নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বঙ্গভাষাপ্রেমী

হাসনাত ইবনে তারিক

সাংবাদিক, লেখক, সংস্কৃতিমনা

হাসনাত ইবনে তারিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রশ্নবিদ্ধ চুক্তিতে হবে না উত্তেজনা প্রশমন

২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:১২

শুক্রবার থেকে তালেবান-যুক্তরাষ্ট্র-আফগান সরকার সমর্থক বাহিনীর মধ্যে এক সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেন, যুদ্ধবিরতি সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে আগামী শনিবার তালেবান ও আফগান সরকার সমর্থকদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করা হবে। কিন্তু আদৌ কি তা সম্ভব ? দীর্ঘ আঠারো বছর ধরে এ যুদ্ধ চলাকালীন বারবার তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে আর বারবার সে প্রতিশ্রুতি ভেঙে সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, আফগানিস্তানের ইতিহাস দেখলে এ কথা বোঝা যায়, আফগানিস্তানে তালেবানের উদ্ভব হয় ১৯৯৪ সালে। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবেলার জন্য তালেবান ও আল কায়েদাকে সৃষ্টি করে যুক্তরাষ্ট্র। ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উসকানি ও বিভেদ সৃষ্টি করতে তৎপর হয় তারা। বিশেষ করে পশ্চিমা মদদপুষ্ট হয়ে তারা শক্তি আরও সঞ্চয় করতে থাকে। ১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানে সাউর বিপ্লবের মাধ্যমে সামরিক অভ্যুত্থান করে ক্ষমতায় গ্রহণ করে নূর মুহম্মদ তারকীর পিডিপিএ। নূর মুহম্মদ তারকী ছিলেন কমিউনিস্ট প্রভাবিত। পিডিপিএ এর ক্ষমতা লাভের পর পরই আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দিতে থাকে। কিন্তু ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর হঠাৎ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যরা আফগানিস্তানে ঢুকে পড়ে। তখন মস্কো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলো, তারা ছয় মাস থাকবে। কিন্তু তারা দশ বছর ধরে আফগানিস্তানে অবস্থান করে। এ যুদ্ধে সুন্নি মুজাহিদিনদের মধ্যে ছিলো জমিয়ত-ই-ইসলাম, শুরা-ই-নজর, মক্তব আল খিদমাত, হিজাব-ই-ইসলামি খালিস, ইত্তেহাদ-ই-ইসলামি, হারাকাত-ই-ইনকিলাব-ইসলামি, এনএলএফ, মাহাজ-ই-মিল্লি ইসলামি আফগানিস্তান। আর শিয়া মুজাহিদিনদের মধ্যে ছিলো হারাকাত-ই-ইসলামি আফগানিস্তান, আফগান হিজবুল্লাহ, আল নাসর, কোর অব ইসলামিক রেভোলিউশন গার্ডিয়ানস অব আফগানিস্তান, শুরা-ই-ইঞ্জিলাব-ই-ইত্তিফাক-ই-আফগানিস্তান, ইসলামিক রেভলিউশন মুভমেন্ট, ইউনিয়ন অব ইসলামিক ফাইটার্স, রাদ পার্টি। সুন্নি মুজাহিদিন গোষ্ঠীকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, সৌদি আরব, চীন, যুক্তরাজ্য, মিশর, লিবিয়া, তুরস্ক, ইসরায়েল, পশ্চিম জার্মানি ও ফ্রান্স। আর শিয়া মুজাহিদিন গোষ্ঠীকে সমর্থন করে ইরান। আফগানিস্তান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিলো তাদের প্রতিপক্ষ। তাদেরকে সমর্থন করে ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, কিউবা, ভারত, পূর্ব জার্মানি, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড। এ যুদ্ধে আফগানিস্তানের ছয় থেকে বিশ লাখ বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে ৩৪ টি মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আফগানিস্তান থেকে ‘সোভিয়েত সৈন্যদের তাৎক্ষণিক, জরুরি ও নিঃশর্ত অপসারণের’ প্রস্তাব পাস করেন। এদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১০৪-১৮ ভোটে আফগানিস্তানের সোভিয়েত সৈন্য মোতায়েনের প্রতিবাদ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর ফলে আফগান মুজাহিদরা পাকিস্তান ও চীনে প্রশিক্ষণ লাভ করে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলগুলো থেকে আর্থিক সহায়তা লাভ করে।
একদিকে যেমন সোভিয়েত সৈন্যরা আফগানিস্তানের যোগাযোগ কেন্দ্রগুলো এবং বড় বড় শহরগুলো দখল করে নেয়, অন্যদিকে তেমনই আফগান মুজাহিদরা আফগানিস্তানের ৮০ শতাংশ ভূমি আফগান সরকার ও সোভিয়েতদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিলো সেখানে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গেরিলা যুদ্ধ আরম্ভ করে।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সোভিয়েত সৈন্য সংখ্যা বাড়ানো হয় এবং তা এক লাখ আট হাজারে উন্নীত হয়। এ সময় সংঘর্ষ ব্যাপক রূপ ধারণ করে। কিন্তু এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে। ফলে ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। এরপর ধীরে ধীরে সৈন্য প্রত্যাহার করতে থাকে তারা এবং এ প্রত্যাহার শুরু ১৯৮৮ সালের ১৫ মে। ১৯৮৯ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্তভাবে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। দীর্ঘ সময় ধরে এ যুদ্ধ চলতে থাকায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ যুদ্ধ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিয়েতনাম যুদ্ধ অথবা ভল্লুকের ফাঁদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ যুদ্ধের ফলাফল ছিলো মুজাহিদদের বিজয়, ১৯৮৮ সালের জেনেভা চুক্তি এবং সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার। তবে এ যুদ্ধের ফলে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের বীজ রোপিত হয়। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত প্রথম গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার করা হলেও আফগানিস্তানে সোভিয়েত সমর্থিত সরকার তাদের সাফল্যের জন্য ক্ষমতায় টিকে থাকতে সমর্থ হয়। কারণ এ সময় জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা, হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার সম্ভব না হলেও মুজাহিদদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। ফলে ক্ষমতাসীন হয় মুহম্মদ নাজিবুল্লাহর পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তান। বিশেষ করে ১৯৮৯ সালের জালালাবাদের যুদ্ধে সাফল্যের কারণে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। কিন্তু আফগান সরকারের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, শীর্ষ নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতা, আফগান সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী কর্মকর্তা আব্দুল রশিদ রোস্তামের দলত্যাগ এবং রুশ সরকার কর্তৃক জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে ১৯৯২ সালের ২৪ এপ্রিল আফগানিস্তান প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটে এবং পেশওয়ার চুক্তির মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র সৃষ্টি হয়। এ যুদ্ধে মুজাহিদদের পক্ষাবলম্বন করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, পাকিস্তান ও সৌদি আরব। আর আফগানিস্তান প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়া।

তবে যুদ্ধ আফগানিস্তানের পিছু ছাড়েনি। ১৯৯২ সালে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় নাম হয় দাওলাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান অর্থাৎ ইসলামি প্রজাতন্ত্র তৈরি হয়। এর মধ্যে ১৯৯৪ সালে তালেবান নামে একটি ইসলামি উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। এসময় বুরহানউদ্দিন রব্বানি ক্ষমতাসীন ছিলো। কিন্তু ১৯৯৬ সালে তালেবান আফগানিস্তানের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নেয়ার পর আফগানিস্তানে ইসলামি আমিরাত গঠন করে তারা। এসময় কঠোরভাবে ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়ন করা হতো। বিশেষ করে পুরুষদের দাড়ি না রাখা আর নারীদের পর্দা না করার ব্যাপারে তারা ছিলো কঠোর। কেউ এর ব্যতিক্রম করলে তারা ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী শাস্তি দিতো। যিনা-ব্যাভিচারের শাস্তি হিসেবে শরিয়াহভিত্তিক শাস্তি তারা নিশ্চিত করে।

এর মধ্যে ঘটে যায় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ক্যালিফোর্নিয়ার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ভয়াবহ হামলা। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করতে থাকে, এ হামলা আল কায়েদাই করেছে। এ সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও চাউর হয় এ কথা। কিন্তু আল কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন এর দায় অস্বীকার করেন।

এ সময় তিনি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, এ ঘটনা আল কায়েদা না ঘটালেও আল কায়েদা এতে ভীষণ খুশি। এদিকে আফগানিস্তানে তালেবানি শাসনের নিন্দা করতে থাকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আফগানিস্তানে অবরোধ আরোপ করে এবং হামিদ কারজাইকে ক্ষমতায় বসান। সেসময় থেকেই আফগানিস্তানের যুদ্ধ চলছে। চলতি বছর শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানের শান্তি আলোচনা শুরু হয় এবং তখন থেকেই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। বলা হয়, শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে আগামী শনিবার ২৯ ফেব্রুয়ারি তালেবানের সঙ্গে চুক্তি করবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তালেবান এই প্রবন্ধটি লেখার কয়েক ঘণ্টা আগেও আফগান সরকারি বাহিনীর ওপর যে হামলা চালিয়েছে তাতে এ চুক্তি না হওয়ার আশঙ্কা বোধ করছি। কেননা এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বরে তালেবানের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে এক যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য নিহতের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনাকে ‘মৃত’ অভিহিত করে আলোচনা বন্ধ করে দিলেও নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব কমন্সের স্পীকার ও ডেমোক্র্যাট নেতা ন্যান্সি পেলোসি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত জালমায় খলিলজাদ পাকিস্তানে এক আকস্মিক সফরে তালেবানের সঙ্গে শান্তি অলোচনা করেন। কিন্তু ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে আবার তালেবান সহিংসতা সৃষ্টি করলে তা বন্ধ হয়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ফলে ২৯ ফেব্রুয়ারি চুক্তি যদি হয়ও, তাহলেও তা হবে প্রশ্নবিদ্ধ এক চুক্তি।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.