সবাই পরাজিত হতে থাকে আর সবাই নিজের মত ব্যস্ত থাকতে শুরু করে, তখন তাঁরা এই পরাজয়টাকে নিজের মাঝে ধারন করে। এখন তাঁরা অনুধাবন-ই করতে পারে না যে তাঁরা আসলে বঞ্চিত! তাঁদের পূর্বপুরুষদের নিরবতা কিংবা মানসিকতা ধারন করে আজ তাঁরা গালভরা সুখী দেশের নাগরিক হয়ে অসুখী।
আমি তাঁদের মাঝে হয়তো ক্ষোভ দেখিনি, কিন্তু তৃপ্তি-ও দেখিনি। তাঁরা জীবনের আসল সুখের সন্ধান জানে না। তাঁরা শুধু শক্ত চোখে দুনিয়া দেখে আর নিয়মতান্ত্রিকভাবে বেঁচে থাকে। সুখ কিংবা দুঃখের রস সেখানে শুকিয়ে গেছে।
বেশ কিছু সময়ের নীরবতা ভাঙেন রাজা মশাই নিজেই। তিনি বলেন-
- প্রতিরক্ষামন্ত্রী সাহেব, সামনে আসুন।
মন্ত্রী সামনে এগিয়ে আসেন মাথা নিচু করে।
- জী হুজুর-
- কী বুঝলেন?
- আমরা লজ্জিত রাজা মশাই। আমরা এখন বুঝেছি।
- হুম, মনে রাখবেন- পরাজয় আসতেই পারে, কিন্তু তাকে অবহেলা করে ফেলে রাখা যাবে না। হয়তোবা সকল পরাজয় অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু তবুও পরাজিত হলে তাঁর প্রতিকার করতে হবে। আজকে যদি আমি একটা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেই, দু’দিন পরে আরও বড় কোন অন্যায় ঘটবে। হয়তো অন্য কারো সাথে অন্যায় ঘটছে, আমি নিরাপদ, কিন্তু আমার নীরবতায় একদিন ওই অন্যায় আমার উপরে পতিত হতে সাহায্য করবে। আর দীর্ঘদিনের নির্লিপ্ততায় আপনি একসময় আপনার অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়বেন। আর তখন-ই আপনি হবেন মানসিকভাবে সম্পূর্ণ পরাজিত একজন মানুষ। আমি হয়তো সবথেকে শক্তিশালী হতে পারবো না, তবে আমাকে আমার সম্পর্কে, আমার অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে, শুধু স্বার্থ- সচেতন নয়। অভিযাত্রী সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ সহযোগিতা করার জন্য। আজকের সভা এখানেই সমাপ্ত।
বলে রাজা দুর্জয় প্রাণ তাঁর আসন ছেড়ে রওয়ানা দিলেন আর সভাসদেরাও নীরবে তাকে অনুসরণ করলেন।
©somewhere in net ltd.