নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মনের কথা লিখি...

হাতির বাচ্চা

স্বপ্ন দেখি……স্বপ্ন লেখি…

হাতির বাচ্চা › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবন থেকে নেয়া

১৯ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ২:২৬

মামা, আর পাঁচ টা টাকা দেন, কম হয়ে গেল তো”

“কিসের কম মিয়া, ঠিকই তো আছে”

“না ,মামা আর পাঁচ টা টাকা দেন”

এবার অকথ্য ভাষায় এক টা গালি শুনতে হল মতিন মিয়া কে। গায়ে মাখল না সে। অভ্যাস হয়ে গেছে এখন তার। রিকশা চালায় আজ সাত বছর হল । এত দিনে ধাতস্থ হয়ে গেছে এই সব ব্যপারে। রিকশা টা নিয়ে শাহবাগ মোড় এ এসে থামল সে। ২০ টাকায় সবজি ভাত খেয়ে রিকশা টার উপর একটু আয়েশ করে বসল ।সারাদিনে এই একটু সময়ই তার আয়েশের সময়।



মাথার উপরের আকাশ টাকে আজ বড় অচেনা মনে হয় তার। সে ঠিক মনে করতে পারে না আজ থেকে ৪০ বছর আগে সে কি এভাবে বেঁচে থাকার জন্যই ভেঙ্গেছিল সব মায়ার বাঁধন।মা এর চোখের পানি, বাবার কড়া আদেশ , বোনের আকুতি সব কিছুই তার কাছে ওই দিন অনেক তুচ্ছ মনে হয়েছিল তার কাছে।তার মাথায় শুধু ছিল একটাই চিন্তা…”স্বাধীনতা”।



যুদ্ধের নয়টি মাস…তার কাছে তরতাজা সৃত্মিগুলো এখনও।নভেম্বর এর মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে তার গ্রাম এর দুই গ্রাম পরের এক গ্রাম এ অপারেশন এ যায় তাদের একটি দল।সেখান থেকে তারা ধরে আনে এক রাজাকার কে। মতিন অবাক হয়ে দেখল রাজাকার টি আর কেউ নয়, তার ই ছোট বেলার খেলার সাথী শামসুল।মতিন কে দেখে শামসুল তার পা ধরে শুরু করল কান্নাকাটি।

“ মতিন, তুই তো বুঝিস আমি শুধু ভয় পাইয়াই এই পথ এ আইছি”

“কিয়ের ভয় তোর?? তুই না আমাগো মইধ্যে সবচাইতে সাহসী ছিলি??”

“জানিনা মতিন, আমি জানি না, ক্যান আইছি আমি জানিনা।তুই আমারে বাঁচা, কসম লাগে তোর”

“না ,তোরে বাঁচাইলে দ্যাশের খারাপ হইব”

“তোরে আমি কথা দিতাছি, আমি বর্ডার পার হইয়া যামু। তুই আমারে বাঁচা মতিন, দয়া কর”

“ঠিক আছে, দ্যাখতাছি আমি কি করন যায়”

মতিন মিয়ার বন্ধুপ্রেমের কাছে ওই দিন তার দেশপ্রেম হার মেনেছিল।সে জানত না কাজ টা ঠিক কি না ভুল তবুও সে ক্যাম্প কমান্ডার এর কাছে গিয়ে ওই দিন তার বন্ধুর প্রাণ ভিক্ষা চায়। তার কথায় শামসুল মুক্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। শামসুল সত্যি ই তার কথা রেখেছিল। বর্ডার পার হয়ে যায় সে ওই রাতেই।

মাস খানেক পরেই শেষ হয় যুদ্ধ, মতিন মিয়াও ফিরে আসে তার নিজের গ্রামে। কিন্তু ফিরে এসে সে যা দেখে তার জন্য সে প্রস্তত ছিল না মোটেই।বিজয়ের কয়েকদিন আগেই তার বাবা-মা কে গাছ এর সাথে বেধে গুলি করে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী তার যুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে। তার আপন ছোট বোনটিকেও ধরে নিয়ে যায় হানাদার এর দল। তার বোনটি বেঁচে আছে কিনা খবর দিতে পারে না কেউ।উদ্ভ্রান্ত মতিন মিয়া তার বোন এর খোঁজ করে বেড়ায় শুধু।দিন সাতেক পরে জ়েলা শহরের এক বীরাঙ্গনা ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করে সে তার বোন কে। বোন কে নিয়ে নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে চাইল সে, কিন্তু দুই দিনের মাথায় সে তার বোন এর শরীর টা আবিষ্কার করে তার বাড়ির পিছনের গাছে ঝুলন্ত অবস্থায়।মতিন মিয়ার কেন জানি কষ্ট হচ্ছিল না। তার এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিল।চারপাশে কাজ করছিল তার এক নিঃসীম শূণ্যতা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে তার বোন এর লাশটা গাছ থেকে নামিয়ে দাফন করে।জীবন এর কাছে তার তখন খুব বেশি কিছু চাওয়ার ছিলনা।শুধু কিছু প্রশ্নের উত্তর ছাড়া ।

সময়ের সাথে সাথে গড়িয়ে যায় অনেক পানি।নিজের বোন কে দেখেই কিনা জানেনা সে নিজেও এক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে করে মোটামুটি থিতু হয় জগৎ সংসারে।কিন্তু সময়ের পালাবদলের সাথে সাথে হঠাৎ সে আবিষ্কার করল কিছু মানুষ কে সমাজের কর্তা হিসাবে, যাদের সে যুদ্ধের সময় এক কথায় রাজাকার বলে চিনত।সে আরও অবাক হয় যখন সে দেখে শামসুলকে গ্রাম এর মোড়ল হিসাবে।তবে তার অবাক হওয়াটা সীমা ছাড়াল যখন সে একদিন ভোরে শামসুল কে লোকজনসহ তার বাড়ির উঠানে দেখল ।হাতে একটা দলিল ছিল তার।

“মতিন ,অনেক দিন ই তো থাকলি আমার বাড়িতে।এবার একটু ছাড়তে হয় যে”

“তোর বাড়ি মানে?? এইটা কি কস শামসুল ??”

“কি কই বুঝসনা তুই??তোর বাপে আমার বাপের কাছে এই বসত ভিটা যে বেঁইচছিল,জানস সেইটা”

“এই সব কি কস তুই??”

“এই দ্যাখ দলিল, সব লেখাই আছে এইহানে”

“শামসুল তোরে বাঁচানোই আমার ভুল হইছিল, কুত্তার ল্যাজ সবসময় ত্যাড়াই থাকে”

“মুখ সামলাইয়া কথা কও মতিন মিয়া, ভুইলা যেওনা কার লগে কথা কইতাছ। সম্মান দিয়া কথা কইয়ো কইলাম”

“তোরে আমি কি সম্মান দিমু,তুইতো একটা রাজাকার ছাড়া আর কিছুই না”

এরপর আর কিছুই মনে নেই মতিন মিয়ার। মাথার উপর বাঁশের এক প্রচন্ড বাড়ি তার জগৎ পুরোই অন্ধকার করে দিয়েছিল ।জ্ঞান ফিরে নিজেকে সে আবিষ্কার করে হাসপাতালের বারান্দায়। দিন পনের পরে সুস্থ হয়ে সে যখন বাড়ি ফিরে আসে, তখন সে দেখে তার বাড়ির চারপাশে পাহারা বসানো হয়েছে, যাতে সে তার বাড়ি ঢুকতে না পারে।রাগে, দুঃখে,ক্ষোভে সে থানায় যায় মামলা করতে।কিন্তু পুলিশ এর বড় বাবু তো তার মামলা নিলোই না বরং তাকে উলটো ধমকিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিল।জীবনের তাগিদে নিজের আত্মসম্মান এর জলাঞ্জলি দিয়ে মতিন মিয়া আবার শামসুল এর কাছে ফিরে গেল।

“শামসুল,তুইত জানিস আমার এই বসত ভিটা ছাড়া আর কিছুই নেই, আমার লগে এইরকম করিস না তুই”

“দেখ মতিন এই ব্যপারে আমি তোর লগে আর কিছু কইতে চাই না”

“আমি এহন ওগো লইয়া কই যামু তুই ক”

“দেখ তুই আমার ছোট বেলার বন্ধু তাই তোরে কইতাছি, ভাবি রে লইয়া তুই আমার বাড়িতে চইলা আয়।তুই বাইরে কাজ করলি আর ভাবি না হয় ভিতরে কাজ করল। এমনিই আমার মানুষ দরকার কামের।কাছের লোক হইলে সুবিধা হয়”

“এইটা কি কস শামসুল! আমরা এখন তোর বাড়ি কাজ করুম!!”

“দেখ তোর ভালা চাই বলে কইতাছি, তাছাড়া তুই কই যাইবি এখন”

“যেই খানেই যাই, তোর মত পিশাচের বাড়ি কাজ করুম না, রাজাকারের বাচ্চা”

“তুই এক্ষনি বাইরা আমার বাড়ি থেইকা,তোরে যেন কালকে আমি গ্রামে দেখি না, দ্যাখলে পিটাইয়া লাশ বানায় ফেলুম কইয়া দিলাম”

জীবনের কাছে পরাজিত এক সৈনিক হিসেবে ওই রাতেই মতিন মিয়া তার পরিবার নিয়ে ঢাকায় আসে।এখানে এসে শুরু হয় তার নতুন পথচলা।বস্তিতে থাকা,প্রখর রোদে রিকশা চালান, বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রীর আর্তি, ছেলে মেয়ের করুণ চাহনি এসব তার জীবনের এখন নিত্য সংগী।এসব কোন কিছুতেই সে এখন বিচলিত হয় না। শুধু তার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।৪০ বছর আগের আত্মত্যাগ এর প্রাপ্তি কত টুকু তার?? সে কি এই বাংলাদেশ এর জন্য যুদ্ধ করেছিল??

“এই মামা, যাবেন??”

চিন্তায় ছেদ পড়ল তার। তাকিয়ে দেখে এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ তাকে ডাকছে, তার হাত ধরে আছে ৫ বছরের এক শিশু।শিশুটির এ গাল থেকে ও গাল পর্যন্ত এক অদ্ভুত হাসি খেলা করছে।আর হাতে ধরে রেখেছে বাংলাদেশের একটি ছোট্ট পতাকা।নাহ! তার আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি।মতিন মিয়ার মুখেও ফুটে উঠে এক চিলতে হাসি।

“কই যাইবেন,মামা?”

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ২:৪৪

খেয়া ঘাট বলেছেন: বড়ই করুন!!!!!!!!!!!!!!!!!
দারুন করে ফুটিয়ে তুলেছেন।
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
একগুচ্ছ প্লাস।

২| ১৯ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ৩:০২

রেজওয়ানা আলী তনিমা বলেছেন: দারুন লিখেছেন!দেশের জন্য যারা রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করেছেন তাদের আসল প্রাপ্তি স্বাধীন স্বদেশ।

৩| ১৯ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ৮:৩৪

ইমরাজ কবির মুন বলেছেন:
খুব চমৎকার লিখসেন ||

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.