![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ময়না
ঢং ঢং ঢং ঢং
স্কুলের ছুটির ঘন্টা বাজলো। স্কুল থেকে ছোট
ছোট ছাত্র ছাত্রীরা আনন্দে লাফাতে
লাফাতে বাড়ির দিকে ছুটলো। এদের মধ্যে
ময়না ও একজন । ময়না সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে।
সেও ছুটতে ছুটতে বাড়িতে পৌছে গেলো।
আম্মা , আম্মা ও আম্মাগো।
আরে আমার ময়না পাখিটা দেহি আমারে
ডাকতাছে। ইস্কুল কি ছুটি অইয়া গেছে?
হ আম্মা জানো আইজ মার কত বান্ধবী হইছে।
স্যারেরা আমাগো সবাইরে অনেক আদর করে।
আমার সোনামনিডা যদি ভালা কইরা লেখা
পড়া করে তইলে সবাই অনেক ভালা কইবো।
ময়নাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে ওর মা ।
আমার মায় কি বাড়িতে আইছে? বলতে বলতে
উঠানে ঢুকে ময়নার বাবা। হাতে বাজারের
ব্যাগ। ময়না ছুটে যেয়ে ওর বাবার কোলে
ঝাপিয়ে পরে।
শোন ময়নার মা , আইজ তুমি আমার ময়না র
লাইগ্যা অনেক মজা কইরা মাছ রানবা। দেহ
আমি তেলাপিয়া মাছ আনছি। বলে বাজারের
ব্যাগটা এগিয়ে দেয়।
খুব ভালা করছেন আপনে। এহন এইহানে বইয়্যা
একটু জিরাইয়্যা লন। ঘামে পুরা ভিইজ্জা
গেছেন গা। আইজ বিয়ালে আপনের কামে
যাওন লাগবো না। ময়নার মা বলে।
এইডা কি কও , কামে না গেলে আমি পয়সা
পামু কেমনে? ময়না পড়ালেখা শুরু করছে। ওর
ইস্কুলের খরচ আছে না । মাস শেষ হইলে
মাস্টারের বেতন দেওন লাগবো। ওর লাইগ্যা
কত ট্যাকা লাগবো। উই অনেক বড় মানুষ অইবো।
দেখবা অর কারনে আমাগো মুখ উজ্জ্বল অইবো।
আমার আর তহন আর কাম না করলেও চলব।
ময়নাই অনেক ট্যাকা কামাইবো। ময়নার বাবা
এতোগুলো কথা বলে থামে।
আইচ্ছা ঠিক আছে। এহন জিরাই লন। এই বলে
ময়নার মা বাজারের ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরের
দিকে চলে গেলো। রান্নাঘর তো নয় যেন একটা
ঝুপড়ি। দুদিকে বাশ আর কাঠের দেওয়াল
উঠানো। আর বাকি দুদিকে খালি কিছু নেই।
এর ভেতরেই মাটির তৈরি চুলায় রান্নার কাজ
চলে।
---------------
সন্ধ্যা বেলায় ময়না মাটির উপর চাটাই
বিছিয়ে বই নিয়ে পড়ছে। জীর্ণ একটা ঘর। ঘরের
আসবাব পত্র বলতে একটি চৌকি আর একটা
কাপড় রাখার আলনা। একপাশে একটা চাটাই
বিছানো যেটাতে বসে ময়না পড়ছিল অ-তে
অজগর, আ-তে আম ইত্যাদি।
ময়নার মা পাশে বসে ময়নার পড়া শুনছে আর
ভাবছে ময়না অনেক বড় হয়ে গেছে। অনেক বড়
চাকরী করে। আর বাড়িতে এসে তাদের দেখে
যায়। ওদের যত কষ্ট ছিলো সব দূর হয়ে গেছে। এক
রাজকুমার ময়নাকে বিয়ে করার জন্য আসছে।
আর বেশি ভাবতে পারে না ময়নার মা ।
এভাবে আশা ভরসা আর হাসি আনন্দের মধ্য
দিয়ে কয়েকটা মাস কেটে যায়। এখন ময়না
আগের চেয়েও পড়ালেখায় অনেক বেশি
মনোযোগী। একদিন স্কুল থেকে ফিরে ময়না
বিছানায় শুয়ে আছে।
কিরে ময়না এই অবেলায় শুইয়া আছস ক্যান?
গতরডাকি ভালা লাগে না? ময়নার মা
জিজ্ঞেস করে।
নাগো আম্মা । মাথাডা কেমন জানি ব্যাথা
করতাছে।
তয়লে তুই একটু ঘুমায় থাক। উইঠ্যা দেখবি ঠিক
হইয়্যা গেছস।
সেদিনের মতো ময়না ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু
কয়েকদিন পর কাপুনি দিয়ে জ্বর আসে ময়নার।
পড়ালেখা না জানা ময়নার বাবা মা বুঝতে
পারে না কি হয়েছে ময়নার। সাধারণ জ্বর
মনে করে গুরুত্ব দেয়না। জ্বর আসতে আসতে
বাড়তে থাকে। একসময় দূর্বলতার দরুন কথা বলার
সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ময়না।
একদিন প্রতিবেশি ভাবী আসে ময়নাকে
দেখতে। তাকে দেখে ময়নার মা বলে, ভাবী
দেখেন না আমার ময়না কেমন কইর্যা হুইয়া
আছে। কথা জিগাইলে খালি চাইয়া থাকে।
কোন জবাব দেয় না।
ময়না, ও ময়না। তোর কেমন লাগে আমারে একটু
ক’তো? মরা কিছু করতে পারি কিনা দেহি।
প্রতিবেশী সেই ভাবী ময়নাকে জিজ্ঞেস
করলো।
ময়না তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে
থাকে । কিছু বলতে চায় কিন্তু কিছু বলতে
পারে না।
ভাবী কিছু বুঝলেন? আমার ময়না এমন কইরা
রইছে ক্যান? ময়নার মা আবার জিজ্ঞেস করে।
আমি ত কিছু বুঝলাম না । আপনেরা ময়নাকে
নিয়া বাবার কাছে যান । বাবায় অরে বালা
কইরা দিতে পারে । ভাবী বললেন।
ভাবী আপনে কোন বাবার কথা কইলেন?
বুঝলাম না। ময়নার মা বললেন।
ওইযে সিরাজ বাবার কথা। তিনিতো অনেক বড়
মাপের মানুষ। মাইনষের রোগ বালা কইরা দেন
আবার জ্বিন ভুতে ধরলে উডিরে ছাড়াইয়্যা
দেন। আপনেরা তারাতারি বাবার কাছে
যান।
আমি এহনই ময়নার বাপরে কইতাছি। বলে ঘর
থেকে বাইরে গেলেন ময়নার মা।
ও ময়নার বাপ , ভাবী কইলো সিরাজ বাবা
নাকি মাইনষের বালা ভালা কইরা দিতে
পারে। ময়নারে লইয়্যা লন হের কাছে যাই।
ঠিক আছে চলো ।
ওরা সবাই সিরাজ বাবার দরবারের দিকে
রওয়ানা দিলো।
----------
সিরাজ বাবার দরবার।
দরবার তো নয় যেন ফলের বাজার। বাড়িটা
পুরো তার মুরিদদের দিয়ে ভরা। বাবা উঠানের
মাঝখানে একটা আসন পেতে বসা। তার
একপাশে মুরিদদের দেওয়া ফলের স্তুপ। আরেক
পাশে কয়েকজন বসে বাবার নামে জিকির
করছে। পেছনে কয়েকজন দাড়িয়ে বাবাকে
বাতাস করছে।
আসনে চোখ বন্ধ করে বাবা বসে আছেন । পরনে
তার গেরুয়া রংগের কামিস। মাথার চুল গুলো
জটা বেধে পেছনে ঝুলিয়ে রাখা। গলায় রঙ
বেরং এর পুতির মালা। এক হাতে কাঠের
দানার ইয়া বড় তসবিহ। আর এক হাতে একটা
লাঠি।
ময়নার বাবা , সিরাজ বাবার সামনে
হাতজোড় করে বসে পড়লো। কাদো কাদো কন্ঠে
বলল, আমার মাইয়্যাডার অনেক অসুখ,বাবা,
আমার মাইয়্যাডারে আপনে ভালা কইরা দেন।
বাবা চোখ খুললেন। তারপর গম্ভীর কন্ঠে
বললেন, চিন্তা করিস না । আমার কাজই তো
তোগো দেখভাল করা । তোর মাওয়্যা ঠিক
হইয়্যা যাইবো। তোর মাইয়্যা কই?
বাবার আসনের সামনে একটা লাল কাপড়
বিছিয়ে সেখানে ময়নাকে শোয়ানো হলো।
বাবা তার আসন থেকে উঠে ময়নার চারপাশে
কয়েকবার ঘুরলেন। তারপর এক পাত্রে পানি
নিয়ে তিনি কিছু পড়ে সেই পানি থেকে কিছু
অংশ ময়নার গায়ে ছিটালেন । হাতের
তসবিহটা ময়নার পা হতে মাথা পর্যন্ত
ঘুরালেন তারপর লাঠিটা ময়নার কপালে রেখে
কি যেন বিড় বিড় করে বললেন। তারপর নিজের
আসনে যেয়ে আবার ধ্যান মগ্ন হয়ে বসে
পরলেন।
সকলের মাঝে পিনপতন নিরিবতা নেমে এলো
। একসময় বাবা চখ খুলে তাকালে বাবা বললেন
, ময়নারে এক বজ্জাত জ্বিনে ধরছে।
এটা শুনে ময়নার বাবা তার পায়ে পরে
গেলেন। বললেন, যে করেই হোক আমার
মাইয়্যাডারে বাচান। আমার মাইয়্যাডা
কথাও কয় না।
ঐ জ্বিন ডাই তোর মাইয়্যার কথা বন্ধ কইরা
দিছে।বাবা বললেন।
আপনে আমার মাইয়্যারে বাচান। আপনে যা
চান আমি তাই দিমু। ময়নার বাবা বললেন।
ঠিক আছে আমি দেখতাছি। আমার আজ্ঞাবহ
জ্বিন দিয়া অরে বালা করন লাগবো।
এই বলে বাবা উঠে একটা বাটিতে পানি নিয়ে
তাতে কিছু পড়ে ফু দিলেন। তারপর সে
পানিটা ময়নার পা থেকে মাথা পর্যন্ত
ছিটিয়ে দিলেন। এরপর হাতের লাঠি দিয়ে
ময়নাকে আচ্ছামতো পিটাতে লাগলেন।
লাঠির বাড়ি সহ্য করতে না পেরে বেহুশ হয়ে
যায়।
বেহুশ হওয়ার পর বাবা পিটানো থামায়।
ময়নার বাবা বলে, বাবা আপনে আমার
মাইয়্যাডারে পিডাইতাছেন ক্যান? উইতো
আরো অসুস্থ হইয়্যা যাইবো।
আরে বলদ আমি তোর মাইয়্যারে পিডাইনাই।
আমি তো অর লগের জ্বিনডারে পিডাইছি।
আমি তো অরে বালা করতেই চাইতাছি। তুই
মাঝখানে আহিস না। এ বলে বাবা হাতের
পানি আবার ছিটিয়ে দিলেন। তারপর নিজ
আসনে যেয়ে বসে পরলেন।
চিন্তা করিস না। জ্বিনডারে আর দুই তিনবার
পিডান দিলে পলাইবো। এইবার আমার
জ্বিনেগো লাইগ্যা নজরানা দে এই বাডিতে।
ময়নার বাবা তার জমানো সমস্ত টাকা
সেখানে দিলেন। কিন্তু বাবা এ কয় টাকা
দেখে বললেন, আরো ট্যাঁকা লাগবো। নইলে
আমার জ্বিনেরা কাজ করতো না।
আমার কাছে তো আর ট্যাকা নাই । আপনে
জ্বিনেগো একটু বুঝান। ময়নার বাবা বললেন।
কি? ট্যাকা নাই । এতো বড় কথা। তাইলে তোর
মাইয়্যারে এইহানে লইয়্যা আইছোস কেন?
তোরা এখখুনি ভাগ এহান থাইক্যা । আমি
তোর মাইয়ার জ্বিন ছুডাইতে পারুম না।
ময়নার মা আর বাবা দুইজনে অনেক অনুরোধ
করলো কিন্তু ভন্ড বাবা তাদের কথায় কান
দিলেন না। বরং তিনি লোকদেরকে ডাকতে
লাগলেন।
এই কই তোরা ,এদিকে আয় । অগোরে এই বাড়িত
থন বাইর কর।
কয়েকজন লোক তাদেরকে বাড়ি থেকে টেনে
হিচড়ে বের করে রাস্তায় নিয়ে গেলো। আর
সেখানেই তাদের ফেলে দিয়ে গেলো।
সেই রাস্তা দিয়ে একজন লোক যাচ্ছিলেন।
তিনি তাদের দুরবস্থা দেখে সামনে আসলেন।
বললেন , আপনারা কি কোন বিপদে পড়েছেন?
দেহেননা ভাই এই সিরাজ বাবায় কয় আমার
মাইয়্যারে নাকি জ্বিনে ধরছে । ------------
সব কথা বলে যায় ময়নার বাবা।
দেখুন আমি একজন ডাক্তার। আপনার মেয়েকে
একটু দেখবো।
ডাক্তার ময়নার কপাল ও শিরায় হাত রেখে
পরীক্ষা করে বলে, আপনার মেয়ের তো খুব
জ্বর। এখনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
আমরাতো কোন হাসপাতাল চিনিনা। আর
আমাগো কাছে কোন ট্যাকাও নাই,
ডাক্তার এদের কথা শুনে বললেন, আপনারা
আমার সাথে আসুন । আমি এর ব্যাবস্থা করছি।
শহরের এক হাসপাতালে ময়নাকে ভর্তি করা
হয়েছে। পরীক্ষা করার পর দেখা গেছে ওর
ভাইরাস জ্বর হয়েছিলো। কিন্তু ভন্ড বাবার
পিটূনির ফলে ওর অবস্থা আশঙ্কা জনক হয়ে
পরেছে। ওর শারীরিক অবস্থার অবনতির
কারনে আই.সি.ইউ তে শিফট করা হয়েছে।
এই ধরনের ভন্ড বাবাদের কারনে সমাজ
হারাচ্ছে শত শত মেধাবী মুখ । মা-বাবা
হারাচ্ছে তাদের আদরের সন্তানকে। সামান্য
অসুস্থতা থেকে ময়নাকে মৃত্যুর দুয়ারে পাঠিয়ে
দিয়েছে এক প্রতারক। সমাজে যেমন এসব
প্রতারকদের অভাব নেই তেমনি এ ধরনের
ডাক্তার দের ও অভাব নেই যারা মানুষের
সেবা করাকে কর্ম বলে ঠিক করেছেন।
শিক্ষার অভাবের কারনে সমাজের অনেক
মানুষ কু সংস্কারে বিশ্বাস করে যার ফলাফল
হয় অনিবার্য ধংস। সমাজকে শিক্ষিত করার
মহান উদ্দেশ্যই হতে পারে একজন শিক্ষিত
মানুষের মূল লক্ষ্য।
[ লেখাটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক but বাস্তবেও
কখোনো এ রকম হয়। ]
My Blog
AmaderPage.Com
©somewhere in net ltd.