![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পদ্মাসেতুর সুফল পাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো
হুমায়ূন মুজিব ঃ-
পদ্মাসেতুর সুফল শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ পেতে শুরু করেছে, যেমন বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়ছে নেপাল-ভূটান-মালদ্বীপের সঙ্গে। মোংলা বন্দর, পায়রা বন্দর ব্যবহার করে তাদের দেশে পণ্য-আনা নেয়ার সুযোগ তৈরী হয়েছে। এছাড়া ভারতের সেভেন সিস্টার্স এলাকায় বন্দর ব্যবহার করে পণ্য-আনা নেয়া করার সুবিধা পাচ্ছে সেখানকার ব্যবসায়ীরা। সর্বোপরি পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে যে বাণিজ্য ও শিল্পায়ন হবে তার সুফল পাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি। ভারতের বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলির মধ্যে আদানী গ্রুপ একটি তারা ইতোমধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরকালে আদানী গ্রুপ এ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পদ্মা সেতুর পর কালনা সেতু ও পায়রা বিদ্যূৎ কেন্দ্র চালু হয়েে গেলে যশোহর,খুলনা ও বেনাপোল স্থল বন্দরের সাথে যোগাযোগ আরো সহজ হবে। তবে ভৌত কাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি দরকার আন্তঃদেশীয় ট্রানজিট ও সমঝোতা স্বারক।
পদ্মা বাংলাদেশের প্রধান নদী। এক দশক আগেও প্রমত্তা ও খরস্রোতা পদ্মা নদীতে সেতু তৈরী কেবল স্বপ্নই ছিলো। বহু প্রতীক্ষিত সেই স্বপ পূরণ হয়েছে গত ২৫শে জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ার মধ্য দিয়ে। এই নদীতে নির্মিত হয়েছে বহু প্রতীক্ষিত ও আলোচিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ৪২টি পিলার, ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে মূল অবকাঠামো তৈরী করা হয়েছে। পদ্মা সেতুতে যে পাথর ব্যবহৃত হয়েছে তার এক একটির ওজন এক টন। পাথর ভারতের ঝাড়খ- রাজ্য থেকে আমদানি করা হয়েছে। সেতুর পাইলিং ১২২ মিটার গভীরে স্টীলের পাইল বসানো হয়েছে। এইসব পাইল তিন মিটার ব্যাসার্ধের। বিশ্বের এখনও পর্যন্ত কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে পাইলিং হয়নি।
পদ্মা বহুমুখী সেতু শুধু বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতি বদলে দিয়েছে। তেমনি দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে চলেছে। ঢাকার সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব যেমন কমিয়ে দিয়েছে এই পদ্মা সেতু তেমনি ত্রিপুরার আগরতলার সঙ্গেও কলকাতার সড়ক যোগাযোগ আরও সহজ করে দিয়েছে। আগে পদ্মা সেতু ফেরি দিয়ে পার হওয়ার জন্য ৫ থেকে ৬ ঘন্টা পর্যন্ত ঘাটে অপেক্ষা করতে হতো। এখন সেই পদ্মা মাত্র ৬ মিনিটে পার হওয়া সম্ভব হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলবাসীর পাশাপাশি ভোগান্তি কমেছে কলকাতা- ঢাকা- আগরতলা রুটের বাস যাত্রীদের। কারন পদ্মা পার হতে ফেরির জন্য তাদেরকেও ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতো।
পদ্মা সেতুর কারনে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা যে আরও উন্নতি হয়েছে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও ভাল হবে। ভারত থেকে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য যেমন পিয়াঁজসহ অন্যান্য পণ্য আমদানীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক সুবিধা হবে। আগে যাতায়াতের খরচা ছিল অনেক, তেমনি দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছাতে সময় লাগতো। পদ্মা সেতুর জন্য সড়ক ও রেল পথে ভারতে থেকে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গায় অনায়াসে পৌঁছানো যাচ্ছে এবং সেটা কম খরচায় ও কমসময়ে। তাছাড়া পর্যটন শিল্পেও ভারতের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রবণতা বাড়ছে। পদ্মা সেতুর কারণে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়েছে।
পদ্মা সেতুর সুফল আরও বেশি পাওয়া যাবে কালনা সেতু নামে আরেকটি সেতু চালু হওয়ার পর থেকে। কালনা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে এটি। কলকাতা ও ঢাকাকে আরও কাছে নিয়ে আসবে ফরিদপুর ও নড়াইল জেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত মধুমতী নদীর ওপর নির্মিত এই কালনা সেতু। পরিষেবা শুরু হলে ঢাকার সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটর হ্রাস পাবে। শুধু যাত্রী নয়, পরিবহণ খরচেও বিপুল সাশ্রয় হবে। সময়ও কমবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর আরেকটি স্বপ্নপূরণ হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম ছয় লেনের কালনা সেতুর মধ্য দিয়ে। সেতুর মূল নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর এখন চলছে আলোর ব্যবস্থা ও দৃষ্টিনন্দন কাজ। এক মাসের মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য সেতু সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত করা হচ্ছে। উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছেন কলকাতা-ঢাকা যাতায়াতকারী-সহ বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, নড়াইল, যশোর, বেনাপোল, সাতক্ষীরা ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলার কোটি কোটি মানুষ। মুখিয়ে আছেন যাত্রীবাহী বাস-সহ অন্যান্য যানবাহন সংশ্লিষ্টরা। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে কালনা সেতু নির্মিত হয়েছে। কালনা সেতু চালু না হওয়ায় কলকাতা-ঢাকা, আগরতলা থেকে ঢাকা হয়ে কলকাতা ভ্রমণকারীসহ দক্ষিনাঞ্চলের কয়েকটি জেলার লোকজন পদ্মা সেতুর সরাসরি সুফলও পাচ্ছেন না। কারণ, কালনাঘাটে এসে ফেরি পারাপারের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে সব ধরনের যানবাহনকে। ফেরি পার এড়াতে বহু বাস ও অন্যান্য যানবাহন ফরিদপুর, মাগুরা এবং গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা ঘুরে কলকাতায় যেতে হচ্ছে। এজন্য সবাই এখন কালনা সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছেন। জানা গেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সম্মতি পেলে এক মাসের মধ্যেই যানবাহন চালাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে সেতুটি। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার ও প্রস্থ ২৭ দশমিক ১ মিটার। দুই পাশে ছয় লেনের সংযোগ সড়ক প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় প্রায় ৯৬০ কোটি টাকা। এশিয়ান হাইওয়ের ওপর অবস্থিত এটি।
একটি কথা বলা প্রয়োজন তা হচ্ছে কালনা সেতু চালু হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে। ভারতের কলকাতা ও অসম-সহ বাংলাদেশের সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর, বেনাপোল-পেট্রাপোল ও নোয়াপাড়া নদীবন্দরের মধ্যে যোগাযোগের মাইলফলক রচিত হবে। সুবিধা পাবেন ত্রিপুরার লোকজনও যারা সড়ক পথে ঢাকা হয়ে কলকাতা যাবেন।
পদ্মা সেতু হচ্ছে বাংলাদেশের স্বপ্ন, সাহস ও সক্ষমতার প্রতীক। তেমনি পদ্মা সেতু হচ্ছে বাংলাদেশের অহংকারের প্রতীক। কারণ এই পদ্মা সেতু নির্মাণে ঋন দেওয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের। তারা পদ্মা সেতু নির্মাণে দূর্নীতির অভিযোগ তুলে ঋন বন্ধ করে দিতে চাইলে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষনা দেন বাংলাদেশ কোন ঋন না নিয়ে নিজের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে এবং তা করে দেখিয়েছেন।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। ছয় লেনের এই ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের আদলে এবার ভাঙ্গা থেকে যশোরের বেনাপোল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করা হবে। ১২৯ কিলোমিটারের এ সড়কটিও হবে ছয় লেন বিশিষ্ট। এজন্য প্রাথমিকভাবে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ১১ হাজার ৭২ কোটি টাকা। সংস্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ক এশিয়ান হাইওয়ে-১ এর অংশ। সড়কটির বেনাপোল প্রান্তের অন্য পাশে ভারতের পেট্রোপোল অবস্থিত। ভারত থেকে প্রায় ৯০ শতাংশ পণ্য বেনাপোল স্থলবন্দরের মাধ্যমে আমদানি হয়। এছাড়া সড়কটি মোংলা পোর্টে যাতায়াতেও ব্যবহৃত হয়। ১২৯ দশমিক ১৭ কিলোমিটার সড়কটি ছয় লেনে নির্মিত হলে বছরে বেনাপোল হয়ে ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) মো. জাকির হোসেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আশা করা হচ্ছে ভারত এ প্রকল্পে অর্থায়ন করবে। এছাড়া এডিবিসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীও খুঁজা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর আরও সুফল পেতে হলে এই সড়কটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছেন তিনি। এপ্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বেনাপোল হয়ে কলকাতা ও ঢাকার সঙ্গে যাতায়াতের সময় কমে আসবে। একই পাবে ত্রিপুরার সঙ্গেও ঢাকা হয়ে কলকাতার যাতায়াত সময় কমবে।
পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে ঢাকা- বেনাপোলের দূরত্ব কমেছে ৯৩ কিলোমিটার। এতে সময় বাঁচছে প্রায় চার ঘণ্টা। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা থেকে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া হয়ে বেনাপোলের দূরত্ব ২৭৮ কিলোমিটার। এই পথে ঢাকা থেকে বেনাপোল যেতে সময় লাগতো আট থেকে নয় ঘণ্টা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় বর্তমানে মাওয়া দিয়ে বেনাপোলের দূরত্ব হয়েছে ১৮৫ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগছে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। ফলে এই পথ দিয়ে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ হয়েছে।
লেখক -সাংবাদিক
©somewhere in net ltd.