![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
“বর্ষণের বটবৃক্ষ নগরে ছড়ায় তার বিচারের সভা ।
স্বর্গের হাওয়ার প্রতি এই সেই ভ্রাম্যমান এরকম,
‘আমাদের’ মধ্যে বসবাসে আগমন!”
লিফটে উঠে ‘9’ লেখা বাটনে চাপ দিতে গিয়ে হঠাৎ মাথা ঘুরে ওঠায় ওসমান গণির মনে পড়ে তার অ্যাক্রোফোবিয়ার প্রায় শিশুতোষ রোগের কথা । দমবন্ধ অনুভূতিটাকে আরো প্রসারিত হতে না দিয়ে সে নিচে যায় । এক কাঠি সরেস নিকোটিন মুখে গলিয়ে সব প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া । নিজের সাথে বহুদিনের প্রশিক্ষিত এ প্রতারণা ওসমানের । ভুল হবার নয়, অথবা ভুল হয়ে যায়, সজ্ঞাতে বা অগোচরে । আমরা এখানে অনির্ধারিত দর্শক ।
আজ অবশ্য ওসমান সে সবকিছুই ভুলে যায় । সে হেঁটে হেঁটে খানিক পরে দাঁড়ায় রেললাইনের সামনে । তারও কিছুক্ষণ পর যখন চলন্ত ট্রেন ছুটে যায় জোড়া রেলের যেকোনো একটির উপর দিয়ে, তখন আমরা ওসমান গণীর চোখ জ্বলজ্বল করতে দেখি । চলন্ত ট্রেনের গায়ে হয়তো কিছু অন্ধকার আটকে ছিল শ্যাওলার মত । ওসমান সে অন্ধকারে নিজের অতীত দেখে । হয়তো একইসাথে বর্তমান এবং ভবিষ্যতকেও । সে তার ছ’মাস বয়েসী শিশু সন্তানকে প্রতিমুহূর্তে বা তারচেয়েও কম সময়ে বেড়ে উঠতে দ্যাখে । একসময় সে শিশুটি হয়ে যায় ওসমান গণির নিজেরই এক অতীত সত্ত্বা । ওসমান অস্বস্তিভরে তার সন্তানকে আবিষ্কার করে নিজের কিশোরবয়েসী প্রেমিকার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আলিঙ্গনের আগ-মুহূর্তে । ট্রেন চলে যায় । ওসমান গণির স্মৃতি আটকে থাকে পনের বছর বয়েসী আলেয়ার মুখে, আর সে মুখের প্রশ্রয় দেয়া অস্বস্তিতে অথবা আরো গভীরে । অত গভীরে সে ডুব দিয়ে দ্যাখেনি কখনো ।
ওসমান গণি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে । দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অতীত খোঁড়ে । রেললাইনের ওদিকটায় ইউসুফ আলী পানের পিক ফেলে । মসজিদ থেকে ফিরতে ফিরতে গুনগুনিয়ে হয়তো দরুদ শরীফ পড়ে । রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে ন্যাড়াদের কুত্তাটা নোংরার মধ্যে খাবার খুঁজে । নাম না জানা কোনো পাখি হয়তো ভুল করেই ডেকে ওঠে এই রাতে । এদিকে দোকানদার রুহুল আমিন চায়ের কাপ ধোঁয়া শেষে অদৃশ্য কাউকে জাউরার পোলা বলে গালি দেয় আর বাদ বাকি কি কি বলে তা শোনা যায়নি । কাছেই আমজাদ লুঙ্গি কাছা দিয়ে ‘পিশাব’ করে আর তারপর উঠে এসে ‘ঐ ওসমাইন্যা’ বলে ডাক দেয় বাল্যবন্ধুকে, অথবা ডাক দেয় না । যার কারণে ওসমান গণিকে আমরা আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি । তারপর আবার ট্রেন আসে । ওসমান গণির চোখ আর জ্বলে ওঠে না শ্বাপদের মত । সে দৃষ্টিতে দেখা যায় ক্লান্তি । আমরা ওসমান গণির সহচর হই ।
ওসমান হাঁটতে থাকে রেললাইনের পাশের পায়ে চলা পথ ধরে । অথবা কেবল সাদামাটা হাঁটে না, কিছু একটা তাড়িয়ে নিয়ে যায় ওকে । সেটা অবচেতনভাবে ঘাপটি মেরে থাকা স্মৃতি থেকে শুরু করে আজকের রাতের এই মেঘলা আকাশের দু’চারটা মেঘও হতে পারে । সঠিক তথ্য জানার জন্য ওসমান গণির মস্তিষ্কে অনুপ্রবেশের সিদ্ধান্ত নিই আমরা । বাংলাদেশের পেনাল কোডের কোনো ধারায় এর উল্লেখ না থাকায় হয়তো তা অবৈধ হিসেবে গণ্য হবে না ।
ওসমান যাচ্ছে প্রায় বিশ বছর আগেকার চেনা পথ ধরে । এ পথ দিয়ে স্কুলে যেত সে, অথবা এখনো যায়, কেমন যেন দ্বিধায় পূর্ণ মনে হচ্ছে আজকের এই রাতটা । ওসমান নিজেকে জিজ্ঞেস করে সে কোথায় যাচ্ছে, কার কাছে, কি কাজে । বয়োবৃদ্ধ বটের শেকড়ের আভাস দেখা যায় পথে । অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে গিয়ে ওসমান হয়তো আগে উষ্টা খেয়ে উলটে পড়তো, আজ পড়ে না । ওসমান গণি এই অন্ধকারেও দিনের আলোর মত দেখতে থাকে হারুন মুচিকে, যার এক পায়ে খুঁত রয়েছে বলে হাঁটে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে । হারুন মুচি ভরাট স্বরে উচ্চারণ করে, “মোহাম্মদ ওসমান গণি, এতো রাইতে কি গুণতে যাইতাছো তুমি অ্যা ? হিসাব নিকাশ কিছু বাদ আছিলো নিহি ?”
ওসমান গণি হয়তো তাতে সায় দেয় । সে কিছু একটা মেলানোর চেষ্টা করছে সেরকম ভঙ্গিতে হেঁটে যায় সামনের দিকে । আমরা তার মস্তিষ্কে দেখতে পাই অনেকগুলো সংখ্যা আর দৃশ্যপট ; অগোছালো, ওলটপালট । ওসমান গণি বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গ্যাছে ।
আমরা দেখতে পাই অথবা ওসমান গণি হিসেবে দেখতে পাই, বিশাল এক স্কুল মাঠে এসে এই পথটা মিশে গিয়েছে । যে স্কুল মাঠে প্রাত্যহিক শারীরিক কসরত সেরে ছাত্ররা এলোমেলোভাবে পা ফেলে ক্লাসরুমে এগিয়ে যাচ্ছে । স্কুল-ঘরের বারান্দায় কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে এক বা অনেকগুলো ওসমান গণি ।
ভীত-চোখে ওসমান দেখতে পায় মধ্যবয়েসি গোলাম মোস্তফা স্যার তাঁর লাল দাঁড়ি মুড়িয়ে প্রচণ্ড আক্রোশে বেত্রাঘাত করে যাচ্ছে একাধিক ওসমান গণির হাতে । ওসমান হাতের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় কাঁচা লাল রক্ত আর তার কানে বাজে সমস্বরে চিৎকার-কান্না-প্রলাপ । সে শব্দে বেজে চলে, বেজেই চলে, জ্যামিতিক হারে সে প্রতিশব্দীয় বিভীষিকার ডেসিবল মাত্রা বাড়তে থাকে । ওসমান এবারে দৌড়ে পালাতে চায় । আর তারপরই বা তখনই সে দেখতে পায়, কেউ একজন গায়ের জোরে শট মেরে ফুটবলটাকে এনে ফেলেছে রেললাইনের ওপাড়ে । ডানপিটে এক ছোকরা সেই বল নিতে আসার সময় মাটি ফুঁড়ে ট্রেন বেরিয়ে এসে চাপা দেয় তাকে অকস্মাৎ । হাড় চূর্ণ হওয়ার নির্মম শব্দ শুনে পুলকিত হয়ে লুকিয়ে যেতে থাকে কোনো এক খেলোয়াড় ছোকরা । ওসমান গণি নিজেও পালিয়ে যেতে চায় সেই সময় থেকে, আমরাও পালাই একই সাথে । পালিয়ে পৌঁছাই বা ওসমান গণি পৌঁছায় কোনো এক কানা গলিতে, যেখানে ওসমান গণি প্রথম কবিতা শুনিয়েছিল জীবনানন্দের, এক ভাসমান দেহ-পসারণীকে ।
“সে যে মন্বন্তর, মৃত্যুর দূত, অপঘাত মহামারী-
মানুষ তবু সে তারচেয়ে বড়, সে যে নারী, সে যে নারী ।”
সমাজ থেকে তাদের অবশ্য নামকরণ করা হয়েছিল পতিতা হিসেবে । তরুণ ওসমান গণি অবশ্য তাতে বিশ্বাসী নয় বৈকি ।
অতঃপর মাইল-খানেক বাদে যখন একটু বসবার অবকাশ পাওয়া গ্যালো ওসমান গণি দ্যাখলো সে রয়েছে খোলা আকাশের নিচে, প্রায় মরা এক নদীর পাড়ে । ময়লার স্তূপের মাঝে জমানো বিষণ্নতা গলা চেপে ধরেছে নদীটির দুপাশ । এই নদীতীরে ওসমান গণি কিছু সময় এবং অনেকখানি বিষাদ অতিবাহিত করে । ওসমান বড্ড ভালবেসেছিল কিনা ঐ ‘পতিতা’কেই । দেশ-সমাজ পালটে দিয়ে ইন্টেলেকচুয়াল গার্বেজ ঝেড়ে বিনামূল্যে শান্তি চায় নারীটির হাতের বন্ধনে । ওসমান গণি হয়তো চাইছিলো শেকল ভাংতে অথবা কিছু দায়মুক্তি চাইতে অথবা এর কিছুই নয়, ওসমান গণি স্রেফ নিজের মত করে পার করেছিল জীবনটা, যেমনটা করছে এই মধ্যরাত্রিতে, ময়লার নদীর ধারে ।
নাহ, সে বড্ড ভালোবাসে সেই নাম না জানা মহিলাকে । তাই বিষাদ পেরোতে গিয়ে গলা শুকিয়ে যায় না তার, যেমনটা ঘটে কিছুক্ষণ পর আলেয়ার সিলিং হতে ঝুলতে থাকা লাশের দৃশ্য দেখে । বিস্মিত ওসমান গণির গলা কেমন যেন উশখুশ করে, ভেতরটা যেন সাহারা মরুভূমি হয়ে গ্যাছে নিমেষেই, এক মুহূর্তেই ঢক ঢক করে গিলে নিতে পারবে এখন পুরো প্রশান্ত মহাসাগর আর এই মরা নদীর সকল জল ।
দৃশ্যপটে আলেয়ার প্রত্যাবর্তনে আমরা কৌতূহলী হই । সিলিং হতে ঝুলতে থাকা আলেয়া যেন খুব উঁচুতে, এভারেস্টও মেয়েটিকে ছুঁতে পারেনি । আলেয়া আক্তার রয়েছে আকাশেরও উপরে হয়তোবা মহাশূন্যে । অত উঁচুতে থাকতে দেখেই হয়তো ওসমান চমকে উঠে, আতংকিত বোধ করে । অথবা সে ভয় পায় আলেয়ার ফুলে থাকা বেঢপ পেটের দিকে তাকিয়ে । আলেয়া এই পেট চিরে তার সন্তানকে ত্যাগ করতে চায়নি, বরং সে চেয়েছিল ওসমানকেই স্বামী হিসেবে পেতে । ওসমানের হয়তো তাতে মত ছিল না অথবা মত ছিল কিন্তু সে তার বাপকে ডরায় । হয়তো বাপের ডরেও না, ওসমান বিশ্বাস রাখতে পারে না তার নিজের উপরই, সে কি চায় আর কি চায় না সেই দ্বিধার পেন্ডুলামে ঝুলতে থেকে একসময় ছিটকে বেরিয়ে যায় অথবা একসময় গিয়েছিল ।
ওসমানের শ্বাসরোধ হয়ে আসে, সে একবার আর একবারের জন্য হলেও প্রাণভরে শ্বাস নিতে চায় । পুরো বায়ুমণ্ডল জায়গা হয়ে যাবে এই এক নিঃশ্বাসে । ওসমানের এই আই-টাই প্রাণ তখন ছোঁয়া পায় বৃষ্টির । তুমুল বৃষ্টির ফোঁটা বর্ষার মত আঘাত হানে ওসমান গণির সারা দেহে, আর ভরিয়ে দেয় তার হৃদপিণ্ড এক আদিম বিশ্বাসে । সে বিশ্বাসে ভর দিয়ে ওসমান যেন শূন্যে ভেসে যায় । বিচার অনুষ্ঠান শেষ হলো কিনা!
ওসমান গণি আজ তৃপ্ত,
ওসমান গণি আজ তৃপ্ত,
ওসমান গণি আজ তৃপ্ত...
নিখোঁজ সংবাদ পাওয়া যায় তার পরের দিনের পরের দিন অথবা আরো কয়েক কোটি বছর পরে...
“নগরের দ্বারে দ্বারে আমরা ফের নীত হবো
এপ্রিলের নিচে দীর্ঘকায় বৃষ্টি হেঁটে যায়,
চাবুকের নিচে দীর্ঘকায় বৃষ্টি ছোটে,
যেন নিজ পিঠে বেত্রাঘাত অনুষ্ঠান ।”
( গল্পের শুরুতে এবং শেষে ব্যবহৃত কবিতার লাইনগুলি ফরাসী কবি সাঁ-ঝঁ প্যার্স এর কবিতা থেকে নেওয়া । অনুবাদ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । )
২| ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:১৬
হাসান মাহবুব বলেছেন: চমৎকার।
©somewhere in net ltd.
১|
১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:১৪
করিম কাকা বলেছেন: সুন্দর হয়েছে।