নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বোকা মানুষের কথায় কিই বা আসে যায়

বোকা মানুষ বলতে চায়

আমি একজন বোকা মানব, সবাই বলে আমার মাথায় কোন ঘিলু নাই। আমি কিছু বলতে নিলেই সবাই থামিয়ে দিয়ে বলে, এই গাধা চুপ কর! তাই আমি ব্লগের সাহায্যে কিছু বলতে চাই। সামু পরিবারে আমার রোল নাম্বারঃ ১৩৩৩৮১

বোকা মানুষ বলতে চায় › বিস্তারিত পোস্টঃ

রন্তু\'র কালো আকাশ (অখণ্ড)

২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৫৪



রন্তু'র কালো আকাশ (সকল পর্ব) PDF File (in mediafire)

রন্তু'র কালো আকাশ (পিডিএফ লিঙ্ক) এখানে

ধরনঃ উপন্যাস
শিরোনামঃ রন্তু'র কালো আকাশ
রচনাকালঃ জুন, ২০১৪ - অক্টোবর, ২০১৫
প্রকাশঃ সামহোয়্যার ইন ব্লগ

মুখবন্ধঃ
অনেক আগে একটা ছোট গল্প লিখেছিলাম, মনে পড়ে রুবি রায়, সেখানে ব্লগার মশিকুর ভাই কমেন্টে একটা কথা বলেছিলেন, 'আপনার ভেতর লেখক আছে ভাই'। সেই ছোট্ট একটা কথা মনের মাঝে দাগ কেটে গিয়েছিল। সেই থেকে মাঝে মাঝে চেষ্টা (চেষ্টা না বলে অপচেষ্টা বলা উচিত) করি গল্প লেখার, সবই ছোট গল্প। "রন্তু'র কালো আকাশ" নামে একটি এক পর্বের ছোট গল্প। গল্পটি লেখার পর মনে হল, এই গল্পটা'কে উপন্যাসে রূপ দেয়া যায়। সেই ভাবনা থেকে বছর খানেক আগে এই রন্তু সিরিজ শুরু করি কোন একটা বড় কিছু লেখার আশায়। শুরু থেকে সহ ব্লগারদের উৎসাহ আমায় প্রেরণা দিয়ে গেছে এই গল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। গত মাসে সিরিজের শেষ পর্ব পোস্ট করার পর থেকে অনেকের অনুরোধ ছিল, সকল পর্ব একসাথে পোস্ট করার। আর তাই আজকের এই রিপোস্ট, সকল পর্ব একসাথে, অখণ্ড। রন্তু সিরিজের সাথে যারা থেকেছেন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা; হাসান মাহবুব, ডি মুন, স্বপ্নবাজ অভি, এহসান সাবির, স্নিগ্ধ শোভন, আলম দীপ্র, ঢাকাবাসী, মুনতাসির নাসিফ (দ্যা অ্যানোনিমাস), সুমন কর, লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, সচেতনহ্যাপী, কলমের কালি শেষ, সোহানী, জাফরুল মবীন, শ্রেষ্ঠা, মনিরা সুলতানা, দিশেহারা রাজপুত্র, জুন, কামরুন নাহার বীথি, প্রামানিক, কম্পমান, দৃষ্টিসীমানা, কাবিল, বিদ্রোহী ভৃগু, সুফিয়া, শামছুল ইসলাম সহ সকল পাঠক যারা রন্তুকে ভালবেসেছেন, রন্তুর সাথে থেকেছেন। অনেকে নিয়মিত পড়ে গেছেন, কিন্তু কমেন্ট করে জানান দেন নাই, সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। যারা আগের পর্বগুলো পড়েন নাই, হাতে সময় থাকলে পড়ে নিতে পারেন এখান থেকে। যারা পুরো সিরিজটা আবার ঝালিয়ে নিতে চান, তারাও পড়তে পারেন।


১.
রন্তু বারবার জানাল দিয়ে বাহিরের খোলা মাঠের দিকে তাকাচ্ছে, তার দৃষ্টি মাঠের শেষ প্রান্তের যে নারিকেল-সুপারির গাছের সারি তার উপরে ঐ আকাশের দিকে। না কোন সুতো কাটা ঘুড়ির দিকে নয়, সে বারবার আকাশের কালো মেঘের দিকে তাকাচ্ছে। আজো কি বৃষ্টি হবে, আকাশ জুড়ে কালো মেঘের আনাগোনা এখন জটলা পাকিয়ে ঘন হয়েছে। আজো কি বাবা আসবে না! বাবা! লোকটাকে বাবা বলে ডাকতে কেমন সংকোচ হয়ে। কেমন যেন খুব চেনা কিন্তু বড় অচেনা মনে হয় তাকে। টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি মনের আনাচে কানাচেতে উঁকি দিয়ে যায়, কিন্তু সেই স্মৃতিগুলো জোড়া দিয়ে একটা গল্প হয় না। শুধু কিছু আবছা আবছা স্মৃতি।

হঠাৎ পাশের জনের খোঁচায় রন্তু সম্বিৎ ফিরে পেল যেন, ছেলেটার দিকে তাকালো সে। ছেলেটি ইশারায় সম্মুখে ম্যাডামের দিকে তার দৃষ্টি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। নাসরিন ম্যাডাম কড়া চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন, কতক্ষণ তাকে ডেকেছেন আল্লাহ্‌ই জানেন। রন্তু ভয় পেল, নাসরিন ম্যাডাম খুবই ভালো একজন টিচার, ক্লাসের প্রতিটি বাচ্চাকে খুবই স্নেহ করেন। রন্তুকে কেন জানি ম্যাডাম খুব বেশী আদর করেন, সেই নাসরিন ম্যাডাম কেমন রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। রন্তু শুনলো ম্যাডাম তাকে কি যেন বললেন। সে ভয়ে কখন কেঁদে দিয়েছে নিজেও টের পায় নাই। শার্টের হাতায় চোখ মুছতেই ম্যাডামের গলার আওয়াজ তার কানে এল,

‘এই রন্তু কাঁদছিস কেন?’
‘না ম্যাডাম কাঁদছি না তো’
‘তাহলে চোখ মুছছিস কেন?’ বলে ম্যাডাম রন্তুর দিকে এগিয়ে এলেন
‘কি হয়েছে রন্তু? জানালা দিয়ে বাইরে কি দেখছিলি?’
‘আ...কা...শ...’
‘আকাশ! তুই আবার আকাশ দেখা শুরু করলি কবে থেকে?’ বলে নাসরিন ম্যাডাম জানাল দিয়ে বাইরের পানে চেয়ে দেখলেন আকাশে প্রচুর মেঘ জমেছে, ঝুম বৃষ্টি হতে পারে। দ্রুত বাচ্চাদের ছেড়ে দেয়া দরকার, তার ক্লাসই শেষ পিরিয়ড; তাই তিনি ছেড়ে দিলেই বাচ্চাদের ছুটি।

‘কিরে আকাশ দেখে কান্না করতে হয়?’ রন্তু মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো।
‘বাবা আসবে আজ?’ বলে নাসরিন ম্যাডাম মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন রন্তুর।
রন্তুর চোখে এবার যেন জলের বাণ ডাকলো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ম্যাডাম তাকে বসিয়ে ডেস্কে গিয়ে বাচ্চাদের আগামী দিনের হোম টাস্ক দিয়ে ছুটি দিয়ে দিলেন। আর ক্লাস হতে বের হবার সময় রন্তুকে গিয়ে বললেন,
‘তোর বাবাকে আমার সাথে দেখা করতে বলবি। ঠিক আছে? এবারো ভুলে যাস না যেন...’। রন্তু ঘাড় নেড়ে সম্মতিসূচক জবাব দিল।
‘আর হ্যাঁ, কথায় কথায় এতো কাঁদিস কেন? ছেলে মানুষদের এত কাঁদতে হয় না বোকা ছেলে, বুঝলি?’। এবারো রন্তু ঘাড় নেড়ে সম্মতিসূচক জবাব দিল। রন্তু নিজেও কাঁদতে চায় না, কিন্তু কোথা থেকে জানি শুধু কান্নারা চোখে চলে আসে।

আসলে রন্তুর ঠিকই মনে ছিল, গতবার বাবা যখন এল, সে ইচ্ছা করেই বলে নাই। তার লজ্জা করে, স্কুলের প্রতিটি টিচার, প্রতিটি ছেলে মেয়ে তার সমস্যার কথা জেনে গেছে। জেনে গেছে যে তার বাবা-মা আলাদা হয়ে গেছেন। সবাই কেমন দৃষ্টিতে যেন তার দিকে তাকায়, ম্যাডামরা কেমন যেন একটু বেশী বেশী আদর করেন এখন তাকে। রন্তুর খুব লজ্জা লাগে, খুব। সবাই কেমন করে যেন তাকায়, আর সেই তাকানো দেখলেই তার কান্না পায়। রন্তু তার বেঞ্চে বসে রইল, ক্লাসের সব ছেলে মেয়ে বের হয়ে গেলে পরে সে বের হলো। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল স্কুলের মাঠ পেরিয়ে মূল ফটকের দিকে। মূল ফটক দিয়ে বের হয়ে সেই প্রতি দিনকার ঘুঘনিওয়ালা, আমসত্ত-আচার বিক্রেতা, মালাই আইসক্রিমওয়ালা বুড়ো চাচা আর চানাচুররর... বলে চেচাতে থাকা সেই চানাচুর মামা। সবার সামনেই ছেলেমেয়েদের ভীড়। সাথে রয়েছে বাচ্চাদের নিতে আসা বাবা-মা’দের ভীড়। এত্ত এত্ত ভীড় ঠেলে তার দু’চোখ তার বাবাকে খুঁজতে লাগলো।

রন্তু এখন ক্লাস টু’তে পড়ে। সে যখন স্কুলে ভর্তি হল, তার কিছুদিন পর থেকে সে তার মা’র সাথে নানাবাড়ী’তে থাকতে লাগলো। প্রথমে রন্তু ভেবেছিল তারা বেড়াতে এসেছে, কিন্তু কয়েকদিন পর যখন সে মাকে জিজ্ঞাসা করলো তারা বাড়ী কবে যাবে? মা তাকে ঠাস করে একটা চড় মেরে বলেছিল, ‘এটা কি বাড়ী না? এটা কি বস্তি? বদ ছেলে কোথাকার?’। রন্তু চড় খেয়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, সে তখন কিছুই বুঝতে পারে নাই মা তাকে কেন চড় মারলো। ধীরে ধীরে রন্তু বুঝতে পেরেছে তারা আর তাদের বাসায় ফিরে যাবে না। বাবা-মা’র ঝগড়া হয়েছে, কিন্তু কেন তা রন্তু জানে না। সেই তখন থেকে রন্তু নানাবাড়ী’তেই আছে।

এই ক্লাস টু’তে উঠার পর থেকে হঠাৎ করেই বাবা মাসে দুয়েকবার রন্তু দেখতে স্কুল ছুটির পর স্কুল গেটে আসতে লাগলো। নানু তাকে একদিন ডেকে বলল, ‘শোন তোমার বাবা স্কুল গেটে আসবে আজ, তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে। সে তোমাকে বাসায় দিয়ে যাবে’। সেই থেকে মাসে একবার কি দু’বার বাবা তার সাথে দেখা করতে আসে। বাবা আসলে রন্তুর কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হয়, সে চুপচাপ থাকে। বাবা কেমন গম্ভীর হয়ে তাকে প্রশ্ন করতে থাকে, পড়ালেখা করে কি না, দুষ্টুমি করে কি না, মা তাকে মারে কি না... আরও কত হাবিজাবি প্রশ্ন। রন্তু মিনমিন করে সে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায়।

বাবাকে দেখলে রন্তুর কেমন অস্বস্তি শুরু হয়, বাবা তার হাত ধরে যখন হাঁটতে থাকেন রাস্তা ধরে তার খুব ভালো লাগে তখন। সবচেয়ে মজা হয় বাবা যখন বড় রাস্তার খাবার হোটেলে নিয়ে গিয়ে তাকে পরাটা-মিষ্টি-দই খেতে দেয়। পরাটা তার খুবই পছন্দের খাবার, কিন্তু বাবার সামনে সেগুলো নিয়ে সে বসে থাকে। নাড়াচাড়া করে কিছুক্ষণ, কিন্তু মুখে দেয় না। বাবা তখন খুব রাগী রাগী মুখে ধমকে উঠেন, তারপর নিজ হাতে তার মুখে সেগুলো তুলে দেন। রন্তুর লজ্জা করে এত্ত মানুষের মাঝে এভাবে খেতে আবার কেমন এক ভালো লাগাও কাজ করে।

ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, রন্তু কি করবে ভেবে না পেয়ে দৌড়ানো শুরু করলো বড় রাস্তাটার দিকে। প্রায় আধঘণ্টা হবে রন্তু স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে ছিল, সারাক্ষণ তার খুদে চোখদুটি ছলছল দৃষ্টি নিয়ে বাবা নামের মানুষটিকে ইতিউতি খুঁজেছে। কিন্তু বাবা আজ আসেনি, গত মাসেও বৃষ্টির কারণে বাবা আসে নাই। পরপর দুমাস হল বাবা এলো না। রন্তু দৌড়ে বড় রাস্তায় এসে সেই খাবার হোটেলে ঢুকে পড়ল। প্রতিটি টেবিলে চোখ ঘুরিয়ে কোথাও বাবাকে না পেয়ে তার খুব কান্না পেল। চোখে হতে গড়িয়ে পড়া জল শার্টের ভেজা হাতায় মুছতে লাগলো। হোটেলে গেটে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মাঝ হতে একজন বলল,
‘এই খোকা কাঁদছো কেন?’

‘কই? কাঁদছিনাতো...’ বলে রন্তু সেই মানব জটলা ঠেলে রাস্তায় নেমে এল। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা রন্তুকে ভিজিয়ে দিতে লাগলো। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা রন্তুর ছোট ছোট অশ্রুকে গ্রাস করে নিতে লাগলো তার বিশাল জলাধারে। রন্তু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কেন? সে নিজেও জানে না। এতো কান্না নয়, এ হল রন্তুর কালো আকাশ হতে ঝরে পরা বৃষ্টিকনা। রন্তুর জীবনের কালো আকাশে যে অনেক মেঘ জমেছে এই ছোট্ট সময়েই।


২.
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো খুব তীক্ষ্ণ আজ, রন্তুর শরীরে সূচের ন্যায় বিঁধছে। একটু শীত শীত অনুভূতি, কিন্তু রন্তুর সেদিকে খেয়াল নেই। কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে কেঁদে এখন অনেকটা শান্ত সে। সামনে বৃষ্টির ঘোলাটে পর্দা ভেদ করে কোন সুদূর পাণে তার দৃষ্টি তা বোধগম্য নয়। একটানা বৃষ্টিতে সে ভিজে ভিজে হেঁটে চলেছে। হঠাৎ করে রাস্তার জমে থাকা পানির নীচের কোন এক খানাখন্দে হোঁচট খেয়ে সে পড়ে গেল এবং তখন বুঝি তার সম্বিৎ ফিরে এল। হঠাৎই তার খেয়াল হল তার ব্যাগের বইখাতা সব ভিজে একাকার। হায় হায় কি হবে এখন! ভাবতেই তার আবার কান্না পেতে লাগলো।

রন্তু খেয়াল করলো সে বাড়ীর রাস্তা ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে এসেছে, সে আবার উল্টা পথে হাঁটা শুরু করলো। রন্তু নানু বাসায় আসার পর প্রথম কয়েকদিন মা অথবা নানু তাকে স্কুলে আনা নেওয়া করেছে। এরপর একটা বুয়া ঠিক করা হল, কিন্তু প্রথম দিনই ঘটনা ঘটলো। বুয়া রন্তুকে স্কুল থেকে আনতে দেরী করলো, আর রন্তু নিজে নিজে বাসায় চলে আসলো। মা আর নানু তাকে সেই কি বকাটাই না দিল! কিন্তু লাভ হল একটাই, রন্তুকে স্কুল থেকে আনা নেওয়া করার জন্য আর কাউকে কষ্ট করতে হল না। সে প্রতিদিন একা একা বাসা থেকে স্কুল যাওয়া আসা করতে লাগলো। যদিও প্রথম দিকে নানু আর মা তাকে রোজ সাবধান করে দিত, কারো সাথে রাস্তায় কোন কথা না বলতে অথবা কেউ কিছু দিলে যেন সে না খায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন কেউ আর এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। রন্তু নিয়ম করে রোজ স্কুলে যায়, আসে।

বাসার দরজায় রন্তু খুব হালকা করে কড়া নারে, কলিং বেল পর্যন্ত তার হাত যায় না। অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর গেট খুলল নানু, রন্তুকে দেখেই তিনি হা হা করে উঠলেন।
‘এই ছেলে তুই এই বৃষ্টিতে ভিজে এসেছিস কেন? তোর বাবা কই...?’ বলে নানু দরজার বাইরে কাউকে খুজলেন। কাউকে সেখানে খুঁজে না পেয়ে তিনি আবার রন্তুর দিকে দৃষ্টি দিলেন।
‘কিরে তোর বাবা আজ আসে নাই?’
রন্তু মাথা নিচু করে ঘাড় নেড়ে জানালো যে, বাবা আজ আসে নাই।
‘আমি এই জন্যই শায়লাকে বলি, ছেলেকে তার বাবা কেন মায়া দেখাতে স্কুলে আসবে। নিকম্মাটার যদি এতই ছেলের জন্য মায়া লাগে তো নিয়ে যা না তোর কাছে বাবা... সেই মুরোদতো নেই...’ নানু গজগজ করতে করতে ভেতরে চলে গেলেন।

রন্তুর এসব কথা শুনতে মোটেও ভালো লাগে না। নানু কেন জানি বাবাকে দুচোখে একদমই দেখতে পারে না, বাবার নাম শুনলেই কেমন রেগে যায়। বাবা সম্পর্কে খুব বাজে বাজে কথা বলতে থাকে। রন্তুর কেন জানি বাবার জন্য খুব মায়া লাগে। কেন? সে নিজেও জানে না। বাবাকে ঘিরে তার তেমন জমাট স্মৃতি নেই, কিন্তু তারপরও বাবার জন্য তার খুব মায়া লাগে।
হঠাৎ করেই নানুর গলার স্বরে রন্তু সজাগ হয়।

‘এই যে রাজপুত্র, নবাবজাদা... ব্যাগটা খুলে দেন। বইপত্রতো সব ভিজিয়ে ছারখার করে নিয়ে এসেছেন। এগুলো শুঁকোতে দেই, আর আপনি গিয়ে ভেজা জামা কাপড় পাল্টে দ্রুত গোসল করে আসেন। এইবার যদি জ্বর আসে... রন্তু... তোকে ঐ বড় রাস্তার পাশে মসজিদের গেটে শুইয়ে দিয়ে আসবো...’
নানুর কথা শুনে রন্তু ফিক করে হেসে দিল। নানু রেগে গেলে উল্টাপাল্টা কিসব যে বলে, শুনলেই রন্তুর খুব হাসি পায়।
‘এই বাঁদর কোথাকার, হাসছিস কেন? কি বললাম কথা কানে যায় না? হায় খোদা শায়লা নিজেও পুড়লো, আমাকেও পোড়ালো...’ বলে নানু গজগজ করতে করতে আবার ভেতরে চলে গেল।

রন্তু পায়ে পায়ে গোসলখানার দিকে গেল। জামা কাপড় খুলে কল ছেড়ে দিতেই বালতিতে জল পড়তে লাগলো, কেমন গরম মনে হচ্ছে কল হতে বের হওয়া জল জলগুলোকে। রন্তু খেয়াল করেছে বৃষ্টিতে ভেজার পর গোসলখানার জল কেমন গরম লাগে, কি আশ্চর্য! অন্যসময় কিন্তু এমন হয় না, কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজার পরপরই কেন যেন এমন লাগে। রন্তু দ্রুত গায়ে ঝপাঝপ পানি ঢালতে লাগলো। দরজায় নানুর আওয়াজ পেয়ে রন্তু ঘুরে তাকালো। নানু তার জন্য শুকনো জামা কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে। রন্তুর সাথে কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে, এখানে সাবান দাও, তো সেখানে ভালো মত পানি দাও... উফ! নানুর যন্ত্রণা ভালো লাগে না।

গোসল শেষ করে শুকনো জামা গায়ে দিয়ে রন্তু খেতে বসলো। মা’কে কোথাও দেখা গেল না। রন্তু খুব ভয়ে ভয়ে ছিল, মা তাকে না আজ মেরেই ফেলে। গত সপ্তাহে সে স্কুলের হোমওয়ার্ক করে নাই, ম্যাডাম ডায়েরিতে তা লিখে রিপোর্ট করে দিয়েছিল গার্ডিয়ানের সিগনেচার এর জন্য। রন্তু মা’কে সেই ডায়েরি দেখাতেই মা কেন জানি খুব ক্ষেপে উঠলো। রন্তুকে আচ্ছা মত চড় মারতে লাগলো, এমন মার রন্তু তার জীবনে কখনো আগে খায় নাই। মা একসময় রন্তুরকে মাটিতে ফেলে তার উপর বসে তাকে মারতে লাগলো। মায়ের নখের আঁচড় লেগে রন্তুর বাঁ চোখের নীচের দিকে ছড়ে গিয়ে রক্ত বেড়িয়ে গিয়েছিল। নানু এসে মা’কে না থামালে মা বোধহয় তাকে মেরেই ফেলতো। রন্তু দ্রুত খাওয়া শেষ করে বিছানায় চলে আসলো। তার কেমন যেন ঘুম পাচ্ছে।

ঘর অন্ধকার, কেমন যেন কালো একটা জগৎ। রন্তু’র ঘুম ভেঙ্গেছে এই কিছুক্ষণ আগে। প্রথমে সে কিছুতেই চোখ খুলতে পারছিল না, অনেক কষ্টে চোখ খুলল। পুরো ঘর অন্ধকার, এখন কয়টা বাজে? রন্তু ঠাওর করার চেষ্টা করল। সে স্কুল থেকে ফিরেছে দুপুর বারোটা নাগাদ। গোসল খাওয়া শেষে সে যখন বিছানায় গেল তখন দুপুরের আজান দিচ্ছে। ওমা! সে নিজে অবাক হল, কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে? এখন কি রাত হয়ে গেছে? সবাই কি ঘুমিয়ে পড়লো নাকি? রন্তু’র খুব শীত করছে। তার গায়ে কে যেন একটা পাতলা কাঁথা দিয়ে গেছে, মা অথবা নানু হয়তো। তারপরও রন্তুর খুব শীত শীত করছে। মা’র কথা মনে হতেই রন্তুর খুব ভয় হতে লাগলো। আজ সে স্কুল থেকে ফেরার সময় সব বইপত্র ভিজিয়ে ফেলেছে। গত মাসে অংক বইটা হারিয়ে ফেলায় মা তাকে কত বকাঝকা দিল, আর আজতো সে সব বইপত্র ভিজিয়ে ফেলছে। আজ আর তার রক্ষা নেই, ভাবতেই রন্তুর খুব কান্না পেল।

কান্না ভেজা চোখ মুছতেই তীব্র আলো চোখে লাগলো, চোখে আলোটুকু সয়ে আসতেই রন্তু দেখতে পেল তার মা এই ঘরে এসেছে। ভয়ে ভয়ে রন্তু মা’র মুখের দিকে তাকালো। মা রন্তুর পাশে বিছানায় বসে তার কপালে হাত রাখলো।
‘রন্তু সোনা, খুব জ্বর এসেছে যে? বৃষ্টিতে কেন ভিজলে?’ মা’কে খুব শান্ত এবং মিষ্টি দেখাচ্ছে। রন্তু কোন কথা বলল না।
‘আজো বাবা আসে নাই’ শায়লা’র কথায় রন্তু ঘাড় নেড়ে জানালো যে না আসে নাই।
‘রন্তু সোনা, বাবাকে তোমার খুব ভালো লাগে?’
‘জানি না...’
‘জানি না মানে কি? তোর বাবা, তোর তাকে ভালো লাগে কি না সেটা তুই জানবি নাতো কে জানবে? আমি?’
মায়ের কথা শুনে রন্তু ফিচ করে হেসে দিল।
‘এই যে জ্বর বাঁধালি, এখন যদি নানু তোকে সত্যি সত্যি মসজিদের গেটে দিয়ে আসে? তো কেমন হবে?’ মা কেমন দুষ্টুমি মাখা স্বরে বলল।
‘জানি না...’
রন্তুর উত্তর শুনে শায়লা একটু হেসে উঠলো।
‘কিরে তোর সব উত্তর কি আজকে ‘জানি না’ দিয়েই হবে?’
‘মা পাখাটা বন্ধ করে দাও না... শীত করে...’
‘ওমা, পাখাতো বন্ধই। দেখি জ্বর বোধহয় আরো বেড়েছে... দেখি জলপট্টি নিয়ে আসি...’ বলে শায়লা উঠে যেতে নিতেই রন্তু তার ছোট্ট হাত দুটি দিয়ে তাকে টেনে ধরলো।
‘মা... ওমা...’
‘আবার কি হল?’ শায়লা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রন্তুর দিকে তাকালো।
‘আমি আর বৃষ্টিতে ভিজবো না, সত্যি... এইযে তোমায় ছুঁয়ে বললাম’
‘হুম বুঝলাম...’
‘মা আমার বইগুলো না সব ভিজে গেছে, তুমি আমাকে মেরো না। আমি আর বইখাতা নষ্ট করবো না’ বলেই রন্তু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

শায়লা ছেলের পাশে বসলো। রন্তু এখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শায়লা রন্তুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। জানালা দিয়ে দূরে ঐ আকাশে একটুকরো চাঁদ মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু আকাশে প্রচুর মেঘ থাকায় চাঁদ বারবার হারিয়ে যাচ্ছে মেঘেদের আড়ালে। শায়লার কাছে তার ছেলে রন্তু ঐ চাঁদের মত দামী। ঠিক হল কি ভাবনাটা? শায়লা নিজেকেই প্রশ্ন করে। ঐ চাঁদের জীবনে অমাবস্যা আছে, কলঙ্ক আছে। রন্তুর জীবনে সেগুলো আসুক শায়লা তা চায় না। কিন্তু না চাইতেও ঐ কালো মেঘের দল যেমন চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে, তেমনি রন্তুর জীবনেও না জানি কতশত কালো মেঘের দল ধেয়ে আসছে। ভাবতেই দুফোঁটা অশ্রুজল শায়লার চোখ হতে আবার ঘুমিয়ে পড়া রন্তুর গায়ে গিয়ে পড়ল।


৩.
শায়লাদের এই বাড়িটা একতলা। শায়লার বাবা সরকারী কেরানী ছিলেন, তাই পৈত্রিক এই ভিটায় তিনি কোন দালান তুলতে পারনে নাই। একতলা এই পুরানো আমলের বাড়ী’র মাঝখানে উঠান রেখে চারিদকে ঘরগুলো তৈরি হয়েছিল। উঠোনে এখনো একটা নারিকেল গাছ আছে, যা শায়লার দাদী নিজ হাতে লাগিয়েছিল। মোট চারটে ঘর চারদিকে রেখে মাঝখানে উঠোন। পূবপাশের ঘরটা শায়লার, বিয়ের আগে শায়লা এই ঘরটাতেই থাকতো। জাভেদের সাথে বিয়ের পর থেকে ঘরটা ফাঁকাই ছিল, শায়লার বড় ভাই ভাড়া দিতে চেয়েছিল কিন্তু মা দেয় নাই। শায়লার বিয়ের মাস ছয়েক আগেই তার বাবা মারা গেলেন। শায়লা কলেজে যাওয়া আসার পথে জাভেদের সাথে দেখা হত, জাভেদ কলেজের রাস্তায় বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিত। সেই থেকে কখন কীভাবে পরিচয়, পরিণয় এবং দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে। সব আজ কেমন ঝাপসা লাগে শায়লার কাছে।

রন্তু এখনো বেঘোরে ঘুমুচ্ছে, কাল রাতে জ্বর আরও বেড়েছিল, সারারাত মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিয়ে পার করেছে। ছেলেটা যে কার মত হল আল্লাহ্‌ই মালুম। শায়লা বা জাভেদ কারো সাথেই ছেলের স্বভাব চরিত্র মিল খায় না। জাভেদের কথা মনে পড়তেই শায়লার মুখ ইস্পাত কঠিন হয়ে ওঠে। জাভেদ একটা মানুষ নয়, মানুষ নামের হিংস্র পশু সে শায়লার কাছে। বিয়ের আগে কতশত ভালোবাসার গান...! বিয়ের পর একে একে বের হয়ে আসলো তার আসল রূপ। অল্পতেই রেগে যাওয়া আর রাগলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে শায়লার গায়ে হাত তোলা... এ ছিল নিত্যকার ব্যাপার। মজার ব্যাপার ছিল, রাগ কমে আসলে জাভেদের হাস্যকর আচরণগুলো। কতশত পাগলামি যে করতো, কানে ধরা, নিজেকে নিজে চড় মারা আরও কত কি। প্রথম প্রথম শায়লা খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলো ব্যাপারগুলোকে। অনেকের খুব রাগ থাকে, রাগ কমলে আনুশোচনা হয়; জাভেদকেও শায়লা তেমনই ভেবেছিল। কিন্তু দিন দিন অবস্থা খারাপের দিকে যেতে লাগলো, জাভেদের মধ্যে নতুন রোগ দেখা দিল সন্দেহ বাতিকগ্রস্থতা। অবস্থা এতটাই খারাপের দিকে গেল যে, একরাতে জাভেদ কুকুর-বেড়ালের মত পেটালো শায়লাকে, তুচ্ছ এক সন্দেহের কারণে। অমানুষিক প্রহারে শায়লা অচেতন হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ চেতনা ফিরতে দেখে ঘর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। জাভেদ নিজে নিজের হাত থেতলে দিয়েছে। শায়লা দৌড়ে কাছে যেতেই তাকে হাসি মুখে বলল, ‘শায়লা দ্যাখো, এই হাত...এই হাত তোমার গায়ে তুলেছি আমি! তাই এই হাতকে শাস্তি দিলাম...’। এই বলে কেমন অপ্রকৃতস্থ মানুষের ন্যায় হাসতে লাগলো।

সেদিন সকালের আলো ফুটতেই শায়লা রন্তুকে নিয়ে মায়ের বাসায় চলে আসে। জাভেদ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে তাকে বুঝিয়ে ফেরত নিয়ে যেতে, কিন্তু শায়লা রাজী হয় নাই। সেই রাতে জাভেদের চোখে যে পশুর চাহনি দেখেছে সে, সেই চাহনিকে শায়লার বড্ড ভয়। বছর খানেকের মাথায় মিউচুয়ালি ডিভোর্স হয়েছে তাদের, জাভেদ কোনরকম ঝামেলা করেনি। মাঝে মাঝে স্কুলের গেটে এসে রন্তুকে দেখে যায়, কখনো-সখনো বাসার গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যায়।

শায়লা দ্রুত নিজের ব্যাগ গুছিয়ে রন্তুকে এক নজর দেখে নিয়ে বাসা হতে বের হল, গত আট মাস হল সে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে পারসোনাল এসিস্টেণ্ট এর চাকুরী করছে। কলেজের গণ্ডি না পেরুতেই বিয়ে, একাডেমীক কোয়ালিফিকেশন না থাকায় এর চেয়ে ভালো কিছু সে আশাও করে নাই। এই যবটাও পেয়েছে তার এক কাজিনের বাবার অফিসে, ঐ আঙ্কেলেরই পিএ হিসেবে। শায়লাদের বাসাটা একটু গলির ভেতরের দিকে, বড় রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে রিকশা নিতে হয়। আজ লেট হয়ে গেছে, শায়লা দ্রুত পা চালাল।
রন্তু’র ঘুম ভাঙ্গলো বেলা দশটার পরে, এখন তেমন জ্বর নেই, কিন্তু কাশছে সমানে। ঘড়ির কাটা দশটা পেরুনো দেখে রন্তু চিৎকার করে নানুকে ডাকতে লাগলো। রন্তুর নানু ছিলেন রান্না ঘরে, দৌড়ে আসলেন...
‘এই ছাগল কোথাকার, এত চেঁচাচ্ছিস কেন?’
‘এখন কয়টা বাজে তুমি দেখনি? আমার যে স্কুল মিস হয়ে গেল...’
‘হয়েছে আমার স্কুলওয়ালা, এতোই যখন স্কুলের চিন্তা তখন বৃষ্টিতে ভেজার সময় মনে ছিল না? জ্বর বাঁধিয়ে উনি এখন স্কুলগিরি ফলাচ্ছেন’
রন্তুর মনে পরে গেল কাল বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সে বাসায় ফিরেছে এবং জ্বর এসে হানা দিয়েছে তার শরীরে।
‘নবাবজাদা এখন কি জ্বর আছে?’ বলে নানু এগিয়ে এসে কপালে হাত দিলেন।
‘হুম, খুব অল্প। নে, এখন বিছানা থেকে ওঠ। দাঁত ব্রাশ করে হাত মুখ ধুয়ে আয়’

রন্তু বিছানা থেকে নামলো।

‘আর শোন নাস্তায় দুধ পাউরুটি... কোন ঘ্যানর ঘ্যানর করবি না খবরদার, নাইলে পিটিয়ে তক্তা করে দিবো।’
দুধ পাউরুটির কথা শুনেই রন্তুর গা গুলিয়ে উঠলো। ইয়াক, এসব মানুষ খায়? উহ... নানুকে নিয়ে আর পারা গেল না। রন্তুর জ্বর হলেই
তাকে এই বিচ্ছিরি খাবারটা খেতে দেয়, ধুর ভাল্লাগে না। রন্তু বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো।

ফ্রেশ হয়ে নাস্তা শেষ করার পর রন্তুর হাতে কোন কিছু করার ছিল না, শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগে না। এখনো হালকা হালকা শীত লাগছে, কিন্তু কেমন আরামও লাগছে। একবার ভাবলো ড্রইং খাতাটা নিয়ে বসে, কিন্তু মন টানলো না। সে চলে এলো ছাদের উপরে চিলেকোঠার ঘরে, ছোট মামার ডেরায়। শায়লারা দুই ভাই এক বোন। বড় ভাইয়ের পর শায়লা, আর শায়লার বছর পাঁচেকের ছোট আরেক ভাই। রন্তুর ছোট মামা শিবলি, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পরে, রন্তুর খুব পছন্দের মানুষ ছোট মামা। ছোট মামার ঘরে ঢুকে দেখে মামা দুই বন্ধুকে নিয়ে দাবা খেলায় মশগুল। গুটি গুটি পায়ে মামার ঘরে ঢুকলো রন্তু।
‘আরে রন্তু সাহেব যে, কি খবর? জ্বর সাহেব কি আছেন না গেছেন?’
রন্তুর ছোট মামাটা না খুব মজার, রন্তুকে সব সময় সাহেব বলে ডাকেন। মামার বন্ধুগুলোও তাকে রন্তু সাহেব বলেই ডাকে।
‘গেছেন...’ বলেই রন্তু একটা হাসি দিল।
‘তো, ভালই চালাকি শিখেছিস তাই না? জ্বর বাঁধিয়ে স্কুল কামাই...’
‘মোটেও না, আমি স্কুল কামাই দিতে চাই নাই। মা-নানু কেউ আমাকে ঘুম থেকে ডেকে দেয় নাই।’
‘আহালে... আর তুই যে কাল বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধালি’

রন্তু কোন উত্তর দিল না, সে একমনে মামাদের দাবা খেলা দেখতে লাগলো। কিছুদিন হল রন্তু ছোট মামার কাছ থেকে দাবা খেলা শিখেছে। মামা যখন একা থাকে, দুপুরের পরটায় বিকেলের শুরুর বেলা, তখন মাঝে মাঝে রন্তুকে নিয়ে দাবা খেলা শেখায়। রন্তু সবসময় তিন চালে মামার কাছে হেরে যায়। মামাটা না খুব পচা, প্রতিবার তাকে তিন চালে হারিয়ে দেয় শুধু। তবে মামার দোষ না, মামা প্রতিবার তাকে শেখায় কোন ঘুটি প্রথমে চাললে কখনো কেউ তিন চালে হেরে যায় না। কিন্তু রন্তু প্রতিবারই ভুলে যায় আর তিন চালে হেরে যায়।

মামার এক বন্ধু হঠাৎ বলল, ‘রন্তু সাহেব, কাল তোমার বাবাকে দেখলাম সকাল বেলা, বৃষ্টিতে এক দোকানে দাঁড়িয়ে’। বাবার কথা উঠতেই রন্তুর মনটা খারাপ হয়ে গেল, বাবার উপর খুব অভিমান হল। রন্তু যদি ভিজে ভিজে বাসায় ফিরতে পারে, বাবা কি ভিজে ভিজেই রন্তুর সাথে দেখা করতে আসতে পারলো না। রন্তু ছোট মামার ঘর থেকে ছাদে চলে এলো। সকালের রৌদ্রজ্জ্বল আকাশ, কিছু ধবধবে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। কোন এক বাসা হতে কেউ লাল রঙের একটা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। ঘুড়িটাকে দেখে রন্তুর মনে হল, সে যদি ঐ ঘুড়িটার মত উড়ে উড়ে ঐ সুদূর আকাশে হারিয়ে যেতে পারতো। অনেক দূরে, কোথায় তা রন্তুর জানা নেই।


৪.
আজ বেশ কয়েকদিন পর স্কুলে এসেছে রন্তু। দু’দিন জ্বরে ভুগেছে, এরপর মাঝে ছিল বৃহস্পতিবার, নানু বলল স্কুলে আজ আর যাওয়ার দরকার নেই, একেবারে সামনে রবিবার থেকে যেয়ো। টানা পাঁচদিন! পাঁচদিন স্কুল আসে নাই রন্তু, আর তাতেই তার কেমন কেমন যেন লাগছে। একটু কেমন যেন, ছোট্ট মাথায় সেই কেমন কেমনটা ধরা দেয় না। এখন টিফিন টাইম, ছেলে-মেয়েরা সব স্কুলের মাঠে ধুলো উড়িয়ে খেলছে। রন্তু মাঠের উত্তর পাশটাতে যে ছাতিম গাছটা আছে, তার তলায় বসে আছে। ইদানীং তার খেলতে মন চায় না, টিফিনের এই সময়টায় এই ছাতিম গাছের নীচে বসে থাকতে তার ভালো লাগে। বসে বসে রন্তু অনেক কিছুই ভাবে। এই যেমন ভাবছে কীভাবে ছোট মামাকে দাবা খেলায় হারানো যায়, পারলে তিন চালে। এরকম একেকদিন একেক ভাবনা আসে মনে। মাঝে মাঝে রন্তু ভাবে তার বাবা-মা আবার মিলেমিশে গেছেন, আর তাদের মধ্যে রাগ নেই, আড়ি নেই। যেমন তোতোনের সাথে এখন আর তার আড়ি নেই, মিল হয়ে গেছে। তোতোনের সাথে কি ঝগড়াটাই না হয়েছিলো রন্তুর!

টিফিনে রন্তু তেমন কিছুই একটা খায় না, ভোর বেলা নানু ঘুম থেকে উঠে তার জন্য নাশতা রেডি করে দেয়। অবশ্য শুধু তার জন্যই না, মা আর ছোট মামা’র জন্যও রেডি করে। এত্ত সকালবেলা এত্তগুলো খাবার খেতে মোটেও ভালো লাগে না রন্তু’র। নানুটা মহা দুষ্টু, জোর করে তাকে রোজ একগাদা খাবার খাইয়ে দিবে। আর তাই রন্তু স্কুলে টিফিন নিয়ে আসে না, যদিও নানু এক্ষেত্রেও জোরাজুরি করে অনেক। মাঝে মাঝে রন্তু’র আম্মু তাকে পাঁচ টাকা কি দশ টাকা দিয়ে দেয়, কিন্তু রোজ না। বেশীরভাগ দিনই রন্তু টাকাগুলো খরচ করে না, রেখে দেয় তার পুরোনো জ্যামিতি বক্সটার ভেতর। মাঝে মাঝে আমসত্ত্ব আর মালাই কুলফি খায়, এই দুটো খুব ভালো লাগে রন্তুর। ঘণ্টা বাজছে, টিফিন পিরিয়ড শেষ, সবাই ক্লাসের দিকে ছুটছে। পুরো মাঠ জুড়ে যেন ধুলোর তুফান।

ক্লাসে আসতেই রন্তু দেখল সবাই বই নিয়ে পড়ায় খুব ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে, ঘটনা কি? আজও! আবার! উফ... রন্তুকে বিমর্ষ দেখালো। এখন মারজিনা ম্যামের ক্লাস, উনি জেনারেল নলেজ ক্লাস নেন, সপ্তাহে দুইদিন, বৃহস্পতিবার আর রবিবার। প্রায় সপ্তাহেই তিনি হঠাৎ কুইজ নেন, আগের দিন বলে দেন না যে নেক্সট ক্লাসে কুইজ হবে। রন্তু গত বৃহস্পতিবার স্কুলে আসে নাই, তাই সে জানে না গত ক্লাসে কুইজ হয়েছল। আর জানলেই বা কি? ম্যাম কোথা থেকে যে উদ্ভট উদ্ভট সব প্রশ্ন করেন, কেউ বুঝে উঠতে পারে না। পুরো সাধারণ জ্ঞান বই পড়ে শেষ করে ফেললেও কোন লাভ হয় নাই, ম্যাম এই আচমকা টেস্টে যেসব প্রশ্ন করেন, সেগুলো ঐ বইগুলোয় খুঁজে পাওয়া যায় না। আর মজার ব্যাপার হল, ম্যাম পরে বোর্ডে সেইসব প্রশ্ন এবং উত্তর লিখে দেন। সেগুলো স্টুডেন্টদের তুলে নিতে হয় খাতায় এবং নেক্সট ক্লাসে সেগুলো তিনি পড়া ধরেন। আজ যেমন ধরবেন!

রন্তু চুপচাপ তার সিটে গিয়ে বসে রইল, পাশ থেকে তোতোন কয়েকবার তাকে ওর খাতা থেকে পড়তে বলল, কিন্তু রন্তুর মন চাইছে না। এইসব ছাইপাশ পড়তে ভালো লাগে না তার, আর এগুলো থেকে একটাও ফাইনাল এক্সামে আসবে না। আসবে সেই সাধারণ জ্ঞান বই থেকেই। একটু পর মারজিনা ম্যাম ক্লাসে এলেন, উনি সবসময়ই একটু দেরী করে ক্লাসে আসেন। ক্লাসে ঢুকেই তিনি বললেন, ‘এই যে লিটল লিটল বিচ্ছুরা, পড়া শিখে এসেছো?’ সবাই সমস্বরে উত্তরে জানালো হ্যাঁ। রন্তু বোকার মত ঘাড় নেড়ে না জানালো এবং মারজিনা ম্যামের তা চোখ এড়াতে পারলো না।
‘কি ব্যাপার রন্তু, ঘাড় নাড়ছো কেন?’
‘ম্যাম আমি গতদিন আসি নাই, তাই পড়া পড়ে আসি নাই।’
‘আচ্ছা তাই নাকি? ইয়েস, ইয়েস... গতদিন তোমাকে দেখি নাই। তো কোথায় গিয়েছিলে? মামা বাসা বেড়াতে? নাকি খালা বাসা?’ ম্যাম হেসে উঠলেন।
‘ম্যাম...জ্বর...জ্বর এসেছিলো...’
‘ও আচ্ছা! গুড গুড... ভালো বাহানা স্কুল কামাই দেবার। এখন বলো ইথুপিয়ার রাজধানীর নাম কি?’
‘ম্যাম জানিনা...’
‘না জানলেতো হবে না... যা ক্লাসের বাইরে গিয়ে নীল ডাউন হয়ে বসে থাক’

রন্তু মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইলো, সে মরে গেলেও এমনটা করতে পারবে না। বাইরে নীল ডাউন হওয়া মানে পুরো স্কুলের ছেলে মেয়েদের দেখা।

‘কিরে? কথা শুনিস না?’... মারজিনা ম্যাম কাছে এসে উনার ভয়াবহ শাস্তিটি দিলেন। দুই আঙ্গুলের মাঝখানে কাঠ পেন্সিল রেখে জোরে আচমকা চাপ দিলেন। মট করে একটা শব্দ রন্তুর চিৎকারের শব্দে ঢাকা পরে গেলো। ম্যাম রন্তুকে ছেড়ে দিয়ে অন্যদের দিকে মনোযোগ দিলেন। রন্তু তার আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে দেখে ফুলে টোল হয়ে আছে জায়গাটা, কেমন নীল হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ব্যাথা হচ্ছে, ব্যাথায় রন্তুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।

রন্তু ব্যাথা নিয়ে কোনমত ক্লাস শেষ করল, ক্লাশ শেষ হতেই ওয়াশরুমে গিয়ে অনেকক্ষন পানি দিল ফুলে ওঠা আঙ্গুলটায়। পরের দুইটা ক্লাস কোনমতে পার করলো, একটুও মন বসাতে পারে নাই ক্লাসে। ম্যাথ রন্তুর খুবই প্রিয় সাবজেক্ট, সেই ম্যাথ ক্লাসেই সে মনোযোগ দিতে পারলো না। আজ ছিল জ্যামিতির ক্লাস, আঁকাঝোঁকার সাথে গনিত, রন্তুর খুব ভালো লাগে। কিন্তু আজ সেই জ্যামিতি ক্লাসেও রন্তুর মন বসে নাই। স্যারের কোন কথাই যেন মাথায় ঢুকছিলো না। ছুটির ঘণ্টা পড়তে রন্তু যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

আজ অনেকক্ষণ রন্তু একা একা ক্লাসে বসে রইল। সব ছেলে মেয়ে বের হয়ে গিয়ে যখন প্রায় মাঠ ফাঁকা, তখন সে মেইন গেটের দিকে পা বাড়াল। হাতে খুব ব্যাথা হচ্ছে, মারজিনা ম্যামটা এমনই, কিচ্ছু বুঝতে চায় না। তার জ্বর ছিল শুনেও বিশ্বাস করলো না, তাকে শাস্তি দিয়ে দিল। স্কুল এক্সামে কিন্তু জেনারেল নলেজে রন্তুই হাইয়েস্ট মার্কস পায়। রন্তু হঠাৎ আকাশে ঘুড়ি দেখল, নীল-সাদা ডোরাকাটা ঘুড়ি। ঘুড়ি দেখলেই রন্তুর খুব ভালো লাগে, মনে হয় সে যদি ঘুড়ি হতে পারতো! তবে ঐ ঘুড়ির মত নীলাকাশে উড়ে উড়ে সুদূরে হারিয়ে যেত।

স্কুল গেট দিয়ে বের হতেই রন্তু খুব অবাক হল। রাস্তার অপর পাশে রন্তুর বাবা জাভেদ দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে দেখে রন্তু যারপরনাই খুশী হল, কিন্তু সাথে সাথে প্রচণ্ড অভিমানও হল। এতদিনে সময় হল বাবার, সেই দুই মাস আগে এসেছিলো, আর আজ এলো। রন্তুকে বাবার বুঝি আর মনে পরে না! অভিমান করে রন্তু বাবাকে না দেখার ভান করে সোজা হাটতে লাগলো।

জাভেদ কিন্তু রাস্তার অপর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছেলের কাণ্ড দেখছিল। ছেলেকে হাঁটা আরম্ভ করতে দেখে দৌড়ে গিয়ে ছেলের হাত ধরতেই রন্তু ‘উফ’ করে উঠলো। সেই আঙ্গুলটায় জাভেদের হাতের চাপ পড়েছিল।
‘কি হল রন্তু, এমন করছো কেন?’
‘কৈ, কিছু হয়নিতো। তুমি কবে এলে?’
‘আমি কবে এলাম? তুমি কিন্তু গেট থেকে বের হয়েই আমাকে দেখেছো...’
‘নাহতো...!’ রন্তু কপট অভিনয় করলো।
‘আমার সাথে মিথ্যে কথা বলবে না রন্তু। আমি মিথ্যে কথা একদম পছন্দ করি না’

রন্তু কিছু বলল না। মনে মনে বলল, তুমি যে দুই মাস এলে না? তোমার জন্য গতদিন ভিজে ভিজে বাসায় গেলাম, তিনদিন জ্বরে ভুগেছি... তুমি খুব খারাপ বাবা, তুমি খুব খারাপ।

‘কি হল রন্তু? কথা বলছ না কেন? আমার রাগ উঠাবে না কিন্তু...”
কথাটা বলেই জাভেদ থেমে গেল। রন্তু কেমন হিংস্র চোখে তার দিকে তাকালো মনে হল? নাহ, এ হয়তো তার দেখার ভুল। ঐতো রন্তু, মাথা নিচু করে হাঁটছে তার সাথে সাথে, এখনো রন্তুর কচি সরু হাতটি তার হাতে ধরা। দীর্ঘ দুই মাস পর ছেলেকে দেখছে, শায়লাকে দেখেনা কত দিন? জাভেদের রাগ! তার রাগ তাকে শেষ করে দিল। স্ত্রী, ছেলে, সংসার... সব। সব তছনছ হয়ে আজ এক যন্ত্রণার জীবন সে ভোগ করছে। তার এই যন্ত্রণা কি কেউ বুঝবে? কেউ বুঝবে না। অথচ তারই সন্তান, রন্তু কি সুন্দর, শান্ত, চুপচাপ প্রকৃতির হয়েছে। জাভেদ ছেলের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে পিচ ঢালা পথ ধরে কোন অজানায়? এতো কাছে থেকেও সে আজ রন্তুর কত দূরে।


৫.
জাভেদ যে মেস বাড়িটায় থাকে তা মোটামুটি ভালোই বলা চলে, গতমাসে সে এখানে উঠেছে। এটাকে মেস বাড়ী বলা উচিত নয়, বাড়ী বলতে ঠিক যেমনটা বুঝায়, এটা ঠিক তেমনটা নয়। রুবেল নামের চাটগাঁও এর এক ছেলে ঢাকায় বদলী হয়ে এসেছে, প্রাইভেট ব্যাংকের চাকুরী, উঁচু পদে মোটা অংকের সেলারি। তাই বাধ্য হয়ে ঢাকায় আসতে হয়েছে। গুলশান-১ এ তার অফিস বলে, মহাখালী ওয়্যারলেস গেটের কাছের তিন রুমের এই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে, তার একজন পার্টনার দরকার ছিল, টাকার সমস্যা না, সমস্যা ভদ্রলোক খালি বাসায় একা থাকতে ভয় পান। জাভেদের স্কুল ফ্রেন্ড মনিরও রুবেলের সাথে ঐ ব্যাংকে চাকুরী করে, তবে একটু নীচের পোষ্টে। যাই হোক, সেই সুত্র ধরে জাভেদের এই ফ্ল্যাটে ওঠা।

আগের কোন মেস বাড়ীতেই তার এডজাস্ট হচ্ছিল না, এক জায়গায় এক বোর্ডারের সাথে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে। মনির বলে, তার নাকি ধৈর্য কম এবং উগ্র মেজাজ আর রাগ; শায়লাও বলতো। কি জানি? জাভেদের মনে হয় কেউ আসলে তাকে বুঝতে পারে না, বোঝার চেষ্টা করে না। সে যে জিনিশগুলো অপছন্দ করে, তার চারিপাশের মানুষগুলো সবসময় সেই কাজগুলোই বেশী করে করবে। আর জাভেদ তাতে রিঅ্যাক্ট করলেই সে খারাপ হয়ে যায়, সত্যি আজব এই পৃথিবী!

আর এই এডজাস্ট করতে না পাড়ার জন্য আজ সে একা, সম্পূর্ণ একা, মুক্ত, পিছুটানহীন এক মানুষ, সুখী মানুষ। সুখী! সুখী কি তাকে বলা যায়? অথবা পিছুটানহীন? জাভেদ নিজেই মাঝে মাঝে নিজেকে বুঝতে পারে না। মাঝ রাতে যখন ঘুম ভেঙ্গে অবুঝ শিশুর মত সে ডুকরে কেঁদে উঠে, কেন? কোন অজানা কষ্টে। আগের মেসের রুমমেট একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে জাভেদকে কাঁদতে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতে বলেছিল দুঃস্বপ্ন দেখেছি। পিছুটান কি সে নিজে এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে না? নইলে কেন ছুটে যায় রন্তুর স্কুলে? সত্যি মাঝে মাঝে নিজের কাছেই নিজেকে বড় অচেনা লাগে জাভেদের।

এই মধ্য দুপুরে জাভেদের কিছু করার নেই। জাভেদ টুকটাক ব্যাবসা করতো আগে, বিয়ের আগে দিয়ে ভালোই জমে উঠেছিল ব্যাবসা। সব গুছিয়ে নিয়ে বিয়ে করেছিল শায়লাকে। কিন্তু বিয়ের পর থেকে কোন কিছু আর ভালো হতে লাগলো না। একটু আধটু মনোমালিন্য ধীরে ধীরে বাক-বিতন্ডতায় রূপ নিলো। রন্তু জন্মের পর কিছুদিন ভালোই চলছিল, এরপর কথায় কথায় ঝগড়া শুরু হল জাভেদ আর শায়লা’র মাঝে। জাভেদ মানসিকভাবে সারাক্ষণ ভীষণ অস্থিরতার মধ্যে কাটাতে লাগলো, ব্যাবসা গেল খারাপের দিকে। শায়লা তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর গ্রামের বাড়ীর সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিল, ব্যাবসা গুটিয়ে নিল। সব কিছুর সাথে গুটিয়ে নিল নিজেকেও। ব্যাংকে কিছু টাকা জমানো আছে তা দিয়ে এখন চলছে জীবন। একে কি চলা বলে? এতো জীবনকে বয়ে চলা।

জাভেদের চোখ গেল ফোনটার দিকে, রন্তুকে একটা ফোন করলে কেমন হয়? এতক্ষণে নিশ্চয়ই স্কুল থেকে ফিরে নাওয়া খাওয়া শেষ করে ফেলেছে ছেলেটা। জাভেদ ডায়াল ঘুরালো, ওপাশে রিং হচ্ছে।
‘হ্যালো?’ ফোন ধরেছে শায়লার মা। জাভেদ কোন শব্দ করলো না।
‘হ্যালো? এই কে? কথা বলছো না কেন?’
‘আমি জাভেদ...’
‘তুমি ফোন করেছো কেন?’ ওপাশ থেকে রাগী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
‘একটু রন্তুর সাথে কথা বলতাম...’
‘দেখো, তোমাকে আগেও বলেছি, এখনো বলছি। রন্তুর প্রতি তোমার এই আলগা আদর দেখানো বন্ধ কর। ছেলেকেতো নিজের কাছে নিয়ে রাখার মুরোদ নেই, তবে এই আদিখ্যেতা কেন?’
‘না...মানে...’
‘রাখো তোমার মানে। আর তোমার কাছে এই ছেলে থাকলে সেও তোমার মত পাগলই হবে। শোন আজকের পর আর কখনো তুমি ফোন করবে না। আর স্কুলে গিয়ে ছেলের সাথে দেখা করার নামে দয়া করে রন্তুর মাথায় তোমার পাগলামির বীজ ঢোকানো বন্ধ কর...’ বলেই ভদ্রমহিলা খট করে ফোন রেখে দিলেন।

জাভেদ ঘরের লাগোয়া এক চিলতে বারান্দাটায় এসে দাঁড়ালো, চোখ জ্বালা করছে। প্রচণ্ড ক্রোধে মাথার রগগুলি দপদপ করছে। লোহার গ্রিলে প্রচণ্ড আক্রোশে ঘুষি বসিয়ে দিয়ে একদলা থুথু বাইরের রাস্তার দিকে ছুড়ে ফেলল। এই বিশাল পৃথিবীতে এতো নিঃসঙ্গতা কেন? কেন কেউ কেউ তার মত এতো একলা, এতো অসহায়। কেন জীবনের গল্পগুলো ছিঁড়ে যাওয়া বইয়ের পাতার মত এতো বেশী এলোমেলো হয়ে গেল।


৬.
প্রশ্নগুলো দেখে রন্তুর খুব হাসি পাচ্ছে, আজ থেকে স্কুল ফাইনাল শুরু হয়েছে। পরীক্ষা দিতে রন্তুর খুব ভালো লাগে, প্রিপারেশন যেমনই থাকুক না কেন, পরীক্ষা দেয়া তার কাছে একটা মজার খেলা। যে খেলায় হার-জিত আছে, পাশ করলে জিতে গেল আর ফেল হলে হার। আর প্রিপারেসশন ছাড়া পরীক্ষায়তো আরও বেশী মজা। কিন্তু রন্তুর খুব ভালোই প্রিপারেশন আছে, নানু আর মা’য়ের যন্ত্রণায় ভালো প্রিপারেশন না নিয়ে উপায় আছে? সারাক্ষণ শুধু পড় আর পড়। রন্তু ঘণ্টাখানেক পড়লেই যেখানে তার সব পড়া হয়ে যায়, সেখানে মা-নানু তাকে রোজ ঘড়ি ধরে রাতের বেলা ঘণ্টা তিনেক বইয়ের সামনে জোর করে বসিয়ে রাখে। রন্তু আর কি করবে? ভালো ছেলের মত বইয়ের সামনে বসে থেকে ভাবনার জগতে যায় হারিয়ে, যেমনটা রোজ টিফিন টাইমে স্কুল মাঠের ছাতিম গাছটার নীচে বসে ভাবনার জগতে হারায়।

আজ গনিত পরীক্ষা, প্রথমদিনই গনিত। অন্যান্যবার প্রথমে বাংলা-ইংরেজি হয়ে পরে গনিত পরীক্ষা হয়, এবার উল্টো নিয়ম, প্রথম দিনই গনিত। এতে অবশ্য রন্তুর কোন সমস্যাই হচ্ছে না, গনিত তার খুবই প্রিয় বিষয়। তার বইয়ের যে কোন অংক সে চোখের পলকে করে ফেলতে পারে। কিন্তু মা কখনোই একথা বিশ্বাস যায় না, জোর করে নিয়মিত রন্তুকে অংক করায়। উফ কি যে বিরক্তিকর... কিছু অংকতো দেখেই উত্তর বলে দিতে পারে সে আজকাল, মুখস্ত হয়ে গেছে। যদিও মুখস্ত করা রন্তুর পছন্দ নয়, কিন্তু একেতো সহজ সহজ অংক, তার উপর বারে বারে করা। রন্তুর ছোট মামা রন্তুকে ক্লাস থ্রি আর ফোর এর গনিত বই এনে দিয়েছে, লুকিয়ে লুকিয়ে ঐ বইগুলোর ম্যাথ করে অবসর সময়ে রন্তু। সেইগুলোও প্রায় সব করে ফেলেছে। এটা খুবই গোপন খবর, রন্তু আর ছোট মামা ছাড়া আর কেউ এই খবর জানে না। ছোট মামা রন্তুকে কথা দিয়েছে রন্তু যদি ছোট মামাকে দাবা খেলায় কখনো হারাতে পারে, তাহলে তাকে ক্লাস ফাইভের গনিত বইও এনে দিবে। আর তাইতো সে সময় সুযোগ পেলেই ছোট মামার রুমে চলে যায়, যদি একটু দাবা খেলা যায়। যদিও বা খেলার সুযোগ হয়, সে প্রতিবারই হারে, তাও মাত্র তিন চালে বেশীরভাগ সময়।

রন্তু অতি দ্রুত অংক করে যাচ্ছে, সবকটা প্রশ্নই অনেকবার করে তার করা আছে। এই প্রশ্নের প্রতিটি অংকই তার করতে মন চাচ্ছে, কিন্তু অপশন রয়েছে, যে কোন ৫টি বা ১০টি এমন করে দেয়া। ইচ্ছা থাকলেও সব প্রশ্নের উত্তর তার দেয়া যাবে না। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই তার সব উত্তর করা শেষ হয়ে গেছে। খুব বিরক্তিকর লাগা সত্ত্বেও একবার রিভিশন দিয়ে নিল, প্রতি এক্সামের আগের রাতে মা বার বার কিছু কমন কথা কানের সামনে ঘ্যানর ঘ্যানর করবে, প্রশ্ন মনোযোগ দিয়ে লিখবে, সব উত্তর ঠিক করে লিখবে, হাতের লেখা যেন খারাপ না হয়, সব লেখা শেষ হলে কমপক্ষে তিনবার রিভিশন দিয়ে দেখবে কোন ভুল আছে কি না... । উফ! একবার রিভিশন দিতেই হাই উঠে রন্তুর, আর তিনবার!!!

রন্তু হাত ঘড়িটা দেখলো, দুই ঘণ্টা শেষ হতে মিনিট পাঁচেক তখনও বাকী। এই ঘড়িটা গত এক্সামে মা কিনে দিয়েছে, কালো রঙ্গের লেদার বেল্টের ঘড়ি, রন্তুর একটুও পছন্দ হয় নাই ঘড়িটা। আগের ঘড়িটা রন্তুর খুব পছন্দের ছিল, গত জন্মদিনে বাবা তাকে ঘড়িটা গিফট করেছিল। বাবা তখন সবেমাত্র তার সাথে মাসে দুয়েকবার করে স্কুল গেটে দেখা করতে আসা শুরু করেছে। জন্মদিনের দুইদিন আগে বাবা ঘড়িটা নিয়ে এলো। তাকে যখন বলল, “এটা তোমার জন্মদিনের গিফট” রন্তু অবাক হয়ে বলেছিল, “আমার জন্মদিনতো আজ নয়, আগামী পরশু...”। বাবা বলেছিল, “পরশু যদি তুমি না আসো স্কুলে, অথবা আমিই যদি না আসতে পারি...”। ঘড়িটা দেখে মা কিছুই বলল না, কিন্তু নানু মুখ গোমড়া করে রেখেছিল। তার কয়েকমাস পরই মা এই ঘড়িটা কিনে দেয়, আর বাবার দেয়া ঘড়িটা কোথায় যেন রেখে দিল। মা’কে কয়েকবার সেই ঘড়ির কথা জিজ্ঞাসা করেছে রুন্তু, মা বলে, “আছে আমার কাছে, নতুন ঘড়িতে কি সমস্যা?”

দ্বিতীয় ঘণ্টার ঢং ঢং শব্দ হতেই রন্তু সীট ছেড়ে উঠে খাতা হাতে ম্যাডামের দিকে এগিয়ে গেল খাতা জমা দিতে। ম্যাডাম খাতা জমা নিয়ে খুলে চেক করলেন সব উত্তর করেছে কি না? দেখে সন্তুষ্ট হলে পরে তাকে ক্লাসরুম ছেড়ে বের হতে পারমিশন দিলেন। রন্তু তার সীট হতে পেন্সিল-কলম-জ্যামিতি বক্স সব নিয়ে বাইরে বের হয়ে এল। জ্যামিতি বক্সটা একটু বড়, তাই পকেটে ঢুকে না। বাকী জিনিশগুলো পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে জ্যামিতি বক্স হাতে স্কুল গেটের দিকে এগিয়ে গেল। রন্তু যখন ক্লাস হতে বের হচ্ছিল, সবাই কেমন অবাক আর ঈর্ষা নিয়ে তাকে দেখছিল। তার ক্লাসের সবাই জানে সে ম্যাথে খুব ভালো, তাই অনেকেই তাকে খুব হিংসেও করে।

পুরো স্কুল মাঠ ফাঁকা, পরীক্ষার দিনে এমনিতেও মাঠে কেউ খেলে না, দৌড়ায় না, সবাই এই কদিন খুব সিরিয়াস হয়ে যায়। রন্তুর খুব ইচ্ছে করছিলো পুরো মাঠ জুড়ে খুব জোরে দৌড়োয়, কিন্তু সেই ইচ্ছাকে দমন করে সে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। এক ঘণ্টা আগে বাড়ী ফেরা, যদি ছোট মামা বাসায় থাকেতো তার সাথে এই সময়টা দাবা খেলা যাবে। রন্তু খুশীতে একা একাই হেসে উঠলো। স্কুলের মেইন গেট দিয়ে রাস্তায় বের হতেই রন্তু অবাক হয়ে দেখলো তার বাবা, জাভেদ, গেটের উল্টো দিকের রাস্ততায় একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বাবাকে দেখে রুন্তু একটা মিষ্টি হাসি দিল যা সে সচরাচর করে না, আজ পরীক্ষা ভালো দিয়ে মনটা খুব উৎফুল্ল। বাবার কাছে যেতেই রন্তু দেখলো বাবাকে কেমন যেন বুড়ো বুড়ো দেখাচ্ছে। কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি আর চোখের নীচের কালি, এই দুইয়ে মিলে জাভেদকে সত্যি সত্যি অনেক বুড়ো দেখাচ্ছিল। কেমন ঠাণ্ডা লেগে বসে যাওয়া কণ্ঠে জাভেদ ছেলের পরীক্ষার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে করতে হাঁটতে লাগলো। অন্যান্য দিনের মত আজ খাবার হোটেলে না নিয়ে গিয়ে, উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলো।
‘রন্তু চল শিশু পার্ক থেকে ঘুরে আসি, যাবে?’
‘হু...’
‘বাসায় মা-নানু বকবে নাতো?’
‘উঁহু...’
‘তা হলে চল যাওয়া যাক...’
একটা রিকশা ডেকে বাবা-ছেলে রিকশায় উঠে বসলো। রন্তুর খুব কান্না পাচ্ছে, বাবার সাথে এই প্রথম কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে, কি যে আনন্দ হচ্ছে! আনন্দে কেন কান্না পায়? রন্তু জানে না। রিকশা নিউমার্কেট পেরুনোর সময় জাভেদ ছেলেকে নিয়ে নেমে পড়লো। ছেলেকে কোন একটা কিছু কিনে দিবে, কে জানে আর কখনো যদি দেখা না হয় ছেলের সাথে। রন্তু অবাক হল মাঝ পথে মার্কেটে কেন? বাবার মেজাজ-মর্জি বোঝা দায়। রন্তু খুশী মনে বাবার হাত ধরে হাটতে লাগলো। জাভেদের মনে হল রন্তু যেন কোন বলিষ্ঠ এক পুরুষালী হাত দিয়ে তার বাঁ হাতের কবজিটা ধরে রেখেছে। নীরবে যেন বলছে এ বন্ধন কভু ছিন্ন হবার নয়... কিন্তু জাভেদ জানে, জীবনের সব বন্ধন মিছে... সব মিছে মায়া...।


৭.
হালকা শীত পড়েছে, খুব ভোর বেলা এখন হালকা কুয়াশা দেখা যায়। এই হালকা কুয়াশা কেমন যেন একটা দৃষ্টি বিভ্রম সৃষ্টি করে। কখনো কখনো একজন মানুষ নিজের অজান্তেই হয়তও আরেকজন মানুষের হৃদয়ে এই কুয়াশার ন্যায় বিভ্রম তৈরি করে। শায়লার কাছে ইরফান একটা কুয়াশাচ্ছন্ন বিভ্রম বৈ অন্য কিছু কি? শায়লা নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন করে করে দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে একটু একটু করে খসে পড়ছে তার বিবেক-আবেগে’র বালি-পাথরের বাঁধ। আজকের এই শীত শীত সকালে মনটা খুব বিষণ্ণ, একেবারেই অফিস যেতে মন চাচ্ছে না।

শুরুতে ইরফানের সাথে সহকর্মী হিসেবে জাস্ট বন্ধুত্বপূর্ণ সৌহার্দ ছাড়া আর কিছু ছিলনা। শায়লা কোম্পানি এমডি’র পার্সোনাল এসিস্ট্যাণ্ট হওয়ায়, তার সাথে অফিসের সকল ডিপার্টমেন্টের উপরের দিককার পদস্থদের সাথে পরিচয় হতে থাকে। ইরফান হল ফাইন্যান্সের জিএম। আইবিএ থেকে ফাইন্যান্সে বিবিএ-এমবিএ করে লন্ডন থেকে সিএফএ করে এসেছে। এতো মেধাবী এবং ব্রিলিয়াণ্ট একটা লোক, কিন্তু তার আচার ব্যাবহার দেখে কেউ আঁচ করতে পারবে না। যেমন মিশুক, তেমনি মন খোলা আমুদে মানুষ। কখনো কখনো তার ডিপার্টমেন্টের এক্সিকিউটিভ লেভেলের কারো ডেস্কে বসে তাকে খোশ গল্প করতে পর্যন্ত দেখা যায়। আর তার সাথে প্রকৃতি প্রদত্ত পুরুষালী সৌন্দর্য তাকে করেছে হাজারের ভিড়ে আলাদা একজনে।

ফাইন্যান্সের কাজে ইরফানকে প্রায় রোজ দিনই বারে বারে এমডি স্যারের রুমে আসা যাওয়া করতে হয়। কখনো তার নিজের প্রয়োজনে, কখনো এমডি স্যার ডেকে পাঠায়। আর এই নিত্যদিনকার অফিসিয়াল কর্মব্যাস্ততার ফাঁকে ফাঁকে শায়লার সাথে ধীরে ধীরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে ইরফানের। জবে ঢোকার আগে অফিসিয়াল পিএ’র চাকুরী নিয়ে নানান ভয়াবহ কাহিনী নানান জনের কাছে শুনেছিল সে। কিন্তু এই অফিসের পরিবেশ একেবারেই ব্যাতিক্রম। যাই হোক বন্ধুত্বের সম্পর্ক গাঢ় হতে হতে কখন যে অন্যদিকে মোড় নেয়া শুরু করলো, শায়লা বুঝতে পারে নাই। গতকাল ইরফান তাকে প্রপোজ করে বসেছে, শায়লা কোন প্রতিউত্তর না দিয়ে বাসায় চলে এসেছে। সেই থেকে শায়লার মনোজগৎ যেন এক আজব কুয়াশার ন্যায় ঘোলাটে ঘোরের মাঝে ডুবে আছে।

শায়লা খাটের এক প্রান্তে বসে ছেলে দেখছে। রন্তু বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে দুই হাতে ভর দিয়ে বই পড়ছে। ছেলেটার বার্ষিক পরীক্ষা চলছে, কিন্তু পড়া শোনায় এতটুকু মনোযোগ নাই। জোর করে ধরে ধরে পড়তে বসাতে হয়। পড়তে বসলে আধঘণ্টা-একঘণ্টায় তার সব পড়া শেষ। এতো ফাঁকিবাজ হয়ে যাচ্ছে দিনদিন ছেলেটা! কিন্তু পরীক্ষায় রেজাল্ট খুব একটা খারাপ করছে তা নয়, বরং আশানুরুপ। কিন্তু এখন থেকে পড়াশোনায় মনোযোগী না হলে উপরের ক্লাসে উঠার পর তার এডজাস্ট করতে সমস্যা হবে, পড়াশোনার লোডের সাথে টাইমিং এর সামঞ্জস্য করতে হিমশিম খাবে। কিন্তু এতোটুকুন ছেলে কি আর এতসব বুঝে। রন্তু’র দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শায়লা চোখ ভিজে উঠে। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে, বড্ড বেশী অসহায়।

মা উঠে রান্না ঘরের দিকে যেতেই রন্তু হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আজ কোন এক্সাম নেই, মাঝখানে একদিনের এই গ্যাপ যে কেন দেয় এক্সামগুলোতে রন্তু ভেবে পায় না। আজ সারাদিন নানুর ঘ্যানর ঘ্যানর শুনতে হবে, ‘রন্তু পড়, কাল এক্সাম’। রন্তু অবশ্য একটা বুদ্ধি বের করেছে, ছোট মামাকে সে তার দলে টেনেছে। ছোট মামার কাছে পড়া বুঝতে যাচ্ছে নানুকে এই বলে সে দশটার দিকে চলে যাবে ছোট মামার চিলেকোঠার ঘরটায়। মামা পড়া ধরবে, রন্তু সব পটাপট উত্তর দিতে পারলে মামার সাথে দাবা খেলা যাবে। রন্তু ঘড়ির দিকে তাকালো, এখন সকাল আটটা, মা নয়টার মধ্যে বেড়িয়ে যাবে। তারপরও আরও একঘণ্টা বই সামনে নিয়ে বসে থাকা... উফ!

রন্তুর খুব ইচ্ছা করছে বাইনোকুলারটা নিয়ে ছাঁদে যেতে। গত সপ্তাহে বাবা তার ম্যাথ এক্সামের দিন স্কুল গেটে দেখা করতে এসে তাকে নিয়ে ঘুরতে বেড় হয়। কথা ছিল তারা শিশু পার্ক যাবে, কিন্তু হঠাৎ করেই বাবা ডিসিশন চেঞ্জ করে কি মনে করে রিকশা ঘুড়িয়ে তাকে নিয়ে গেল নিউমার্কেট। সেখান থেকে এই বাইনোকুলারটা তাকে কিনে দিয়েছে। বাইনোকুলারটা রন্তুর খুব পছন্দ হয়েছে, খুব দূরের সব জিনিষই কত বড় হয়ে কাছে চলে আসে। রন্তু বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘বাবা রাতের বেলা কি তারাগুলোও এটা দিয়ে দেখা যাবে?’। বাবা বলেছে না, তারা দেখতে টেলিস্কোপ লাগে। রন্তু একবার ভাবলো বাবাকে বলে, টেলিস্কোপ কিনে দাও তাহলে। কিন্তু তা কি আর রন্তু বলতে পারে? বাবা দেখা করতে আসলে রন্তুর কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হয়, খুব ভালো লাগে, খুব... কিন্তু কেমন এক জড়তাও কাজ করে। বাবাকে মনে হয় অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা খুব কাছের কোন একটা মানুষ।

ছোট মামা বাইনোকুলারটা খুব পছন্দ করেছে, মজা করে বলেছে আমাকে তুই এইটা দিয়ে দিলে আমি রোজ তোর কাছে দাবা খেলায় হেরে যাবো। মামাটা যে কি সব বলে না। তবে মজার কথা হল, মামা প্রমিজ করেছে রন্তুর এক্সাম শেষ হলে তাকে স্টেডিয়াম নিয়ে যাবে, বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখাতে। তখন নাকি খুব কাজে দিবে বাইনোকুলারটা। মামা অবশ্য আরও একটা কথা বলেছে, সেটা গোপন রাখতে হবে, কাউকে বলা যাবে না। এই বাইনোকুলার নিয়ে মামা কোথায় যেন পাখি দেখতে যাবে, কোন মতেই নানু যেন না জানতে পারে। রন্তু প্রমিজ করেছে, আর রন্তু’র প্রমিজ মানে...প্রমিজ।


৮.
হুট করে কোন কিছু বদলে গেলে কেমন যেন একটা অজানা অস্বস্তি লাগে সবারই। নিত্যদিনকার কর্মকাণ্ডের পূর্ব নির্ধারিত নির্দেশ যেন অবচেতনেই সবার মনে গেঁথে যায়। আর তাই এই নির্ধারিত কর্মযজ্ঞে ব্যাতয় ঘটলে মানুষ মাত্রই কেমন অস্বস্তি অনুভব করে। হুট করে মানিয়ে নিতে গিয়ে অনুভূত অদ্ভুত অচেনা এক অসামঞ্জস্য। রন্তুর ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়েছে গতকাল। ফলে আজ সকালেও যখন প্রতিদিনকার মত ভোরবেলাই ঘুম ভেঙ্গে গেল, তখন রন্তু বিছানায় বসে ভাবতে লাগলো কি করা যায়। প্রথমে প্রতিদিনের রুটিনমত স্কুল যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার উদ্দেশ্যে বিছানা হতে নেমেছিল; কিন্তু বাথরুম অভিমুখে যাওয়ার সময় মনে পড়ে গেল আজ স্কুল যাওয়ার তাড়া নেই। আজ শুক্রবারও নয়, তার উপর ফাইনাল এক্সাম শেষ হল গতকাল, তাই আজ কোন পড়ার চাপও নেই। তাই বিছানায় বসে বসে রন্তু কেমন যেন অথৈ সাগরে পড়ে গেল এই ভেবে ভেবে যে কি করা যায় এতো সকালে।

বিছানা হতে নেমে রন্তু গুটি গুটি পায়ে বাইরে বের হয়ে এল, সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদের চিলেকোঠায় ছোট মামার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। রন্তুর ছোট মামা শিবলি দরজা খুলে রেখে ঘুমায়। এই নিয়ে নানুর সাথে কতবার যে মামার ঝগড়া হয়েছে। ছোট মামা কিছুতেই দরজা বন্ধ করে ঘুমুতে পারে না; তার নাকি মনে হয় দরজা বন্ধ করে ঘুমালে সে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়বে আর কোনমতেই ঘর হতে বেড়িয়ে কাউকে ডাকতে পারবে না। শেষে তার লাশ নাকি দরজা ভেঙ্গে বের করতে হবে। অন্যদিকে নানুর কথা কোনদিন চোর-ডাকাত এসে সব লুটে নিয়ে যাবে, সাথে যাওয়ার সময় ছোট মামাকে খুন করে রেখে যাবে। যে মৃত্যুর ভয়ে দরজা খোলা রাখা, সেই মৃত্যু নাকি খোলা দরজা দিয়েই ঢুকবে মামার ঘরে। রন্তু বড়দের বেশীরভাগ কথাবার্তা বুঝতে পারে না। তাদের কথাবার্তার বেশীরভাগেরই কোন মানে নেই, রন্তুর ধারনা বড়দের বুদ্ধি একটু কমই হয়। কিন্তু তার স্কুলের টিচারদের তো বুদ্ধিমানই মনে হয়। রন্তু সবশেষে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে তা হল তার বাসার সবার বুদ্ধি কম, এমন কি বাবারও।

সেদিনের পর থেকে রন্তুর বারবার বাবার কথা মনে পড়ে, হঠাৎ করেই কেন যেন বাবার প্রতি মায়া জন্মেছে ছোট্ট মনের মণিকোঠায়। কিন্তু সেদিনের পর বাবার এখনও দেখা পায় নাই। অবশ্য এখনও মাসখানেক সময় পার হয় নাই। বাবাতো মাসে একবার দেখা করতে আসে। ইদানীং রন্তু তার আঁকার খাতায় বাবার একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না। বাবার চেহারা মনে করতে গেলেই কেমন গুলিয়ে যায় সব কিছু। কখনো বাবার চোখের জায়গায় মা’র চোখ চলে আসে। কখনো নানুর হাসি, কখনো ছোট মামার মুখের অবয়ব। রন্তুর ছোট্ট মাথায় ধরে না কেন এই বিভ্রম ঘটছে। আসলে যতটা কাছে থাকলে একটা মানুষের মুখচ্ছবি আমাদের হৃদয়পটে বসে যায়, ততটা সময় বাবার সাথে কাটানোর সৌভাগ্য রন্তুর হয় নাই। সেই চার বছর বয়সে বাবা-মা ঝগড়া করে আলাদা হয়ে গেলে পরে বিগত বছর দুয়েকের বেশী সময় ধরে রন্তু তার মা শায়লার সাথে আছে নানু বাড়িতে।

ছোট মামাটা কেমন কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে, দেখে মনে হয় একটা কাপড়ের পুঁটলি। রন্তুর নানু ছোট মামাকে এভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলেই বলবে কাপড়ের পোঁটলা। রন্তুর তখন খুব মজা লাগে, সে মাঝে মাঝে মামাকে পোঁটলা মামা বলে ডাকে। মামার মুড ভালো থাকলে মামা কিছু বলে না, কিন্তু মুড খারাপ থাকলে রন্তু’কে ধরে কান মলা দিয়ে দেয়। রন্তু মামাকে ঘুম থেকে না তুলে ছাঁদে হাঁটতে লাগলো ধীর পায়ে। কুয়াশা পড়ে ছাঁদটা কেমন ভেজা ভেজা হয়ে আছে। হালকা বাতাস বইছে, তাই রন্তুর শীত শীত লাগছে। এখন মোটামুটি শীতকাল বলা যায়, মা রন্তুর গরম কাপড় বের করে দিয়েছেন। কিন্তু রন্তু মনে করে পড়ার কথা ভুলে যায়, আজ যেমন ছাঁদে আসার আগে মনে ছিল না। এখন আবার নীচে নামতে মনে চাচ্ছে না, কিন্তু শীতও ভালোই গায়ে লাগছে। রন্তুর শীতকাল মোটেও ভালো লাগে না, কারণ, শীত এলেই তার চামড়া শুকিয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যায়। নানু বলে ‘ফাটা বাঙ্গী’, এই বলে তাকে খুব ক্ষ্যাপায়। আর শীত এলেই রন্তুকে রুটিন করে গ্লিসারিন, তেল, লোশন মেখে বাবু সেজে শীত কাপড় গায়ে চাপিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। এতো আয়োজনের সময়টুকু রন্তুর খুবই যন্ত্রণাদায়ক মনে হয়। অবশ্য একবার সব শেষ করে ফিটফাট বাবু সেজে গেলে পড়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগে। এখন খুব মিস করছে সেই ফিটফাট রূপ, ঠাণ্ডায় হাত-পা, নাক-কান যেন জমে যাবে। রন্তু ফের ছোট মামার ঘরে চলে আসলো, আস্তে করে মামার পাশে শুয়ে পড়ে মামার লেপের তলায় নিজেকে ঢেকে দিল।

‘কিরে, এতো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে এখানে কেন?’ মামার কথায় রন্তু কিছুটা চমকে গেল, একটু কি ভয়ও পেল? সে ভেবেছিল মামা গভীর ঘুমে।
‘ঘুম ভেঙ্গে গেল যে...’
‘ঘুম ভেঙ্গে গেলে আবার জোড়া লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হয় এটা জানিস না?’
‘যাহঃ তা আবার হয় নাকি? কিসব যে তুমি বল না মামা...’
‘শোন রন্তু আমাকে ঘুমাতে দে, ঝামেলা করলে মাথায় একটা গাট্টা মারবো মনে থাকে যেন।’
‘ওমা! আমি কি তোমায় কিছু বলেছি নাকি? আমিতো ঠাণ্ডা লাগছিল বলে তোমার লেপের তলায় ঢুঁকে পড়লাম’
‘ঠিক আছে মুখ বন্ধ, যতক্ষণ ইচ্ছা বসে থাক, শুয়ে থাক... কিন্তু নো কথা... ওকে?’
‘ওকে...’ রন্তু বসে বসে ছোট মামার ঘরখানি দেখতে লাগলো। রাজ্যের জিনিসে মামার রুমখানি ঠাসা। এত্ত এত্ত বইপত্তর, তার সাথে নানান যন্ত্র, খেলার সরঞ্জাম, ম্যাগাজিন... আরও কত কি! কিন্তু রন্তুর কাছে ঘরটা খুব ভালো লাগে, মনে হয় তার যদি এমন একটা ঘর থাকতো! মামার দেয়ালে দুলতে থাকা ক্যালেন্ডারের পাতায় লাল রঙে ষোল তারিখ দেখে রন্তুর মনে পড়ল কাল বাদে পরশু দিনই ষোলই ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস! সাথে সাথে ছোট মামাকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ঠেলতে লাগলো।

‘রন্তু! মারবো কিন্তু একটা গাট্টা... ঠেলছিস কেন?’
‘মামা... ষোল তারিখ...’
‘কিসের ষোল তারিখ?’
‘বিজয় দিবস...’
‘হুমম বিজয় দিবস, তো ধাক্কাচ্ছিস কেন?’
‘পতাকা লাগাবে না মামা?’
‘হুমম...’
‘কবে?’
‘উফ রন্তু ঘুমাতে দে... পতাকা আগামীকাল লাগাবো। আর একটা কথা বললে কিন্তু কান ধরে নীচে দিয়ে আসবো, আর আগামী এক সপ্তাহ উপরে আসার ভিসা ক্যান্সেল হয়ে যাবে’

মামার এই কথা শুনে রন্তু ভয় পেল, সে মামার ‘ভিস ক্যান্সেল’ শাস্তি খুব ভয় পায়। আর তাই চুপ করে কিছু সময় বসে থেকে ধীর পায়ে প্রায় নিঃশব্দে খাট থেকে নীচে নেমে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ঘরে হতে বের হবে এমন সময় মামা লেপের তলা থেকে মাথা বের করে রন্তুকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বিকেল বেলা রেডি থাকিস, চকবাজার যাবো পতাকা কিনতে’। বলেই কচ্ছপের মত আবার মাথাটা ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। রন্তু খুশী মনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আগত দুতিন দিনের সম্ভাব্য আনন্দমুখর দিনের কথা ভেবে ভেবে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। কি কি করবে ভেবেই হয়রান হতে হতে হঠাৎ মনে হল, ইস... এসময় যদি বাবাও তাদের সাথে পতাকা সাজাতে চলে আসতো, তবে কতই না মজা হত। বাবার সাথে কখনো পতাকা সাজানো হল না রন্তুর। এরকম আরও কতশত না পাওয়ার অনুভূতি গড়ে উঠবে রন্তুর জীবনে বাবাকে ঘিরে? আগত সময়ই তা বলে দিবে। রন্তুদের জীবনে না পাওয়ার হিসেব করেই পাওয়ার হিসেব মিলাতে হয় যে।


৯.
কুয়াশাভেদ করে গুচ্ছ গুচ্ছ সূর্যকিরণ ছাদের উপর এসে পড়ছে, আকাশে লম্বা লম্বা ইয়া মোটা মোটা আলোর রেখাগুলো অদ্ভুত এক নকশা তৈরি করছে। রন্তু অনেকক্ষণ ধরে এই রোদের খেলা দেখতে লাগলো। ছাদের শেষ মাথায় টাঙানো বাংলাদেশের পতাকাখানি কেমন নেতিয়ে আছে, দূর থেকে ভেজা ভেজা মনে হচ্ছে। রন্তু বুঝতে পারলো সারারাতের কুয়াশায় ভিজে নেতিয়ে আছে পতাকাটি। গত পরশু বিজয় দিবস ছিল। তার আগের রাতে রন্তু তার ছোট মামার সাথে কি মজা করে রাতের বেলা ছাদে পতাকা সাজিয়েছে। পাটের চিকন দড়িতে ছোট ছোট লাল-সবুজের পতাকা একটা একটা করে আটকে দিয়ে পতাকার মালা বানিয়ে সারা ছাদজুড়ে সাজিয়েছে অনেক রাত পর্যন্ত। মা-নানু দুজনেই ছাদে এসেছিল রাতের বেলা। সবচেয়ে মজার কথা রাতের বেলা রন্তু ছাদে থাকার জন্য কোন বকাঝকা খায় নাই দুজনের কারো কাছ থেকে। ইস... রোজ রোজ কেন এমন হয় না। আজ সকাল বেলা ছাদে এসে বার বার তার এই কথাই মনে হচ্ছিল।

ভাল জিনিসগুলো সবসময় হুট করে শেষ হয়ে যায়, যেমন হাওয়াই মিঠাই। রন্তুর খুব প্রিয় ছিল হাওয়াই মিঠাই, কিন্তু এখন সে আর ওটা পছন্দ করে না। হুট করেই মজা শেষ হয়ে যায়। রন্তুর জীবনে আনন্দ অনেক কম বলেই কিনা জানা যায় না, সে ক্ষণস্থায়ী কোন আনন্দে আগ্রহ পায় না এই ছোট বয়সেই। ছয় পেরিয়ে সাতে পড়তে যাওয়া রন্তু কীভাবে যেন এই বয়সেই অদ্ভুত এক মানসিক জগত নিয়ে বড় হচ্ছে। ছোট শিশু মনে এগুলো ধরা না দিলেও তার কেমন নীরবতা’র প্রতি অদ্ভুত একটা টান তৈরি হয়েছে। আর আট দশটা ছেলেমেয়ের মত শিশুসুলভ চাঞ্চল্য তার মাঝে খুঁজে পাওয়া ভার। আজ এই সকালের প্রথম লগ্নে খোলা ছাদে কুয়াশার চাদরের নীচে দাঁড়ানো রন্তু’র ভাবনাগুলো একটু সচেতনভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অতি অল্প বয়সেই কেমন অদ্ভুত এক পরিপক্ক মনোজগৎ গড়ে উঠেছে তার মাঝে।

রন্তু ধীর পায়ে পতাকা যে বাঁশটিতে টাঙানো হয়েছে তার নীচে গিয়ে দাঁড়ালো। তার ছোট্ট হাত দিয়ে বাঁশটিকে নাড়াচাড়া করে ভিজে নেতিয়ে পড়া পতাকাটিকে বাতাসে উড়ানোর চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। শেষে ব্যর্থ হয়ে ছাদের পাঁচিল এর দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে চোখ দিল, এখনো মানুষজনের তেমন আনাগোনা আরম্ভ হয় নাই। ফাঁকা রাস্তা, নেতিয়ে পড়া পতাকা, বিজয় দিবসের উৎসবমুখর সময় শেষে আজকের সকালবেলার এই মনখারাপ করা সকালবেলা... সবকিছু মিলে রন্তু’র কেন যেন খুব মন খারাপ হল; সাথে খুব কান্না পেল। আর আজব করা ব্যাপার হল কান্না পেলেই রন্তুর ইদানীং খুব বাবার কথা মনে হয়। কেন এতো বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করে?

সেদিন মা খাটে শুয়ে গল্প করতে করতে কি কারনে যেন হঠাৎ করেই রন্তুকে জিজ্ঞাসা করল তার কাকে সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে? রন্তু কিছুই না ভেবে অকপটে বলে বসল, ‘বাবাকে...’। কিন্তু কথাটা বলেই মনে হল এই উত্তরে মা খুশী হয় নাই, কষ্ট পেয়েছে। রন্তুর তখন খুব মন খারাপ হয়েছিল, রন্তু মা’কে খুব ভালবাসে, খুব। কখনো মা’কে বুঝতে দেয় না। মা বাসায় থাকলে অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ নাকে আসে রন্তুর, রন্তু এই ঘ্রাণের নাম দিয়েছে ‘মা ঘ্রাণ’। এই পৃথিবীতে রন্তু সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে তার মা’কে। কিন্তু সেদিন মা কেন তার উপর অখুশী হল রন্তু ভেবে পায় না। তার বাবা’কে খুব ভালো লাগে এটা কি দোষের? বাবা মানুষটা কেমন অদ্ভুত! রন্তুর কাছে তার বাবাকে সিনেমার কোন নায়কের মত মনে হয়। মাঝে মাঝে যার দেখা পাওয়া যায় রন্তু’র স্কুল গেটে। কেমন গম্ভীর হয়ে থাকে, রাগী রাগী কণ্ঠে কথা বলে। রন্তুর কিন্তু বাবার সেই রাগী রাগী কণ্ঠস্বর শুনে খুব হাসি পায়, কিন্তু সে হাসি চেপে রাখে অনেক কষ্টে। সে এই হাসি চেপে রাখার একটা উপায় খুঁজে বের করেছে। তা হল দাঁত দিয়ে জিহবা চেপে রাখা। আর এটা করতে গিয়ে সে বাবা’র সাথে দেখা হওয়ার সময়টায় প্রায় কথাই বলতে পারে না। বাব খুব রেগে যায় সে কোন প্রশ্নের উত্তর না দিলে, তখন রন্তু খুব ভয় পেয়ে যায়। সেই রাগী বাবাকে রন্তুর খুব অচেনা মনে হয়, খুব অচেনা।

কিছুক্ষণ ছাদে মুখ গোমড়া করে ঘোরাঘুরি করে নীচে নেমে এল রন্তু। মা আজ অফিস যায় নাই, খাটে লেপের তলায় শুয়ে আছে, চোখ খোলা, ঘরের সাদা দেয়ালে কি যেন একমনে দেখে আছে। রন্তু চুপটি করে গিয়ে মায়ের পাশে বসল।

‘কিরে? এখনতো স্কুল নেই, রোজ সকাল সকাল উঠে যাস যে... ঘুম ভেঙ্গে যায় বুঝি?’
‘হুমম’
‘অভ্যাস... সবই অভ্যাস’ বলে মা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। রন্তু মা’কে ইদানীং বুঝতে পারে না, কেমন অচেনা মনে হয়। কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই কেমন মুড বদলে যায়। রন্তু’র ছোট মন আর মস্তিস্ক এই পরিবর্তন ধরতে পারে না। রন্তু’র মা শায়লা, এক অদ্ভুত মানসিক দ্বিধা’র মধ্যে রয়েছে। দিন দিন সে অফিসের ফাইন্যান্সের জিএম, ইরফানের সাথে তার সম্পর্কটা বন্ধুত্ব থেকে এগিয়ে অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে তা সে বুঝতে পারছে প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছে। কিন্তু শায়লার মনে হয় তার কিছুই করার নেই, অজানা এক অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে টেনে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্কের দিকে প্রতিদিন হু হু করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোন প্রতিরোধ করার শক্তি যেন তার নেই, নিয়তির লিখন যেন লিখে চলেছে শায়লার জীবনগাঁথা। সেই কৈশোর পেড়িয়ে তরুণী হওয়ার সময়টায় প্রেম করে পারাবারিক সম্মতিতে বিয়ে করেছিল জাভেদকে। কত ভালবাসার সেই সম্পর্ক! কিভাবে সব বদলে গেল? বদলে গেল জাভেদ, বদলে গেল সে নিজেও... বদলে গেল তাদের জীবনটাই। মাঝে মাঝে শায়লা ভাবে কি স্বপ্ন একেছিল আর কি বাস্তবে হয়ে গেল। কোথায় কতদূর চলে গেছে জাভেদ আর সেই সাথে তাদের সেই ভালবাসা; শুধু চিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে তাদের সন্তান রন্তু।

শায়লা’র খুব কষ্ট লাগে তার ছয় বছরের ছোট্ট ছেলে রন্তুর জন্য। তাদের দুইজনের ভুলের কি চরম মাশুল এই শিশু রন্তুকে দিতে হচ্ছে। এই অপরাধবোধ শায়লা প্রতিদিনই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, আর সেই অনুতপ্ত ক্ষণগুলোতে খুব কষ্ট হয় শায়লার। আজ এই সকাল বেলা ঘুম ভেঙ্গেই খুব মন খারাপ হয়ে গেল। গতকাল ইরফান তাকে স্পেশাল লাঞ্চের দাওয়াত দিল, খুব নামকরা এক রেস্টুরেন্টে। আজ দুপুরে তাদের সেখানে খাওয়ার কথা, শুধু শায়লা আর ইরফান, ইরফান বলল স্পেশাল ট্রিট, তার পক্ষ থেকে শায়লাকে। শায়লা’র কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল, সে বুঝতে পারছিল বিশেষ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে আগামীকাল দুপুরে। আর তাই আজ ঘুম ভাঙ্গতেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আজ অফিস যাচ্ছে না। অসুস্থতার কথা বলে দিবে অফিসে ফোন করে। সে জানে ইরফান খুব অবাক হবে, কষ্ট পাবে, কিন্তু শায়লা ভেবে পাচ্ছে না সে কি করবে? চোখ জ্বালা করে অশ্রু’র দল উঁকি দিচ্ছে। এইসময় ছেলে এসে তার সামনে বসায় তার কষ্ট যেন আরও বহুগুন বেড়ে গেলে। ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো শায়লা। রন্তু মায়ের কাছ থেকে হঠাৎ পাওয়া বাড়তি আদর উপভোগ করতে লাগলো মায়ের গায়ে হেলান দিয়ে। সকালবেলার মন খারাপ ভাবটা হুট করেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল, মনটা খুব ভাল হয়ে উঠল। শুধু একটা আক্ষেপ শিশু মনে জেগে রইল... এখন যদি পাশে বাবাও থাকতো, তবে কি ভালই না হত। রন্তু মনে মনে বলল, ‘এই যে বাবা, তুমি কি শুনছো? প্লিজ রাগ না করে চলে আস না এখানে... প্লিজ... প্লিজ... প্লিজ...’


১০.
মানুষের মন বড় আজব এক বস্তু, এর ভাবার্থ বোঝা বড় দায়। মন কখন কি ভাবে, কি করে, কোন পথে ধাবিত করে জীবনের গতিপথ তা ঠাওর করা বুঝি মানুষের কম্ম নয়। মানুষ হিসেবে সে শুধু পারে মন নামক এক পাষণ্ডের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে। খুব কম মানুষই এই শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পেরেছে, যারা পেরেছে তারা মানব সমাজে দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে, হয়েছে বরেণ্য, স্বনামধন্য, সাধারণ থেকে অসাধারণ। কিন্তু শায়লার মত আটপৌরে জীবনের মানুষেরা সবসময় এই মনের কাছে হেরে গিয়ে বেঁচে থাকে, আর তাই মনের কাছে পরাজয়’কে নিয়তি হিসেবে ভেবে নিয়ে নিজেকে প্রবোধ দেয়।

গত তিনদিন হল শায়লা অফিস কামাই করছে, অফিসে ফোন করে জানিয়েছে অসুস্থতার কথা। এখনো সিক লিভ, ক্যাজুয়াল লিভ মিলে প্রায় বিশের উপর ছুটি পাওনা আছে তার, তাই এটা নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা নেই। কিন্তু এমডি স্যার শায়লার উপর অনেক নির্ভর করেন, স্যার তাকে পিএ হিসেবে ট্রিট করেন না, আপন মেয়ের মতই স্নেহ করেন। তাই, অনেকটা নির্ভর করেন দৈনন্দিন কাজে শায়লার উপর। তাই সে অফিস মিস করলে এমডি স্যারের বড় অসুবিধা হয়ে যায়। শায়লা এটা জানে, তাই অফিস মিস করাতে খুব খারাপ লাগছে স্যারের জন্য। কিন্তু শায়লা নিরুপায়, সে নিজে বুঝতে পারছে মানসিকভাবে সে প্রচণ্ডরকম দ্বিধায় ভুগছে। ইরফানের স্বপ্নময় ভালবাসার হাতছানি তাকে প্রলুব্ধ করছে অতি গোপনে, কিন্তু বাস্তবতার ইস্পাত কঠিন দেয়াল তাকে বেঁধে রাখছে সারাক্ষণ।

গত তিনদিন হল একরকম বিছানাতেই আছে শায়লা, শীতের দিন বলে লেপমুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে খুব একটা খারাপ লাগছে না। কিন্তু সমস্যা হল শায়লার মা একটু অবাক হচ্ছে মেয়ের এই হঠাৎ পরিবর্তন দেখে। মেয়ের গায়ে জ্বর নেই, অন্য কোন শারীরিক অসুস্থতাও নেই, কিন্তু মেয়ে শরীর ভালো লাগছে না বলে তিনদিন হল অফিস যাচ্ছে না। শায়লার মা মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন, মেয়েকে কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেও কিছু জানা যায় নাই। অফিসে কোন ঝামেলা হয়েছে কি না? বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছেন, মেয়ে প্রতিবারই বলছে কিছু হয় নাই। কাজ করতে করতে নাকি হয়রান হয়ে গেছে, তাই একটু রেস্ট নেয়া। উনি আর কিছু বলেন নাই মেয়েকে, কিন্তু উনি বুঝতে পারছেন কোথাও কোন একটা সমস্যা হয়েছে, মেয়ে তার কাছে লুকাচ্ছে। এতো সমস্যার মাঝে আবার নতুন কোন সমস্যা এসে দেখা দেয় এই চিন্তায় তার নিজেরও আর কিছু ভালো লাগছে না।

শায়লা নিজেও ভেবে পাচ্ছে না আসলে সে কাকে ফাঁকি দিতে বাসায় বসে আছে? তার এই লুকিয়ে থাকা’র কোন মানে নেই সে নিজেও জানে। কিন্তু সে যে নিজেই নিজের মনের কাছে হেরে বসে আছে। মনের আয়নায় নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে তার খুব ভয় হয়, সে জানে নিমিষেই ধরা পড়ে যাবে তার হৃদয়ের গোপন কুঠিরে ইরফানকে ঘিরে বইতে থাকা চোরাস্রোত। তবে একি নিজের কাছ থেকে নিজের লুকিয়ে বেড়ানো নয়। শায়লা এসব ভাবতে গেলেই তার মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছে। উফ... জীবনে কেন এতো কষ্ট, কেন?

“মা, তোমার কি আবার মাথা ব্যাথা করছে?” রন্তু ঘরের দরজার কাছ থেকে ভীতু ভীতু চোখে জিজ্ঞাসা করল। গতকাল মা তাকে কড়া করে একটা ধমক দিয়েছে, কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর না করার জন্য। তারপর থেকে রন্তু মা’কে এড়িয়ে চলছে, কখন জানি ধরে আবার মারতে আরম্ভ করে। নানু বলেছে, মা’র শরীর খারাপ করেছে, মা’কে জ্বালাতন না করতে। রন্তু খুব মজা পেয়েছে নানুর কথায়, মা’কে রন্তু জ্বালাতন করতে যাবে কোন দুঃখে? নানু’র কথার কোন আগা মাথা নেই... তবে রন্তু মায়ের মুখ দেখে বুঝতে পারছে মার শরীর খারাপ, সাথে মনও খুব খারাপ, অফিস যায় নাই কয়দিন ধরে।
“কেন? তুই কি ডাক্তার? মাথা ব্যাথার ওষুধ দিবি?” মা হেসে জিজ্ঞাসা করল। রন্তু একটু অবাক হল, গত দুইদিনে এই প্রথম মা’কে হাসতে দেখল।
“বড় হয়ে যদি ডাক্তার হই, তাহলে দিব”
“তার মানে ততদিন আমার মাথা ব্যাথা থাকবে?”
“আমি কি তাই বলেছি নাকি?”
“থাক থাক, তোকে আর বলতে হবে না। ছোট মামা বাসায় নাই?”
“উঁহু... একটু আগে বন্ধুদের সাথে বেড়িয়ে গেল।”
“হুমম...”
“আচ্ছা মা... ডাক্তার হওয়া কি খুব কঠিন? ছোট মামা বলেছে, ডাক্তারী পড়া নাকি খুব কঠিন?”
“কিভাবে বলি? আমিতো ডাক্তারি পড়ি নাই... কঠিন হলে কঠিন, তরল হলে তরল। এদিকে আয়তো রন্তু...”

মায়ের দিকে রন্তু এগিয়ে গেল, মায়ের পাশে খাটে বসল। শায়লা ছেলের হালকা কোঁকড়ানো চুলে হাত বুলিয়ে দিতেই মনে পড়ল জাভেদের কথা। ছেলের চুলগুলো হয়েছে ঠিক বাবার মত, ছেলের দৈহিক গড়নও বাবার মতই হবে। মুখের আদল পুরো বাবার মত, ঠিক যেন জাভেদের ছোট্ট একটা প্রতিকৃতি। কিন্তু ছেলের স্বভাব হয়েছে ঠিক বাবার উল্টো, শায়লা এতে কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হয়, ছেলে বাবার মত মানসিক গঠনের না হলেই ভালো হয়। জাভেদের কথা মনে হলেই শায়লার চোখে এতো এতো স্মৃতি ছাপিয়ে একটি স্মৃতি ভেসে ওঠে, রক্তাক্ত হাত নিয়ে জাভেদের সেই ভয়ংকর হাসি ধরে রাখা মুখে বলা একটি কথা, “শায়লা দ্যাখো, এই হাত...এই হাত তোমার গায়ে তুলেছি আমি! তাই এই হাতকে শাস্তি দিলাম...”

রন্তু মায়ের কোলে ঘেঁষে বসে রইল চুপটি করে। মায়ের শরীরের মিষ্টি গন্ধ আর মায়ার ওমে বসে বসে সে এক কল্পনার জগতে হারিয়ে গেল। ইদানীং সে প্রায়ই এক খেলাটা খেলে, নিজের মনে সে বাবা আর মা’র সাথে কথা বলে। এই কথা কথা খেলাটা তার খুব ভালো লাগে। সে তার খেলা শুরু করে দিল...
“এই শুনছো, খুব মাথা ধরেছে, ঘরে কোন ট্যাবলেট আছে নাকি?” মা বলল বাবাকে উদ্দেশ্য করে।
“না নেই। শোন শায়লা, নিজে নিজে ডাক্তারি করে কোন ঔষধ খাবে না কখনো।” বাবা বলল।
“ইস... পণ্ডিত আমার। শোন রন্তুকে নিয়ে আজ একটু নিউমার্কেটের দিকে যেতে হবে” মা বলল বাবাকে উদ্দেশ্য করে।
“কেন? ও বুঝেছি... ওর জন্মদিনের ড্রেসটা আনতে তো?” বাবা রন্তুর দিকে চেয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিল। মা দুই হাত দিয়ে মাথার দুই পাশ চেপে ধরল। রন্তু বাবা’র দিকে চেয়ে বলল,
“বাবা, তুমি মা’র মাথাটাতো একটু টিপে দিতে পার? তাই না?”
“না পারি না? তুমি দেখছ না আমার হাতে ময়দা মাখা... তোমাদের জন্য আলু-পরাটা বানাচ্ছি...”
“ইয়াক... আমি এটা খাই না...”
“তোমাকে কে দিচ্ছে...”
“ওমা! তুমি তো বললে তোমাদের জন্য বানাচ্ছি...”
“ঐটা তো কথার কথা”
“মা, ভালোই হল এখন থেকে বাবা রান্নাবান্না করবে, তুমি আর আমি আরাম করে খাব”

শায়লা ছেলের কথা শুনে খুব অবাক হল, রন্তু নিজের ভুল বুঝতে পেরে গুটিয়ে গেল। মনের ভেতরে কথা কথা খেলা খেলতে খেলতে কখনো জোরে কথা বলে ফেলেছে সে নিজেও টের পায় নাই। ইস... মা কি তাকে পাগল ভাববে? পাগল ছাড়া আর কে এমন উদ্ভটভাবে নিজের মনে কথা বলে? রন্তু মায়ের কোল হতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছাঁদের দিকে দৌড় লাগাল। শায়লা হতভম্ব হয়ে বসে রইল, রন্তু নিজে নিজে কথা বলে সে আগেও খেয়াল করেছে। বিড়বিড় করে কি যেন বলে, শায়লার মা বলে বাবার মত পাগল হবে, হাজার হলেও বাবার রক্ত শরীরে, বংশের দোষ। শায়লার এসব শুনতে ভালো লাগে না, রন্তুর জীবনে কোন অমানিশার ছায়া সে দেখতে চায় না। কিন্তু রন্তুর আজকের কথা শুনে শায়লা বুঝতে পারছে ছেলে মনে মনে তার বাবাকে মিস করে খুব। না না বাবাকে নয়, একটা পরিবার মিস করে... যেখানে শায়লা আছে, জাভেদ আছে, রন্তু আছে, আর আছে মিষ্টি সুখের এতোটুকু পরশ... এতটুকু নয়... এত্তগুলান। কিন্তু সেই স্বপ্নের জীবনতো সেই অতীতে শুরুর আগেই শেষ হয়ে হারিয়ে গেছে কালের গহবরে। আজ কোথায় সে, কোথায় জাভেদ। এর বেশী আর শায়লা ভেবে উঠতে পারল না। দুচোখ বেয়ে অশ্রুধারা’র সাথে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে চারদেয়ালের মাঝে।


১১.
আজ বহুদিন পর রন্তু এই হোটেলে ঢুকলো, সেই শেষবার বাবা যখন রন্তুর সাথে দেখা করতে এলো তারও আগে রন্তু এসেছিল এই হোটেলে। সেই বৃষ্টিভেজা দিনে, বাবাকে খুঁজতে অবুঝ শিশুমন রন্তুকে টেনে এনেছিল এই হোটেলে। সেদিন বাবাকে খুঁজে না পেয়ে অশ্রুসজল চোখে রন্তু এই হোটেলে থেকে বের হয়ে গিয়েছিল তুমুল বর্ষণের মাঝে। কিন্তু আজ রন্তু একা একা এসেছে, বাবার খোঁজে নয়, তার জ্যামিতি বক্সের ভেতরে জমানো টাকা দিয়ে মিষ্টি কিনতে। আজ রন্তুর রেজাল্ট দিয়েছে, বরাবরের মত ভালো রেজাল্ট করেছে। রেজাল্ট দেয়ার পরপরই তার মনে হয়েছে মিষ্টি কেনার কথা। বড়দের রেজাল্ট দেয়ার পর দেখা যায় কত মিষ্টি কেনা হয়, রন্তু’র শখ তার রেজাল্টেও মিষ্টি কেনা হোক। ইস... আজকে যদি বাবাটা দেখা করতে আসতো? কতই না মজা হত।

‘কি খবর রন্তু মিয়া, হাতে মিষ্টির প্যাকেট কেন?’
‘তুমি জানো না বাবা আজ আমার রেজাল্ট দিয়েছে’
‘ও হ্যাঁ তাইতো। তো কি ফেল করা হয়েছে নিশ্চয়ই’
‘বাবা!... আমি কখনো ফেল করেছি?’
‘ও হ্যাঁ তাইতো, রন্তু মিয়া তো খুব ভালো ছেলে, সে কখনো ফেল করতেই পারে না।’
‘বাবা তোমাকে না বলেছি আমাকে রন্তু মিয়া বলে ডাকবে না। মিয়া আমার নাম নাকি? বাসার দারোয়ান রহিম মিয়া চাচা’কে ডাকতে ডাকতে তুমি এখন আমাকেও রন্তু মিয়া ডাকছ... যাও তোমার সাথে কথা বলবো না’
‘আচ্ছা ভুল হয়েছে, আর রন্তু মিয়া বলে ডাকবো না। এখন থেকে তোকে রন্তু শেখ বলে ডাকবো, ঠিক আছে?’
‘আমি কি আরবের লোক নাকি বাবা, আমাকে শেখ বলে ডাকবে?’
‘ওমা! তুই দেখি আরবের লোকদের খবরও রাখিস’
‘হুমম... আমাদের সাধারণ জ্ঞান বইয়ে আরও অনেক কিছুই পড়ানো হয়। আমি আরও অনেক খবরই রাখি, হুহ...’

‘এই রন্তু কিরে একা একা বিড়বিড় করে কার সাথে কথা বলছিস?’ রন্তুর ছোট মামা শিবলি রন্তুর কাঁধে হাত রাখল, রন্তু কখন একা একা কথা বলতে বলতে বাসার কাছাকাছি চলে এসেছে সে নিজেও খেয়াল করে নাই। বাসার আগের বড় রাস্তার মোড়ে এখন রন্তু’র সাথে ছোট মামার দেখা। রন্তু খুব লজ্জা পেল, ছোট মামাও তাকে একা একা কথা বলতে দেখে ফেলল। কয়েকদিন আগে রাতের বেলা মা’ও দেখেছে। ছিঃ কি লজ্জা, সবাই তাকে পাগল ভাববে। রন্তু নিজের কাজে নিজেই খুব লজ্জিত হল। কিন্তু এই কথা কথা খেলা খেলতে রন্তু’র যে খুব ভালো লাগে। এই কাল্পনিক কথার জগতে রন্তু তার বাবা-মা’র সাথে তার স্বপ্নের কাল্পনিক এক জগত সাজায়, সেই জগত যেখানে রন্তু আর তার বাবা-মা তাদের নিজেরদের বাড়িতে অনেক সুখে বসবাস করছে।

রন্তু তার ছোট মামা শিবলির সঙ্গে একসাথে বাসায় ফিরল। নানু গেট খুলেই প্রশ্ন করল পাশ করেছিস? রন্তু’র মজা লাগলো। সে বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে আসছে, আর নানু সবসময় জিজ্ঞাসা করে পাশ করেছিস? নানু’র চিন্তা পাশ-ফেল নিয়ে, অন্য কিছুতেই নানুর কোন আগ্রহ নেই বুঝি। রন্তুর হাতে ছোট কাগজের প্যাকেট দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই ঠোঙায় কি?’। রন্তু নিচু স্বরে বলল, ‘মিষ্টি’। ‘ও... স্কুল থেকে দিয়েছে? বাহ ভালোই তো পাশ করলে মিষ্টিও দিচ্ছে ইদানীং স্কুলগুলো। ভালোই...’ রন্তু কিছু বলল না, নানুকে সত্যি কথা বললে নানু আবার বকাঝকা শুরু করে দিবে। তারচেয়ে আর কিছু না বলাই ভালো। রন্তু জামা-কাপড় ছাড়তে ভেতরের ঘরে চলে গেল।
রন্তু দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, বিকেল বেলা তার ঘুম ভাঙল। ঘুম থেকে উঠেই তার মন হল, আচ্ছা মাকে তো রেজাল্ট জানানো হয় নাই। মা কি বাসায় এসেছে? রন্তুর খুব ক্ষুধা পেয়েছিল, তাই আজ দুপুরের খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সদ্য এই বিকেল বেলায় কিছু করার নেই রন্তুর। নতুন ক্লাসে উঠেছে, স্কুলে ভর্তি... নতুন বই কেনা... এগুলোর ঢের বাকী আছে। এখন এই ফাঁকা সময়ে রন্তুর কিছুই করার নেই। বিকেল বেলা ছাঁদে গিয়ে বসে রইল সে, ছোট মামা তার ঘরে নেই। ছোট মামা বলেছিল বিকেলে রন্তুর সাথে দাবা খেলবে, কিন্তু কোথায় গেল কে জানে?

রন্তুদের বাসার ছাদ থেকে পেছনের দিকের একটা মাঠ দেখা যায়, প্রায় দিনই রন্তু সেই মাঠের মাঝে ছেলেদের খেলা দেখে। এখন শীতকাল বলে ছেলের দল ক্রিকেট খেলছে, গরমের দিনে ফুটবল খেলতে দেখা যায়, চলে বর্ষা’র শেষ অবধি। এরপর একটু শীত শীত ভাব পড়লে শুরু হয় ক্রিকেট খেলার ধুম। ছোট্ট রন্তুর খুব ইচ্ছা হয় ঐ ছেলেপেলেদের সাথে মাঠে গিয়ে খেলতে, কিন্তু নানু বা মা কেউই তাতে সায় দেয় না। বলে আরও বড় হয়ে নাও, এখন ঐসব খেলায় যাওয়ার দরকার নেই। নানু বলে মজার করে, ‘ঐ ধামরা ধামরা ছেলেদের সাথে তুই খেলবি কি? তোকে এক কিক মেরে এই বাড়ীর ছাদে পাঠিয়ে দেবে’। রন্তু ছাদের রেলিঙ্গের দেয়ালে তার থুতনি রেখে খেলা দেখতে লাগলো।

শায়লা ছাদে উঠে দেখে রন্তু ছাদের রেলিঙ্গের দেয়ালে মাথা রেখে একমনে মাঠের দিকে চেয়ে আছে। দেখে বড়ই মায়া হল। ছেলেটা একা একা সারাদিন কাটায়, কোন খেলার সাথী নেই, নেই কথা বলার সাথী। শায়লার মা থাকে সংসারের কাজে ব্যস্ত, শায়লা অফিসে, শিবলির কলেজ না থাকলে যদি বাসায় থাকে তবে রন্তু ছোট মামা’র ঘরে গিয়ে সময় কাটায়। শিবলিও রন্তুকে খুব ভালোবাসে, খুব আদর করে, এইটুকু পিচ্চিটার সাথে দাবা খেলতে বসে পড়ে। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে শায়লা ছাদে উঠে, এরকম বেশ কয়েকদিন সে আড়াল থেকে ওদের মামা-ভাগ্নের কথা শুনেছে। বড়দের মত কি রাশভারী কথাবার্তা এই পুচকেটার। শায়লার কলিজার টুকরা পুচকে সোনাটা।

শায়লা ধীর পায়ে রন্তুর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আস্তে করে নিজের বাম হাতটা রন্তুর কোঁকড়া চুলে বুলিয়ে দিল। রন্তু এতোটাই তন্ময় হয়ে খেলা দেখছিল যে কখন তার মা ছাদে এসেছে, কখন নীরবে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পায় নাই। মায়ের হঠাৎ করে এই স্পর্শে সে ভীষণ রকমে চমকে গেছে। রন্তু হাসি মুখে মায়ের দিকে চেয়ে দেখল। মা ডান হাতে করে কতগুলো গ্যাসবেলুন ধরে আছে। রন্তু অবাক হল মা বেলুন নিয়ে ছাদে কেন? আজকে কি রন্তুর জন্মদিন? নে সেতো সামনের মাসে। তবে...
‘কি মা? বেলুন কেন?’
‘তোর জন্য নিয়ে এলাম... সুন্দর না?’
‘হুমম, সুন্দর। কিন্তু বেলুন দিয়ে আমি কি করব?’
‘এটাও একটা ভালো কথা। বেলুন দিয়ে কি করবি... এক কাজ করা যেতে পারে একটা একটা করে বেলুন ফুটিয়ে ফেল’
‘যাহ, শুধু শুধু বেলুন ফুটাতে যাব কেন? মা এগুলো কি গ্যাস বেলুন?’
‘হুমম, গ্যাস বেলুন। কেন?’
‘ওয়াও, তাহলে চল এইসব কটা বেলুন উড়িয়ে দেই।’
‘বেলুন উড়াতে মজা লাগে তোর?’
‘কি জানি কখনো উড়াই নি তো। মাঝে মাঝে আকাশে উড়ে যেতে দেখি। জানো মা কয়েকদিন আগে রাতের বেলা আগুন দেয়া গ্যাস বেলুন উড়েছিল আকাশে। ছোট মামা আর আমি দেখেছি। কি যেন নাম ছিল...’
‘ফানুশ... চল নীচে চল সন্ধ্যা হয়ে আসেছে।’

মায়ের সাথে ছাদ থেকে নামতে নামতে রন্তু দেখলো কে যেন আকাশে একটা লাল রঙের ঘুড়ি উড়িয়েছে। কেন জানি রন্তুর ঘুড়ি খুব ভালো লাগে, বিশেষ করে সুতো কাটা ঘুড়ি, যখন ছুটতে থাকে ঐ নীলাকাশে অজানা গন্তব্যের পাণে। আজকের এই গ্যাস বেলুনগুলোও ভালো লাগছে রন্তুর। তাহলে? গ্যাস বেলুন নাকি সুতোকাটা ঘুড়ি, কোনাটা বেশী ভালো লাগে তার? রন্তু নিজেও হয়ত জানে না, অথবা এভাবে ভাবে না। দুটোই বাঁধাহীনভাবে উড়ে যায় নীল দিগন্তপানে। কিন্তু দুটোই একসময় নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। তবে গ্যাস বেলুন যতটা উপরে উঠে অবাক বিস্ময়ে পৃথিবীকে দেখার সুযোগ পায় সুতো কাটা ঘুড়ি কি ততটা পায়? কিন্তু রন্তু’র নিজেকে সুতো কাটা ঘুড়ি ভাবতে ভালো লাগে। একসময় সুতোর বাঁধনে নাটাইয়ের সাথে বাঁধা ছিল মায়াবী এক সম্পর্কের বাঁধনে, তারপর কোন এক ঝড়ে সম্পর্কের সুতো কেটে গিয়ে নীল আকাশের অজানা গন্তব্যে উড়াল দেয়া। পরিবার নামক নাটাইয়ের সাথে যে বাঁধনে রন্তু বাঁধা ছিল সেই বাঁধন ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে কি রন্তুও সুতো কাটা ঘুড়ি হয়ে ঘুরে বেড়াবে সমাজ নামক বিশাল আকাশে? সময়ই সব বলে দেবে...


১২.
মায়েদের গায়ে এক অজানা গন্ধ থাকে বোধহয় আর সেই গন্ধটি পায় শুধুমাত্র সেই মায়ের সন্তানেরা। এই গন্ধ এক মায়ার অদৃশ্য বন্ধনের গন্ধ, নাড়ির সম্পর্ককালীন যে গন্ধ মাতৃজঠর থেকে সন্তানের ইন্দ্রিয়ে বাসা বাঁধে। আশ্চর্য এক ঘোরলাগা মাদকতাময় সেই ঘ্রাণে প্রতিটি সন্তান খুঁজে পায় অপার্থিব এক সুখানুভুতি। এই মুহূর্তে রন্তু নিজ মনে মায়ের শরীরের সেই গন্ধটা উপভোগ করছে। ছোট্ট রন্তুর খুব ভালো লাগে মন ভালো করে দেয়া এই পরম প্রিয় গন্ধটি। রন্তু এই মুহূর্তে মায়ের হাত ধরে হাঁটছে নিউমার্কেটের ভেতরের পিচঢালা রাস্তা ধরে। মা সবসময় এই মার্কেটে শপিং করতে আসে। আজ রন্তু মায়ের সাথে এসেছে তার স্কুলের জন্য নতুন ড্রেস তৈরির মাপ দিতে। ছোট মামা যদিও মা’কে বলেছিল তার পরিচিত এক দোকানে নিয়ে গিয়ে জামা বানিয়ে দিবে, কিন্তু মা রাজী হয় নাই। সবসময় যে দোকান থেকে রন্তুর জামা তৈরি করিয়ে দেয় সেই দোকান থেকেই এবারো জামা বানাবে বলে মামাকে জানিয়ে দেয়।

রন্তু অবশ্য এতে খুব খুশী, কেননা মা’র সাথে যখনই নিউমার্কেট আসে মা তাকে নিউমার্কেট দুই নম্বর গেটের ফাস্টফুডের দোকান থেকে মেশিনে তৈরি কোণ আইসক্রিম কিনে দেয়। তাই এখান থেকে জামা বানালে দু’বার কোণ আইসক্রিম খাওয়া যায়, একবার মাপ দিতে যেদিন আসে আর আবার যেদিন জামা নিতে আসে। মা সবসময় জামা ডেলিভারি নেয়ার দিনও রন্তুকে নিয়ে আসে, নতুন জামা রন্তুর গায়ে চাপিয়ে দেখে নেয় সব ঠিক আছে কিনা? মা সবসময় রন্তু ধমক দেয়, রন্তু নাকি তালগাছের মত দিন দিন বড় হয়ে যায়। কোনদিন দেখা যাবে জামা’র মাপ দিয়ে গেল একরকম আর ডেলিভারি নেয়ার সময় সে বড় হয়ে যাওয়ায় তা আর তার গায়ে আঁটছে না।

শায়লা ছেলেকে নিয়ে হাঁটছে আনমনে। আজ তার মনটা ভালো নেই, ভালো নেই বলাটা বোধহয় ঠিক না, বলা যেতে পারে মেঘলা। বিষণ্ণ নয়, তবে তার খুব কাছাকাছি, সাথে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি। গত কিছুদিন ধরে ইরফান আর তার সম্পর্ক নিয়ে অফিসে নানান কথা হচ্ছে, অথচ তেমন কোন সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক তাদের মাঝে আছে বলে সে মনে করে না। যদিও ইরফান আর শায়লা দুজনই দুজনকে পছন্দ করে, কিন্তু তাদের মাঝে আনুষ্ঠানিক কোন প্রেমালাপ হয়েছে এমনটা নয়, ইরফান তাকে আনঅফিশিয়ালি প্রপোজ করেছে এটা ঠিক। কিন্তু শায়লা কৌশলে সেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে, এটা না করে তার আর কিই বা উপায় আছে। তার পেছনে ফেলে আসা জীবন, জাভেদের সাথে পেছনের স্মৃতিময় জীবন, স্মৃতিময় বলা যায় কি? স্মৃতি’র চেয়ে এখন বেশী মনে পরে দুঃস্মৃতির সময়গুলো। কত স্বপ্ন, কত ভালবাসার সম্পর্ক কিভাবে যেন কোন ফাঁকে দুঃস্বপ্ন আর যন্ত্রণার উপাখ্যান হয়ে গেল।

রন্তু’র মুখের দিকে চেয়ে শায়লা সব দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করে যায় অবিরত। মাঝে মাঝে খুব যখন অস্থির লাগে নিজের ভেতরটা, তখন মনে হয় এই কষ্টময় জীবন ছেড়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যায়, অনেক দূরে। যেখানে তার কষ্টের অতীত ভুলেও উঁকি দিবে না কখনো। সেই অস্থির সময়ে মাঝে মাঝে ছোট্ট ছেলেটার উপর শায়লার খুব রাগ হয়, এই পিছুটান না থাকলে আজ তার জীবনটা কি আবার নতুন করে শুরু করা যায় না? কিই বা তার বয়স হয়েছে, এখনও ত্রিশ পেরোয়নি, তার সমবয়সী অনেক আত্মীয়া এখনো অবিবাহিত অবস্থায় হনহন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর শায়লা কি না এই ছোট্ট সময়ে জীবনের সব রূপ দেখে যেন বুড়িয়ে গেছে। মনের এই দোলাচালের সময়ে যোগ হয়েছে ইরফান, না পারে ইরফানকে জীবনে টেনে নিয়ে আঁকড়ে ধরে নতুন করে সব শুরু করতে, না পারে তাকে ঝেড়ে ফেলে দিতে।
‘মা... মা... চশমা...’ চশমা’র দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে রন্তু শায়লা’র হাত নেড়ে ইশারা করল।
‘হুমম চশমা... তো কি হয়েছে’
‘তুমি বলেছিলে আমাকে চশমা কিনে দিবে’
‘কবে বলেছিলাম?’
‘রেজাল্ট যেদিন দিল... ওমা আজকে দাওনা কিনে...’
‘না... এই ছেলে তোর কি চোখে সমস্যা হয়েছে যে তুই চশমা পড়বি? এইটুকুন বয়সেই চশমা শখ। বড় হয়ে নে, তখন দেখবি এমনি এমনি চোখে চশমা দিতে হবে’
‘কেন? বয়স হলে কি চশমা পড়তে হয়? তো তুমি, ছোট মামা... তোমরা পড় না কেন?’
‘আমাদের চোখের পাওয়ার অনেক ভাল, তাই’
‘আমারও চোখের পাওয়ার ভাল’
‘তাহলে তো হলই, নো চশমা। চশমা হল চোখের সমস্যার জন্য বুঝেছিস’
‘হুমম... কিন্তু তুমি বলেছিলে আমায় চশমা কিনে দিবে’ রন্তু গাল ফুলিয়ে কথাগুলো বলে গম্ভীর হয়ে গেল। ছেলের জামার মাপ দিয়ে শায়লা মার্কেটে একবার চক্কর দিচ্ছিল। এই বিকেলবেলা বাসায় গিয়ে আর কি করার আছ? সেই চারদেয়ালে বন্দী হয়ে বসে থাকা। তারচেয়ে নিউমার্কেটের এই খোলামেলা চত্বরে ছেলেকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগছে। রন্তুকে নিয়ে দুই নাম্বার গেটের ফাস্টফুডের দোকানের দিকে হাঁটা আরম্ভ করতেই শায়লার নজরে এল। ইরফান দুই নাম্বার গেটের সেই ফাস্টফুডের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শায়লা’র সাথে চোখাচোখি হতে সুন্দর করে একটা হাসি দিল, এই হাসি দেখলেই শায়লার বুকে একটা তরঙ্গ খেলে যায়। কিন্তু কেন? শায়লা কখনোই চায় না এমনটা হোক, তবু ইরফান তার সামনে আসলেই তার ভেতরে এই তরঙ্গের খেলা শুরু হয়ে যায়। অফিসে যখনই সে ইরফানের মুখোমুখি হয়, সে নিজেকে চেষ্টা করে স্বাভাবিক রাখতে। তার মনে হয় এই বুঝি তার আশেপাশের সবাই জেনে যাচ্ছে, সবাই তার প্রতিটি হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে।

আর এখনতো ছেলে রন্তু সাথে রয়েছে। শায়লা’র কেন যেন খুব রাগ হচ্ছিল, ইরফান কেন এখানে এল? শায়লা আজ অফিস থেকে একটু আগে বের হয়েছে, সে যখন এমডি স্যারকে বলছিল আগে বের হয়ে যাবে আজ, ছেলেকে নিয়ে নিউমার্কেট যেতে হবে; তখন ইরফান সেখানে ছিল। আর সেই সুযোগটা সে নিয়েছে। গত সপ্তাহ দুয়েক শায়লা ইরফানকে যথা সম্ভব এড়িয়ে চলেছে। এতদিন দুজনার ভালো লাগা দুজন জানতো, অনুভব করতো, কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কাউকে কিছু বলে নাই। কিন্তু সপ্তাহ দুয়েক আগে ইরফান যখন শায়লাকে সরাসরি তার মনের কথা বলে ফেলল, কেন জানি শায়লা’র কাছে ভালো লাগেনি। অদ্ভুত মানুষের মন, শায়লা কেন ব্যাপারটায় অসন্তুষ্ট সে নিজেও বুঝতে পারছে না। সে শুধু জানে, তার ভালো লাগেনি। ইরফান শায়লার মনোভাব বুঝে সরি বলেছে বেশ কয়েকবার, অফিসের বাইরে শায়লার সাথে দেখা করতে চেয়েছে, কিন্তু শায়লা সবসময়ই তা এড়িয়ে গেছে। শায়লা নিজের মনের এই দ্বৈত আচরণে নিজেই খুব মনঃকষ্টে আছে। সে নিজেকে সময় দিতে চায়, নিজের মনের সাথে তার আরও বোঝাপড়া করার দরকার আছে। ইরফান বুঝতে পারেছে না, ইরফানের এই অতি আগ্রহী হয়ে ওঠাটা শায়লার ভালো লাগছে না। সময়ের স্রোতে যদি তাদের গন্তব্য একই ঘাটে হয়ে থাকে, তবে তাই হবে। অন্যথায় না...

শায়লা রন্তুকে নিয়ে ফাস্টফুডের দোকানে পৌঁছতেই ইরফান এগিয়ে এল তাদের দিকে। শায়লা নিজেকে সামলে নিয়েছে মনে মনে, রন্তুর সামনে কোন ধরণের রিঅ্যাক্ট করা যাবে না। শায়লা জানে, তার ছেলে ছোট্ট হলে কি হবে, এই বয়সেই তার মানসিক গঠন অনেক পরিপক্ক। ছেলে বুঝতে পারে অনেক কিছুই, যা তার সমবয়সী ছেলেমেয়েরা বুঝবে না।
‘আরে ইরফান স্যার, আপনি এখানে’ শায়লা ইরফানকে দেখে অবাক হবার ভান করল।
‘এইতো, অফিস শেষে কিছু কেনাকাটা করতে চলে এলাম’
‘অফিস হতে এই মার্কেট একটু উল্টো পথ হয়ে যায় না? মৌচাক মার্কেটতো আপনার বাসার পথে... বিশেষ কিছু কেনাকাটা ছিল বুঝি...’ শায়লা ইচ্ছে করে ইরফানকে অপ্রস্তুত করে দিল।
‘হ্যাঁ, কিছু বই কেনার ছিল, নিউমার্কেট ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না বইগুলো।’
‘আমি এলাম ছেলের স্কুলের জামা বানাতে দিতে। রন্তু আঙ্কেলকে সালাম দিয়েছো?’ শায়লা রন্তুর দিকে চাইতে রন্তু ইরফানের দিকে ফিরে হাত তুলে সালাম দিল। ছেলের সালাম দেয়ার ভঙ্গি দেখে শায়লা হেসে ফেলল, তার সাথে ইরফানও হেসে উঠলো।
‘তো রন্তু, স্কুলের নতুন জামা বানাতে দেয়া হল?’
‘হুম...’
‘এখন কি কোণ আইসক্রিম খাবার পালা’
‘হুম...’
‘আমাকেও কি একটা আইসক্রিম খাওয়াবে তোমাদের সাথে?’
‘হুম...’
‘ওমা! তুমি কি সব কথার উত্তর ‘হুম’ দিয়েই দাও?’
‘হুম...’

রন্তুর হুম... শুনতে শুনতে আবারো শায়লা আর ইরফান হেসে উঠল। তাদের অজান্তেই পরিবেশটা হালকা হয়ে গেল। ইরফান তিনটে মেশিন কোণ আইসক্রিম এর অর্ডার দিয়ে রন্তুর কাছে এসে দাঁড়ালো। ঢাকা শহরে এখন এই দোকানেই একমাত্র মেশিন কোণ আইসক্রিম পাওয়া যায়। ইরফানের খুব পছন্দের জায়গা, শায়লারও... তবে তারা দুজনে কখনো একসাথে আইসক্রিম খায় নাই বাইরে কোথাও। আজ ইরফানের সাথে এই বিকেল বেলা নিউমার্কেটের এই চত্বরে কোণ আইসক্রিম খেতে খেতে শায়লা ভুলে যায় তার অতীত, তার দুঃখগাঁথা পেছনের জীবনের কথা। ইরফানকে ঘিরে মনে মনে কতশত কল্পনার খেলা তখন দানা বাঁধতে শুরু করেছে শায়লার হৃদয়ের গোপন ঘরে। এদিকে ইরফান ব্যস্ত রন্তুকে ঘিরে।
‘রন্তু কোণ আইসক্রিম নাকি চকবার আইসক্রিম কোনটা বেশী মজার বলতো?’
‘কোণ আইসক্রিম’
‘ওমা তুমি দেখি ‘হুম’ ছাড়াও কথা বলতে পার!’

রন্তু লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিল। লজ্জা পেয়েছে কিন্তু কথা বলার জন্য না। ইরফানকে কেন জানি রন্তুর বাবা বলে মনে হচ্ছে। বাবা তাদের সাথে থাকলে এমন করে হয়ত কথা হত রন্তুর সাথে। শেষ যেদিন বাবা স্কুলে দেখা করতে এল, সেদিন স্কুল হতে বাবার সাথে এই নিউমার্কেটে এসেছিল রন্তু। বাবা তাকে একটি বাইনোকুলার কিনে দিয়েছিল, জন্মদিনের অগ্রিম উপহার হিসেবে। তারপর আজ অনেকদিন হল বাবার সাথে আর রন্তুর দেখা হয় নাই। রন্তু মনে মনে এখন মাঝে মাঝে বাবার সাথে কথা বলে, তবে খুব সাবধানে। নানু, মা বা ছোট মামা দেখে ফেললে তাকে পাগল ভাববে বলে সে খুব সাবধান থাকে। আজ এই লোকটাকে কেন জানি রন্তুর বাবা বলে মনে হচ্ছে। বাবা বুঝি বহুদিন পর মা’র সাথে দেখা করতে এসেছে। রন্তু হাসি হাসি মুখ করে আইসক্রিমে মুখ দিল। শেষ বিকেলের মায়াবী আলোয় রন্তুর মুখখানি ঝলমল করতে লাগলো। পাশে শায়লা আর ইরফান নিজেদের মাঝে কথোপকথনে মত্ত। এই বিকেলে আগত কোন এক বিকেলের বীজ বপন হয়ে গেল কি? সেই আগত বিকেলে এরা তিনজন একসাথে আবার কোন আইসক্রিম পার্লারে আইসক্রিম খেতে খেতে জীবনের সব পঙ্কিলতাকে পেছনে ফেলতে পারবে কি না তা ভবিষ্যতই বলে দিবে।


১৩.
বাতাসের শো শো শব্দে পুরো রিকশাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে, বৃষ্টির ফোঁটা থেকে রক্ষা পেতে যে প্লাস্টিকের পর্দাটা দেয়া ছিল সেটা হাত ফস্কে ছুটে গিয়ে পতাকার মত পতপত করে উড়ছে। বৃষ্টিটা বিপরীত দিক থেকে আসছে বলে রন্তুর পুরো শরীর ভিজছে না, শুধুমাত্র কোমরের নীচের অংশে ঠাণ্ডা বৃষ্টির ফোঁটা তীরের মত বিঁধছে। গোদের উপর বিষ ফোঁড়ের মত হাতে থাকা খাবারের প্যাকেটটা সামলাতে হচ্ছে রন্তুকে। এই প্যাকেট সামলাতে গিয়েই হাত থেকে পর্দাটা ছুটে গেল। রিকশার হুডের সাথে আটকানো থাকায় তা উড়ে চলে না গিয়ে রিকশার সাথে পতপত করে উড়ছে পতাকার মত।

আজ রন্তুর জন্মদিন, তাই ছোট মামা শিবলী’র সাথে পুরাতন ঢাকার চকবাজারে এসেছে কিছু খাবার দাবার আর বেলুনসহ আরও কিসব কিনতে। মিষ্টি আর বিস্কিটের প্যাকেট রন্তুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে মামা গেছে আগে থেকে অর্ডার করে রাখা কেকটা নিয়ে আসতে। বাসা থেকে বের হওয়ার পরপরই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। তাই ছোট মামা রিকশা ছেড়ে না দিয়ে বেশী ভাড়ার বিনিময়ে রেখে দিয়েছিল রিকশাওয়ালাকে। ছোট মাম এই হালকা বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সব দোকান থেকে সবকিছু কিনছিল আর এনে রন্তুর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছিল। একবারের জন্যও রন্তুকে রিকশা হতে নামতে হয় নাই। কিন্তু ছোট কেক আনতে যাওয়ার পরপরই শুরু হলে তুমুল বৃষ্টি সাথে প্রচণ্ড বাতাস। রিকশাওয়ালা রন্তুকে বসিয়ে পাশের একটা দোকানের ঝাঁপের নীচে চলে গেল আশ্রয় নিতে। এখন রন্তু বসে বসে একা একা ভিজতে লাগলো।

শিবলী হাতে কেক নিয়ে কিংকর্তব্যবিমুর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, এই কাগজের বক্সে ভরা জন্মদিনের কেক নিয়ে কোন মতেই এই তুমুল বৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে রিকশা পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব নয়। সাথে ছাতাও নেই, আর ছাতা থাকলেও কোন লাভ হতে বলে মনে হয় না। উফ... বৃষ্টি হওয়ার আর সময় পেল না। রন্তুকে একা রিকশায় বসিয়ে রেখে এসেছে, তাই চিন্তা আরও বেশী। বৃষ্টিতে ভিজে গেল কিনা কে জানে? ছেলেটার আবার ঠাণ্ডার ধাত আছে, অল্পতেই সর্দিজ্বর বাঁধিয়ে বসে। তারউপর হাতে ধরিয়ে দিয়ে এসেছে খাবারের প্যাকেটগুলো।

প্রায় মিনিট দশকে ঝরার পর বৃষ্টি একেবারে থেমে গেল। শিবলী দ্রুত রিকশার দিকে হাঁটতে লাগলো হাতে কেক নিয়ে। আকাশে এখনো অনেক মেঘ রয়েছে, কালো মেঘ ভেদ করে মাঝে মাঝে বিজলী চমকাচ্ছে। রিকশার কাছে এসে দেখে রন্তু প্রায় ভেজা শরীরে রিকশায় বসে আছে। কিন্তু কোন এক দুর্ভেদ্য উপায়ে খাবারের প্যাকেটগুলো শুকনো আছে।
‘কিরে একেবারে যে ভিজে কাক হয়ে গেলি? পর্দা ছিল কই?’
‘পর্দা পতাকা হয়ে উড়ছিল’ ফিক করে হেসে উত্তর দিল রন্তু। তার সাথে সাথে রিকশাওয়ালাও হাসছে। যেন খুবই আনন্দের কোন খবর দিচ্ছে।
‘হাসি বের হবে একটু পরে, সর্দিজ্বর নিয়ে আবার বিছানায় থাকবি আর নানুর দেয়া দুধ পাউরুটি খাবি’ রন্তুকে খ্যাপানোর জন্য শিবলী কথাগুলো বলতে বলতে রিকশায় উঠে বসল। দুধ পাউরুটির কথা শুনতেই রন্তু মুখ কুচকে ফেলল। এই অপছন্দের খাবারটি প্রতিবার জ্বর এলেই নানু টাকে জোর করে খাইয়ে ছাড়বে। ছোট মামা উঠে বসতে রিকশাওয়ালা রিকশা চালাতে শুরু করল। কেক কেনার ফাঁকে ছোট মামা আরও অনেক কিছু কিনে ফেলেছে। হাতে অনেকগুলো আরও ছোট ছোট প্যাকেট ভর্তি ব্যাগ। ঝিরঝির ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, কেমন একটা অদ্ভুত পরিস্কার চারিপাশ। রন্তু খেয়াল করে দেখেছে প্রতিবার বৃষ্টি শেষে চারিপাশ কেমন অদ্ভুত রকমের সুন্দর হয়ে যায়। মনে হয়ে টেলিভিশনে দেখা কোন সিনেমার দৃশ্য, কেন এমনটা মনে হয় রন্তু জানে না। কিন্তু প্রতিবার বৃষ্টি শেষে সে দৌড়ে ছাঁদে চলে যায়, অজানা কোন এক সুন্দরের টানে।

আধভেজা শরীরে রন্তু শিবলীর সাথে বাসায় ঢুকলো, নানু গেট খুলেই শুরু করল চেঁচামেচি। আজ কিন্তু রন্তুর সাথে নয়, চেঁচাচ্ছে ছোট মামার সাথে। আজ রন্তুর জন্মদিন আর এই দিনে ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজিয়ে আনায় নানু আচ্ছামত বকা দিচ্ছে ছোট মামাকে। রন্তু কোন কথা না বলে ভেজা জামাকাপড় ছাড়তে ভেতরে চলে গেল।

রন্তুর মা রন্তুর জন্য আজ স্পেশাল চিকেন ফ্রাই ভাঁজছে। রন্তু খুব পছন্দ করে চিকেন ফ্রাই। ছেলেটার পছন্দের তালিকা খুবই ছোট। খাবার দাবারে তেমন কিছু আগ্রহ দেখা যায় না, শুধুমাত্র এই চিকেন ফ্রাইটাই তার খুব পছন্দ। যখনই তাকে নিয়ে বাইরে গেছে চিকেন ফ্রাই আর আইসক্রিম এই দুটো পেলেই সে খুশী। তেমন কোন খেলনা বা অন্য কিছু কখনো চায় না। অবশ্য ছেলেটা যে ধরেনের চাপা স্বভাবের আর এই ছোট বয়সেই অনেক বেশী পরিণত তাতে করে কোন কিছু পছন্দের থাকলেও কখনো মুখ ফুটে বলবে না। রন্তু জামা পাল্টে রান্না ঘরের দাওয়ায় এসে দাঁড়ালো। মা মুরগীগুলোকে মেয়নেট করছে, রাতে খাবারের আগে গরম গরম ভেঁজে দেবে। রন্তুর চাহনী দেখে শায়লা বুঝলো ছেলের লোভ হচ্ছে চিকেন ফ্রাই এর জন্য, কখন খাবে এই চিন্তায় সে অধীর।
‘কিরে? লোভ হচ্ছে?’
‘হুম’
‘কাঁচা খাবি একটা? দেব?’
‘ইয়াক...’
‘ইয়াক কেন? এই জিনিষতো তেলে ভেঁজে দিলে ঠিকই গপাগপ খাবি’
‘তুমি খাও কাঁচা চিকেন’

রন্তু ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো, আকাশে মেঘের দল সরে গিয়ে সূর্য উঁকি দিয়েছে। রন্তু ছাঁদের রেলিঙ্গে হেলান দিয়ে চারিপাশ দেখতে লাগলো। আজ রন্তু সাত বছর পূর্ণ করেছে, সে যে কবে বড় হবে? ছোট মামার মত বড়, তার আলাদা একটা ঘর থাকবে, ঠিক ছোট মামার ঘরের মত। সেই ঘর জুড়ে থাকবে রন্তুর নানান শখের জিনিষপত্রে ঠাসা। মা মাঝে মাঝে তার ঘরে ছুটে আসবে এটা সেটা খাবার নিয়ে, কখনো চা নিয়ে। সিগারেট... ইয়াক ছিঃ... ছোট মামাটা লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খায়, রন্তু দেখেছে। রন্তু কখনো সিগারেট খাবে না বড় হয়ে, বিশ্রী গন্ধওয়ালা এই জিনিশ মানুষ খায় কিভাবে? আচ্ছা বাবা কি সিগারেট খায়? রন্তুর জানা নেই... মাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে।

বাবাও মাঝে মাঝে তার রুমে এসে সিগারেট খেতে পারে... সে নিষেধ করবে না। বাবা গম্ভীর হয়ে সিগারেট খাচ্ছে রন্তু যেন চোখে দেখতে পেল। ঠিক তখনই রন্তুর মনে পড়ল, বাবা এখন আর তাদের সাথে থাকে না। সেই কবে বাবা তাকে অগ্রিম জন্মদিনের গিফট কিনে দিয়ে চলে গেল, আর আসে নাই স্কুল গেটে দেখা করতে। বাবার জন্মদিনের সেই গিফটের কথা মনে হতেই রন্তু নীচে নেমে আসল। মায়ের কাছ থেকে চেয়ে বাইনোকুলারটা নিতে নীচে নামা, বাবা মাস দুয়েক আগে এই বাইনোকুলারটা তাকে জন্মদিনে অগ্রিম গিফট হিসেবে দিয়ে গেছে। এই বৃষ্টি শেষের চারিপাশটা বাইনোকুলারে দেখতে কেমন লাগবে ভাবতে ভাবতে রন্তু আবার মা’র কাছে গেল।
মা ঘর গুছাচ্ছে, একটু পর ছোট মামা বেলুন দিয়ে ঘর সাজাবে। মা’র পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এর আগে বাবা’র দেয়া ঘড়িটার কথা বলায় একবার মা খুব বিরক্ত হয়েছিল। এখন বাইনোকুলারটা চাইলে মা না আবার রাগ করে।
‘কিরে? কিছু বলবি?’
‘হুম’
‘কি? বলে ফেল? জ্বর বাঁধিয়েছিস? দেখি এদিকে আয়...’ বলে শায়লা ছেলের কপালে হাত ছোঁয়াল, নাহ জ্বর আসে নাই।
‘কি বলবি বলে ফেল?’
‘মা... বাইনোকুলার...’
‘বাইনোকুলার? কিসের বাইনোকুলার?’
‘ঐ যে, বাবা দিল...’
‘ও...’ বলে শায়লা আলমারির উপরের তাক থেকে প্যাকেটটা নামিয়ে ছেলের হাতে দিল। রন্তু দেখল মা’র মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে। রন্তু প্যাকেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মা রাগ করেছে রন্তু এখন বাবা’র দেয়া গিফটের বাইনোকুলারটা এখন চাওয়ায়। রন্তু শায়লার দিকে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে বলল,
‘মা, প্যাকেটটা রেখে দাও।’
‘ওমা কেন?’
‘এমনি...’
‘এইমাত্র চাইলি, এখনই আবার ফেরত দিচ্ছিস... সমস্যা কি?’
‘না... ভেবেছিলাম ছোট মামা’র সাথে ছাঁদে গিয়ে বাইনোকুলার দিয়ে চারপাশটা দেখব। কিন্তু ছোট মামাইতো এখন ঘর সাজাবে বেলুন দিয়ে। তাই...’

শায়লা ছেলের হাত থেকে প্যাকেট নিয়ে আবার আগের জায়গায় রেখে দিল। ছেলেটা বাবার মায়া কাটাতে পারছে না, তার মনে বাবার জন্য বিশাল একটা অংশ রয়ে গেছে। জাভেদ যদি তা বুঝত... ছেলের দিকে চেয়ে সে নিজেকে বদলাতে পারত, তা সে করে নাই। তার নিজের ইগো, একরোখা স্বভাবের জন্য আজ শায়লা আর রন্তু থেকে সে কত দূরে। মানসিক সমস্যাকে সে জাভেদ কখনো স্বীকার করে নাই, স্বীকার করে চিকিৎসা করালে সব মানসিক রোগেরই সমাধান আছে। কিন্তু তার আগে যার রোগ তাকে বুঝতে হবে সে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। কিন্তু জাভেদ তা কখনোই মনে করে নাই। যদিও এখন তার মানসিক সমস্যা সারল কি না তা নিয়ে শায়লা মোটেও চিন্তিত নয়। কিন্তু এক সময় যাকে ভালোবেসেছে, সংসার করেছে, সেই মানুষটি’র এতটুকু কল্যাণতো সে কামনা করতেই পারে। শায়লা সবসময় চিন্তিত রন্তুকে নিয়ে। ছেলেটা মনে মনে বাবা-মা নিয়ে একটা পরিবার খুব মিস করে তা শায়লা এখন বুঝতে পারে। চাপা স্বভাবের বলে সে কাউকে কিছু বলে না, কিন্তু শায়লা মা হিসেবে তা বুঝতে পারে। কিন্তু সে কি করবে? জীবন যে মাঝে মাঝে খবু বেশী নির্মম। তাইতো আজ রন্তু আর সে জাভেদ হতে অনেক দূরে, একই শহরে থেকেও যোজন যোজন মাইল দূরে যেন।


১৪.
ব্যাথায় রন্তু কুঁকড়ে উঠলো, হাঁটুর কাছটায় চামড়া ছড়ে গিয়ে হালকা রক্ত বেড়িয়েছে। রন্তু দৌড়চ্ছিল ঠিকই, কিন্তু কিসে যেন পা একটু আটকে গিয়ে মনে হল পেছন থেকে জোরে কেউ ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিল। ভারসম্য হারিয়ে প্রায় তিনচারটা ডিগবাজী মত খাবার পর সে স্থির হল। প্রথমে ব্যাথার চেয়ে লজ্জা পাচ্ছিল বেশী, ব্যাথার তীব্রতা ধীরে ধীরে উপলব্ধি হওয়ার পরপরই তার চোখ মুখ কুঁকড়ে উঠলো। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে পায়ে, রন্তু ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। তার পা’টা না আবার ভেঙ্গে গেল, সে এই ভাঙ্গাটাঙ্গা খুব ভয় পায়। বছর খানেক আগে ছোট মামার পা ভেঙ্গেছিল, উফ... কি যে ভীষণ কষ্ট। রন্তু ভয়ে কেঁদে দিল। তার কান্না দেখে গেম টিচার ছুটে এল তার কাছে।
‘এই রন্তু, খুব বেশী ব্যাথা পেয়েছিস’
রন্তু মাথা নেড়ে জানালো হ্যাঁ।
‘ইস... চামড়া ছড়ে গেছে দেখি। দৌড়তে গিয়ে পড়ে গেলি কীভাবে?’
‘ম্যাডাম কে যেন পেছন থেকে মনে হল ধাক্কা দিয়েছিল’
‘আবার মিথ্যা কথা বলিস, গাধা কোথাকার। সবার শেষে ছিলি তুই, তোকে আবার কে ধাক্কা দিবে? আমিতো ভালো মতই সব দেখছিলাম।’
রন্তু কোন কথা বলল না, চুপচাপ চোখের জল ফেলতে লাগলো।
‘নে উঠে দাঁড়া এবার’
‘ম্যাডাম পারবো না, আমার পা ভেঙ্গে গেছে’
‘মানে! পা ভাঙলো কীভাবে? তুই দাঁড়া দেখি।’ ম্যাডাম হাত ধরে রন্তুকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। রন্তু দাঁড়িয়ে কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটার পর দেখল সে ঠিকঠাক হাঁটতে পারছে।
‘এই তো হাঁটতে পারছিস, পা ভাঙল কোথায়? ভীতুর ডিম কোথাকার, কিছু হলেই ভ্যা করে শুধু কান্না আসে?’

রন্তু কোন কথা বলল না, চুপচাপ হেঁটে হেঁটে মাঠের কিনারের দিককার ছাতিম গাছটার নীচে এসে বসল। সে নিজে কিন্তু কোন খেলায় অংশ নিতে চায় নাই। এইসব দৌড়ঝাঁপ তার ভালো লাগে না, কিন্তু বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তাকে অংশগ্রহণ করতেই হবে। এমনটাই নাকি নিয়ম, স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হয়। তাই গেম টিচার জোর করে তার নাম দৌড় প্রতিযোগিতায় দিয়ে দিয়েছে। রন্তুর এসব খেলা মোটেও ভালো লাগে না, তার ভালো লাগে গান, কবিতা, গল্প বলা এসব। রন্তু সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছে। তার ইচ্ছে ছিল সবকয়টায় নাম দেয়ার, কিন্তু একজন নাকি তিনটার বেশী বিষয়ে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তাই সে কবিতা আবৃত্তি, ছবি আঁকা আর গল্প লেখা এই তিনটায় নাম দিয়েছে। আজ সকালে সে তার নিজের লেখা গল্পটা জমা দিয়েছে। রন্তু, মা আর বাবা, এই তিনজনকে নিয়ে একটা গল্প, যেখানে তারা সবাই মিলে সাগর দেখতে গেছে। সেখানে গিয়ে রন্তু হঠাৎ হারিয়ে গেল ভিড়ের মাঝে, তারপর অনেক কষ্টে তার বাবা-মা তাকে খুঁজে পায়। এই নিয়ে লেখা গল্প, রন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে লিখেছে।

আগামী পরশু স্কুল মাঠে মূল অনুষ্ঠান, আজ শেষ দিনের বাছাই চলছিল। রন্তুর ইচ্ছা ছিল যেমন খুশী তেমন সাজো প্রতিযোগিতায়ও অংশ নেয়ার। এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না, ইচ্ছে হচ্ছে কবিতা, আর ছবি আঁকাটাও বাদ দিয়ে দিতে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। খুব কান্না পাচ্ছে, বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আজ কতদিন হয়ে গেল বাবাকে দেখেনা। কয়মাস? রন্তু হিসেব করে ভাবতে পারছে না। তার খুব কান্না পাচ্ছে, এই কান্নাটা এত্ত পচা না, যখন তখন চোখের কোণে এসে হাজির হয়।

দুইদিন পর, আজ স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। গতকাল সকল স্পোর্টস ইভেন্টের ফাইনাল হয়ে গেছে। আজ রন্তু তার মা শায়লার সাথে স্কুলে এসেছে। আজ রন্তুর দুটো ইভেন্ট রয়েছে, একটা ছবি আঁকা আর একটা হল কবিতা আবৃত্তি। রন্তু এখন বড় হলঘরটায় ছবি আঁকায় ব্যস্ত। এক ঘণ্টা সময়ে একটা বড় আর্ট পেপারে জলরঙ্গ দিয়ে ছবি আঁকা, রন্তু আঁকছে ‘আমাদের পরিবার’ নামের একটা ছবি। যেখানে একটা পরিবারে একটা ছেলে তার বাবা-মা তিনজন তিনটা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। বাবা মা দুজনই বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে। আর ছেলেটা একটা ঘরের দরজায় মাথা নিচু করে বসে আছে। রন্তু কি কারণে এই ছবিটা আঁকছে তা হয়ত সে নিজেও জানে না। কিন্তু তার পারিপারিক জটিলতাই তার শিশু মনে এই ছবি এঁকে দিয়েছে।

শায়লা স্টেজের সামনে অভিভাবকদের জন্য যে চেয়ারপাতা নির্দিষ্ট স্থান আছে সেখানে একেবারে শেষের দিকে একটা চেয়ারে বসে আছে অনেকক্ষণ। আজ সকালবেলাই সে রন্তুর সাথে স্কুলে এসেছে। ছেলেটা গত পরশু দৌড়তে গিয়ে পা ছিলে ফেলেছে, সেই ব্যাথায় রাতে এল জ্বর। ছেলেটার যে কি হল খোদাই জানে, একটু কিছু হলেই জ্বর চলে আসে। আজ বলতে গেলে শায়লা জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে, ছেলেতো আসতেই রাজী না। বলে, ‘আমি এসব কম্পিটিশনে যাব না’। শেষে শায়লার ধমকে রাজী হল, আজ রন্তুর ছবি আঁকা আর কবিতা আবৃত্তি করার কথা। ছবি আঁকা পর্ব শেষ, এখন চলছে কবিতা আবৃত্তি, একটা ছোট মেয়ে স্টেজে কি চমৎকার করে তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে... কবিতাটি আবৃত্তি করছে। এক পায়ে কথাটি বলার সময় সে একটা পা উঁচু করে রাখছে, সাথে মুখের অভিব্যক্তি মিলে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। ডায়াসে দাঁড়ানো ম্যাডাম রন্তুর নাম ধরে বলতেই শায়লা নড়েচড়ে বসল। গুটি গুটি পায়ে রন্তু স্টেজে এসে দাঁড়াল, মাইক যখন এডজাস্ট করার জন্য টেকনিশিয়ান ব্যস্ত তখন শায়লা চমকে উঠলো। রন্তু’র মাঝে অবিকল জাভেদের প্রতিচ্ছবি, দাঁড়ানোর ভঙ্গী, ঘাড় একটু কাত করে মাথা নিচু করে কি যেন ভাবছে। ঠিক জাভেদের কপি যেন। শায়লা নির্বাক বসে রইল।

হঠাৎ করে মাইকে চমৎকার একটা কণ্ঠে আবৃত্তি শুরু হতেই শায়লা দেখতে পেল রন্তু কবিতা আবৃত্তি শুরু করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’।
মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা, চ’ড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ‘পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।।

সন্ধে হল, সূর্য নামে পাটে,
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।
ধূ ধূ করে যে দিক-পানে চাই,
কোনখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপন-মনে তাই
ভয় পেয়েছ – ভাবছ, ‘এলেম কোথা।’
আমি বলছি, ‘ভয় কোরো না মাগো,
ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।’

আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে -
অন্ধকারে দেখা যায় না ভাল।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
‘দিঘির ধারে ওই-যে কিসের আলো!’
এমন সময় ‘হাঁ রে রে রে রে’
ওই-যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে!
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর-দেবতা স্মরণ করছ মনে...

এতোটুকু আবৃত্তি করে রন্তু থেমে গেল। শেষের দিকে তার গলা ধরে আসছিল, কান্না জড়ানো কণ্ঠে আবৃত্তি করতে করতে হঠাৎ থেমে গেল। শায়লা ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেছে। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন যে শিক্ষক তিনি এগিয়ে গিয়ে রন্তুকে ধরে স্টেজ থেকে নামিয়ে আনলেন। শায়লা গিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে একপাশের চেয়ারে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল। রন্তু বেশ কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে গেল, একসময় একটু ধাতস্ত হয়ে এলে শায়লা তাকে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছিল? কবিতা কি ভুলে গিয়েছিল? নাকি ভয় পেয়েছিল? রন্তু কোন কথা না বলে শুধু ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিল, না এমন কিছু নয়।

কিন্তু রন্তু যে কথাটা মা’কে বলতে পারে নাই, তা হল... সে যখন কবিতা পাঠ করছিল বারবার তার বাবার কথা মনে হচ্ছিল। চারিদিকে বাবার মুখটা খুঁজতে খুঁজতে কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছিল। আবৃত্তি করতে করতে যখন “এমন সময় ‘হাঁ রে রে রে রে’
ওই-যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে!” এই অংশটা আবৃত্তি করছিল, তখন সে যেন দেখতে পেল বাবা ডাকাতের পোশাক পড়ে রন্তুদের দিকে তলোয়ার উচিয়ে হাঁ রে রে ডাক ছুঁড়ে এগিয়ে আসছিল। রক্তাক্ত চোখের বাবাকে দেখে রন্তুর খুব ভয় হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল পুরোটা কবিতা পড়তে পড়তে সত্যি বাবা ডাকাতের বেশে এসে রন্তু আর মাকে মেরে ফেলবে। বাবার এই রূপ রন্তুর মনে কেন এল রন্তু নিজেও জানে না। কিন্তু রন্তু বড় ভয় পেয়েছে, তারচেয়ে বড় কথা ভীষণ আঘাত পেয়েছে মনে। এমন কল্পনা রন্তুর মনোজগতে যে ঝড় তুলেছিল তা কেউ জানতে পারবে না, কক্ষনো না।


১৫.
রন্তু খুব মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটি দেখছে, আপ্রাণ চেষ্টা করছে আর মাত্র দুজনকে চিনতে। তার হাতে একটা দৈনিক পত্রিকা, খেলার পাতায় ছোট মামার বাংলাদেশী প্রিয় ফুটবল দলের ছবি। মামা দু’চার দিন পরপরই ঢাকা স্টেডিয়ামে গিয়ে লীগের প্রিয় ফুটবল খেলা দেখে। রন্তু বেশ কিছুদিন ধরে মামার পেছনে লেগে আছে তাকে স্টেডিয়াম নিয়ে যেতে হবে, সেও মামার সাথে খেলা দেখবে। কিন্তু ছোট মামা রাজী হয় না, বলে ওখানে খেলা শেষে প্রায় দিনই মারামারি হয়। আজ সকালে অনেক করে ধরাতে মামা রাজী হয়েছে তাকে খেলা দেখতে নিয়ে যেতে, কিন্তু একটা শর্তে। ছোট মামা রন্তুর হাতে একটা কয়েকদিন আগের দৈনিক পত্রিকার খেলার পাতা ধরিয়ে দিয়ে একটা ছবি দেখিয়ে বলল, এই ছবি হতে যে কোন পাঁচটা খেলোয়াড়ের নাম বলতে হবে। ছোট মামা অনেকবার রন্তুকে ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে নাম বলেছে, এমন কি মাঝে মাঝে যখন বড় ম্যাচগুলো টিভিতে দেখায়, তখনো দেখিয়েছে। কিন্তু রন্তুর যে কিছুতেই তা মনে থাকে না।

আজ রন্তু যেভাবেই হোক পাঁচজনের নাম বলবেই বলবে। তিনজন’কে ইতিমধ্যে চিনে ফেলেছে, আর দুজন হলেই হয়। আবারো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। ঐ যে লম্বা লম্বা ঝাঁকড়া চুলের লম্বু খেলোয়াড়টা, কি যেন নাম? কি যেন... কি যেন... ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই নামটা মনে পড়ে গেল। যাক হয়ে গেল চারজন, আর দরকার একজনের নাম। রন্তু আবার থেকে সবার চেহারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা শুরু করল। কিন্তু প্রায় আধঘণ্টা চেষ্টা করেও যখন আর পারছে না, তখন ছোট মামার দিকে গেল। ছোট মামা তার ঘরের একমাত্র টেবিলে কি যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে লিখছিল। রন্তু’র ডাকে ঘুরে তাকাল।

‘কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন?’

‘কাঁদছি কই? দেখো দেখো, আমার চোখ মোটেও ভেজা না’

‘চোখ শুকনো রেখেও কাঁদা যায় বুঝলি, বড় হলে বুঝবি।’

‘আমি এখন বড়ই আছি’

‘আচ্ছা বুঝেছি, এখন ভাগ, আমার পরীক্ষার নোট করছি, জ্বালাস নে..’

‘ও মামা... চারজনের নাম মনে করতে পেরেছি। আরকেজনেরটা কিছুতেই পারছি না যে...’

‘তো আমি কি করব? ডিল ইজ ডিল। তোর সাথে আমার কথা হয়েছে, তুই পাঁচজন খেলোয়াড়ের নাম বলতে পারলে তোকে খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে নিয়ে যাব। তাই না?’

‘হু...’

‘তো এখন ভাগ, আমাকে আমার কাজ করতে দে’

রন্তু মন খারাপ করে নীচে নেমে এল। ধুর কেন যে রন্তু নামগুলো মনে থাকে না। থাক আজ না হয় আর খেলা দেখতে নাই বা গেল। বড় হয়ে সে নিজে নিজেই কত খেলা দেখতে যেতে পারবে, হুহ...। অথবা, যদি বাবা আবার দেখা করতে আসে, বাবাকে বলবে খেলা দেখতে নিয়ে যেতে। বাবা যেমন রাগী মানুষ, খেলা দেখতে নিয়ে যেতে রাজী হবে কি না রন্তুর ভয় হয়। আর যদি রাজী হয়েও যায়, মা যেতে দিবে কি না রন্তুর সন্দেহ হয়। বাবার কথা বললেই মা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যায়, মাঝে মাঝে খুব রেগেও যায়। রন্তুর তখন খুব খারাপ লাগে, খুব। মা কেন বুঝে না, তাকে এবং বাবাকে, দুজনকেই রন্তুর ভালো লাগে। দুজনকেই রন্তু ভালবাসে।

রন্তু তার রংপেন্সিলের বক্সটা নিয়ে বসল, আজ স্কুল ছুটি থাকায় রন্তুর হাতে তেমন কোন কাজ নেই। স্কুলে নতুন ক্লাসে এখনো তেমন পড়াশোনা’র চাপ নেই। সবেমাত্র গতকাল স্কুলের স্পোর্টস আর কালচারাল প্রোগ্রাম শেষ হল, তাইতো আজ স্কুল ছুটি। এমন কাজ নেই দিনে রন্তুর খুব বিরক্ত লাগছে, রং পেন্সিলে নিয়ে একটা সাদা কাগজে সে একটা ঘোড়ায় চড়া রাজপুত্রের ছবি আঁকার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু হঠাৎ করেই স্কুলের সেই ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটি আবৃত্তি করার কথা মনে পড়তে আর ছবি আঁকার ইচ্ছা করল না। নানুর ঘরে গিয়ে দেখে নানু কি একটা কাপড় হাতে নিয়ে সুঁই-সুতো দিয়ে সেলাই করছে। নানুর পাশে গিয়ে রন্তু বসল।

‘নানু, ও নানু, কি কর?’

‘নাচছি... ড্যান্স’ নানুর কথা শুনে রন্তু হেসে দিল, তবে মনে মনে রন্তু খুশী হল। নানুর মুড ভালো আছে।

‘মিথ্যা কথা বলছ কেন নানু? তুমি সেলাই করছ, অথচ বললে ড্যান্স’

‘এই ফাজিল, তুই যখন দেখছিস যে আমি সেলাই করছি তাহলে আর জিজ্ঞাসা করা কেন?’

‘ওমা, এমনি করলাম। তোমরা সবাই তো কর? কি কর না?’

‘যা ভাগ এখান থেকে, জ্বালাস না’

‘নানু, ক্ষুধা লেগেছে’

‘ছাদে গিয়ে রোদের দিকে চেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাক, ক্ষুধা চলে যাবে’

‘নানু... সত্যি সত্যি অনেক ক্ষুধা লেগেছে।’

‘যা, রান্না ঘরে লাল কৌটোয় টোস্ট বিস্কুট আছে, নিয়ে খা গিয়ে।’

‘ইয়াক... টোস্ট বিস্কুট মানুষ খায়?’

‘আহারে আমার জমিদার কোথাকার? টোস্ট বিস্কুট মানুষ খায়? তাহলে কি ছাগলে খায়?’

‘না, তুমি খাও?’

‘তার মানে কি আমি মানুষ না? এই বদমাশ এদিকে আয়, তোর কানটা টেনে ছিঁড়ে দেব।’

রন্তু ঝট করে লাফ দিয়ে সরে গেল, নানুটার স্বভাব খারাপ। কথায় কথায় শুধু কান ধরে টেনে দেয়। নানু হাতের কাজটা শেষ করে রন্তুকে দুপুরের খাবার দিয়ে দিল। বেলা সাড়ে বারোটার মত বাজে, আজ একটু তাড়াতাড়ি ভাত খাওয়া হয়ে গেল। আসলে যেদিন কোন কাজ থাকে না, সেদিন যেন খুব ক্ষুধা লাগে রন্তুর। খাওয়াটাও তো একটা কাজ তাই না, তাই হয়ত ক্ষুধা লাগে এতো। রন্তু খাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আরেকটা খেলোয়াড়ের নাম মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। চোখ বন্ধ করে পত্রিকার পাতার ছবিটা কল্পনা করে খেলোয়াড়দের নাম ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

‘রন্তু, এই রন্তু...’ ছোট মামার হাতের ঝাঁকুনি আর ডাকের কারণে রন্তু গভীর ঘুম থেকে চোখ মেলে তাকাল। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে রন্তু বুঝতে পারছে না। কিন্তু মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে। চোখ ডলতে ডলতে ছোট মামার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।

‘ওঠ, এই গাধা, ওঠ... কত ঘুমোবি? বিকেল তো হয়ে এল?’

‘আমার আরও ঘুম পাচ্ছে মামা, ঘুমোতে দাও না...’

‘খেলা দেখতে যাবে কে? যাবি না স্টেডিয়াম?’

খেলার কথা শুনতেই যেন হুট করে রাজ্যের যত ঘুম চোখের পাতা হতে নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। দ্রুত বিছানা ছেড়ে নেমে রন্তু হাতমুখ ধুয়ে এসে জামা পড়ে তৈরি হয়ে নিল। ছোট মামা তৈরি হয়েই ছিল, মিনিট পনের পরে তারা বাসা থেকে বেড়িয়ে স্টেডিয়ামের উদ্দেশ্যে একটা রিকশা ভাড়া করে রওনা হল। আকাশে হালকা মেঘ রয়েছে বলে চমৎকার মিষ্টি একটা বাতাস বইছে। এমন আবহাওয়ায় রিকশা করে ঘুরতে মজাই লাগছে। চারিপাশে রন্তু মনোযোগ দিয়ে দেখছে, তার খুব ভালো লাগছে।

‘রন্তু মিয়া, যদি তুই খেলা দেখতে গিয়ে হারিয়ে যাস তাহলে কি হবে?’

‘কি হবে আবার? একা একা বাসায় চলে আসব।’

‘বাসায় আসবি কি করে? তুই স্টেডিয়াম হতে রাস্তা চিনবি কি করে?’

‘মানুষদের জিজ্ঞাসা করে করে’

‘আর যদি সেই মানুষেরা ‘ছেলেধরা’ হয়?’

‘হুম... এটাও একটা চিন্তার বিষয়। তাহলে রিকশা করে চলে আসব’

‘কিন্তু তোর কাছে তো রিকশা ভাড়া নেই? টাকা পাবি কোথায়?’

‘মামা, তুমি না একটা বোকা। বাসায় গিয়ে নানুর কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে নেব।’

‘কি বললি? আমি বোকা? সাহস বেড়েছে অনেক রন্তু মিয়া, তাই না? মাথায় একটা গাট্টা দিলে সাহস বের হয়ে যাবে।’

রন্তুর খুব মজা লাগলো, ছোট মামাকে বোকা বলায় মামা বুঝি একটু মাইন্ড করেছে। কিন্তু ছোট মামা রাগ করলে তাকে দেখতে মজা লাগে। রেগে গেলে ছোট মামা মাথায় গাট্টা মারে, সেইটা শুধু ভালো না। রন্তু চুপচাপ আবার চারিপাশ দেখতে লাগলো।

‘কিরে গাট্টা’র কথায় ভয় পেয়েছিস?’

‘না...’

‘আচ্ছা শোন, ভিড়ের মাঝে হাঁটার সময় ভুলেও আমার হাত ছাড়বি না কিন্তু... মনে থাকে যেন।’

রন্তু মাথা নেড়ে সায় দিল। এখন রিকশাটা নিউমার্কেট ক্রস করছে। এই জায়গাটা রন্তু চেনে, সেই যে বাবার সাথে হুট করে একদিন স্কুল শেষে শিশুপার্ক যেতে যেতে নিউমার্কেটে আসা, সেই যেবার বাবা শেষ এসেছিল রন্তুর সাথে দেখা করতে। রন্তুকে একটা বাইনোকুলার কিনে দিল রন্তুর জন্মদিনের গিফট হিসেবে। বাইনোকুলারের কথা মনে হতেই রন্তুর মন খারাপ হয়ে গেল। স্টেডিয়াম যাচ্ছে খেলা দেখতে, বাইনোকুলারটা নিয়ে এলে কতই না ভালো হত। ধুর... কেন যে বাসায় থাকতে মনে হল না। বাইনোকুলারের দুঃখেই কি না জানে না, রন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে রিকশা হতে পেছনে নিউমার্কেটের দিকে তাকাল। আর তখন সে দেখল, কয়েক রিকশা পেছনে একটা রিকশায় যেন মা বসে আছে, সাথে আরেকজন, ঐ সেদিনের ঐ আঙ্কেলটা বুঝি। রন্তুর জামা নিতে এসে যেদিন একটা আঙ্কেলের সাথে দেখা হল, তারা তিনজনে আইসক্রিম খেয়েছিল। রন্তু ছোট মামার হাত ধরে টান দিয়ে চিৎকার করে উঠলো,

‘ছোট মামা, ছোট মামা, দেখ দেখ মা...’ রিকশার পেছনের দিকে ইশারা করল। শিবলী ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে কোথাও কোন রিকশায় তার বোন শায়লাকে দেখতে পেল না।

‘কই দেখলি তোর মাকে?’

‘এখনই তো দেখলাম তিনচারটা রিকশা পেছনে ছিল...’ রন্তু নিজেই দ্বিধায় পরে গেল। সে নিশ্চিত মাকে দেখেছে, কিন্তু মা চোখের পলকে তো আর হাওয়া হয়ে যাবে না। ধুর কাকে দেখতে কাকে দেখেছে সে, নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হল। মায়ের প্রসঙ্গ ধরে আবার তার বাইনোকুলারের কথা মনে পরে গেল, ধুর...

শায়লার মাঝে কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। কয়েক রিকশা আগে, হঠাৎ করে রন্তুকে শিবলীর সাথে দেখে শায়লার চমকে ওঠা, রন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখতে পাওয়ার সাথে সাথে রিকশাওয়ালাকে রিকশা ঘুরিয়ে নিতে বলা, এসব কেন করল সে। সে কি ইরফানের সাথে এক রিকশায় অফিস শেষে নিউমার্কেটে শপিং করতে এসে অন্যায় করেছে? ইরফান আর শায়লার সম্পর্ক এতদিনে একটা ভিত্তি পেয়েছে, দুজনেই জানে তারা পরস্পরকে ভালবাসে, তাই লুকোচুরি বেশীদিন রইল না। কিন্তু শায়লা রন্তু’র মা, প্রেমিকা সত্ত্বার সাথে মা সত্ত্বার প্রতিনিয়ত চলা একটা বোঝাপড়ার সংঘাতে শায়লা মানসিকভাবে প্রতিনিয়ত ভীষণ চাপে রয়েছে। এই দ্বৈত সত্ত্বার যুদ্ধে মানুষ শায়লা দিনদিন অসহায় হয়ে যাচ্ছে। বুঝে উঠতে পারছে না, সে কি কোন অন্যায় করছে? ইরফানের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়াটা কি ভুল হচ্ছে? শায়লা জানে না, কিচ্ছু জানে না। জানতে চায় না...


১৬.
আজ সকাল থেকে রন্তু খুব ব্যস্ত আছে, নতুন বইগুলোর মলাট বাঁধা নিয়ে। ছোট মামার কাছ থেকে সে কিছুদিন আগে মলাট বাঁধা শিখেছে। কয়েকবার ট্রায়াল দিয়ে পাশ মার্ক পাওয়ার পর আজ সে তার বইগুলো মলাট বাঁধাই করছে। যদিও আজ রন্তুর স্কুল খোলা ছিল, কিন্তু সে যেতে পারে নাই। যাবে কীভাবে? সকাল থেকে যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে... আর মজার ব্যাপার হল বাসার সবার কিন্তু ঘুম ভাঙ্গতে দেরী হয়েছে। এমনকি মা আর নানুও! একে দেরীতে ঘুম থেকে ওঠা আর বাইরে ঝুম বৃষ্টি, তাই নানু বলল থাক আজ আর স্কুল যেতে হবে না। রন্তুর কি যে মজা লাগল... যদিও সে ভয়ে ভয়ে ছিল, এই বুঝি মা আবার বলে বসে, ‘না না, নতুন ক্লাস, স্কুল কামাই দেয়া যাবে না...’। কিন্তু না, রন্তুকে অবাক করে দিয়ে মা কিছুই বলল না। রন্তু ইদানীং খেয়াল করছে মা তাকে তেমন কিছুই বলে না। একটু চুপচাপ গম্ভীর হয়ে থাকে। রন্তু পরশু রাতের বেলা মা’র কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে বসে মাকে জিজ্ঞাস করেছিল, ‘মা, তোমার কি মন খারাপ’। ‘আহ রন্তু, কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করো না তো, ভাল লাগে না...’ বলে রন্তুকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে।

ছোট মামা রন্তুকে বেশ কিছু ক্যালেন্ডার যোগাড় করে দিয়েছে মলাট বাঁধার জন্য, যার প্রতিটিতেই কি সুন্দর সুন্দর সব ছবি, কোনটায় পাহাড়-নদী, আবার কোনটায় কোন ফসলের মাঠ, ফুলের বাগান অথবা ঝর্ণার ছবি। রন্তু ভেবে পাচ্ছে না, এই ছবিগুলো কি উপরের দিকে দিয়ে মলাট করবে, নাকি ভেতরের দিকে। ছোট মামা অবশ্য বলেছে ছবিগুলো ভেতরের দিকে দিতে, উপরে সাদা অংশ রেখে মলাট করতে। তাতে নাকি বইগুলো সুন্দর দেখাবে আর তার সাথে সাদা অংশে বইয়ের নাম, রন্তুর নিজের নাম এসব আরও কত কি লেখা যাবে। কিন্তু এতো সুন্দর ছবিগুলো বইয়ের মলাটের ভেতরে চাপা পড়ে থাকবে ভাবতেই রন্তুর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ বই, ক্যালেন্ডার আর সুঁই-সুতো নিয়ে বসে থাকার পর রন্তু মনস্থির করল, সাদা অংশ উপরে রেখেই মলাট বাঁধবে। এতে লাভ হবে ছবিগুলো ময়লা হবে না, ভেতরের দিকে চাপা পড়ে থাকবে। যখন রন্তুর ইচ্ছা হবে বইয়ের মলাট খুলে দেখতে পারবে। রন্তু বই বাঁধাই শুরু করল।

সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে, আকাশ কালো করে এমন অন্ধকার হয়ে আছে চারিপাশ দেখে মনে হয় এই বুঝি রাত হল বলে। শায়লা বিছানায় আধশোয়া হয়ে জানালা দিয়ে বাইরের পাণে চেয়ে আছে। আকাশ থেকে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়ছে, মাটিতে জমে থাকা পানির উপর পড়ে কেমন একটা শব্দ তুলছে। এই শব্দটা কেমন যেন একটা ঘোর এনে দেয়, একটানা বিরামহীন বেজে যাওয়া। ছাঁদের চিলেকোঠার ঘরে শিবলি গান শুনছে। শায়লার এই ছোট ভাইটা একটু অন্যরকম, নিজের মত করে থাকে, নিজের জগতে ডুবে থাকা যাকে বলে। কিন্তু কোন এক অলৌকিক উপায়ে সে সারা সংসারের সবকিছুর খবর রাখছে। রন্তুটা হয়েছে ছোট মামার ন্যাওটা, ছোট মামা বলতে অস্থির। শিবলি এমনিতে আধুনিক ব্যান্ড সঙ্গীতের ভক্ত, যখনই গান বাজাবে কোন না কোন চটুল গান হবে সেটা। যদিও সে গান খুব কম শোনে। আজ কি মন করে যেন রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাচ্ছে। রেজওয়ানার চৌধুরী বন্যার কণ্ঠে ‘আমারও পরাণও যাহা চায়’ গানটা এখন বাজছে। বর্ষণমুখর এই সকাল বেলায় গানটা শুনতে ভালো লাগছে। আমারও পরাণও যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো? আসলেই কি তাই? শায়লার পরাণ যাহা চেয়েছিল জাভেদকে তো তাই মনে হয়েছিল? কিন্তু বাস্তবে সেই হিসেবটা আর মিলল কোথায়? আর এই যে এখন ইরফানকে তার পরাণ এতো চাইছে, আসলেই কি চাইছে? শায়লা নিজেকেই জিজ্ঞাসা করে, উত্তরটা জোর করেও নেতিবাচক করতে পারছে না। সেই ইরফানও যদি সেই পরাণের চাওয়া মিছে করে দেয়। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখের কোনে জলের দানা জমে উঠেছে শায়লা খেয়াল করে নাই। মাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সম্বিৎ ফিরে পেল। শাড়ির আঁচলের কোনা দিয়ে সেই জলদানা মুছে নিল।

‘আজ দুপুরে কি খাবি?’ শায়লাকে উদ্দেশ্য করে বলল শায়লার মা।‘যা রাঁধবে তাই খাব’

‘আজ অফিস গেলি না যে, সমস্যা হবে না’

‘না সমস্যা হবে না, ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি’

‘খিচুড়ি রাঁধবো? ঘরে যদিও মাংস নেই, ডিম ভাজি আর ভর্তা-টর্তা করি?’

‘মা তোমার যা খুশী কর, আমায় কেন জিজ্ঞাসা করছ?’

‘জিজ্ঞাসা করাটা কি অপরাধ?’

‘আমি কি তা বলছি?’

‘তাহলে তুই এমন করে ঝনঝন করে উঠলি কেন?’

‘আমি কোন ঝনঝন করে উঠি নাই, শুধু বলেছি আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন?’

‘কেন তোকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়?’

‘উফ মা... তোমার যা খুশী তুমি জিজ্ঞাসা কর...’ বলে শায়লা জানালা দিয়ে বাইরের পাণে চেয়ে রইল।

‘কত কিছুই তো জিজ্ঞাসা করি না, করা উচিত, তবুও কিছু বলি না...’ বলে বিড়বিড় করতে করতে শায়লা মা, রন্তুর নানু রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।

শায়লা হঠাৎ খেয়াল করল মায়ের শেষের কথাগুলো, অনেক কিছুই তো জিজ্ঞাসা করি না! কি জিজ্ঞাসা করে না মা? কি সে জানতে চায়? মা কি তবে কিছু টের পেয়েছে? নাহ এতো হতে পারে না। বাসায় কারো কিছু জানার কথা না। কিন্তু মা তো মাই... হয়ত কিছু বুঝতে পারছে। শায়লা কিছুই ভাবতে পারছে না। সে কীভাবে কি করবে? কীভাবে মা, ভাই, ছেলে এদের বুঝাবে, কীভাবে সমাজকে, কীভাবে সবাইকে? কিন্তু শায়লা কি করবে, ইরফান যে তার হৃদয়ের অনেক গভীরে বসত গড়ে নিয়েছে। সেখান থেকে তাকে উৎপাটন করা অসম্ভব। শায়লার খুব চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

বাইরে বৃষ্টি আরও বেড়েছে। রন্তু তিনটি বই মলাট বাঁধা শেষ করেছে, তার খুব ইচ্ছা হচ্ছে ছোট মামার সাথে গিয়ে চিলেকোঠার রুমে বসে বসে বই বাঁধতে। মামা গান শুনছে মজা করে, যদিও এই গানগুলো কেমন কঠিন কঠিন শব্দে লেখা। রন্তুর বেশীরভাগ কথাই বুঝতে পারছে না। আজ ছোট মামার মুড খুব ভালো নিশ্চয়ই, নইলে ছোট মামা এতো জোরে খুব কম সময়ই গান শোনে। কিন্তু রন্তু এখন এই বইপত্র নিয়ে ছাদে যেতে নিলে ভিজে যাবে সব, আর যদি নাও ভিজে ছোট মামা হয়ত রাগ করবে। কি আর করা, নীচের ঘরে বসেই মলাট বাঁধতে লাগল। এমন সময় দরজায় মাকে দেখতে পেল রন্তু। মা তার দিকে তাকিয়ে আছে, মা কি রেগে আছে না ভাল মুডে বোঝা যাচ্ছে না।

‘কি বই বাঁধাই শেষ হয়েছে?’

‘উঁহু’

‘কয়টা বাকী?’

‘আরও পাঁচটা’

‘এগুলো কি পরে করা যায় রন্তু সাহেব’ মায়ের কথা শুনে রন্তু ফিক করে হেসে দিল। মায়ের মুড এখন ভালো আছে, অনেক অনেক দিন পর মা রন্তুকে রন্তু সাহেব বলে ডাকল। মায়ের যখন মুড খুব ভালো থাকে তখন মা রন্তুকে রন্তু সাহেব বলে ডাকে।

‘হুম... যায়’

‘তাহলে চল আমরা ছাঁদে যাই’

‘এই বৃষ্টিতে ছাঁদে গেলে ভিজে যাব যে’

‘ভেজার জন্যই তো ছাঁদে যাব’

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ সত্যি’ মায়ের কথা শুনে রন্তুর খুব কান্না করতে ইচ্ছে করছে। খুশীতে যে মানুষের কান্না পায়, আজ রন্তু প্রথম জানল।

শায়লা আর রন্তু ছাঁদে উঠে আসতেই ঠাণ্ডা বাতাসের সাথে তীরের ফলার মত বৃষ্টির পানির ফোঁটা গায়ে বিঁধতে লাগলো। কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি। রন্তুর খুব মজা লাগছে মায়ের সাথে ভিজতে। যদিও উপরে আসার সময় নানু গজগজ করছিল, রন্তু বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসে... এসব বলে। মায়ের আজ কি যেন হয়েছে, নইলে মা রন্তুকে বৃষ্টিতে কক্ষনো ভিজতে দিতে চায় না। সেখানে আজ নিজে সাথে করে ছাঁদে নিয়ে এসে বৃষ্টিতে ভিজছে। রন্তু ছোট মামার রুমের দিকে চেয়ে দেখল ছোট মামা একটা গল্প বই পড়ছে, আর গান এখনো বেজে চলেছে। রন্তু জোরে ‘ছোট মামা’ বলে ডাক দিয়ে ইশারা করল তাকেও বৃষ্টিতে রন্তুদের সাথে ভিজতে বাইরে আসার জন্য। ছোট মামা একটা ভেংচি দিয়ে আবার বইয়ের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।

শায়লা বহুদিন পর বৃষ্টিতে ভিজছে। আজ তার মন বড়ই তরল হয়ে আছে, নইলে রন্তুকে নিয়ে ছাঁদে ওঠা কেন? সে জানে রন্তু বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর বাঁধায়, তারপরও কেন জানি মনে হল ছেলেটাকে নিয়ে ছাঁদে গিয়ে খুব করে বৃষ্টিতে ভিজতে। শায়লা রন্তুর হাত ধরে বৃষ্টিতে ছাঁদের এমাথা হতে ওমাথা হাঁটতে লাগলো। পেছনের জীবনের ফেলে আসা দিন আর সামনের অনাগত দিনগুলো নিয়ে ভাবনার দল বারবার উঁকি দিতে চাইলেও শায়লা এই মুহূর্তে সব পেছনে ফেলে রাখতে চাইছে। এখন সে এই মুহূর্তে সব কিছু ভুলে গিয়ে এই মুহূর্তটা উপভোগ করতে চাইছে। কিন্তু শায়লা যদি জানতো, আজকের এই দিন বহুবছর পরেও তার হৃদয়ে স্মৃতি হয়ে গেঁথে রবে... কি মনে করে শায়লা রন্তুকে কোলে তুলে নিল, বহুদিন পর ছেলেকে কোল নিল। রন্তু এর মাঝে এতো বড় হয়ে গেছে, ছেলেকে কোলে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তারপরও শায়লা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে লাগলো। কয়েক কদম যেতেই বুঝতে পারল ছেলেকে নিয়ে হাঁটা সম্ভব না, তাই নামিয়ে দিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিল। বৃষ্টির জলে চোখের জল মিশে একাকার হয়ে গেলেও মায়ের বুকের কাঁপুনিতে ছোট্ট রন্তু নিজেও বুঝতে পারল মা কাঁদছে। আর সেই বোধ থেকে অজানা কোন কারণে রন্তুর বুক ফেটে কান্না চলে আসল। মা ছেলে দুজনে বৃষ্টিতে সিক্তে হয়ে মনের গহীনে লুকানো অজানা কোন দুঃখজলে স্নাত হল তা কেউ জানে না। রন্তুর ছোট মামা শিবলির ঘরে তখন বেজে চলেছে, ‘মোর হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে তোমায় পাইনি আমি দেখতে...’


১৭.
আচ্ছা সবারই কি এমন হয়? রন্তু ভেবে পায় না, যেদিনই তার স্কুল ছুটি থাকে, সেদিনই কেন জানি খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে যায়। এত্ত খারাপ লাগে রন্তুর, ওর খুব শখের কাজ হচ্ছে আরাম করে লম্বা সময় ঘুমানো। কিন্তু কেন জানি সেই শখটা যেদিন স্কুল খোলা থাকে সেদিন ভোরবেলাই কাজ করে। অথচ আজ শুক্রবার, স্কুল বন্ধ, সকালে উঠবার কোন তাড়া নাই। নানু বা মা এসে চেঁচামেচি করবে না, ‘এই রন্তু, রন্তু... ওঠ, স্কুলের দেরী হয়ে যাবে। এই ছেলে ওঠ না...’

রন্তু বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেয়ালে টাঙ্গানো ঘড়ির দিকে তাকাল, ঘড়িতে সবেমাত্র ভোর ছয়টা দশ। অন্যদিন স্কুল খোলা থাকার সময়েও রন্তু সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত আরামসে ঘুমিয়ে থাকে। রন্তু পাশে শায়লার দিকে তাকাল, মা কেমন গুটিসুটি মেরে কাঁত হয়ে মাথার নীচে হাত দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। মাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, কেমন যেন সিনেমার নায়িকাদের মত সুন্দর। চোখের পাতার উপর কয়েকটা চুল চোখটাকে ঢেকে রেখেছে, নিঃশ্বাসের সাথে সাথে সেই চুলের প্রান্তগুলো কেমন পতাকার মত নড়ছে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রন্তুর বুকটা কেমন হুহু করে উঠলো। চোখের কোনে জল জমে উঠতে দেখে রন্তু দ্রুত বিছানায় উঠে বসল, তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘মা, তোমায় ভালবাসি, খুব ভালবাসি...’

রন্তু ছাঁদের দিকে রওনা হল, ভোর বেলা ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে ছাঁদে চলে যায়। ভোর বেলা ছাঁদের রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশে সূর্যোদয় দেখতে খুব ভালো লাগে। কেমন করে গাঢ় কুসুম কুসুম রঙ্গা সূর্যটা ধাঁধাল উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করে, তখন আর তার দিকে তাকান যায় না। ছোট মামা বলেছে, তখন সূর্যের দিকে তাকালে নাকি চোখের ক্ষতি হয়। কিসব রশ্মি যেন চোখের ক্ষতি করে। সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে রন্তু রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ শুনে উঁকি দিল, নানু এরই মধ্যে ঘুম থেকে উঠে গেছে। রন্তুর মনে হয় নানু সারা রাত ঘুমান না। কারণ রন্তু যখন ঘুমুতে যায় তখনো দেখে নানু জেগে আছে, আর ঘুম থেকে উঠেও দেখবে নানু জাগনাই আছে। এমন কি মাঝে মাঝে রাতে টয়লেটে যাবার জন্য ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখবে নানু বারান্দায় পায়চারী করছে। একবার ভাবল নানুকে গিয়ে কথাটা জিজ্ঞাসা করে আসে, পরক্ষনে মনে হল না থাক, কে জানে নানু আবার রেগে গিয়ে কান মলা দিয়ে দেয় কি না?

ছাঁদে আসতেই আশ্চর্যরকম শীতল একটা মিষ্টি বাতাস পুরো শরীরে ছুঁয়ে গেল। ছোট্ট রন্তুর শরীরের প্রতিটি লোমকূপ যেন দাঁড়িয়ে প্রতিক্রিয়া জানালো। আজও বুঝি ভোররাতে খুব বৃষ্টি হয়েছে, চারিপাশ কেমন ভেজা ভেজা, মনে হয়ে কেউ যেন অতি যত্ন করে ধুয়েমুছে সব সাফ করে রেখেছে। রন্তুদের বাসার নারিকেল গাছটার পাতাগুলো বাতাসে নড়লে কেমন শিরশির শব্দ হচ্ছে আর তা থেকে পাতায় জমে থাকা কিছু পানির কনা ঝিরঝির করে ঝরে পড়ছে। রন্তু সাবধানে পা ফেলে পূব পাশের রেলিঙ্গের ধারে এগিয়ে গেল। আকাশে এখনো মেঘের দলের দৌড়ঝাঁপ রয়েছে। তাই সূর্য মামা মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। এখন বুঝি আরও ভোরবেলা সূর্য উঠে, কারণ সেই উঁকি দেয়ার মাঝেই রন্তু দেখল সূর্য মামার গায়ের রং এখন অনেকটাই উজ্জ্বল সোনালি হয়ে গেছে। রন্তুর মনে হল, ঘুমটা যখন ভাঙলই তখন আরেকটু আগে কেন ভাঙল না!

রন্তু রেলিঙ্গের কাছ থেকে ছোট মামার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল এবং খুব অবাক হয়ে দেখল ছোট মামা জেগে আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে খাতায় কিছু লিখছে, সামনে বেশকিছু বইপত্র খোলা রয়েছে। পায়ের শব্দে ছোট মামা মাথা ঘুরিয়ে রন্তুকে দেখল, তারপর আবার খাতার দিকে মনোযোগ দিল। রন্তু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ছোট মামার চিলেকোঠার ঘরটিতে ঢুকলো। মামার ঘরে ঢুকলেই রন্তুর খুব মজা লাগে, মনে হয় রূপকথার গল্পে চড়ে অন্য কোন জগতে চলে এসেছে। রাজ্যের জিনিসপত্রে ঠাসা অগোছালো এই ঘরখানি রন্তুর খুবই ভালো লাগে। রন্তুর ধারণা এমন কোন জিনিস নাই যা ছোট মামার ঘরে পাওয়া যাবে না। রন্তু গুটিগুটি পায়ে ছোট মামার কাছে এসে দাঁড়াল।

‘কি চাই?’

‘কিচ্ছু না’

‘এতো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লি যে?’

‘ঘুম ভেঙ্গে গেল যে তাই’

‘এতো সকালে ঘুম ভাঙ্গে কেন?’

‘ওমা! আমি কি জানি?’

‘ঘুমকে শক্ত করে ধরে রাখতে পারিস না?’

‘যাহ, ঘুমকে কি ধরে রাখা যায় নাকি?’

‘হুম যায়, কায়দা জানতে হয়। আমাকে দেখিস না কত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকি’

‘হুমম... কিন্তু আমি যে কায়দা জানি না, তুমি শিখিয়ে দিবে?’

‘উঁহু... এই কায়দা কেউ কাউকে শেখাতে পারে না। নিজে নিজে শিখতে হয়।’

‘নিজে নিজে কীভাবে শিখব?’

‘আরেকটু বড় হয়ে নে, দেখবি নিজে নিজে শিখে গেছিস’

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ, সত্যি। এখন ভাগ এখান থেকে, আমার একটা এসাইনমেণ্ট রেডি করছি, কাল জমা দিতে হবে।’

‘ওমা, তুমি না কাল বলেছিলে যে, আজ ঘুড়ি ওড়াবে আমাকে নিয়ে...’

‘হুমম ওড়াবো, এখন আমাকে কাজ করতে দে। ডিস্টার্ব করলে কিন্তু ঘুড়ি ওড়ানো বন্ধ।’

এই কথার পর আর ছোট মামার ঘরে থাকা চলে না। রন্তু ছাঁদে বের হয়ে এল, আকাশে মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য দেখা যাচ্ছে। সোনালি রোদে নারিকেল গাছের পাতাগুলো কেমন চিকচিক করছে, চারিপাশ আলোয় ঝলমল করছে। ভোররাতের বৃষ্টিতে চারিপাশ ধুয়েমুছে পরিস্কার হয়ে যাওয়াতে সকালের এই স্বর্ণালী আলোতে বড় মায়াময় দেখাচ্ছে চেনা এইসব কিছুকেই। রন্তু কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ছাদ হতে নেমে এল। নীচে নামতেই নানুর সাথে দেখা হয়ে গেল, মা এখনো ঘুম থেকে উঠেনি, মায়ের আজ অফিস নেই বলে আরামসে ঘুমুচ্ছে।

‘কি রে, আজও ঘুম ভেঙ্গে গেল?’

‘হুম’

‘তো ঘুম ভাঙ্গলেই কি এই সাতসকালে ছাঁদে যেতে হবে?’

‘ভোরবেলা ছাঁদে যেতে ভালো লাগে নানু...’

‘শিবলি কি ঘুমুচ্ছে?’

‘নাহ, পড়ালেখা করছে।’

‘ওহ... একটু উপরে গিয়ে শিবলিকে বল আমি ডাকছি। ঘরে সরিষা তেল নেই, দোকান থেকে তেল এনে দিতে হবে। আজ আলু পারাটা বানাচ্ছি’

‘আলু পরাটা! ওয়াও...’ বলে রন্তু নানুকে জড়িয়ে ধরল।

‘ছাড় আমার ওয়াও-ওয়ালা, ঢং করতে হবে না ছোঁচা কোথাকার। যা শিবলিকে ডেকে নিয়ে আয়।’

রন্তু ছাঁদে গিয়ে ছোট মামাকে ডেকে আনতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল। ছোট মামা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে যে, তাকে আরেকবার ডিস্টার্ব করলে রন্তুর ছাঁদে আসার ভিসা একমাসের জন্য ক্যান্সেল করে দিবে। রন্তু দ্রুত নীচে নেমে এসে নানুকে বলল,

‘নানু ছোট মামার কাল কি যেন জমা দিতে হবে, পড়ছে, তাই আসতে পারবে না’

‘সারা মাস টো টো কর ঘুরে বেড়াবে, এখন এই সাতসকালে উনার পড়ালেখার বাহার। যতসব... এখন খাওয়াব সব কয়টাকে সয়াবিন তেলের পরাটা, আমার কি...’

‘ও নানু, দাও আমি তেল এনে দেই’

‘তুই এনে দিবি মানে। তুই কি বড় রাস্তার ঐ মুদিদোকান চিনবি?’

‘কি যে বলনা নানু, আমি রোজ স্কুলে একা একা যাই না? বড় মসজিদের কাছে থেকে আমার স্কুল গেছে হাতের বামদিকে আর বড় রাস্তার ঐ মুদিদোকানটা হল ডানের রাস্তায়, বাজার গেছে যে রাস্তা দিয়ে।’

‘তুই এতো কিছু কীভাবে চিনলি?’

‘ছোট মামা চিনিয়েছে, এখন দাও তেল নিয়ে আসি। আজ আলু পরাটার নাস্তা... আমার এখনই খিদে লেগে গেছে যে...’ বলে রন্তু ফিক করে হেসে দিল।

ঘুড়িটা এখন দেখাচ্ছে একেবারে ছোট্ট একটা বিন্দুর মত। ছোট মামা বলেছে এক বলে ছোড় দেয়া, সুতো ছেড়ে ঘুড়িকে অনেক অনেক উঁচুতে নিয়ে যাওয়া। এখন আকাশে তেমন একটা ঘুড়ি নেই, দূরে আরও দুয়েকটা ঘুড়ি উড়ছে। তাই এই অবিরাম সুতো ছেড়ে ঘুড়িকে দূর আকাশ পাণে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায়। নইলে, আকাশভরা ঘুড়ির দল থাকলে যে কেউ এসে কাটাকুটি খেলে ঘুড়ি কেটে দিলে ঘুড়ির সাথে সাথে সবসুতোও চলে যায়, তাই এই সকালবেলা ছোট মামা রন্তুকে নিয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। নাস্তা শেষে রন্তু বেশ কিছুক্ষণ পড়ার বই নিয়ে বসেছিল, মাসখানেক পর প্রথম পার্বিক পরীক্ষা, তাই বইগুলো নিয়ে বসেছিল। আগে ছুটির দিনে রন্তু রংপেন্সিল নিয়ে বসত, ছবি আঁকার চেষ্টা করত; এখন ছবি আঁকতে মন চায় না। বেলা দশটার দিকে ছোট মামা তার ছাদের ঘর হতে নেমে নাস্তা করে রন্তুকে নিয়ে ছাঁদে এসেছে ঘুড়ি ওড়াতে।

নাটাই খুব ভারী বলে রন্তু ঘুড়ি ওড়াতে পারছে না মজা করে। ছোট মামা দুয়েকবার রন্তুকে সুতো ধরে ঘুড়ি ওড়াতে দিয়েছে, তখন ছোট মামার হাতে নাটাই ছিল। ছোট মামা বলে দিচ্ছিল কখন সুতো ছাড়তে হবে, কখন টানতে হবে; সেই অনুযায়ী রন্তু কাজ করে যাচ্ছিল। রন্তুর খুব মজা লাগছে, মনে হচ্ছে ঘুড়ি নয়, রন্তু নিজেই যেন ঐ নীলাকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। শুধু ঐ অত উঁচু হতে নীচের পৃথিবীটা দেখতে কেমন দেখায় এটাই জানা হল না।

বেলা বারোটা নাগাদ ছাদ থেকে রন্তু নেমে এল। নামতেই মা’র সাথে দেখা হল রন্তুর। মাকে কেমন যেন গম্ভীর দেখাচ্ছে, সেটা অনেকক্ষণ ঘুমনোর কারণে কি না বুঝা যাচ্ছে না। মা কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকে ইদানীং, অনেক কিছুই খেয়াল করে না। এই তো গত পরশু রন্তু বাসার সামনে ছেলেপেলেদের সাথে ফুটবল খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল, হাঁটুর কাছের চামড়া ছিলে গিয়ে একটু রক্তও বের হয়েছিল। বাসায় আসার পর নানুর সে কি বকা, রন্তু ভয়ে ভয়ে ছিল মা না জানি তাকে ধরে মারা শুরু করে। কিন্তু রাতে মা অফিস থেকে ফেরার পর যখন শুনল এই ঘটনা, রন্তুকে অবাক করে দিয়ে কিছুই বলল না।

রন্তু গোসল সেরে নিয়ে পাজামা-পাঞ্জাবী পড়ে তৈরি হয়ে গেল। ইদানীং সে ছোট মামা শিবলির সাথে মসজিদে জুম্মা নামাজ পড়তে যায়। রন্তুর খুব ভালো লাগে নামাজ পড়তে যেতে। কত মানুষ, সবার মাথায় সাদা টুপি, গায়ে পাঞ্জাবী, দেখতে খুব ভালই লাগে। তবে অনেকের টুপি রঙ্গিনও হয়, কেউ কেউ আবার শার্ট গেঞ্জি পরেও নামাজ পড়তে আসে। নামাজ শুরুর আগে হুজুর আরবিতে অনেক কিছু তেলাওয়াত করেন, তখন সবাই একেবারে চুপচাপ হয়ে মনোযোগ দিয়ে সেগুলো শুনতে থাকে। রন্তু একবার মামাকে কি যেন জিজ্ঞাসা করতে নিলে, মামা রন্তুকে চুপ করিয়ে দেয়। পরে রন্তু মামার কাছে থেকে জানতে পারে ঐ সময় কোন কথা বলতে হয় না। রন্তু ধীরে ধীরে নামাজ শিখছে, নানুর কাছে ও নিয়মিত কোরআন শরীফ পাঠ করা শিখছে। কিছুক্ষণ পর ছোট মামাও পাঞ্জাবী পড়ে তৈরি হয়ে এলে মামার হাত ধরে রন্তু মসজিদের দিকে রওনা হল।


১৮.
ইদানীং রন্তু’র ক্লাসে মন বসে না, বিশেষ করে শেষের ক্লাস দুটোয় তার খুব হাই উঠে। মনে হয় যেন কয়দিন ধরে না ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়াটা রন্তুর অভ্যেস, ও রাত একদমই জাগতে পারে না। অনেক সময় দেখা যায় বাসায় সবাই গল্প করছে, রন্তুও খুব আগ্রহ নিয়ে বসল সবার সাথে, সেই বসে বসেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়বে সে, এমনই তার ঘুমের অবস্থা। যদিও স্কুলের কারণে খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে। নানু ফজরের নামাজ শেষ করে রন্তুকে ডেকে তোলেন, রন্তু স্কুলের জন্য তৈরি হতে হতে নানু নাস্তা তৈরি করে ফেলেন।

আজকে নাজনীন আপা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় পড়াচ্ছেন, তিনি পরিবেশ পরিচিতি পড়ান। ক্লাসের শুরুতেই উনি বলে দিয়েছেন যে, এটা ফাইনাল পরীক্ষায় থাকবেই থাকবে। ফলে সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে ম্যাডামের কথা শুনছে, যখন ম্যাডাম লিখতে বলছে সবাই লিখে নিচ্ছে। কিন্তু রন্তু কোন কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে না, তার শুধু হাই আসছে আর সেই হাই হাত দিয়ে চেপে রাখতে বার বার দুইহাতে মুখে চেপে ধরছে। ভাগ্যিস এখনো ম্যাডামের চোখে পড়ে নাই। রন্তু আড়চোখে চেয়ে দেখে সবাই লিখে লিখে খাতা ভরে ফেলছে, কিন্তু সে কিছুই লেখে নাই। মনে মনে ভাবল, থাক পরে কারো কাছ থেকে তুলে নেবে। উফ, কখন যে স্কুল ছুটি হবে?

আজ রন্তুর একেবারেই ক্লাসে মন বসছে না, মনে মনে সে এক্সাইটেড হয়ে আছে এই কয়েকদিন ধরে। কারণ, রন্তুর বড় মামা বিদেশ থেকে আসছে, আগামীকাল। এটা নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে বাসায় কেমন উৎসব উৎসব ভাব। নীচের উত্তরের দিকের ঘরটা এতদিন রাজ্যের সব জিনিসপত্র দিয়ে বোঝাই ছিল, সেটা এই কয়দিন নানু আর ছোট মামা মিলে পরিস্কার করেছে। মাঝে মাঝে রন্তু নিজেও সাহায্য করেছে। বড় মামা এসে এই ঘরে থাকবে। রন্তু বড় মামাকে যদিও স্বচক্ষে দেখেনি, কিন্তু ছবিতে দেখেছে। ছবি দেখে রন্তুর খুব ভয় লেগেছে, মনে হয় বড় মামা খুব রাগী মানুষ। কেমন ইয়া মোটা একখানা গোঁফ, দেখলেই মনে হয় কোন সিনেমার ভিলেন বুঝি। এই কথা রন্তুর কাউকে বলে নাই, বলবে কিভাবে? এই কথা কি কাউকে বলা যায়।

শেষ ক্লাস ছিল ড্রইং ক্লাস, যদিও আজ স্যার তেমন কিছু আঁকতে দিলেন না। ড্রইং টিচার মানুষ হিসেবে খুব মজার, বেশীরভাগ দিন উনি ড্রইং না করিয়ে মজার মজার সব গল্প করেন। কোন একদিন হয়ত কোন একটা নৌকা ভ্রমণের গল্প বললেন, কোনদিন কোন একটা ডানাকাটা পরীর গল্প। কিন্তু মজার ব্যাপার হল গল্প শেষে স্যার হোমওয়ার্ক ধরিয়ে দেন, সেটাও খুব মজার। যে গল্পটি বলা হল, সেটার উপর ভিত্তি করে পরের ক্লাসে একটা ছবি এঁকে আনতে হবে। রন্তুর খুব মজা লাগে। আজ স্যার গল্প করছেন বনের রাজা সিংহ আর ধূর্ত শেয়ালের একটা কাহিনী নিয়ে। রন্তু খুব মনোযোগ দিয়ে গল্প শুনতে পারছে না, সে চিন্তায় আছে সিংহ আর শেয়ালের ছবি কিভাবে আঁকবে। কেন জানি কোন প্রাণীর ছবি আঁকতে গেলে তার সব তালগোল পাকিয়ে যায়। দেখা যায় গরুর ছবি আঁকতে গেছে, দেখতে হয়ে গেছে ইঁদুরের মত। ছোট মামা এটা নিয়ে রন্তুকে খুব ক্ষ্যাপায়।

ছুটির ঘণ্টা পড়েছে, ছেলে মেয়ে সব একসাথে বেঞ্চে হাত দিয়ে বাড়ি দিয়ে কোরাস গাইছে একসাথে, “ছুটি ছুটি, গরম গরম রুটি; এক কাপ চা, সবাই মিলে খা।” ছোট বয়সে আসলে মানুষের মাঝে একধরণের অদ্ভুত সারল্য থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেগুলো সব কোথায় হারিয়ে যেতে থাকে। তাইতো এই শিশুকালে বলতে পারে, এক কাপ চা, সবাই মিলে খা। কিন্তু এই বোধ বড় হবার পর বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কর্পূরের মত হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। রন্তু আর তার সহপাঠীরা সেই সারল্য এখনো ধরে রেখেছে বিধায় আনন্দগীত গাইতে গাইতে তাঁরা স্কুলের মাঠে ধুলোর ঝড় তুলে ছুঁটে যাচ্ছে স্কুল গেটের দিকে। স্কুল ছুটি যেন প্রতিদিনকার এক আনন্দ উৎসব ঐ শিশুগুলোর জন্য। কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে স্কুল গেটে না গিয়ে খেলা শুরুর করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, কাধের ব্যাগকে মাঠের এক পাশে জড়ো করে।

রন্তু স্কুল গেট দিয়ে বের হয়ে এল, দূর থেকে একটা লোককে দেখে কিছুটা চমকে উঠল। অবিকল বাবার মত দেখতে, পড়নের জামাটাও বাবার মত। ঠিক একই রঙের একটা জামা বাবাকেও পড়তে দেখেছে। রন্তুতো প্রথম দেখাতে খুব খুশী হয়ে উঠেছিল, এতদিন পর তাহলে তার কথা মনে পড়ল বাবার! কিন্তু কয়েক পা এগিয়ে যেতে ভুল ভাঙল, যখন দেখলো লোকটা একটা ছোট্ট মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে এদিকে ঘুরলো। কিছুটা মন খারাপ করেই রন্তু বাড়ির দিকে পা বাড়াল। ইদানীং বাবার কথা রন্তুর একটু কম মনে পড়ে, কিন্তু আজ কেন জানি খুব মন খারাপ হয়ে গেল। সেই খাবারের হোটেলটা পার হয়ে যাওয়ার সময় মনে পড়ে গেল, বাবার সাথে এই হোটেলে বসে পরাটা-দই-মিষ্টি খাওয়ার স্মৃতিগুলো। রন্তু নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করল, সে কাঁদবে না। সবাই তাকে বলে সে নাকি ছিঁচকাঁদুনে, কিন্তু রন্তু জানে সে মোটেও ওরকম না। শুধু কষ্ট পেলে তার চোখে পানি চলে আসে, সেটাও ওর নিজের ইচ্ছাতে না, এমনি এমনি চলে আসে। তো সে কি করবে?

বাসায় এসে রন্তুর মন ভালো হয়ে গেল, বাসায় আরও দুয়েকজন আত্মীয় এসেছেন। আজ রাতে সবাই মিলে বড় মামাকে এয়ারপোর্ট থেকে আনতে যাবে। রন্তু জামা কাপড় পাল্টে নানুর পেছনে ঘুরঘুরে করতে লাগলো, সেও এয়ারপোর্ট যাবে সবার সাথে বড় মামাকে আনতে। নানু’র কথা “না, ছোট মানুষ বাসায় থাক, মামাতো সেখান থেকে সরাসরি এই বাসাতেই আসছে, তখন যত খুশী দেখিস তোর মামাকে মন ভরে”। কিন্তু রন্তুতো মামাকে দেখতে এয়ারপোর্ট যেতে চাচ্ছে না, সে যেতে চায় এয়ারপোর্ট দেখতে, প্লেন দেখতে। আকাশে যখন প্লেনগুলো উড়ে উড়ে যায়, সেগুলো দেখতে এত্তটুকুন লাগে। কিন্তু নীচে যখন থাকে তখন নাকি দেখা যায় প্লেনগুলো ইয়া বড়, ইয়া লম্বা। রন্তদের ক্লাসে ছোটন বলেছে, সেগুলো নাকি ওদের পুরো স্কুলের চাইতেও বড় বড় হয়, ছোটন নিজে দেখেছে। ও তো প্লেনেও চড়েছে, ওর বাবা-মা’র সাথে গেল শীতে যখন কোথায় যেন বেড়াতে গেল তখন। রন্তুর মনে হল, ইস... সেও যদি বাবা-মা’র সাথে ওরকম প্লেনে করে বিদেশ বেড়াতে যেতে পারতো।

রন্তু বাসায় মাকে দেখতে পেল না, তার মানে মা অফিসে গেছে। রন্তু ভেবেছিল বড় মামা আসছে এই উপলক্ষে মা অফিস যাবে না। রন্তু কি করবে ভেবে না পেয়ে ছাঁদে চলে আসল, ছোট মামার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে ছোট মামা শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছে। রন্তু ঘরে ঢুঁকে ছোট মামার খাটের কোনায় বসল।

‘মামা, কি কর?’

‘ড্যান্স’

‘ধুর, তুমিও দেখি নানুর মত কথা বলছ’

‘বলবই তো, আমি নানুর ছেলে না’

‘হুমম’

‘আর তুই যখন দেখছিস আমি বই পড়ছি, তাহলে জিজ্ঞাসা করছিস কেন?’

‘ওমা, তোমরাও তো জিজ্ঞাসা কর অনেক সময়’

‘এখন বল এখানে কেন এই দুপুরবেলায়, ভাত খেয়েছিস?’

‘না, পরে খাব। মামা...’

‘কি?’

‘আমিও যাব...’

‘কোথায় যাবি?’

‘এয়ারপোর্ট, তোমাদের সাথে বড় মামাকে আনতে’

‘উঁহু, সেখানে শুধু বড় মানুষেরা যাবে। তুই তোর আম্মুর সাথে বাসায় থাকবি।’

‘কেন? আমি গেলে কি হয়?’

‘কিছু হয় না, ছোট মানুষ সেখানে গিয়ে কি করবি? আর অনেকক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করে থাকতে হবে।’

‘আমিও থাকব’

‘উঁহু, রাতের বেলা তুই এমনিতেই ঘুমে কাঁদা হয়ে থাকিস। পরে তোকে টানবে কে?’

‘প্রমিজ, আমি ঘুমাব না। প্লিজ মামা, প্লিজ, আমাকেও নিয়ে চলে না।’ রন্তু মামা হাত ধরে টানতে লাগলো। শেষে বাধ্য হয়ে রন্তুর ছোট মামা শিবলি কথা দিল তাকেও নিয়ে যাবে, কিন্তু শর্ত একটাই ঘুমানো চলবে না। রন্তু খুশীতে লাফাতে লাফাতে নীচে নামল, অনেক ক্ষুধা লেগেছে।

এমন আনন্দের সময়গুলোর জন্য সময় যেন আর কাটতে চায় না। রন্তু সেই দুপুর থেকে অস্থির হয়ে আছে কখন রাত নামবে। ছোট মামা বলেছে, তারা রাত আটটার দিকে রওনা দিবে, বড় মামার প্লেন নাকি রাত এগারোটার দিকে ল্যান্ড করবে। রন্তু মনে মনে উত্তেজিত হয়ে আছে এতো সামনে থেকে প্লেন দেখতে পাবে বলে। সারাটা বিকেল একা একা ছাঁদে ঘুরে বেড়ালো, সন্ধ্যের আগে আগে ছাদ হতে নীচে নেমে এসে দেখে মা অফিস থেকে ফিরেছে। মাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, মুখ কেমন গোমড়া করে বসে আছে। রন্তু ধীর পায়ে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

‘মা, তুমিও চল না?’

‘কোথায়?’ শায়লা বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকাল

‘এয়ারপোর্ট, বড় মামাকে আনতে।’

‘বড় মামা কি ছোট্ট বাবু, তাকে আনতে সবার এয়ারপোর্ট যেতে হবে?’ শায়লার গলার স্বর উচ্চগ্রামে উঠেছে।

রন্তু গুটিগুটি পায়ে ঘরে থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, শায়লা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমারও কোথাও যেতে হবে না, তুমি আমার সাথে বাসায় থাকবে’

‘কিন্তু আমি যাব মা, ছোট মামা বলেছে।’

‘আমি বলছি তুমি যাবে না, তাই যাবে না’

‘আমি যাব, যাব, যাব’ রন্তু মুখ গোমড়া করে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল। শায়লা উঠে এসে ছেলের গায়ে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল। রন্তুর নানু ঠিক সে সময় এইঘরে এসে উপস্থিত, উনি এগিয়ে এসে রন্তুকে ধরে ফেললেন।

‘তুই ছেলেটিকে মারলি কেন?’ নানু রাগী চোখে রন্তুর মায়ের দিকে চেয়ে কথাটি বললেন।

‘মুখে মুখে কথা বললে বেয়াদপ ছেলে এমনই মার খাবে’

‘ও কি এমন কথা বলেছে তোকে, শুনি হ্যাঁ?’

‘মা, আমি তোমার সাথে এখন ঝগড়া করতে পারবো না, তুমি প্লিজ যাও’

‘তুই অন্যজনের ঝাড়, ছোট্ট ছেলেটার উপর ঝাড়ছিস কেন?’

‘মা ঘ্যানর ঘ্যানর করো না তো...’

‘এই রন্তু তুই ছোট মামার ঘরে যা, আমি তোকে নিয়ে যাব, দেখি কে কি করতে পারে।’ নানু গজগজ করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। মা খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে, চোখের কোনে আলোয় চিকচিক করছে জমে থাকা জলকণা। রন্তু কাঁদতে কাঁদতে ছাঁদে চলে গেল।

রাতের প্রথম প্রহরের এই আলো আঁধারির মাঝে নিঃশব্দে রন্তু কাঁদতে লাগলো। মা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে দিনদিন। কিছু হলেই কেমন রেগে যায়, মাঝে মাঝেই রন্তুর গায়ে হাত তোলে। রন্তুর কিছু ভালো লাগছে না, তার কোথাও যেতে মন চাচ্ছে না, এই রাতের হালকা হয়ে আসা আঁধারের মাঝে আজীবনের জন্য হারিয়ে যেতে মন চাইছে। বাবা-মা দুজনই খুব খারাপ, খুব পচা। তারা কেউ রন্তুকে ভালবাসে না, কেউ না।

শিবলি তার ঘর হতে বের হয়ে দেখতে পেল ছাঁদের কোনায় অন্ধকারের মাঝে কে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এগিয়ে গিয়ে দেখে রন্তু। বুঝতে বাকী রইল না, আবার নিশ্চয়ই তার বড় বোন মেরেছে ছেলেটাকে। ইদানীং এই বদভ্যাস হয়েছে বড় আপার, কথায় কথায় মেজাজ গরম হবে, আর হাতের সামনে পেলে সেই রাগ ঝাড়বে ছেলেটার গায়ে হাত তুলে। আজ আবার কি হল কে জানে। শিবলি এগিয়ে গেল রন্তুর কাছে।

‘কিরে রন্তুর আঁধারের মাঝে বসে বসে গান গাইছিস কেন?’

‘আমি গান গাইছি না...’ ছোট মামার কণ্ঠ শুনতে পেয়ে চোখ মুছল রন্তু।

‘কিন্তু আমি যে শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। তবে কি কান্না করছিলি?’

‘না...’ বলে রন্তু নিজে লজ্জা পেল, ছোট মামা তার কান্না শুনে ফেলেছে। এখন নিশ্চয়ই তাকে ক্ষ্যাপানো শুরু করবে। কিন্তু রন্তুকে অবাক করে দিয়ে ছোট মামা বলল, ‘চল, চল, নীচে চল। দেরী হয়ে যাবে, ঝটপট তৈরি হয়ে নে। গাড়ী চলে এসেছে।’ রন্তুর একবার ইচ্ছে হল বলে, ‘আমি যাব না, তোমারা যাও’। কিন্তু প্লেন দেখার লোভ সামলাতে পারল না, ফলে অভিমান দূরে ঠেলে ছোট মামার সাথে নীচে নেমে এল।

মাইক্রোবাসে করে রন্তুর খুব কম ঘুরাঘুরি করা হয়েছে। একবার কার বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় যেন চড়েছিল মনে নেই। গাড়ির ভেতর জানালার পাশে বসে বাইরের নিয়ন আলোয় রাস্তাগুলো দেখতে লাগলো। এই হলদে আলোর বাতিগুলো রন্তুদের ওখানে নেই, এগুলো শুধু এই বড় রাস্তাগুলোতে আছে বুঝি। রন্তু আগে কখনো দেখে নাই। সেই ঘোর লাগা নিয়ন আলোয় প্লেন দেখা থেকে শুরু করে নিজে প্লেনে করে বিদেশে বেড়াতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে একসময় ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল।


১৯.
অসময়ের ঘুম বড্ড বাজে একটা জিনিস, যা রন্তুর খুব খারাপ লাগে। দিনের বেলা ঘুমালে পরে ঘুম ভাঙ্গার পর কেমন সব কিছু অদ্ভুত লাগে। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা, কেমন হালকা হয়ে যায় যেন। অদ্ভুত এক অস্বস্তিকর অনুভূতি, রন্তু এটা বলে বোঝাতে পারবে না। আর তারচেয়ে আরও বেশী বিরক্তিকর হল ঘুম না আসা সত্ত্বেও বিছানায় শুধু শুধু শুয়ে থাকা। স্কুল বন্ধের দিনগুলোতে নানু অথবা মায়ের পীড়াপীড়িতে রন্তুকে মাঝে মাঝে ঘুমের ভান করে দুপুর বেলা শুয়ে থাকতে হয়। বিকেল না হওয়া অবধি এই মটকা মেরে পড়ে থাকা কি যে কষ্টকর, উফ... তখন সময় যেন কাটতেই চায় না। আলতো করে চোখের পাতা ফাঁক করে ঘড়ির দিকে তাকালে দেখতে পায় ঘড়ির কাটাগুলো সব যেন থেমে আছে, কোন নড়াচড়া নেই। মাঝে মাঝে রন্তুর সন্দেহ হয়, ঘড়িগুলো নষ্ট হয়ে গেল কি না। কিন্তু রন্তুকে অবাক করে দিয়ে বিকেল বেলা থেকে আবার যেন ঘড়ির কাটাগুলো তরতর করে এগুতে থাকে।

কিন্তু গত তিনদিন ধরে রন্তুর সারাক্ষণ বিছানায় কাটাতে হয়েছে। প্রথমদিনের কথা অবশ্য মনে নেই, সেদিন নাকি ও অচেতন ছিল। তারপরের দুইদিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে রন্তু অধৈর্য হয়ে গিয়েছিল। থেকে থেকে নানুকে সারাক্ষণ পেরেশান করেছে, “ও নানু, বাসায় যাব কখন”। নানু চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে একই উত্তর দিয়েছে, ‘আজীবনের জন্য তোকে এখানে রেখে যাব, বুঝবি মজা।’ আজ সকালে হাসপাতাল থেকে বাসায় এসেছে, কিন্তু বাসায় এসেও নিস্তার নেই। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে হচ্ছে, এভাবে নাকি আরও এক সপ্তাহ তাকে শুয়ে শুয়ে রেস্ট নিতে হবে। ভাবতেই রন্তুর কান্না পাচ্ছে, কেন যে মণ্টির সাথে সেদিন মারামারি করতে গেল। কিন্তু রন্তুর কি দোষ, মণ্টি তো তাকে ঐসব বাজে বাজে কথা বলেছিল।

গত চারদিন আগের কথা, সেদিন বুঝি বৃহস্পতিবার ছিল, সপ্তাহের শেষদিন। স্কুল ছুটি শেষে সব ছেলেমেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় পরের ছুটির দিনের কথা ভেবে। স্কুল শেষে সবাই এইদিন স্কুলের মাঠে খেলা করে, এটা প্রতি সপ্তাহান্তের ঘটনা। রন্তু কোন খেলায় তেমন আগ্রহ পায় না, সে সোজা বাসায় চলে আসে। আগে বাবা দেখা করতে আসতো প্রতি বৃহস্পতিবারেই, তখন স্কুল শেষে বাবার সাথে দেখা করতো। এখন তো বাবাও আসে না, রন্তু মাঝে মাঝে একাএকা রাস্তায় কোন কোনদিন হেঁটে বেড়ায়। সেদিন স্কুলের সব ছেলেপুলে রন্তুকে ধরল তাদের সাথে ফুটবল খেলতে। একবার রন্তুরও ইচ্ছে হল তাদের সাথে খেলায় যোগ দিতে, কিন্তু পরক্ষণেই সেই ইচ্ছে মিইয়ে গেল। অনেক জোরাজুরির পরও যখন রন্তু খেলতে রাজী হচ্ছিল না, তখন মণ্টি হঠাৎ বলে বসল, ‘কেন রে? আজ কি তোর বাবা আসবে? তোর বাবা তো আর কক্ষনো আসবে না’ বলে হো হো করে হেসে উঠলো, তার সাথে বাকী অনেকেই।

রন্তু মাথা নিচু করে স্কুল গেটের দিকে চলে আসছিল, তখন পেছন হতে মণ্টি আবার বলে উঠলো, ‘তোর বাবা তো তোকে ফেলে পালিয়েছে, এই রন্তু তোর বাবা নাকি পাগল হয়ে গেছে...’ এইটুকু শুনেই রন্তুর মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল। দৌড়ে পেছনে গিয়ে মণ্টির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, এলোপাথাড়ি চর-থাপড়, ঘুষি মারা আরম্ভ করে দিল। সবাই তখন তাকে থামাতে এগিয়ে গেল, কিন্তু তখন রন্তুর গায়ে যেন মোষের শক্তি, বাচ্চার দল রন্তুকে থামাতে হয়রান। এরই মাঝে রন্তু হাত ছাড়িয়ে আবার ছুটে গিয়ে মণ্টিকে মাথা দিয়ে গুঁতো দেয়ার মত করে আঘাতের জন্য সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, মণ্টি নিজেকে বাঁচাতে সরে গেলে রন্তু গিয়ে পড়ে পাশের একটি দেয়ালের উপর। সরাসরি মাথা গিয়ে আঘাত করে দেয়ালে। ততক্ষণে স্কুলের দারওয়ান এবং দুতিনজন টিচার ছুটে এসেছে। কিন্তু রন্তু দেয়ালে আঘাত পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে জ্ঞান হারাল। স্কুল হতে তাকে সরাসরি স্কুলের পাশের ফার্মেসীতে নেয়া হল প্রথমে, খবর দেয়া হল বাসায়। ছোট মামা আর নানু সাথে সাথে স্কুলে হাজির হল, সেখান থেকে রন্তুকে নেয়া হল হাসপাতালে। ডাক্তাররা বলেছে আঘাত গুরুতর ছিল, আরেকটু হলে মাথার ভেতর রক্তক্ষরণ হতে পারতো। ডাক্তার আর বাসার সবাই শঙ্কায় কাটিয়েছে সেইদিন, ডাক্তাররা বলেছিল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরে না আসলে ভয়ের কথা। কিন্তু সবার দুশ্চিন্তা দূর করে রাতের দিকে রন্তু চোখ খুলে তাকিয়েছিল এবং খুব অবাক হয়ে আবিস্কার করেছিল সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে।

এরপর দুইদিন দুইরাত্রি হাসপাতালের বিছানায় রন্তুকে শুয়ে থাকতে হয়েছে, গিলতে হয়েছে বিস্বাদ সব ঔষধ। না করলেই বিপদ, ইনজেকশন দেয়া হবে... শুনেই রন্তুর কান্না পেয়েছে। শেষে বাধ্য হয়ে ভদ্র ছেলের মত সব ঔষধ বিনাবাক্যে গিলতে হয়েছে তাকে। শুয়ে থাকার কারণেই বুঝি তার খুব নিজেকে দুর্বল লাগতো, নানুকে একথা বলতেই নানু মুখ ঝামটা মেরে বলেছিল, ‘আরও মোষের মত গুঁতো মারতে যা মানুষকে’

‘কিন্তু নানু আমি ইচ্ছে করে ওকে গুঁতো মারতে যাই নাই’

‘তোকে কি কোলে করে ওরা গুঁতো মারতে নিয়ে গিয়েছিল’

‘না, ওরা আমাকে ধরে রেখেছিল; আমি যেন মণ্টিকে না মারতে পারি’

‘তুই কেন মণ্টিকে মারতে গেলি, গুন্ডা হচ্ছিস দিন দিন?’

‘মণ্টি বাবাকে নিয়ে বাজে কথা বলেছিল।’

‘কি এমন বাজে কথা বলল যে ছেলেটাকে এমন করে মারতে গেলি?’

‘ও বাবাকে পাগল বলেছিল...’

‘তো কি হয়েছে, তোর পাগল বাবাকে ঐটুকু বাচ্চা ছেলেও বুঝেছে তোর বাবা বদ্ধ পাগল’

‘নানু বাবাকে পাগল বলবে না কিন্তু...’ রন্তুর মুখ ভার হয়ে গেল।

‘কেন? আমাকেও মহিষ সেজে গুঁতো দিবি তোর বাবাকে পাগল বললে?’ নানু বিরক্তি নিয়ে বলল। রন্তু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু নানু ওকে আর কোন কথা বলতে দেয় নাই। ডাক্তার নাকি বলেছে কোন কথাবার্তা না বলে চুপচাপ শুয়ে শুয়ে রেস্ট নিতে। কিন্তু এভাবে শুয়ে শুয়ে রেস্ট নিতে ভাল লাগে না। এরই মাঝে বড় মামাকে কয়েকবার দেখেছে রন্তু হাসপাতালে, রন্তুকে দেখতে এসেছিলেন। বড় মামার চেহারা দেখেই রন্তুর খুব ভয় লাগছিল, কেমন রাগী রাগী। রন্তুর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে কেমন গম্ভীর গলায় বলছিল, ‘কিরে এতো রাগ কেন? আর মারামারি করা কেন? যারা মারামারি করে তারা তো খুব বাজে ছেলে। তুইও খুব বাজে ছেলে হয়েছিস, একেবারে তোর বাবার মত’ রন্তুর কথাগুলো মোটেও ভালো লাগে নাই। বড় মামাকে রন্তুর দিন দিন আর পছন্দ হচ্ছে না।

যেদিন বড় মামা দেশে এসেছিল, সেদিন রন্তু খুব উৎফুল্ল ছিল বড় মামাকে নিয়ে। কিন্তু বড় মামার আসার পর থেকে সে যতই মামাকে দেখেছে, ততই হতাশ হয়েছে। মামা আসার কয়েকদিন পর একদিন সকালবেলা গুটিগুটি পায়ে বড় মামার ঘরে গেল, মামা খালি গায়ে ভুসভুস করে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল। রন্তুর দেখেই কেমন পচা একটা অনুভূতি হল। বড় মামা সব কথাই কেমন যেন ঝাড়ি দিয়ে বলে, আর মজার একটা ব্যাপার হল সব কথার শুরুতে অথবা শেষ একটা শব্দ বলবেই বলবে, সেটা হল, ‘হুহ...’। বড় মামার কিছু কথার নমুনা দেয়া যাক,

‘এই রন্তু তুই পড়ালেখা ঠিকমত করছিস তো, হুহ...’

‘হুহ... রন্তু দিনদিন অনেক দুষ্ট হয়ে যাচ্ছিস’

‘হুহ... দেখ তোর জন্য এই খেলনাটা এনেছি, পছন্দ হয়েছে? হুহ...’

‘এই রন্তু, তোর মাকে একটু আমার ঘরে আসতে বলতো হুহ...’

‘হুহ... দেখত তোর নানুর রান্না শেষ হল কি না’

রন্তুর মনে হয় বড় মামার শ্বাসকষ্টের সমস্যা রয়েছে, তাই প্রতি কথার শুরুতে অথবা শেষে উনি যখন শ্বাস নেন তখন সেটা হুহ... বলে শোনা যায়। এই ব্যাপারটা নিয়ে ছোট মামার সাথে কথা বলতে হবে, ছোট মামা নিশ্চয়ই ভাল ব্যাখ্যা দিতে পারবে। ছোট মামার কাছে সব সমস্যার ব্যাখ্যা আছে। এই যে, সবাই বাবাকে পাগল বলে, যা রন্তুর একটুও শুনতে ভালো লাগে না। ছোট মামা কিন্তু বলেছে, বাবা আসলে পাগল না। উনি হচ্ছেন সবার থেকে একটু ভিন্নরকমের মানুষ। আমরা সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা। তাই সাধারণ মানুষ বাবাকে পাগল বলে ভেবে স্বস্তি পায়। কিন্তু বাবা পাগল না, একটু ভিন্নরকমের ভালো একটা মানুষ। এই কারণেই রন্তুর ছোট মামাকে এতো পছন্দ, ছোট মামার সাথে রন্তুর মতের অনেক মিল আছে। ছোট মামা হাসপাতালের সেই কয়টা দিন ছোট মামা রন্তুর সাথেই কাটিয়েছে বলা চলে। রন্তুর ঔষধপত্র থেকে শুরু করে রাতে তার সাথে থেকেছেও। দিনের বেলা রন্তুর ঘুম না আসলে, রন্তু যখন ছটফট করেছে শুয়ে শুয়ে, তখন ছোট মামা খুব নিচু স্বরে রন্তুকে কত কত গল্প শুনিয়েছে। নার্স দেখলেই বলেছে, উঁহু কোন কথা নয়, রোগীকে রেস্ট নিতে দিন।

এই কয়দিনে বড় মামা’র পর সবচেয়ে কম কাছে পেয়েছে মা’কে। মা বুঝি রন্তুর উপর খুব রাগ করে আছে। যেদিন হাসপাতাল থেকে বাসায় আসলো, তার আগেরদিন মা বিকেল বেলা অফিস থেকে রন্তুকে দেখতে হাসপাতালে এসেছিল। রন্তু তখন ঘুমিয়ে ছিল, মায়ের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল, কিন্তু চোখ না খুলে মটকা মেরে পড়ে ছিল। মায়ের শরীরের সেই মিষ্টি ঘ্রাণটা হাসপাতালের কড়া ফিনাইলের গন্ধের মাঝেও রন্তু টের পাচ্ছিল ঠিকই। চোখ খুলে তাকাবে কি তাকাবে না, এই নিয়ে যখন রন্তু দোলাচালে ভুগছে, তখন শুনতে পেল মা নানুকে বলছে, ‘হাজার হলেও রক্তের টান, বাবাকে পাগল বলেছে বলে ছেলে নিজের মাথা ফাটিয়ে প্রতিবাদ করতে গেছে’

‘ছিঃ শায়লা, এসব কি বলিস। ও বাচ্চা একটা ছেলে’

‘মা, তুমি বুঝবে না, ওর মাঝেও আমি জাভেদের ছায়া ভয়াবহভাবে দেখতে পাই।’

‘আলাই বালাই সাট, কিসব বাজে চিন্তা তোর মাথায়’

‘বাজে চিন্তা না মা, দেখো ও ঠিক বাবার মতই হবে। আমারই পোড়া কপাল, জাভেদ আমাকে জ্বালিয়েছে, এখন সারাজীবন এই ছেলেও আমাকে জ্বালাবে’ এইটুকু বলেই মা চাপা স্বরে কেঁদে উঠলো। শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে হাসপাতালের বারান্দার দিকে চলে গেল। রন্তু চোখ না খুলে ঘুমের ভান করে পড়ে রইল আর মনে মনে বলল, ‘মা আমি তোমাকে কখনো কষ্ট দেব না, বিশ্বাস কর। কখনো না। আমি বাবার মত হব না, তুমি যেমন চাইবে, তেমনই হব’।

রন্তু বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো, নামতেই মাথাটা কেমন একটু চক্কর দিল যেন। সবকিছু কেমন মৃদু দুলে উঠলো যেন, কিন্তু তা এক মুহূর্তের জন্য। একটু দাঁড়িয়ে ধাতস্ত হতে যেন নিজের মাঝে বল পেল, খুব ধীর পায়ে ঘরের থেকে বেড়িয়ে বারান্দায় এল। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে বলে, নানু বুঝি নানুর ঘরে, শুয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। বড় মামার ঘর হতে শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, তার মানে মামা ঘরেই আছে। ছোট মামা কি বাসায় আছে? রন্তু একবার ভাবল ছাঁদে গিয়ে দেখে আসে, কিন্তু পর মুহূর্তে সেই চিন্তা বাদ দিল। এই দুর্বল শরীর নিয়ে ছাঁদে যেতে পারবে না, হয়তে আবার সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যাবে। রন্তু ধীর পায়ে বড় মামার ঘরে গেল। রন্তুকে দেখে বড় মামা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বড় মামা তার বিদেশ থেকে আনা বড় বড় ব্যাগগুলো খুলে কি যেন গুছাচ্ছে। কাজ করতে করতেই রন্তুর সাথে কথা বলা শুরু করল,

‘কিরে, এখন কি অবস্থা?’

‘ভাল...’ রন্তু শুকনো মুখে বলল। বড় মামা কথা বললেই মনে হয় যেন ঝাড়ি দিচ্ছে।

‘মাথা ব্যাথা করে? হুহ...’

‘উঁহু’

‘ভাল। শুয়ে থাক গিয়ে, ডাক্তার বলেছে এক সপ্তাহ ফুল রেস্ট। বুঝলি, হুহ...’

‘হুহ... বুঝেছি।’ বলেই রন্তু আঁতকে উঠলো, সে বড় মামাকে নকল করছে, হুহ... বলেছে। আল্লাহ্‌, এখনই বুঝি বড় মামা দিবে একটা রাম চড়। ছোট মামা বলেছে, বড় মামা রেগে গেলে নাকি রাম চড় লাগায়, ছোট মামা এমন কি মা’ও সেই চড় খেয়েছে। কিন্তু রন্তু অবাক করে দেখল বড় মামা তার ব্যাগ নিয়েই ব্যস্ত।

‘কিছু বলবি?’

‘নাহ...’

‘তাহলে গিয়ে শুয়ে থাক, যা রেস্ট নে। আমি একটু ব্যস্ত আছি, বুঝলি। হুহ...’

রন্তু ফিক করে হেসে দিয়ে ঘাড় কাঁত করে সম্মতি জানিয়ে বড় মামার ঘর থেকে বের হয়ে এল। খুব ইচ্ছে হচ্ছে ছাঁদে যেতে, কিন্তু তাকে কে নিয়ে যাবে? ছোট মামাকে ডাকা গেলে ভাল হত, মামা ছাঁদে নিয়ে যেত। একবার ভাবল নানুকে ডাকে, কিন্তু সেই চিন্তা বাদ দিল। নানু এসে বলবে শুয়ে থাকতে, এতো ছাঁদে বেড়াতে হবে না। রন্তুর হঠাৎ করেই বাবাকে মনে পড়ল, আচ্ছা বাবা এখানে থাকলে কি ওকে নিয়ে ছাঁদে যেত। রন্তুর ধারণা বাবা অবশ্যই নিয়ে যেত, যদিও মুখটা খুব গম্ভীর করে রাখত। বাবার সাথে রন্তুর যতটুকু স্মৃতি মনে পড়ে, সবটুকু জুড়ে বাবা খুব গম্ভীর। কিন্তু রন্তু জানে, বাবা আসলে রন্তুকে খুব আদর করে, কিন্তু মুখটা খুব গম্ভীর করে রাখে। সবাই সেটা দেখে ভাবে, বাবা খুব রাগী মানুষ। কিন্তু রন্তুর বিশ্বাস বাবা মোটেও তেমন নয়, বাবা অনেক ভাল একজন মানুষ। কিন্তু সবাই বাবাকে ভুল বুঝে, কিন্তু রন্তু কখনো ভুল বুঝবে না। রন্তু একটু বড় হলে, বাবাকে ধরে নিয়ে আসবে বাসায়, মা হাজারো রাগ করলেও লাভ হবে না। রন্তু জোর করে বাবার সাথে মা’র মিল করিয়ে দেবে, রাগ ভাঙ্গিয়ে দিয়ে বাবা-মা’কে সাথে নিয়ে তাদের নিজের বাসায় ফিরে যাবে। হুট করেই রন্তুর মনটা খুব ভালো হয়ে গেল, সে ধীরে ধীরে তার নিজের ঘরের বিছানায় ফিরে গেল। শুয়ে শুয়ে এই মিষ্টি স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যেন আবার ঘুমিয়ে পড়ল।


২০.
সেই ভোরবেলা থেকে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে, কখনো থেমে থেমে, কখনো মুষলধারে। চারিদিক যেন পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। উঠোনে এরই মাঝে পানি জমে গেছে, শায়লা পানির দিকে তাকিয়ে আছে একমনে। ছোটবেলায় বৃষ্টিতে এরকম পানি জমে গেলে কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিত তারা তিন ভাইবোন মিলে। শিবলি তখন অনেক ছোট, শায়লা আর তার থেকে তিন বছরের বড় ভাই শিপলু দুজনই মূলত মেতে উঠতো এই খেলায়। সেইসব দিনের কথা মনে করে শায়লা যেন সেই ছোট্ট খুকী হয়ে গেল। ইচ্ছে হচ্ছে রন্তুর খাতা হতে কিছু কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে ঘরের চৌকাঠের উপর বসে বসে নৌকা বানিয়ে ভাসাতে থাকে এই জমে থাকা জলের মাঝে। এই কথা মনে হতেই শায়লা ঘরের ভেতরে রন্তুর দিকে চেয়ে দেখে ছেলে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আজ যদিও স্কুল খোলা ছিল, কিন্তু এই বৃষ্টি দেখে শায়লা আর ডেকে তোলে নাই, শায়লার মা, রন্তুর নানুও আজ রন্তুকে ডাকতে আসে নাই। সবাই যার যার ঘরে বসে বুঝি বর্ষণমুখর এই সকাল বেলা স্বাদ আস্বাদন করছে।

রন্তুর ঘুমের অদ্ভুত ভঙ্গী দেখে শায়লা খুব অবাক হল, ছেলের সবকিছুতেই যেন জাভেদের প্রচ্ছন্ন ছায়া দেখতে পায় সে, ঘুমের ধরণেও জাভেদের সাথে কি মিল ছেলের। আসলে প্রকৃতিই মনে হয় জেনেটিক্যালি ছেলের মাঝে তার বাবা’র স্বভাবগুলোর বীজ বপন করে দিচ্ছে। শায়লা মনে মনে বলল, সব স্বভাব যেন না পায়। হুট করে শায়লার মনে হল এককাজ করলে কেমন হয়? রন্তুকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে কাগজের নৌকা বানানো শিখিয়ে দেয়। রন্তু নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিবে উঠোনের জমে থাকা জলে, শায়লা রন্তুর মাঝে খুঁজবে তার হারানো সেই শৈশব। আচ্ছা রন্তু কি নৌকা বানাতে পারে? জানা নেই শায়লার। ছেলেটা চোখের সামনে বড় হয়ে উঠছে, কিন্তু অনেক কিছুই শায়লার অজানা থেকে যাচ্ছে। এই বছরখানেক আগেও যেন ছেলেটা তার মুঠোর মধ্যে ছিল, খুব ধীরে ধীরে নিজের অজান্তে সেই মুঠো গলে হারিয়ে যাচ্ছে। এতো কাছে থেকেও রন্তু যেন খুব অচেনা হয়ে যাচ্ছে শায়লার কাছে। শায়লা কি রন্তুর দিকে ঠিক আগের মত মনোযোগ দিতে পারছে না?

শায়লা এক অজানা অপরাধবোধে আক্রান্ত হল। ইরফানের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর থেকে প্রতিনিয়ত অদ্ভুত সব অপরাধবোধে জর্জরিত হচ্ছে সে। আজানা কোন এক শঙ্কায় মাঝে মাঝে ভয় হয়। অদ্ভুত এই অনুভূতি, ইরফান তার জীবনে যেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে, তেমনই করে এক অজানা ভয় সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। কি সেই ভয়, সংজ্ঞাহীন, বোধের ঊর্ধ্বে থাকা কোন এক অনুভূতি। একি প্রিয়জন হারানোর মূল্যে অন্য কোন প্রিয়জন পাওয়া। এই জটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর শায়লারও জানা নেই, সে জানার চেষ্টাও করে না। একটু বেশী কিছু ভাবতে গেলে মাথায় খুব চাপ পড়ে, মাথার দুপাশের রগগুলো সব দপদপ করতে থাকে। শায়লা ঘরের উঠোন পেড়িয়ে ছাঁদে চলে এল, সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দেখল বড় ভাই শিপলু তার ঘরে ঘুমাচ্ছে। সদ্য বিদেশ ফেরত এই ভাইটি যেন অন্য অচেনা কেউ, বহুদিনের দূরে থাকায় মানুষ কি এমন করে অচেনা হয়ে যায়? যায়ই তো, যেমন জাভেদ। শায়লা এখন নিজেই খুব অবাক হয় এই ভেবে যে, জাভেদের চেহারাও এখন মাঝে মাঝে মনে করতে কষ্ট করতে হয় তাকে। সেই জাভেদ, যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, সংসার করেছে বছর কয়েক। একই ছাঁদের নীচে কাটিয়েছে কতটি দিনরাত্রি। সেই জাভেদ, যাকে ঘিরে ছিল সব স্বপ্ন, সব কামনা-বাসনা, সব ইচ্ছের নীলঘুড়ি উড়ে বেড়াত শুধুই যার আকাশ জুড়ে। সেই জাভেদ কেমন করে এতো দূরে হারিয়ে গেল তিলতিল করে, ভাবতেই শায়লার চোখে জল এল। ছাঁদে উঠে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো আনমনে, দক্ষিনের কার্নিশের দেয়ালে হাত দিয়ে দূরের আকাশ পাণে চেয়ে রইল। এই সকাল বেলা, কালো করে রাখা আকাশ যেন শায়লার মনের কান্নাগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরিয়ে যাচ্ছে।

রন্তু ঘুম থেকে জেগে দেখে স্কুল টাইম পেড়িয়ে গেছে প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে খুব। কিছুক্ষণ ঘুমঘুম চোখে বসে রইল খাটে। কিছুটা অবাক হল, মা অথবা নানু কেউই আজ তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল না দেখে। ধীরে ধীরে খাট হতে নেমে চারিপাশে দেখার চেষ্টা করল। কারো কোন শব্দ নেই, শুধু রান্নঘর হতে খুটখাট শব্দ পাচ্ছে, নানু নিশ্চয়ই রান্না করছে। বৃষ্টির ছাট গায়ে মেখে রন্তু রান্না ঘরে চলে এল, নানু রান্নায় ব্যস্ত।

‘নানু, ঘুম থেকে ডাক নাই কেন? আজতো স্কুল কামাই হয়ে গেল’

‘হলে হল, দুই একদিন স্কুল কামাই গেলে কিছু হয় না’

‘তোমাকে বলেছে’

‘হ্যাঁ বলেছে, যা ভাগ, গিয়ে শুয়ে থাক, এই বৃষ্টিতে বাইরে বের হওয়ার দরকার নেই।’

‘নানু মা কোথায়, অফিস চলে গেছে?’

‘না তো, ও তো ঘরেই ছিল, দেখ গিয়ে’

‘না কোথাও পেলাম না তো’

‘জানি না, যা ঘরে যা, আমাকে জ্বালাসনে’

রন্তু রান্নঘর থেকে বের হয়ে এল, পুরো রান্নঘরে খিচুড়ির ঘ্রাণে ভরে আছে। আজ তাহলে সকালের নাস্তা খিচুড়ি, রন্তুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। নানুর হাতের খিচুড়ি রন্তুর খুব পছন্দ, বৃষ্টি হলেই নানু খিচুড়ি রাঁধবে, এটা যেন নিয়ম হয়ে আছে। রন্তু ভেবে পেল না, মা কোথায় গেল। সব জায়গা খুঁজে না পেয়ে রন্তু ছাঁদে উঠে আসল, সিঁড়িঘর হতে দেখল মা এই ঝুম বৃষ্টিতে কার্নিশের দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে যেন বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে দেখতে চাচ্ছে। মাকে খুব সুন্দর লাগছে, রন্তু নিঃশব্দে অনেকক্ষণ মায়ের দিকে চেয়ে রইল। একসময় রন্তুর ডাকে শায়লা ফিরে তাকাল, ছেলের ডাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল তার দিকে। রন্তু মায়ের সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চাইলেও শায়লা ওকে সাথে করে নেমে আসল ছাদ থেকে। এই সাত সকালে বৃষ্টিতে ভিজে নিজেই যেন লজ্জা পেল।

খিচুড়িটা খেতে দারুণ হয়েছে, রন্তু অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশী খেয়ে ফেলল। নানু ওর খাওয়া দেখে হেসে দিল, বড় মামা সামনে ছিল বলেই বুঝি তাকে কিছু বলল না। অন্যদিন হলে রন্তুকে কিছু না কিছু বলে ক্ষ্যাপাতই। খাওয়া শেষে সবাই বসে আছে, রন্তুর মা শায়লা চা ঢালছে কাপে, এমন সময় রন্তুর বড় মামা শিপলু কথা বলা শুরু করল।

‘তো শায়লা, কি ভাবছিস?’

‘কোন ব্যাপারে ভাইয়া?’

‘এই যে, এভাবে চাকুরী করে আর কয়দিন কাটাবি?’

‘কেন হঠাৎ এই প্রশ্ন?’

‘না, জাভেদের সাথে তো সব চুকেবুকেই গেছে। তাই বলে কি সারাজীবন এমন একা থাকবি?’

‘ও...’

‘আবার একটা বিয়েথা করে নতুন করে শুরু কর।’

‘ভাইয়া এসব কথা এখন থাক প্লিজ’

‘আমার সাথে আমার অফিসে এক ভদ্রলোক কাজ করেন। উনার বউটা হুট করে ক্যান্সার হয়ে মারা গেল, একটা ছোট পাঁচ বছরের মেয়ে আছে। আমার খুব ভালো লাগে ভদ্রলোককে, দেখতে শুনতে মন্দ নয়, স্বভাব চরিত্রও বেশ ভালো।’

‘ভাইয়া প্লিজ, রন্তুর সামনে এসব কি না বললেই নয়’

‘এই রন্তু, তুই তোর ঘরে যা। না এক কাজ কর শিবলিকে গিয়ে ডেকে তুল গিয়ে, এতো বেলা হল এখনো উঠে না’ রন্তু ঘর হতে ছাঁদের দিকে পা বাড়াল, ছাঁদের চিলেকোঠার ছোট মামার ডেরায়।

‘মা তুমি কি বল?’ শিপলু মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল।

‘আমি আর কি বলব? আমার বলায় কি হবে? তোরা বড় হয়েছিস, ভালমন্দ সব বুঝিস, তোরা যেটায় ভাল মনে করবি সেটাই করবি’

‘মা, তুমি মুরব্বী, তোমার একটা মতামত আছে না’

‘প্লিজ ভাইয়া, আমি এসব নিয়ে কিছু ভাবছি না। এখন এসব কথা বাদ দাও দয়া করে।’

‘কেন? বাদ দিব কেন? তোর বয়স কিই বা হয়েছে, তুই আবার থেকে নতুন করে সব শুরু করতেই পারিস। আর ঐ ভদ্রলোকের ছবি নিয়ে এসেছি, তুই দেখ, যদি ভাল না লাগে অন্য কথা। আর রন্তুকে নিয়ে চিন্তা করার কিছুই নেই, ওকে ক্যাডেট স্কুলে ভর্তি করে দিব, ওখানে ভালো যত্নেও থাকবে, সাথে পড়ালেখাটাও ভালো হবে।’

‘উফ, ভাইয়ে আমি গেলাম...’ বলে শায়লা নিজের ঘরের দিকে রওনা হল।

‘তাহলে যা শুনেছি তাই বুঝি সত্যি।’ বড় ভাইয়ের এই কথায় শায়লা যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টর মত চমকে উঠলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো।

‘কি শুনেছ?’

‘তোর অফিসের একটা ছেলের সাথে তোকে অনেকদিন অনেকজন দেখেছে, আমার কাছে রিপোর্ট আছে’

‘রিপোর্ট? তুমি কি গোয়েন্দা লাগিয়েছ আমার পেছনে, যে তারা রিপোর্ট করে তোমার কাছে’ শায়লা গলা যেন একটু উঁচুতে উঠলো।

‘যা বললাম তা সত্য কি না তা বল?’

‘তোমার সেটা জেনে কি লাভ?’

‘আমার কি লাভ সেটা বড় কথা না, বড় কথা হল এভাবে ঘোরাফেরা করাটা শোভন নয়। হাজার হলেও আমরা একটা সমাজে বাস করি। আর তুই এখন নিশ্চয়ই কলেজ পড়ুয়া ছোট খুকী নেই, যে কোন ছেলের হাত ধরে হেঁটে বেড়াবি রাস্তাঘাটে, মনে রাখিস তুই একটা আট বছরের ছেলের মা।’

‘ভাইয়া আমি কারো হাত ধরে ঘুরে বেড়াই নাই রাস্তাঘাটে। আর যদি ঘুরেও বেড়াই তাতে কারো কিছু বলার আছে বলে আমি মনে করি না। আমার জীবন, আমি ভাল বুঝি কিভাবে চলব। আশা করি এই ব্যাপারে তোমরা কেউ আর আমার সাথে আর কোন কথা বলবে না।’ শায়লা ঘর হতে বেড়িয়ে নিজের ঘরে চলে এল, মাথার দুপাশের রগগুলো লাফাতে শুরু করেছে।

রন্তু ছাঁদে উঠে ছোটমামার ঘরের দাওয়ায় বসে আছে চুপচাপ। বড় মামার কথাগুলো তার কানে বাজছে, কথাগুলো ঠিকমত বুঝতে না পারলেও, কেন যেন তার বুক ফেটে খুব কান্না পাচ্ছে। কেন জানে না কিছু, শুধু জানে অনেক অনেক কান্না জমে আছে তার বুকের মাঝে। আওয়াজ করে কান্না করতে পারছে না, পাছে ছোট মামা ঘুম থেকে জেগে যায়। কিন্তু কান্নার দমকে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে ছোট রন্তুর সারা শরীর। আকাশ ভেঙ্গে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে, আজ বুঝি ভাসিয়েই নিবে পুরো পৃথিবী এই বাঁধভাঙ্গা বৃষ্টির দল। এর সাথে যদি ভেসে যেতে পারতো ছোট রন্তু এই পঙ্কিল পৃথিবী হতে।


২১.
শীত, বর্ষা অথবা শরতের আগমন মানুষ টের পায়, কিন্তু টের পায় না কখন কেমন করে বদলে যায়, হুট করে এক নিমিষেই ছোট্ট এক শিশু থেকে কিশোর অথবা কিশোর থেকে যুবক হয়ে যাওয়া টের পাওয়া যায় না। একদিন হুট করে খেয়াল হয় জীবনটা বদলে গেছে, হুট করেই যেন বয়স বেড়ে গিয়ে অনেক পরিণত হয়ে গেছে সে নিজেই। এমনই এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে সন্ধ্যা শেষের আলো আঁধারির মাঝে রন্তু চুপটি করে বসে আছে ছাঁদের উপর থাকা ছোট মামার চিলে কোঠার ঘরের চৌকাঠের আগে ইটের গড়া তিন ধাপের সিঁড়ির মাঝে। গালের মাঝে এখনো ভেজা ভেজা অনুভূতি, চোখের জল কোনমতেই আর থামতে চায় না যেন।

দুপুরের ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে ছিল রন্তু, স্কুল থেকে আজ ফিরেছে খুব ক্লান্ত হয়ে। অনেক অনেক দিন পর আজ স্কুল মাঠে সহপাঠীদের সাথে ফুটবল খেলে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছে। বাসায় ফিরেই গোসল করে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছিল, খাওয়ার পরপরই রাজ্যের ঘুম যেন দুচোখে একটু ঠাই চাইছিল মনে প্রাণে। কোন এক ফাঁকে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেছে বুঝতে পারে নাই রন্তু। হঠাৎ করে বড় মামার জোরালো গলার চিৎকারেরে সাথে কোন কিছু একটা ভাঙ্গার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল রন্তুর। ঘুম থেকে উঠে খাটে বসতে বসতে রন্তুর মনে হল সে যেন কোন স্বপ্ন জগতে আছে। বাবার গলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে উঠোনের ঐখানে। তাহলে কি রন্তুর এতোদিনের স্বপ্ন পূরণ হল। বাবা আবার ফিরে এল তাদের মাঝে? তাহলে বড় মামা এমন করে চিৎকার করছে কেন?

এসব ভাবতে ভাবতে ঘর হতে উঠোনে পা দিতে যে দৃশ্যটি রন্তু দেখল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ছোট মামা বাবাকে ধরে বাসার দরজা হতে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, আর অন্যদিকে মা আর নানু বড় মামাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। বড় মামা রাগে ফুঁসছে আর অকথ্য ভাষায় বাবাকে গালাগাল করছে। বাবার চেহারা দেখে রন্তু প্রথমে চিনতে পারে নাই। চোখ দুটো গর্তে ঢুঁকে পড়েছে, তার নীচে গাঢ় কালচে ছাপ, গালের চোয়াল দেবে গিয়ে কেমন লম্বাটে হয়ে গেছে চেহারাটা। সারা মাথা ভরা চুলগুলো কেমন উশকো-খুসকো, সারা মুখের মাঝে দাঁড়ি-গোঁফের জঙ্গল। বাবাকে দেখেই রন্তুর চোখে জল চলে এল, তার সাথে বড় মামার বাবার প্রতি মারমুখো আচরণ, ছোট মামার বাবাকে টেনে বাসা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া, সবকিছু একসাথে যেন রন্তুর হৃদয়টাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। সেই মুহূর্তে বাবা ছাড়া বাসার আর সবাইকে অনেক অনেক পচা মানুষ বলে মনে হল রন্তুর। ঘরে ফিরে এসে কাঁদতে লাগলো হু হু করে।

অনেকটা সময় পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসলে, একসময় রন্তুর মা শায়লা ঘরে এসে দেখতে পায় রন্তু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ছেলে কাঁদতে দেখে শায়লার চোখ জলে ভরে এল, শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে ছেলের কাছে এসে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞাসা করল,

‘কিরে কাঁদছিস কেন?’

‘জানি না’

‘ঘুম কখন ভাঙলো?’

‘জানি না, যাও তুমি আমার সাথে কথা বলবে না, তোমার কেউ আমার সাথে কথা বলবে না।’ রন্তু চিৎকার করে কথাগুলো বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। এতো দিন পর বাবা ফিরে এল, আর এরা সবাই মিলে কি না বাবাকে মেরে তাড়িয়ে দিল। সবাই খারাপ, খুব খারাপ।

শায়লা ভেবে পেল না, ছেলেকে কি বলবে; তবে বুঝতে পারলো জাভেদ যখন বাসায় এসেছে তখন কোন একটা সময় রন্তুর ঘুম ভেঙ্গেছে। সে হয়ত বড় ভাইয়ার সেই অগ্নিমূর্তি রূপ দেখেছে, দেখেছে কিভাবে তার বাবাকে বাসা হতে বের করে দিল সবাই। তাই হয়ত সে বলছে, তোমরা সবাই খুব খারাপ।

শায়লা ভেবে পাচ্ছে না কি করে এতো দিন পর, এতো দিন বলা যায় না, এতো বছর পর জাভেদ শায়লার মুখোমুখি হল। দুপুর শেষ হয়ে বিকেলের মিষ্টি আলোতে উঠোনটা আলোকিত হয়ে ছিল, শায়লা সেই মিষ্টি আলোতে হাঁটছিল উঠোনের এক প্রান্ত হতে আরেক প্রান্তে। বেশ কিছুদিন ধরে মনটা খুব অস্থির, মাঝে মাঝে একটা সিদ্ধান্তে আসাটা অনেক কষ্টকর হয়ে যায়। হাঁটছিল আর ভাবছিল, বাসায় সবাই ভাতঘুমে ব্যস্ত, আজ অফিস বন্ধ ছিল, তাই বাসায় ছিল সারাদিন। পড়ন্ত দুপুরে এই হাঁটাহাঁটি করা উপভোগই করছিল শায়লা, এমন সময় দরজায় নক করার শব্দ হল। কে এল এমন ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে যেন বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে গিয়েছিল শায়লা। ওর ভাবনাতে ছিল ছোট ভাই শিবলির বন্ধু কেউ এসেছে বুঝি, প্রায় দিনই বিকেল বেলা বন্ধুদের নিয়ে ছাঁদের ঘরে আড্ডা দেয় তার কলেজ পড়ুয়া এই ছোট ভাইটি। কিন্তু দরজা খুলে যাকে দেখতে পেল তার জন্য কোনভাবেই প্রস্তুত ছিল না সে। পুরোপুরি বদলে যাওয়া অচেনা একটা মুখচ্ছবি, কিন্তু তারপরও চিনতে এতোটুকু অসুবিধা হয় নাই। একটা মানুষের কতটুকু শারীরিক পরিবর্তন হলে সেই শারীরিক অবয়ব দেখে আগের মানুষটি বলে ভাবতে কষ্ট হয় তা আজ জাভেদকে না দেখলে শায়লা উপলব্ধি করতে পারতো না। দরজা খোলার পর হতভম্ব ভাবটা কেটে যাওয়ার সময়টুকু পায় নাই শায়লা, জাভেদ হুড়মুড়িয়ে বাসায় ঢুঁকে পড়ল, শায়লা তার পথ আগলে ধরে জানতে চাইলো,

‘কি চাই এখানে?’

‘তোকে চাই? তোর কাছে উত্তর চাই?’

‘দেখ জাভেদ তুই তোকারি করবে না, এক্ষনি বাসা থেকে বের হও’

‘কেন ভেতরে কি নাগরটা বসে আছে?’

‘কি? কে বসে আছে? অসভ্য কোথাকার, এতোটা ইতর আর নীচ হয়ে গেছ? বের হও বাসা থেকে।’ কথাটুকু চিৎকার করে বলে শেষ করতে পারে নাই শায়লা, অকস্মাৎ জাভেদ তাকে একটা চড় মেরে বসল। ঘটনার আকস্মিকতায় শায়লা নিজেকে সামলাতে না পেরে উঠোনে পড়ে গেল, আর সেই সময় শায়লার বড় ভাই শিপলু ঘর হতে বের হয়ে এল। বের হয়ে বোনকে উঠোনে অগোছালো অবস্থায় ছলছল চোখে বসে থাকতে দেখে বুঝে নিল ঘটনা। সাথে সাথে সে যেন হামলে পড়ল জাভেদের উপর; চড়, ঘুষি, লাথি মারা আরম্ভ করল। এতো শব্দের কারণেই কিনা শায়লার ছোট ভাই শিবলি তার ছাঁদের ঘর থেকে নীচে নেমে এল এবং বড় ভাইকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে জাভেদের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। শিবলি নেমে এসে বড় ভাইকে না থামালে আজ বুঝি মেরেই ফেলত জাভেদকে। শরীর স্বাস্থ্যে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাওয়া জাভেদের পক্ষে সেই আঘাত প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না।

এতো অল্প সময় এতো কিছু ঘটে যাওয়ার পর যেটা শায়লা বুঝতে পারলো, সেটা হল জাভেদ কোথাও শায়লাকে এক রিকশায় দেখেছে ইরফানের সাথে, তাও একাধিকবার। শায়লা ভেবে পায় না, আইনিভাবে শেষ করে পেছনে ফেলে আসা কোন সম্পর্কের জেরে কিভাবে একটা মানুষ বাসায় এসে জেরা করতে পারে? শুধু কি তাই, গায়ে হাত তোলার সেই পুরানো অভ্যাস এখনো ছাড়তে পারে নাই লোকটা। কোন অধিকারে শায়লার গায়ে সে হাত তুলল? বদ্ধ উন্মাদ ছাড়া কোন সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ কি এই কাজ করতে পারে? শায়লা ভেবে পায় না, ভাবতেও চায় না। জাভেদ মানেই এখন তার জীবনে পেছনে ফেলে আসা এক ধুসর অধ্যায়ের নাম।

বিকেল বেলা শিবলি রন্তুকে জোর করে তার সাথে ছাঁদে নিয়ে গেল। রন্তু তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছিল, শিবলি ছাঁদে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রাখল রন্তুকে। কান্না একসময় থেমে গেলে পরে জিজ্ঞাসা করল,

‘কিরে তুই কাঁদছিস কেন? বাবা’র জন্য’

‘তুমিও আমার সাথে কথা বলবে না’

‘কেন রে? আমি আবার কি করলাম?’

‘তুমি বাবাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছ’

‘তাই নাকি? তোর বাবা বাসায় এসে কি কাণ্ড করেছে তা দেখেছিস’

রন্তু কিছু বলল না, সে জানে না বাবা কি এমন করেছে। কারণ বাবা যখন বাসায় এসেছে তখন সে ঘুমিয়ে ছিল, হৈহুল্লোড়ে ঘুম ভেঙ্গেছে, তাই সে জানে না ঠিক আগে কি ঘটেছে।

‘কি রে উত্তর দিস না কেন?’

‘জানি না’

‘তোর বাবা যে বাসায় এসে তোর মাকে মারলো সেই খবর রাখিস’

‘মিথ্যে কথা, আমি বিশ্বাস করি না।’

‘বিশ্বাস করিস না! তোর বাবাতো আবার তোর সুপার হিরো’

রন্তু প্রথমে এই কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু অনেকক্ষণ ছোট মামা আর রন্তু চুপ থাকার পর, রন্তু প্রথম কথা বলল,

‘সত্যি?’

‘শুধু তাই না, আরও অনেক অনেক নোংরা কথাও বলেছে’ এই কথা শুনেই রন্তু ছোট মামাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। একসময় উঠে ছাঁদের কোনায় এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু কান্না কিছুতেই থামতে চায় না যেন। এ যে স্বপ্ন ভাঙ্গার কান্না, স্বপ্নের ছবি ভেঙ্গে খানখান হয়ে যাওয়ার কান্না। রন্তু খুব আশা নিয়ে ছিল যে, বাবা আবার ফিরে আসবে, তারা আবার ফিরে যাবে তাদের আগের বাসায়, বাবা-মা’র সাথে অনেক অনেক আনন্দে থাকবে তারা সবাই। কিন্তু সেটা যে মিথ্যে স্বপ্ন ছিল, ঘুমের মাঝে দেখা স্বপ্নগুলোর মত, তা বুঝতে পারে নাই ছোট্ট শিশুমন। একসময় রন্তুকে একা রেখে শিবলি নীচে নেমে এল, ছোট মানুষ, তাকে একা একা কিছুটা সময় কাঁদতে দিল। কেঁদে যদি এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারে ছেলেটা। কিন্তু মানুষের জীবনে কিছু কিছু ধাক্কা থাকে যা কখনো মানুষ কাটিয়ে উঠতে পারে না। জীবনে বারে বারে সেই ধাক্কা যেন ফিরে ফিরে আসে, নানান ঢঙ্গে, নানান ভঙ্গিতে, নানান সঙ্গী তে।

মন্তব্য ৭০ টি রেটিং +৭/-০

মন্তব্য (৭০) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:২৮

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: পোস্ট আপডেট চলছে। কেন যেন পুরো পোস্ট একসাথে পোস্ট করতে পারছি না :(

২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৯

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: অনেক চেষ্টার পরেও শেষ চারটা পর্ব সংযুক্ত করতে পারলাম না, বার বার এরর দেখায়। চেষ্টা করবো আগামীকালের মধ্যে পুরো ২৫ পর্বই সংযুক্ত করে দিতে।

২| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৩০

মশিকুর বলেছেন:

পড়া শুরু করলাম। বিস্তারিত কমেন্ট কালকে করবো :) ১৯ টা পর্ব আসছে! বাকি ৬ টা কই???

২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৮

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: পুরো আপলোড করতে পারছি না, দুপুর থেকে ট্রাই করছি। :(

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:০৭

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: মিডিয়াফায়ারে পিডিএফ লিঙ্ক দিলাম, পুরোটা একসাথে নামিয়ে নিতে পারবেন।

৩| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৬

অপর্ণা মম্ময় বলেছেন: পড়ি নাই। ধরণ যেহেতু উপন্যাস পর্ব আকারে দিলেই পারতেন। এভাবে পড়তে অনেক সময় লাগবে যে!
একটু একটু করে পড়ে কমেন্ট করবো।
এতো দীর্ঘ লেখনীর জন্য অভিনন্দন।

২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৭

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ অপর্ণা মম্ময়, অনেকদিন পর আপনাকে আমার ব্লগে দেখে ভালো লাগছে। কেমন আছেন? আশা করি ভাল।

এই সিরিজটি পুরোটাই পর্ব আকারে পোস্ট করা হয়েছে গত দুই বছরে, পাঠকদের অনুরোধে এই একত্রে পোস্ট দেয়া। পোস্টের শুরুতে এটা উল্লেখ করেছি, হয়ত আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে। :)

ভালো থাকুন সবসময়, শুভ কামনা জানবেন।

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২৯

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: পোস্টের শুরুতে মিডিয়াফায়ার লিঙ্ক যুক্ত করে দিয়েছি, পিডিএফ ফাইল ডাউনলোড করে নিতে পারবেন।

৪| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৮

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: না আমি পলবো না! কাগ কলেছি! আগের সব সিলিজে সাথে থেকেও আমাল নাম নাইক্যা :((

ফান!!! ;)

দারুন কাজ করেছেন। প্রথম +

এবার বই আকারে অফ লাইন পাঠকদের হাতে তুলে দিন আসছে বই মেলায়। অনেক অনেক শুভ কামনা।

২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৬

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: আপডেট নামের তালিকা দ্রষ্টব্য, আপডেট হবার আগেই পাঠ এবং মন্তব্য! একেই বলে একনিষ্ঠ পাঠক ;) ধন্যবাদ ভৃগু ভাই। বই আকারে প্রকাশের ইচ্ছে নাই :( এই সিরিজের পরের খণ্ড খুব শীঘ্রই শুরু করব আশা করি, নাম হবে, "রন্তু'র দিনরাত্রি"।

৫| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৬

খাদেমুল ইসলাম জয় বলেছেন: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ

২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২১

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ খাদেমুল ইসলাম জয়, বোকা মানুষের ব্লগে স্বাগতম।

৬| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৮

সুমন কর বলেছেন: ভালো কাজ করেছো, সময় করে পড়তে হবে। !:#P

জানান দিয়ে গেলাম।

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৫১

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ বন্ধু :)

৭| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩৩

অপু তানভীর বলেছেন: পিডিএফে আললোড দেন ! একসাথে আরাম কইরা পড়ি ।


সামুতে পোস্ট একটা লিমিট আছে আমি যতদুর জানি । সেই টা মনে হয় ক্রস করেছে ।

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:২৬

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: পিডিএফ তো দিলাম, কিন্তু পারমিশনের ঝামেলা। কোন মিডিয়া দিয়ে শেয়ার দিলে যে কেউ সহজে ডাউনলোড করতে পারবে? জানা থাকলে প্লিজ কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না।

ধন্যবাদ অপু, অনেকদিন পর আপনাকে আমার ব্লগে দেখে ভাল লাগলো। ভালো থাকুন সবসময়।

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৪৭

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: মিডিয়াফায়ারে পিডিএফ আপলোড দিয়েছি, লিঙ্ক পোস্টের শুরুতে।

৮| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: আমারো মনে হয় ওয়ার্ড লিমিট ক্রশ করছে। বাকী অংশটূকু কমেন সেকশনে দিতে পারেন এক এক করে। এজন্য আরেকয়া পোস করতে পারেন কিংবা এখানেরই কমেন্টগুলো ডিলিট করে ধারাবাহিকভাবে অংশুগুলো কমেন্টের মাঝে দিয়ে দেন।

সময় নিয়ে পড়বো। শুভকামনা রইলো। :)

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৭

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: আমারও তেমনটাই মনে হচ্ছে :( কমনলি ওপেন ফর অল, এমন কোন মিডিয়া কি আছে যেখানে শেয়ার করলে যে কেউ সহজে ফাইলটা ডাউনলোড করতে পারবে?

পড়া শেষে অভিমত জানাতে ভুলবেন না, অপেক্ষায় রইলাম।

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪৫

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ শতদ্রু ভাই, মিডিয়াফায়ারে পিডিএফ আপলোড করে দিয়েছি। :)

৯| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১৬

কামরুন নাহার বীথি বলেছেন:

প্রথমেই শুভেচ্ছা!!!! তারপরে সব পর্বগুলো পড়ছি!!!!

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৩৮

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ বীথি আপু, ফুলটা বড়ই সৌন্দর্য... :)

১০| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:২৪

জুন বলেছেন: অভিনন্দন বোকামানুষ। বই এর অপেক্ষায়।

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৫৩

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ জুন আপু, আপাতত কোন বইয়ের ইচ্ছে নেই। তবে রন্তুকে নিয়ে ট্রিলজি লেখা শেষে কোন এক বইমেলায় হয়তো বা বই বের হতে পারে। ইট ডিপেন্ডস... :)

১১| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৫২

গেম চেঞ্জার বলেছেন: ভাল একখানা কাম কইরালচেন। ;) ;)

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৫৬

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধইন্যবাদ ভ্রাতা, কমেন্ট কি পজেটিভলি নিব, নাকি নেগেটিভলি? ;) :P

=p~ =p~ =p~

১২| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:০৯

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন: ওরে বাবা! বিশাল বড় লেখা। অনলাইনে এত বড় লেখা পড়া অনেকটা অসম্ভব। পর্ব করেই দেন না ভাই... পিডিএফ পড়তেও স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা লাগে... এর চেয়ে একটু একটু করে ছাড়েন - সেটাই পড়তে থাকি।

২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৫১

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ, বোকা মানুষের ব্লগে স্বাগতম। রন্ত্রু'র কালো আকাশ (সকল পর্বের লিঙ্ক)

১৩| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:২৬

সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: বই হবে কি?
বই কেনার অপেক্ষায় রইলাম।
তিনটা পর্ব পড়লাম। বেশ লাগছিল...

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:২১

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: নারে ভাই, আপাতত বই হওয়ার কোন সুযোগ নাই। অদূর ভবিষ্যতে হলেও হতে পারে।

ধন্যবাদ, পাঠ ও মন্তব্যে কৃতজ্ঞতা রইল। ভালো থাকুন সবসময়।

১৪| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ২:০১

ফেরদৌসা রুহী বলেছেন: সময় করে পড়ে নিব।

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৪৮

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ রুহী, মিডিয়াফায়ার লিঙ্ক (শুরুতে এড করে দিয়েছি) থেকে পিডিএফ ফাইল নামিয়ে নিয়ে সময়-সুযোগ মত পড়ে নিতে পারেন।

১৫| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ ভোর ৪:৫৫

নাজমুল হাসান মজুমদার বলেছেন: ভাই চা পানের বিরতি নিছিলাম , কিন্তু পরে আর পড়া হয় নাই । অনেকটুকু পড়া হইলো । আপনার লেখা অনেক প্রাঞ্জল সাবলীল ।

লেখাটা পর্ব আকারে দিলে অনেক ভালো হইতো ।

দেশে ভালো গল্প লেখকের অনেক অভাব , আপনি লেখা চালিয়ে যান ।

শুভেচ্ছা রইল :)

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১:১৫

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: প্রথমেই ধন্যবাদ নাজমুল হাসান মজুমদার, চা পান শেষ হয়েছে নিশ্চয়ই?

এই সিরিজ পুরোটা পর্ব আকারেই পোস্ট দেয়া হয়েছে। শেষ পর্ব পোস্ট করার পর পাঠক অনুরোধে এই রিপোস্ট। পিডিএফ ফাইল মিডিয়াফায়ার হতে নামিয়ে নিতে পারেন, শুরুতে এড করে দিয়েছি।

ভালো থাকুন সবসময়, শুভকামনা জানবেন।

১৬| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৩৫

অগ্নি সারথি বলেছেন: পিডিএফ দিয়ে ভাল করেছেন। পুরোটা সময় করে পড়ব। আগে দেখেছিলাম আপনার পর্ব গুলো কিন্তু ঢুকতে সাহস করি নাই। কত্ত বড় বড় লেখা। এবার শুরু থেকে শুরু করা যাবে। শুভ কামনা।

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:০৩

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ অগ্নি সারত্থি ভ্রাতা, পুরোটা পড়া শেষে মতামত জানাতে ভুলবেন না যেন। ভালো থাকুন সবসময়।

১৭| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৪৪

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:

সংগ্রহে রইলো। সময় করে পড়ে নিব অবশ্যই।

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৪৫

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ কান্ডারি অথর্ব ভ্রাতা :)

১৮| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৫

তাশমিন নূর বলেছেন: পিডিএফ লিংক দেখে বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। কভারটাও অসাধারন হয়েছে। এম্নিতে ধারাবাহিক লেখা পড়া হয় না তেমন। কারণ- ব্লগে নিয়মিত আসা হয় না। লিংক থেকে পিডিএফ নিয়ে রাখলাম। থ্যানক্স।

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৪২

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: পিডিএফ লিংক দেখে বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। B:-) কেন রে ভাই?

১৯| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৫০

তাশমিন নূর বলেছেন: ফাইলটা নিতে বোধ হয় আপনার পারমিশন লাগবে। ক্লিক করাতে সেরকমই বলল।

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৫

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: পোস্টের শুরুতে মিডিয়াফায়ার লিঙ্ক যুক্ত করা হয়েছে, সহজেই ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। পাঠ পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রইলাম।

পাঠ এবং মন্তব্যে কৃতজ্ঞতা রইল, ভালো থাকুন সবসময়।

২০| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:০৭

হাসান মাহবুব বলেছেন: আসন্ন বইমেলায় রন্তুকে চাই।

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:১৪

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ হামা ভাই, কিন্তু সে সম্ভাবনা যে নাই। :(

২১| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:২৩

ঘুম হ্যাপি বলেছেন: অসাধারণ।

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:২৯

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ। ইয়ে, এখনও কি ঘুমে? ;)

২২| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:১৮

রেজওয়ানা আলী তনিমা বলেছেন: ধন্যবাদ। এবার মেলাতেও প্রকাশ করে ফেলেন। কম্পিউটারে পড়ে মজা নাই।

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৮

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ রেজওয়ানা আলী তনিমা,সুদূর ভবিষ্যতে হয়ত বইমেলায় দেখা যাবে :)

২৩| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:১২

মাহমুদ মাহাদী বলেছেন: এই ঘটনার মূল কারন টা কি? কাকে দোষ দেয়া যায়?
সামু ব্লগ আসলেই একটা সাংঘাতিক আবেগী অথচ জ্ঞানের জায়গা। সামুতে আমি শুধুই পাঠক। আমি আবেগী পাঠক। আপনারা আসলেই অনেক জ্ঞানী মানুষ। এতো বাস্তব কি করে ফুটিয়ে তোলেন?

সামুতে আরো অনেকের লেখাই এমন। অনেক ভালো। আপনারা না থাকলে সামু না জানি কোথায় থাকতো!!!!

এতো আকর্ষনীয় লাগছিলো যে আমি একসাথে পুরোটা পড়েছি।
Hats off!!!!! emon lekha abar kobe diben? dile amake tag korben.

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৫

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: আবেগি মন্তব্যে ভালোলাগা, এমন মন্তব্য পড়ে আবেগাপ্লুত হলাম। আপনার মত পাঠক পেলে মনে হয় পরিশ্রম সার্থক হল। এখানে পুরো ২৫ পর্ব পোস্ট করতে পারি নাই। পোস্টের শুরুতে মিডিয়াফায়ার লিঙ্ক যুক্ত করেছি, সেখান হতে পিডিএফ ফাইল ডাউনলোড করে পুরোটা পড়তে পারবেন।

ভালো থাকুন সবসময়, শুভকামনা রইল।

২৪| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৮

নীল কপোট্রন বলেছেন: সময় করে পড়তে হবে। :)

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৭

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ নীল কপোট্রন। :)

২৫| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২২

মাহমুদ০০৭ বলেছেন: হাসান মাহবুব বলেছেন: আসন্ন বইমেলায় রন্তুকে চাই।
লগে বোকা নামের চালাক মানুষটারেও চাই
;)

অভিনন্দন ভাই । এই প্রথম বোধ হয় কেউ সামুতে পুরো উপন্যাস প্রকাশ করলো ।
এরকম টা হলে এটি মাইলফলক ।

ভাল থাকবেন ভাই । সময় করে পড়ে নেবো ।

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৪

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ মাহমুদ ভাই। বইয়ের তেমন সম্ভাবনা নেই আপাতত, সুদূর ভবিষ্যতে হলেও হতে পারে। রন্তু'কে নিয়ে তিনখণ্ডে উপন্যাস লেখার ইচ্ছে আছে, যার প্রথম খণ্ড ছিল "রন্তু'র কালো আকাশ"। আগামী জানুয়ারি থেকে দ্বিতীয় খণ্ড "রন্তু'র দিনরাত্রি" শুরু করার প্ল্যান আছে। দাওয়াত রইল সাথে থাকার। আর এই খণ্ড পাঠ শেষে মূল্যবান মতামত জানার অপেক্ষায় রইলাম।

মিডিয়াফায়ার পিডিএফ লিঙ্ক পোস্টের শুরুতে সংযুক্ত করা হয়েছে।

২৬| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩২

শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: মিডিয়াফায়ার লিঙ্ক দেয়াতে মানা না থাকলে দিতে পারেন।

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১৯

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ শতদ্রু ভাই :)

২৭| ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:১৭

প্রামানিক বলেছেন: বোকা ভাই, সামনের মেলায় বই বের করেন কাজে লাগবো।

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫৯

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ প্রামানিক ভাই, আপাতত বইয়ের সম্ভাবনা নাই।

২৮| ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:০১

গেম চেঞ্জার বলেছেন: লেখক বলেছেন: ধইন্যবাদ ভ্রাতা, কমেন্ট কি পজেটিভলি নিব, নাকি নেগেটিভলি?

ওঃ এইডা কি কইলেন? আমি তো কইতারুম্না......... আমনের ইটিচিড দিয়াই বিচার কইরালান।


এক কাজ কোরেন। পিডিএফ করে মিডিফায়ারে ফায়ার কইরালান। ;) ;)

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২৬

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ইটিচিড কুণ্ঠে ;)

=p~ =p~ =p~

২৯| ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:১৮

গেম চেঞ্জার বলেছেন: ডাউনলোড করসি......... অশেষ ধন্যবাদ জানবেন ভাই।

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:০৯

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: সাব্বাস, পড়া শেষে একটা রিভিউ টাইপ মতামত কমেন্টে জানিয়ে যাবেন আশা করি। :)

৩০| ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:২৫

সোহানী বলেছেন: প্রথম কথা এভাবে নয়, বই আকারে চাই।

কিছু পর্ব ছাড়া সবই পড়া ছিল তারপরও পাঠকের দৃস্টি থেকে একটু সমালোচনা:

-যদিও উপন্যাস রন্তুকে নিয়ে তাই রন্তুকে গুরুত্ব দিবেন সেটাই স্বাভাবিক তারপর ও শায়লার অনেক কস্ট এখানে ফুটিয়ে তুলেন নাই বা গুরুত্ব দেন নাই। একজন মেয়ে হিসেবে তখন সে মিসিংগুলো ধরা পড়েছে।
- অনেক পর্ব খুব বেশী বিস্তারিত হয়েছে বা মনোটোনাস হয়েছে যেখানে কয়েকটা বাক দরকার ছিল নতুবা পড়তে পড়তে বোর হতে হয়, মনোযোগ হারায়।

সরি আমি আঁতেল না...... শুধুমাত্র দোস্তব্লগারের দাবী নিয়ে সমালোচনা করলাম। আমি জানি সবাই সমালোচনা পছন্দ করে না।

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৫৬

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: প্রথমেই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে রাখি দোস্তব্লগারকে, অনেকদিন পর আমার উঠোনে...

মজার ব্যাপার বলি, আজ সন্ধায় আমি নিজে পিডিএফ হতে পুরোটা পড়া শুরু করেছিলাম। ত্রিশ পাতা পড়ার পর একঘেয়ে এবং বিরক্ত লাগছিল আমার নিজেরই। আসলে ধারাবাহিকভাবে পোস্ট দেয়ার জন্য লিখতে গিয়ে চেতনে বা অবচেতনা অনেক কথা অনেক পর্বে রিপিট হয়েছে, যা একসাথে পড়তে গিয়ে পাঠক হিসেবে নিজেরই ভালো লাগে নাই।

শায়লা সম্পর্কে এই অভিযোগ আপনি সপ্তম পর্বেও করেছিলেন। আসলে সমস্যা হল আমি বাস্তবের যে রন্তুর কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে গল্পটি লিখছি, সে রন্তু'র জীবনে যে শায়লা ছিল, সে বড়ই নির্মম ছিল। রন্তু'র প্রতি তার শেষ বক্তব্যগুলোর একটি ছিল এমন, "বেঁচে থাকলে এমন রন্তু অনেক জন্মাবে"। শুনতে খারাপ হলেও বাস্তবতা নির্মম। আমি চেষ্টা করেছি বেশ কয়েক পর্বে শায়লার মাতৃ হৃদয়টা তুলে ধরার। সর্বোপরি একজন পুরুষ কখনোই নারী হৃদয়ের অনুভূতি বুঝতে সক্ষম নয়। এই গল্পে সমাজের অতি বিরল কিছু হতভাগা রন্তু'র কাহিনী কিছুটা পরিমার্জিত এবং কিছুটা আরোপিত করে তুলে ধরতে চেয়েছি; যা বাস্তবের রন্তু'র কষ্টের উপাখ্যানের এক আনা হয়ত রিপ্রেজেন্ট করে। লেখক হিসেবে এর বেশী কিছু বলার নেই। শুধু বলব, এখানে নারী তথা মা চরিত্রকে অবমূল্যায়ন করা হয় নাই। সমাজের কিছু অতি ব্যতিক্রমী জীবন কাহিনীর একটি চিত্রায়ন করার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র।

সহব্লগারদের কাছ থেকে গালভরা প্রশংসার চাইতে সমালোচনা অধিক কাম্য আমার কাছে। আর আপনি হলেন আমার দোস্ত ব্লগার, আপনাদের স্থান সর্বাগ্রে।

ভালো থাকুন সবসময়, অনেক শুভকামনা রইল। শুভরাত্রি।

৩১| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:১৫

দৃষ্টিসীমানা বলেছেন: সবগুলো পর্ব পড়া হয়নি , বই আকারে পেলে খুব ভাল লাগত । শরণ করায় কৃতজ্ঞ হলাম । অনেক ধন্যবাদ ।

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:২৬

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: ধন্যবাদ আপু, পোস্টের শুরুতে দেয়া লিঙ্ক থেকে পিডিএফ ফাইল নামিয়ে নিতে পারবেন, বই আকারেই তৈরি করা। :)

৩২| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:১৮

জেন রসি বলেছেন: একসাথে দেওয়াতে ভালো হয়েছে। একসাথে পড়ে ফেলা যাবে। :)

২৭ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৩৩

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: পিডিএফ নামিয়ে পড়ে নিয়েন, পোস্টে ২১ পর্বের বেশী দিতে পারি নাই ওয়ার্ড লিমিটেশনের কারনে। মিডিয়াফায়ার লিঙ্ক শুরুতে দেয়া আছে। সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ জেন রসি।

৩৩| ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৫০

কম্পমান বলেছেন: অনেক দিন পর সামু তে আসলাম। অনেক ধন্যবাদ ভাই আমার মত মানুষের কথা বলার জন্য, কিন্তু একটা কথা আপনার লিখনি শক্তি অসাধারণ। অনেক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রইল আপনার জন্য।

প্রচ্ছদ অনেক সুন্দর হয়েছে।

২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:১৯

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: আরে!!! এতো দিন পর! খেলব না কিন্তু, এইটা কিছু হইল?

অনেক ধন্যবাদ কম্পমান, আপনাদের অকৃত্রিম ভালবাসায় রন্তু সিরিজ শেষ করতে পেরেছি, এজন্য কৃতজ্ঞতা জানবেন।

শেষের দিকে আপনি আর ব্লগার 'শ্রেষ্ঠা' তাগিদ না দিলে হয়ত সিরিজটা শেষ হতই না। যাই হোক, এখন লিখছি একটা ৫-১০ পর্বের ভিন্ন বড় গল্প অথবা উপন্যাসও বলা যেতে পারে। আগামী জানুয়ারি'র শেষ নাগাদ রন্তু ট্রিলজির দ্বিতীয় খণ্ড শুরু করার ইচ্ছে আছে, দেখা যাক পারা যায় কি না। আশা করি সাথে থাকবেন।

ভালো থাকুন সবসময়, প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। অনেক অনেক শুভকামনা রইল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.