নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দূর ঐ নীল আকাশে, তারা-নক্ষত্রের মতই হাজার হাজার গল্প ঝুলে রয়েছে, আমি সেই গল্পগুলোই বলতে চাই।

সন্যাসী পিপড়া

দূর ঐ নীল আকাশে, তারা-নক্ষত্রের মতই হাজার হাজার গল্প ঝুলে রয়েছে, আমি সেই গল্পগুলোই বলতে চাই।

সন্যাসী পিপড়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প:সন্তান

১৬ ই মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৫:০২

প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেও এই গ্রামের নাম ছিল জাহাঙ্গীর চর । চর শব্দটি কোন গ্রামের সাথে সংযুক্ত থাকলেই বোঝা যায় নদী ভাঙ্গনের পর আবার নতুন করে ডাঙ্গায় পরিণত হওয়া কোন গ্রাম ।আবার নদী গর্ভেই হয়তো চলে যাবে কোনদিন । এখন কেউ ঐ নামে ডাকে না বা কেউ হয়তো জানেও না এই কঠুরী গ্রামের পূর্ব নাম কি ছিল । এই প্রশ্ন তো আর বি সি এস পরীক্ষার সাধারণ জ্ঞান অংশে থাকবে না । তাই কেউ আগ্রহ প্রকাশও করে না । গাছ-গাছালিতে ভরপুর ছিল এক সময় । রাস্তার দুই ধারে কত রকমের যে গাছ ছিল তা বলে শেষ করা যাবে না । তবে বড় বড় পাঁচ-ছয়টা পালান এখনও বিদ্যমান , তবে সেখানেও গাছের সংখ্যা সীমিতই বলা যায় । কারণ এখন সব কিছুর মাঝেই মানুষ টাকা খুজে । এমনকি পায়খানায় খুজতেও দ্বিধা করবে না । আর টাকার জন্য গাছ কাটা তো ডের সহজ । এই টাকার জন্য ছেলে তার আপন বাপকে মাড়তে উদগ্রীব । ভাই-ভাইয়ের সাথে দ্বন্ধ তো আছেই ।



একটি মসজিদ আছে এই গ্রামে । যেখানে গোটা কয়েক মুসল্লি নামায পড়ে প্রতিদিন । শুধু শুক্রবারের জুম্মায় মসজিদ ভরে যায় । কে জানে শুধু মিলাদ পড়তেই যায় কিনা সবাই । কারণ মিলাদ শেষে আমৃত্তি বিতরণ হয় । রমজান মাসের শেষ দশদিন তো কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় মসজিদ ।এমনকি মসজিদের বাইরেও অনেককে নামায পড়তে দেখা যায় । এই শেষ দশ দিনও প্রচুর মিলাদ পড়ানো হয় । এই গ্রামের লোকসংখ্যা প্রায় পনেরশয়ের মত । সবার ছেলে-মেয়েরাই স্কুল কলেজে যায় । শুধূ যেতে পারে না ছালাম ।



ছালামের বাবা হাকিম । সবাই হাকি বলেই ডাকে । বয়স পঞ্চাশ-ষাটের কোঠায় । ঠিকমত কাজ করতে পারে না । দুই দিন কাজ করলে তিন দিনই বিশ্রাম নিতে হয় তাকে । ছালাম হাই স্কুলে যাওয়ার পর থেকে হাকির কাজ আরো কমে গেল । ছালাম মোটামুটি ভাল ছাত্রই ছিল । দেখতে কালোই । কিন্তু তার চোখ দু’টি আকর্ষণীয় । কালো মুখে কালো চোখ । এ যেন অন্য রকম সৌন্দর্য সৃষ্টিকর্তার । চিকন-চাকন দেহ । সে যেন তার মায়ের কাছে কালো মানিক । হাকির বয়স বেশী হলে কি হবে । সে বিয়ে করেছিল বিশ বছর বয়সে । কিন্তু অনেক দিন তাদের বাচ্চা-কাচ্চা হয় নি । শেষ পযর্ন্ত যাও হল এই শেষ বয়সে । তার বউ ডালিমা সব সময় তার স্বামীকে নিয়ে চিন্তিত থাকে । হাকি দেখতে কালো, চিকন-চাকন দেহের গড়ন , ছোট-খাটো হলেও ডালিমা কিন্তু দেখতে ভালোই উজ্জল শ্যামবর্ণ , দেহের গঠন বেশ । তার বাবা-মা ছিল না । মামার বাড়িতে মানুষ । হাকি প্রস্তাব দেওয়ার সাথে সাথে তার মামা-মামী রাজী হয়ে গিয়েছিল । হয়তো আপদ বিদায় করেছে । ডালিমাও অমত হয় নি । কিন্তু বিয়ের পর থেকে তারা একটি সন্তানের জন্য কতই না চেষ্টা করেছে । কত পীড়, ফকির, কবিরাজ, ডাক্তার দেখিয়েছে কাউকে বাদ দেয় নি । তাতেও কিছু হল না । সহজ-সরল হাকি তার মিষ্টি সুন্দর বউ কে বলেছে ‘‘থাক, বাদ দাও । দু’জনে সারাজীবন এমনেই কাটায়া দিমু ।’’ কিন্তু বউ কিছু বলে নাই , শুধু অসহায় চোখে তাকিয়ে ছিল স্বামীর দিকে ।



হাকি আর তার বউ যে বাড়িতে থাকে সেটা আসলে তাদের না । ছোট্ট বাড়ি । একটি মাত্র কুড়ে ঘর । ঘরটিকে প্রতি বছর ছন দিয়ে জোড়া দেওয়া লাগে । না হলে ঝড়-বৃষ্টিতে উড়ে যেতে পাড়ে । এমনিতেই সম্ভবনা থাকে । তাদের বাড়ির উঠানে লাউ-গাছের জাংলা আছে । যেখানে বড় বড় আকারের লাউ ধরে । তারা সেই লাউ খায় আবার বাজারে বিক্রিও করে । ছালাম জন্ম নিবার ঠিক আগের বছর ,তখন হাকি কোন জায়গায় কাজ না পেয়ে বড় মিয়ার বাড়িতেই কাজ করতো । বড় মিয়া এই গ্রামের সবচেয়ে ধনী । তার নাম নজরুল ইসলাম । বয়স ষাট-সত্তরের মত হবে । সে নিজের বয়স লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করে । সে সব সময় দাড়িতে মেহেদী লাগিয়ে রাখত । উচ্চতা প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি । দেহে এখনও বয়সের ছাপ পড়ে নি । তার বউটি মাড়া গেছে প্রায় ছ’বছর । তার দুই ছেলে । মিলন ও শান্ত । ঢাকায় থেকে পড়ালেখা করে । গ্রামে মাঝে মাঝে আসে । কিন্তু বেশীদিন থাকে না ।তাদের যেন গ্রামের প্রতি কোন ভালবাসা নেই । তারা অনেক বার চেষ্টা করেছিল বাবাকে শহরে নিয়ে যাবে । কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে । বড় মিয়ার ও একই কথা , বেঁচে থাকতে বাপের ভিটা ছাড়বে না । তাছাড়া এত জমিজমা ,এত বড় বাড়ি ছেড়ে কারই বা থাকতে ইচ্ছে করে । ছেলেরা আশাহত হয়েছে ।



এই বড় মিয়া বেশী সুবিধার লোক না । তার কাছে গ্রামের দশ-বারটা পরিবার জিম্মি আছে । কেউ তার কাছ থেকে বড় অংকের টাকা সুদ নিয়েছে । কারও জমি বন্ধক আছে । কেউ জমি বর্গা নিয়েছে । আর হাকিমের তো নিজের জমি বলতে কিছুই নেই । বড় মিয়াই তাকে ঐ জমিটুকু দিয়েছিল । কথা ছিল কাজের জন্য যখন ডাকা হবে চলে আসতে হবে । কি আর করা । আজও তেমনই এক ডাকে এসেছে হাকি ।

কিরে হাকি, তোর বউয়ের বাচ্চা অয় না জেনেও তালাক দ্যাছ না ক্যান ।

কি,কন বড়মিয়া তালাক দিমু ক্যান ওর তো কেউ নাই ।

না থাকলে জাহান্নামে যাইবো , ওমন বউ কেউ রাখে । তাইলে আর একখান বিয়া কর ।

নিজেই খাইতে পারি না ঠিক মতন ,আবার বিয়্যা ।

তুই তো ডুবালি আমাদের । যাই হোক , আজ রাতে মুকেশের সাথে বান্দুরা যাবি ।কিছু মাল খালাস করতে হইবো । ঠিক আছে ।

ঠিক আছে ,বড়মিয়া যামুনে ।

মনটা খারাপ করে হাকি চলে গেল বাড়ির দিকে । দিনভর কাজ করার পর কারই বা আবার রাতে বের হতে মন চায় । তখন মন চায় মাথার নিচে নরম বালিশ আর পায়ের নিচে কোল-বালিশ দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমানো । কিন্তু বড়মিয়াকে তো না করা যায় না ।



সন্ধ্যা সাতটা । হাকি বউকে বলে হারিকেন নিয়ে ঘর থেকে পা বাড়াল বড় মিয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে । সেখানে তার জন্য মুখেশ অপেক্ষা করছে । সে পৌছালে এক সাথে রওনা হবে । ঝি ঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে চলল হাকি । আম-তলা দিয়ে যেতে হয় , বাম পাশে বাশঝোপ । এই বাশঝোপে নাকি দুপুরে বা সন্ধ্যায় অনেকেই ভয় পায় । পশ্চিম পাড়ার জনি নাকি এক সন্ধ্যায় যাচ্ছিল একা একা এই পথ ধরে । বাশঝাড়ের কাছাকাছি আসা মাত্র সে দেখতে পেল সাদা কাপড় পড়া এক বৃদ্ধা মহিলা তার দিকে তাকিয়ে আছে আর ডাকছে । সে নাকি এই সামান্য দৃশ্য দেখেই অজ্ঞান হয়ে যায় । পরদিন সকালে তাকে বাশঝাড়ের ভিতর পাওয়া যায় । জ্ঞান ফিরলে সে এইসব জানায় গ্রামের লোকদের । তারপর থেকে পাড়তপক্ষে এই পথে কাউকে আসতে দেখা যায় না । কিন্তু হাকিকে যেতে হয় । এটাই সোজা রাস্তা । সে কোন দিন কিছু দেখে নি বা শুনে নি । কেন যে মানুষ ভয় পায় । এত সুন্দর বেলে মাটির পথ । যেখান দিয়ে দিব্যি খালি পায়ে হেটে যায় হাকি ।



বড় মিয়ার বাড়িতে পৌছালে মুখেশের সাথে দেখা । মুখেশ দেখা মাত্রই খ্যাক খ্যাক করে উঠে । বলে বড়মিয়া তো খ্যাইপ্যা আছে । কখন থেইক্যা বইস্যা আছি । হাকি বলে কই দেরী করলাম । এত খ্যাক খ্যাক করিছ না চল্ চল্ । তারপর বড়মিয়াকে সালাম করে দু’জনে চলতে থাকে । এই গ্রাম থেকে বান্দুরা প্রায় আট-দশ মাইল । তাদের হেটে যেতে হবে আবার হেটে আসতে হবে ।



বড়মিয়া বাড়ি থেকে বের হয় । আগে দেখে আশে-পাশে কেউ আছে কিনা । দেখে কেউ নাই । এত রাতে কেউ থাকারও কথা না । ধীরে ধীরে চিন্তা করতে করতে হাটে সে । বামে মসজিদ রেখে বাশঝাড়ের পথ ধরে । এই রাস্তায় সে ভুলেও আসে না । কিন্তু ডালিমার সাথে ক’দিন ধরে তার ভালই ভাব জমে গেছে । ডালিমা যখন তার বাড়িতে কাজ করতে আসে ,তাকে দেখে মিষ্টি মিষ্টি হাসে । দু’একটা সুখদুঃখের কথাও বলে । আজই ডালিমা তার দুঃখের কথা খুলে বলে । তার সন্তান না হওয়ার দুঃখ । স্বামী নিয়ে সে দুঃখী । তখনই বড়মিয়ার বুঝতে বাকি থাকে না ডালিমা কি চায় । সে যে কোন মূল্যে একটা সন্তান চায় । বড়মিয়ারও অনেকদিনের অতৃপ্ত আশা পূরণ হবে । তাই আজ সকল ভয়ভীতি দূর করে ভয়ংকর বাশ-ঝাড় পাড় হয়ে হাকির দুয়ারে দাড়ায় সে । তার জন্য অপেক্ষা করছিল ডালিমা । ডালিমা শব্দ পেয়েই ঘরের দরজা খুলে দেয় ।

হাকির ফিরতে রাত তিনটা বেজে যায় । বাড়ি ফিরেই সে বিছানায় শুয়ে পরে । তার বউ তাকে আদর যত্ন করে শোয়ায় । হাত-পা টিপতে থাকে । মাথায় হাত ভুলিয়ে দেয় । নরম সুরে কথা বলে । হাকিও ধীরে ধীরে ঘুমের দেশে চলে যায় । তার বউ তৃপ্তি নিয়ে তার পাশে শুয়ে পড়ে ।



হাকির বয়স দিন দিন বাড়ছেই । তার ছেলেকে নিয়ে চিন্তা । কিভাবে পড়ালেখা করাবে । টাকার অভাবে শেষ পযর্ন্ত তার লেখা-পড়া চালানো সম্ভব হয় না । বড়মিয়ার কাছে ডালিমা গিয়েছিল টাকার জন্য । কিন্তু সে তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে । এখন দুই বাপ-বেটাই বড়মিয়ার বাড়িতে কাজ করে । বড়মিয়া মাঝে মাঝে অন্য দৃষ্টিতে তাকায় হাকির ছেলের দিকে ।।





মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.