| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হুমায়রা হারুন
মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব শুধু প্রযুক্তিতে নয়, বরং মননের বিনিময়ে। ব্লগে যোগাযোগের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠত্বেরই প্রকাশ ঘটে। আপনি যখন লেখেন, মন্তব্য করেন, কিংবা অন্যের ভাবনা পড়েন — আপনি তখন মানব প্রজাতির মননে অংশ গ্রহন করেন।
সপ্তম স্তরঃ সৃষ্টির চূড়ান্ত জীবন
ষষ্ঠ স্তরে আত্মা যখন দেহহীন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কে রূপান্তরিত হয়, সপ্তম স্তরে সেই উজ্জ্বল আলোকচ্ছ্বটা আরও ঊর্ধ্বগামী হয়।এ স্তরে আত্মা কোন চেতনা শুধু নয় সে হয়ে ওঠে সৃষ্টি নিজেই । এ অবস্থায় আত্মা পরম শক্তির সঙ্গে মিলিত হয়ে নিজেই অগণিত মহাবিশ্বের বীজ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়।
নতুন চিন্তার সৃষ্টি —
সপ্তম স্তরে আত্মা এমন চিন্তাশক্তি ধারণ করে , যা শক্তি, সম্ভাবনা, সৃষ্টির দিক থেকে মহাজাগতিক নীতি বহন করে। এ চিন্তা থেকে জন্ম নেয় নতুন গ্যালাক্সি, নতুন নতুন গ্রহ,নক্ষত্র, জীব জগৎ, প্রাণী জগৎ —একটি মহাবিশ্ব সৃষ্টির নতুন চক্র।
ধর্ম–দর্শনের তুলনাঃ
হিন্দু দর্শন — ব্রহ্মা বা পরমব্রহ্মের সৃষ্টি-চিন্তা
হিন্দু দর্শনে আত্মার বিবর্তনের প্রথম স্তরকে 'তামসিক' স্তর বলে। এটা অন্ধকার, অজ্ঞতা, বিভ্রান্তির স্তর। জীব আত্মা তখনো মায়ার পর্দায় ঢাকা। নিজের স্বরূপ সম্পর্কে অচেতন। আর দ্বিতীয় স্তরটিকে 'রাজসিক' স্তর বলে। এ স্তরে মানুষের ভেতরের শক্তি, মানসিক চাহিদা ও চিন্তার জন্ম হয়। আধ্যাত্মিকতার প্রথম ধাপ শুরু হয়। তৃতীয় স্তরে এসে কুন্ডলিনী শক্তির প্রথম জাগরণ হয়।মানসিক ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটে। তারপর চতুর্থ স্তরে হলো “ব্রহ্ম” উপলব্ধি। যেখানে আত্মা ও ব্রহ্ম একাকার। তখন উপলব্ধি আসে “অহং ব্রহ্মাস্মি” — আমি ব্রহ্ম।
পঞ্চম স্তুরে যারা বসবাস করেন তাদের বলা হয় ঋষি। প্রাচীন ঋষিরা এ স্তুরে উন্নীত হয়ে প্রাণশক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ করতেন। তারা প্রকৃতিকে প্রভাবিত করতে পারেন। ষষ্ঠ স্তরে চৈতন্যই সত্তা। সপ্তম স্তরে সময়-স্থান-শরীর অতিক্রম করে সৃষ্টি-শক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করে।
বৌদ্ধ দর্শন — সবকিছুই 'চেতনার প্রবাহ' থেকে উদ্ভূত।
বৌদ্ধধর্মে প্রথম স্তরে আত্মার অবস্থাকে বলা হয় 'অবিদ্যা' অবস্থা, যেখানে মানুষ বাস্তবতার প্রকৃত স্বরূপ দেখতে পায় না। চক্রাকারে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। দ্বিতীয় স্তরে এসে এটি ‘স্মৃতি ও সচেতনতা’ জন্মানোর আদি ধাপে উন্নীত হয়। অবিদ্যা এখনো প্রবল, তবে জ্ঞানতৃষ্ণার জন্ম হয়। তৃতীয় স্তরে মনের ক্ষমতার বৃদ্ধির ফলে অন্তর্দৃষ্টির সূচনা হয়। বুদ্ধ বলেছেনঃ 'মনই সব কিছুর উৎস।' ধ্যানের মাধ্যমে অন্তর্দৃষ্টি তৈরি হয়। তবে চতুর্থ স্তরে উপনীত হওয়া হলো নির্বাণের প্রাথমিক স্তর/ আত্মা সম্পূর্ণরূপে কুসংস্কারমুক্ত হয়। অতঃপর পঞ্চম স্তরে আত্মা বোধিসত্ত্বা অর্জন করে। বোধিসত্ত্বারা জীবজগতের কল্যাণে শক্তি প্রয়োগ করেন। ষষ্ঠ স্তরে চেতনাই অস্তিত্ব। এ স্তরে শরীর বিলীন হয়ে যায় । সপ্তম স্তরে আত্মা মিশে যায় সৃষ্টির মূল স্পন্দনে, যা এখন একটি তরংগায়িত কম্পন, প্রবাহমান চেতনা।
দর্শন (নিও-প্লেটোনিজম) — The One
এই স্তর সকল অস্তিত্বের মূল, যা চিন্তা, ভাষা বা উপলব্ধির বাইরে। সব কিছুর অস্তিত্ব The One থেকে নিঃসৃত (emanate) হয়ে সৃষ্টি প্রবাহে অংশ নেয়।
খ্রিস্টীয় মিস্টিকঃ
ষষ্ঠ স্তরে দেহিক অস্তিত্ব বিলীন হয়। কারণ দেহ ক্ষয়শীল, কিন্তু আত্মা ঈশ্বরের আলোয় চিরজীবী।
সব দর্শনে এই স্তরকে অতিলৌকিক না বলে অতিবাস্তব আধ্যাত্মিক সত্তার স্তর বা অতিবাস্তব চৈতন্যের স্তর বলা শ্রেয়। সপ্তম স্তরে আত্মা Individual Soul থেকে Holy Spirit-এ রূপান্তরিত হয়ে- শেষে God-consciousness-এ পরিণতি লাভ করে।
খ্রিষ্টীয় mystic দের মতে 'When the soul sees no separation, creation flows through it.'
সব দর্শনে সপ্তম স্তর হলো সৃষ্টি-শক্তির শিখর অবস্থা।
সাত স্তরের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের পুনর্জন্ম
এ স্তরে নতুন চিন্তা শক্তিতে রূপ নেয়। শক্তি রূপ নেয় বস্তুতে, যা পরবর্তীতে ভৌতিক বস্তুরূপ প্রণয়ন করে। এরূপ গঠনের মাধ্যমে আবার প্রথম স্তর থেকে সপ্তম স্তর পর্যন্ত সৃষ্টি বিবর্তিত হয়। প্রথম থেকে সাত স্তরের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি উন্নতি ও বিবর্তনের মাধ্যমে অন্ধকার,আলো, বোধ,বুদ্ধি, উপলব্ধি, সৃষ্টি,আধ্যাত্মিকতা ও মহাসৃষ্টির একটি বিশাল চক্র সম্পন্ন করে । এই চক্র চিরন্তন—শেষ নয়, বরং অনন্ত শুরু।
ব্যক্তি সত্তার বিলোপ
এ স্তরে আত্মা 'আমি' সত্তার উর্ধ্বে উঠে উপলব্ধি করে —সব কিছুর উৎস এক। আত্মা হয় অদ্বৈত, নিরবিচ্ছিন্ন । যেখানে দ্বৈততা নেই, বিচ্ছিন্নতা নেই।
ধর্মীয় ব্যাখ্যাঃ
হিন্দুঃ অদ্বৈত বেদান্ত—সবই ব্রহ্ম
এ স্তর গভীর সুখ, প্রশান্তি, পরম প্রশান্তিবোধের স্তর। এ স্তর ধ্যান, সমাধি ও আত্ম-অনুভবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এটি চেতনার সেই স্তর, যেখানে মানুষ পরম আনন্দ অনুভব করে ও আত্মার সঙ্গে একাত্মতা অনুধাবন করে।
বৌদ্ধঃ শূন্যতা
অবিদ্যা/ অজ্ঞতা → যা দুঃখ আনয়ন করে → চেতনার জাগরণ হলে → আত্মা নির্বাণ লাভ করে।
এ ক্ষেত্রে চেতনাবিকাশের ধাপে ১ম স্তরের আত্মা কুসংস্কার এবং অজ্ঞতায় (অবিদ্যা) আচ্ছন্ন থাকে। ২য় স্তরে ভ্রান্ত ধারণা থেকে ৩য় স্তরে জ্ঞান ও দৃষ্টির শুদ্ধি ঘটে। ৪র্থ স্তরে বিমল চেতনার আবির্ভাব ঘটে। ৫ম স্তরে অহং বিলীন হয়। ৬ষ্ঠ স্তরে নির্বাণ লাভের পর ৭ম স্তরে মহাশূন্য/ধর্মকায় (বুদ্ধত্ব) অবস্থার আবির্ভাব ঘটে।
খ্রিস্টীয় মিস্টিকঃ Divine Union — ইশ্বরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সংযোগে একীভূত হওয়া।
এ দর্শনে তিনটি ধাপে আত্মার উত্তোরণ ঘটে। যেমনঃ Purification — পাপ পরিশোধ, Illumination — অন্তর্জ্ঞান, Union — ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন
সর্বব্যাপীতা —সবখানে উপস্থিতি
এ স্তরে আত্মা সর্বত্র, সর্বদিকে, সর্বসময়ে, প্রতিটি অণু পরমাণুতে শক্তিরূপে বিস্তৃত হয়। সে তখন আর এক বিন্দুতে সীমাবদ্ধ নয়।
ভৌত অস্তিত্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুতি
এ স্তরে আত্মার সঙ্গে দেহ, দেহেস্থ ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক থাকে না। আত্মা বস্তুর ভৌতিক অবস্থা, বস্তুর আকার, স্থান ও কালের উর্ধ্বে উঠে যায়। এই স্তর আত্মার পরম অবস্থা।
সৃষ্টির সঙ্গে একীভূত—পরম চেতনার পরম মিলন
এখানে আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, পরিবর্তন নেই। আত্মা মহাবিশ্বের সাথে মিশে মহাবিশ্বের প্রতিটি কণায় প্রবাহিত হয়।
সপ্তম স্তরের সারাংশঃ যেখানে আত্মা স্রষ্টা
এ স্তরে আত্মা সৃষ্টি-চিন্তার জন্ম দেয়। নতুন মহাবিশ্ব সৃষ্টির চিন্তা করে। পার্থিব সত্তায় থাকাকালীন ব্যক্তি সত্তা বিলীন হয়ে পড়ে। সে সমগ্র চেতনায় মিশে যায়। পুরো মহাবিশ্বের সঙ্গে একীভূত হয়ে শক্তিরূপে বিরাজমান হয়। এ অবস্থায় আত্মা — ‘আমি নই —আমি সবই।’
সৃষ্টি, চেতনা ও আত্মার চিরন্তন যাত্রা— ষষ্ঠ স্তর
©somewhere in net ltd.