নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বি.দ্র.- বিরক্তিকর, দীর্ঘ, পুরুষ-বিদ্বেষী লেখা। সময় কম থাকলে (এবং আপনি পুরুষ হলে) শুধু প্রথম “কুইজ” অংশটা পড়ুন। বাকি সব আবর্জনা। না পড়লেও চলে।
“পুরুষদের” জন্য একটা কুইজ-
আপনি একটু চোখ বন্ধ করে পাঁচটি বাংলা গালি দিন তো। ভাবা-ভাবি না, যেটা মনে আসে সেটাই দিন।
দিয়েছেন?
শাবাশ!
একটু ভাবুন- আপনার দেয়া ৫টি গালির সবকটিই (বা অধিকাংশই) কি কোন-না-কোন ভাবে নারীর সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়? এবার এই গালিগুলোর সমকক্ষ অন্য কোন গালি ভাবুনতো যেটা পুরুষকে নিয়ে তৈরি?
কি? কিছু পেলেন?
আমি ফলিত ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্র। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি- একটা সমাজের ব্যবহৃত ভাষা ঐ সমাজের মানুষের মনোবৃত্তি প্রকাশ করে।
(এ বিষয়ে আরও জানতে চাইলে স্ট্যানফোর্ডের এই লিংকটা দেখতে পারেন)
প্রসঙ্গ কথা-
পহেলা বৈশাখের ঘটনা সবাই এতক্ষণে জেনে গেছেন এবং সরকার, পুলিশ, ছাত্রলীগ, ধর্মীয় উগ্রপন্থী রাজনীতি, মুক্তমনা প্রজন্ম, বেপর্দা নারী- সবার, সবার গুষ্টি উদ্ধার শেষ। একদল চাইছেন ছেলেগুলারে ধরে প্রকাশ্যে ‘খোজা’ বানানো হোক আরেকদল দেখলাম ‘শরীর দেখানো’ মেয়েলোকরে উচিত শিক্ষা দিয়েছে দেখে তাদের সংবর্ধনার আয়োজনে ব্যস্ত।
কিন্তু আসল প্রশ্নটা কেউ করছেন না। একবারের জন্যও জানতে চাচ্ছেন না- এরকম কেন ঘটলো? এমন কি কারণ থাকতে পারে যার জন্য একটা (বা একাধিক) ছেলে প্রকাশ্য দিবালোকে সবার সামনে অপরিচিত একটি মেয়ের বস্ত্রহরণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলো না? একবারও তার কেন মনে হলো না এটা অনুচিত?
জানি, উত্তরে বলবেন- বিচারহীনতার সংস্কৃতি। ১৯৯৯ সালের বাঁধন বা হালের ২০১০ সালের রাজু ভাস্কর্য় ইনসিডেন্টের মত ঘটনাগুলোর বিচার হলে এরকমটা ঘটতো না। স্বীকার করছি কথা সত্য। কিন্তু শুধুই কি বিচারহীনতা?
উত্তরটা আমি আমার জীবন থেকে দেই। বাংলাদেশে একটা ছেলের বেড়ে ওঠাটা একটু লক্ষ্য করি। আমার স্কুল কলেজ দুটোই ছিলো বয়েজ। স্বাভাবিকভাবেই বন্ধুরা সবাই ছেলে। পিউবার্টির সময় যখন একটু একটু করে নারী-পুরুষ ব্যবধান বুঝতে শিখলাম তখন আমার নারী বিষয়ক সকল ‘জ্ঞান’ কোথা থেকে পেয়েছিলাম? উত্তর- সেই ছেলে বন্ধু যে নিজেও নারী সম্পর্কে আমার থেকে বেশি জানে না। আমি কি জ্ঞান পেয়েছিলাম? নারী সম্পর্কে আমার কি অ্যাটিটিউড ছিলো? কোন চোখে দেখতাম আমার চারপাশের মেয়েদের?
বাংলাদেশী কিশোর, তরুণের বেড়ে ওঠার মনস্তত্ব এবং নারীর পণ্যায়ন -
আমি জোর দিয়ে বলতে পারি বাংলাদেশের অধিকাংশ ছেলের নারী সম্পর্কে জ্ঞানের সূত্রপাত হয় পিন-আপ ম্যাগাজিন, ফুটপাতের চটি বই, পর্ন আর বন্ধুদের আড্ডার মাধ্যমে। এবং বলাই বাহুল্য এগুলোতে নারীর যে পোর্ট্রেট পাওয়া যায় সেটা ভীষণ রকম বিকৃত।
টিন এইজে মাসুদ রানা, হুমায়ূন, মিলন, আনিসুল হক বা (ইন রেয়ার কেইস) সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ হয়ে একটা ছেলে যখন যৌবনে পৌঁছায় ততদিনে তার মনে শক্ত ধারনা জন্মে যায় নারী প্রধানত ভোগের বস্তু; প্রেম ও কাম ব্যতীত জগৎ সংসারে তার আর কোন উপযোগিতা নাই। এর পাশাপাশি আছে শীলা-মুন্নি-বিল্লু বা তাগা-ওয়েস্টেক্স এর বিশাল বিলবোর্ড যা প্রতি পলে নারীর ‘আসল’ ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দিবে আপনাকে। আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? কোন মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলা- “মালটাতো জোস”- এই কথা একবারও কানে আসেনি আপনার?
(মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রাণভোমরা হলো- পণ্য। যত বেশি বিক্রয়যোগ্য পণ্য, তত টাকা, তত প্রবৃদ্ধি। এই চক্করে পড়ে আজ সবচেয়ে বিক্রয়যোগ্য পণ্য হলো- নারী। খারাপভাবে বললে নারীদেহ। নারীর পণ্যায়ন নিয়ে অনেক ভালো ভালো বই এবং ডকুমেন্ট্রি রয়েছে। সময় থাকলে একাত্তর টিভির করা এটা দেখতে পারেন। ৪১ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের ডকু। বিলিভ মি, এটা দেখার পর নারীকে দেখার চোখ বদলে যাবে।)
আমার নিজেরও নারী সম্পর্কে ধারনা স্বচ্ছ ছিলো না। কলেজে পড়ার সময় পর্যন্ত প্রচুর হুমায়ূন গলাধঃকরন, টিভি দেখা এবং বন্ধুদের নতুন প্রেমের অভিজ্ঞতার মিথষ্ক্রিয়ায় ধারনা জন্মেছিলো- নারী মানেই হলো অদ্ভুত এক প্রজাতি যারা গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরে ফ্রেঞ্চ বেনীর খোঁপায় সাদা জারবারা গুঁজে কোন এক ভ্যাগাবন্ডকে নিজের হৃদয় দেবার জন্য ঘন মাশকারা দেয়া ছলছল চোখে ঘুরে বেড়ায়। ৬ বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে নারী-ঘনত্বপূর্ণ (!) স্থান কলাভবনে একদিনের জন্যও এরকম কাউকে পাইনি। বুঝেছি, কল্পনা আর বাস্তবে বিশাল ফারাক।
অতঃপর এক যুবকের মেটামরফসিস-
জীবনে প্রথম মেয়েদের সাথে মেশার সুযোগ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। কলা অনুষদের ‘লিপস্টিক’ ডিপার্টমেন্টগুলোতে বরাবরই ছেলের থেকে মেয়ের সংখ্যা বেশি। তা সে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যায় হোক বা শিক্ষক-শিক্ষিকার। প্রথম প্রথম হেজিটেশন আর লজ্জা মিশ্রিত এক অনুভূতি নিয়ে কথা শুরুর পর ধীরে আবিষ্কার করি মেয়েদের মানবীয় রূপ।
বলতে দ্বিধা নেই আমার ধারনা ছিলো মেয়েদের জগৎ শুধু পোষাক, সাজ আর ইটিং আউটে সীমাবদ্ধ। ‘মেইবলিনের কলোসাল কাজল ভালো না ল্যাকমির আইকনিক?’ অথবা ‘খাটোদের ভার্টিকাল আর লম্বাদের হরাইজন্টাল স্ট্রাইপের কামিজে ভালো মানায়’- এর বাইরে যে মেয়েদের সাথে অন্যকিছু নিয়ে কথা বলা সম্ভব সেটা প্রথম আবিষ্কার করি এই ক্যাম্পাসে এসে।
আমার এক শিক্ষয়ীত্রি (এবং পরবর্তীকালে আমার সকল সিদ্ধান্তের মেন্টর) প্রথম আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখান আমার ভুল। নানা কারণে প্রায়ই তাঁর সাথে জমে উঠতো আড্ডা-তর্ক। আমি বরাবরই মানুষের সুন্দর কথায় মুগ্ধ হই। তন্ময় হয়ে শুনতাম তাঁর কথা। ফ্যাশান থেকে রাজনীতি, লিটারেচার থেকে রিলিজিওন। উনার জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর চিন্তার গভীরতা শুধু মুগ্ধ করতো না, মানুষ হিসেবে আমার অজ্ঞতা, মূর্খতা বড় বেশি করে স্পষ্ট হয়ে উঠতো।
জীবনে প্রথমবারের মত প্রেম-ভালোবাসার বাইরে নারীকে শ্রদ্ধা করতে শিখলাম তাঁর কাছে। এরপর আসলেন আরও তিন শিক্ষয়ীত্রি। নারী মানেই যে একই টাইপের স্টক ক্যারেক্টার না বরং একেক টাইপের ডাইনামিক চরিত্র সেটা অনুভব করলাম তাঁদের কাছে। ধীরে ধীরে বাড়লো বন্ধুর সংখ্যা, পেলাম সিনিয়র আপুদের। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এতদিন যা জেনে এসেছি তা ভুল। আমার অনেক মেয়ে বন্ধুই জগৎ সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি ধারনা রাখে।
পুরো শৈশব-কৈশর-যৌবনের প্রারম্ভ বই পড়ে কাটিয়েছি বলে যে চাপা অহংকার আমি পুষে রেখেছিলাম মনের গভীরে আমার এক বান্ধবী দুই ঘন্টার আড্ডায় ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলো তা। ওর পড়ার গন্ডীর কাছে অসহায় লেগেছিলো নিজেকে। নিজের কোন বোন না থাকার কষ্ট জীবনে প্রথমবারের মত উপলব্ধি করেছিলাম সিনিয়র আপুদের ভালোবাসায়। ইংরেজি বিভাগে ছয় বছরে যদি কিছু শিখে থাকি সেটা হলো নারীকে মানুষ হিসেবে দেখতে শেখা।
আমি ভাগ্যবান খুব দ্রুতই কিছু অসাধারণ নারীর সাথে পরিচয় হয় আমার। ফলে ভুল ভেঙে যায় দ্রুতই। সবাই কি ভাগ্যবান হয়? আমার আশেপাশেই দেখতাম আমার বয়েসি (এবং সিনিয়র) ছেলেদের, নারীকে ‘পাবার’ জন্য দিনরাত সিসিফাসের মত সার্কাস-রত। মিথ্যা প্রশংসা নয়, বুকের দিকে না তাকিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারলেই যে নারীর কাছে যাওয়া যায়- এই তথ্য তাদের অজানা। তাদেঁর কাছে নারী শুধুই নারী। মানুষ নয়, বরং অন্য কোন প্রজাতি।
যে ছেলেটা নারীকে মানুষ হিসেবে ট্রিট করতে ব্যর্থ, তাঁর কাছ থেকে আপনি নারীর প্রতি ভালো ব্যবহার আশা করেন? আপনি কখনও লাক্স সাবান ব্যবহার করার আগে তার প্যাকেট খোলার সময় কিছু চিন্তা করেছেন? নারী যখন পণ্যে পরিনত হয় তখন কি এমনই হবার কথা নয়?
দোষ আমাদের সবার। আমরাই আমাদের ছেলেদের কাছে পণ্য হিসেবে তুলে ধরছি আমাদের মেয়েদের। নারী যে মানুষ, চিন্তা চেতনা আর গড়নের প্রকৃতি-প্রদত্ত পার্থক্যের পরেও যে তার রয়েছে একটা মানবীয় সত্তা সেটা আমরাই তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি এবং ক্রমাগত হচ্ছি। যতদিন আমাদের ছেলেদের কাছে মেয়েদেরকে “মানুষ” হিসেবে তুলে ধরতে না পারবো এটা ঘটতেই থাকবে। মনের মধ্যে বিষ থাকলে আপনি শাস্তির জুজুর ভয় দেখিয়ে কতদিন আটকাবেন? সম্মান, শ্রদ্ধা মানুষ শুধু মানুষকে করে, কোন ‘মাল’কে না।
পয়লা বৈশাখের ঘটনার উপযুক্ত শাস্তি কি হতে পারে আমি এখনও বের করতে পারছি না। সেদিন ঐ মেয়েগুলো যে মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছে সেই অবস্থার ভেতর দিয়ে কি একটা পুরুষকে আদৌ নেয়া সম্ভব? উপযুক্ত শাস্তি তাহলে কি হতে পারে?
শেষ কথা-
প্রথমে দেয়া কুইজটার সূত্র ধরে বলি- যে ভাষা তার কন্যাদের সাথে এতকাল ধরে বৈষম্য করে আসছে সে ভাষার পুরুষদের এই আচরনে আমি একটুও অবাক নই।
আই রিপিট- একটুও না!