নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বঙ্গভাষাপ্রেমী

হাসনাত ইবনে তারিক

সাংবাদিক, লেখক, সংস্কৃতিমনা

হাসনাত ইবনে তারিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

দিল্লিতে তুর্কি সালতানাতের ইতিহাস

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:৪৮

১২০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে দিল্লিতে সালতানাতের শাসন শুরু হয়। মামলূক শব্দের অর্থ দাস। মামলূক বংশ বলতে কোনো বিশেষ রাজবংশকে বোঝানো হয় না। বরং এ বংশের বেশিরভাগই কোনো না কোনো সময় দাস ছিলেন। আর সেকারণেই এ বংশের নাম দাস বংশ। তবে তাদের শাসনামলকে দাস বংশের শাসনামল বলা ভুল হবে। যদিও অনেকে ভুল করে মামলূক বংশ তথা দাস বংশ বলে থাকেন। তাদের এ শাসনব্যবস্থার আরেকটি নাম হলো মামলূক শাসকগোষ্ঠীর শাসনামল। কুতুবউদ্দিন আইবেক এ শাসকগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন। তিনি মুহম্মদ ঘুরীর ক্রীতদাস ছিলেন। গজনীর সুলতান মুহম্মদ ঘুরী তাঁকে দিল্লির শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। মুহম্মদ ঘুরীর মৃত্যুর পর কুতুবউদ্দিন আইবেক নিজেকে দিল্লির স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করেন। এ কে এম আবদুল আলীমের ‘ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাস’ গ্রন্থে তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি বিদ্যাবুদ্ধি, সমরকুশলতা ও দূরদর্শিতার দিক থেকে যেমন ছিলেন দিগ্বিজয়ী, তেমন ছিলেন মুহম্মদ ঘুরীর বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য অনুচর। এ গ্রন্থে আরও বলা হয়, মুহম্মদ ঘুরী নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার ফলে কুতুবউদ্দিন আইবেক নিজেকে দিল্লির স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন।

১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিলো তাঁর সালতানাতের সময়কাল। এ সময়কালের মধ্যে তিনি প্রধান সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির সাহায্যে বাংলার ক্ষমতা হাসিল করেন। এছাড়া মুলতান ও উচের শাসনকর্তা নাসিরউদ্দিন কুবাচা তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নেন। তবে ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতে কিরমান প্রদেশের শাসনকর্তা তাজউদ্দিন ইল্দিজ তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও পরবর্তীতে কুতুবউদ্দিনের সঙ্গে পেরে ওঠেন নি।
কুতুবউদ্দিনের শাসনামলের উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো কুতুবমিনার স্থাপনে পদক্ষেপ গ্রহণ। তিনি ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে মিনারটি নির্মাণের আদেশ দিলেও এ নির্মাণ শেষ করে যেতে পারেন নি। ১২১০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর আরাম শাহকে দিল্লির সুলতান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে আরাম শাহ ছিলেন অযোগ্য এবং বিলাসব্যাসনে মত্ত সুলতান। সুতরাং দিল্লির অভিজাতগণ তাঁর দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে শামসউদ্দিন ইলতুৎমিশকে আহবান করেন। দিল্লির কাছে জুদ প্রান্তরে ১২১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি আরাম শাহকে পরাজিত করে দিল্লির সুলতান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ যখন দিল্লির সুলতান হন তখন ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম চেঙ্গিশ খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল আক্রমণের শিকার হয়। এ ঘটনা ১২২১ খ্রিস্টাব্দের। তবে প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে না পেরে লুটতরাজের পরই তারা চলে যায়। এর কিছুদিনের মধ্যে সিন্ধুর নাসিরউদ্দিন কুবাচাকে পরাজিত করে সিন্ধুদেশ হস্তগত করেন তিনি। এসময় নাসিরউদ্দিন কুবাচা সিন্ধুনদ সাঁতরে পালাতে গিয়ে এ নদে ডুবেই জীবন বিসর্জন দেন।
শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো বাংলার ওপর দিল্লির প্রভুত্ব কায়েম। কেননা কুতুবউদ্দিন আইবেকের মৃত্যুর বাংলার খিলজি মালিকগণ দিল্লির আনুগত্য অস্বীকার করতে থাকেন এবং গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে থাকেন। ফলে এক সামরিক অভিযান পাঠানোর পর আলাউদ্দিন জানিকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এছাড়া ১২৩২ খ্রিস্টাব্দে গোয়ালিয়র এবং ১২৩৪ খ্রিস্টাব্দে মালব আক্রমণ করে ভিলসা ও উজ্জয়িনি অধিকার করেন। ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে তাঁর মেয়ে রাজিয়াকে দিল্লির সুলতান মনোনীত করে যান।

একজন নারী দিল্লির সুলতান হবেন এ বিষয়টি সহজে কেউ মেনে নিতে পারেন নি। খোদ অভিজাত মহলেই কানাঘুষা শুরু হয়। বিশেষ করে তাঁর প্রধানমন্ত্রী মুহম্মদ জুনাইদী সুলতান হিসেবে তাঁকে মেনে নিতে পারেন নি। তবে রাজিয়া তাঁর প্রধানমন্ত্রী মুহম্মদ জুনাইদীসহ অভিজাতদের দমন করতে সক্ষম হন। এসময় মিনহাজ-উস্-সিরাজের মতে, তিনি লক্ষণাবতী (লক্ষ্ণৌ) অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ হতে দেবল এবং দামিরিলাহ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেন। কিন্তু বিধিবাম! নূরউদ্দিন নামে জনৈক এক তুর্কির নেতৃত্বে কিরমিতাহ ও মুলাহিদাহ নামে দুটি মুসলিম সম্প্রদায় রাজিয়ার শাসনামলে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। অবশ্য তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হয়। তবে শান্তি তাঁর ভাগ্যে ছিলো না। জালালুদ্দিন ইয়াকুত নামে এক জনৈক অবিসিনীয় বা হাবশী অনুচরের প্রতি পক্ষপাতিত্ব তথা Biasness দেখালে অভিজাতরা সরহিন্দের শাসনকর্তা ইখতিয়ারউদ্দিন আলতুনিয়ার নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এসময় রাজিয়া এ সৈন্য নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে এগোলেও পরে তিনি পরাজিত হন এবং তাঁকে আটক করা হয়। এ যুদ্ধে জালালউদ্দিন ইয়াকুত নিহত হন। এসময় ইলতুৎমিশের আরেক ছেলে মুইযউদ্দিন বাহরামকে সুলতান বলে ঘোষণা করা হয়। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রাজিয়া আলতুনিয়াকে বিয়ে করতে স্বীকৃত হন। তবে সুফল মিললো না। বাহরামের সৈন্যদের হস্তেই তারা উভয়ে পরাজিত হন। এসময় তাঁদের নিজ নিজ সৈন্যরাও তাঁদের পরিত্যাগ করে। ফলস্বরূপ ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে রাজিয়া এবং স্বামী আলতুনিয়া এক হিন্দু আততায়ীর হস্তে নিহত হন।
ইলতুৎমিশের পরবর্তী সুলতানগণের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে বন্দে-চাহেল-ই-গান তথা চল্লিশ আমীরের দল শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এরাই ছিলেন সম্ভ্রান্ত ও প্রতাপশালী। সুলতানা রাজিয়ার পর মুইযউদ্দিন বাহরাম ও আলাউদ্দিন মাসুদ দিল্লির সুলতান হলেও তাঁদের পরে সুলতান হন নাসিরউদ্দিন মাহমুদ। বস্তুত তিনি ছিলেন নামেমাত্র সুলতান। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি। ধর্মকর্মের কাজে নিয়োজিত থাকায় তাঁর প্রধানমন্ত্রী গিয়াসউদ্দিন বলবনই রাজকার্য পরিচালনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর গিয়াসউদ্দিন বলবনই দিল্লির সুলতান পদে আসীন হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের মধ্যে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত এবং তাঁর দুই ছেলে তাঁদের স্বীয় সৈন্যবাহিনী নিয়ে মোঙ্গলদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করা অন্যতম। এছাড়া মোঙ্গলদের আক্রমন প্রতিহত করার সুযোগ নিয়ে বাংলার শাসনকর্তা তুঘরিল খান দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতি আনুগত্য অস্বীকার করেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এসময় গিয়াসউদ্দিন বলবন বাংলায় পর পর তিনটি অভিযান পাঠালে সবগুলো অভিযান ব্যর্থ হয়। এসময় তাঁর ছোট ছেলে বুগরা খানের নেতৃত্বে চতুর্থ অভিযান পাঠানো হয়। এর ফলে তুঘরিল খান ভীত হয়ে রাজধানী ত্যাগ করে জাজনগরের অরণ্যাঞ্চলে পালিয়ে যান। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে আটক করে হত্যা করা হয়। এরপর বুগরা খানকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। বাংলা সমস্যার রেশ কাটতে না কাটতেই ১২৮৫ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলরা পাঞ্জাব আক্রমণ করলে তাঁর বড় ছেলে মুলতানের শাসনকর্তা মুহম্মদ তাদের প্রতিরোধে লাহোর ও দিপালপুর অবিমুখে অগ্রসর হন। তবে এতে মুহম্মদ লড়াই করতে করতে প্রাণ হারান। বড় ছেলে মুহম্মদের মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন বলবন মারা যান। তিনি বুগরা খানকে উত্তরাধিকার মনোনীত করতে চাইলেও বুগরা খান অস্বীকার করায় তাঁর পৌত্র মুহম্মদের পুত্র কাইখুসরুকে উত্তরাধিকার দিতে বাধ্য হন।
১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে কায়কোবাদকে সুলতান হিসেবে মেনে নেন অভিজাতরা। বাংলার শাসনকর্তা বুগরা খান ভ্রাতুষ্পুত্রের সুলতানীর বিরোধিতা করলেন না। তবে আঠারো বছর বয়স্ক এ যুবক শাসনকার্যে ছিলেন সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। ফলস্বরূপ ক্ষমতালোভী নিজামউদ্দিন এর সুযোগ নিলেন। তিনি দেশে অত্যাচার, অবিচার বৃদ্ধি করে দিলেন যাতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর স্থল থেকে সুলতান হতে পারেন। ফলে অভ্যন্তরীন শাসন ব্যাহত হতে থাকে। এসময় বুগরা খান তার ছেলের অকর্মণ্যতায় অতিষ্ঠ হয়ে এবং নিজামউদ্দিনের ঔদ্ধত্য দমন করার জন্য দিল্লির সসৈন্যে অগ্রসর হন। অবস্থাদৃষ্টে পরিস্থিতি ক্রমশ যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠলো। ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যার সরযূ নদীর তীরে যুদ্ধের পরিবর্তে বুগরা খান ও কায়কোবাদের মধ্যে মিলন হলো। তখন বুগরা খান কায়কোবাদকে সদুপদেশ দিয়ে বাংলায় চলে গেলেন। কায়কোবাদ এসময় নিজামউদ্দিনের ব্যাপারে কঠিন উদ্যোগ নিলেন। তাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হলো। কায়কোবাদ এসময় খলজি মালিক জালালউদ্দিন ফিরোজকে সৈন্যাধ্যক্ষ করে বরন প্রদেশের সামন্ত হিসেবে নিয়োগ করেন।
তবে এর মধ্য দিয়ে বিরুদ্ধ শক্তির উত্থান হয়। কেননা খলজি মালিকদের সঙ্গে তুর্কি অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিরোধ ছিলো। ১২৮৯ খ্রিস্টাব্দে বাতরোগে পঙ্গু কায়কোবাদের শিশু পুত্র শামসুদ্দিন কাইয়ুমকে দিল্লির সুলতান হিসেবে অধিষ্ঠান করা হয়। অভিজাতবর্গের অন্তর্দ্বন্দ্ব ষড়যন্ত্রের সুযোগ বুঝে বরন প্রদেশের শাসনকর্তা জালালউদ্দিন ফিরোজ দিল্লি নগরী দখল করেন এবং গোপনে কায়কোবাদকে হত্যা করেন এবং নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন। ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্বয়ং সুলতান পদে আসীন হন। এভাবে মামলূক সুলতান তথা তুর্কি বংশোদ্ভুত সুলতানদের প্রাথমিক আমলের শাসনের অবসান হয়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.