![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দূর ঐ নীল আকাশে, তারা-নক্ষত্রের মতই হাজার হাজার গল্প ঝুলে রয়েছে, আমি সেই গল্পগুলোই বলতে চাই।
আজ সন্ধ্যায় গোরস্থানের পাহাড়াদার মারা গেল। নাম তার পিন্টু মিয়া। তবে তার মৃত্যুতে গ্রামে এক ধরণের উত্তেজনা কাজ করছে। কারণ তার লাশ পাওয়া গেছে সদ্য মৃত কুমারী সেতুর কবরে। লাশটা নগ্ন ছিল, নগ্ন ছিল পিন্টু। ডাক্তার বলেছে, হার্ট এ্যাটাকে পিন্টুর মৃত্যু হয়েছে।
গ্রামের চেয়ারম্যান ও ময়-মরুব্বিরা বসে মিটিং করছেন লাশ নিয়ে কি করবেন? সবাই যখন তার লাশটা উদ্ধার করে তখন বেলা ৯টা। কেউ একজন হঠাৎ করে আবিষ্কার করে মৃত সেতুর কবর খোড়া। সে একা যেতে ভয় পায়, গ্রামে কয়েকজনকে নিয়ে যায়, দেখে পিন্টু উলগ্ন হয়ে লাশের উপর শুয়ে আছে। সবাই দেখে প্রথমত লজ্জায় সেখান থেকে সরে আসে। দূর থেকে পিন্টুকে ডাকে। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরও যখন পিন্টুর কোন পাত্তা নেই, তখন সন্দেহ করে যে পিন্টুও মরে যায় নি তো। তাদের সন্দেহই সঠিক হয়।
পিন্টুর গ্রামে কোন আত্মীয়-স্বজন নাই। কোন গ্রাম থেকে এসেছে কেউ বলতে পারবে না। গোরস্থান পাহাড়া দেওয়ার জন্যে লোক দরকার পড়লে, সে কোথা থেকে যেন উদয় হয়। তার আচার-ব্যবহার খুবই ভাল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত অত্যন্ত ভদ্র লোক বলা চলে তাকে। কেউ কেউ তার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। সে কারো সাথে তেমন কথাবার্তা বলত না। শুধুমাত্র দরকার হলেই সে কথা কইত। তার কথা শুনে অনেকে ধারণা করেছে সে শিক্ষিত। কিন্তু মুখে কিছু বলতে সাহস করে নি।
সেতু গ্রামের এক প্রতাপ-শালী ব্যবসায়ীর মেয়ে। খুব মেধাবী। তার ইচ্ছে ছিল কবি হবে। কিন্তু তার বাবা তাকে বিয়ে দিবেন বলে উঠে-পড়ে লেগেছিল। সেও নাছোরবান্দা। বিয়ে সে কিছুতেই করবে না। তার ধ্যান-ধারণা সব কবিতার প্রতি। একটি কবিতা পত্রিকায় ছাপা হয়। সবাই খুব প্রশংসাও করে। তার ডায়রীতে খুজলে এখনও অনেক কবিতা পাওয়া যাবে। গ্রামের সবাই তাকে খুব ভালবাসত বলা চলে।
একদিন পিন্টুকে দেখা যায় তার সাথে কথা বলতে। পিন্টুর কথা সেতু একদিন তার মাকে বলেছিল, মা গোরস্থানের ঐ ছেলেটা খুব ভাল।
কোন ছেলেরে?
ঐ যে পাহাড়া দেয় যে।
হতে পারে। তাই কি?
না এমনি বললাম, ছেলেটাও কবিতা ভালবাসে। শিক্ষিত, কিন্তু পেটের দায়ে এই কাজ করছে।
সে করুক। পেটের দায়ে তো অনেকে অনেক কিছু করছে, চুরি তো করছে না। ভাল ছেলে বোঝাই যায়। কিন্তু তার বাড়ি-ঘর কোথায় কে জানে?
আমি জানি। বলে সে চুপ করে থাকে। তার মা তাকে অনেক প্রশ্ন করে কিন্তু সে উত্তর দেয় না।
কিছুদিন আগে গ্রামের সবাই কানাকানি করে সেতু ও পিন্টু লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছে। কিন্তু কেউ মুখে বলতে পারে না, কারণ কেউ স্বচক্ষে দেখে নি। একদিন গ্রামের এক ছেলে তাদেরকে হেসে কথা বলতে দেখেছিল, সেইটা সে অন্য একজনকে বলে, অন্যজন অন্যজনকে, এভাবে একটি সামান্য বিষয় বড় আকার ধারণ করে।
সেতুর বাবা তাকে জিজ্ঞাসা করে, কথা কি সত্য?
না।
তাহলে সবাই যে বলে?
আমি কি জানি?
তার বাবা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলে, আর যেন না শুনি।
তার কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে, লোকে বললে তো হবে না। সে আমার কবিতা পছন্দ করে। তাই তাকে একদিন একটি আবৃতি করে শুনিয়েছিলাম।
থাক, তার বাবা রেগে যায়, আর শোনানোর দরকার নাই।
ঠিক আছে।
এর কিছুদিন পর, সেতুর বিয়ের প্রস্তাব আসে পাশের গ্রামের এক ধনী পরিবার থেকে। সে কিছু বলে না। তাকে দেখতে আসলে সেজে-গুজে তাদের সামনে যায়। তাদের আপ্যায়ন করে। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে যায় তারা। সেতুর পরিবারের সবাই খুব খুশি হয়।
কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই সেতু অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার ডাকা হয়। কিন্তু কোন রোগ নাই। ডাক্তার কয়েকদিনের জন্যে বিশ্রাম নিতে বলে চলে যায়।
পিন্টুকে অকারণে কেমন যেন দেখায়। সে রোগা হয়ে গিয়েছিল। পঁচিশ-ছাব্বিশ বয়স্ক পিন্টু ভেঙে পড়ে। ঘর থেকে সে বেশি একটা বের হয় না। শুধু একদিন সে মধ্য রাতে বের হয়। হাঁটতে হাঁটতে বাঁশ ঝাড়ের ভিতর চলে যায়। সেখানে একজনের সাথে দেখা করে। মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যে তার সাথে কথা বলতে পারে সে। তারপর ফিরে আসে নিজ ঘরে।
যেদিন সেতু মারা যায়। মারা যায় বললে ভুল হবে, বলতে হবে আত্মহত্যা করে। বিষ খায় সে। রাতে বিষ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আর জাগে না। সকালে সবাই চিৎকার-চেচামেচি করে। কিন্তু কেউ ঘর খুলে না। তখন বাধ্য হয়ে দরজা ভেঙে প্রবেশ করে দেখে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু বুক আর উঠছে না নামছে না। তার শ্বাস-প্রশ্বাসও চলছে না।
তার কবর দেয়ার সময় পিন্টু সেখানে ছিল না। কোথায় ছিল কেউ বলতেও পারবে না। কেউ কোন সন্দেহও করে নি।
এখন সবাই ভেবে পাচ্ছে না লাশটা নিয়ে কি করবে? এমন নোংরা মনের মানুষকে তো এই গ্রামের কবরে রাখা যাবে না। তাই তারা ঠিক করল পদ্মার জলে ভাসিয়ে দিবে। আর এতদিন কাজ-কর্ম করেছে এই জন্যে কাফনের কাপড় পরানো হবে।
একটা কলা-গাছ কেটে ভেলা বানিয়ে পদ্মার পাড়ে নিয়ে চলল দলবেধে। তার লাশ ভেলার উপর রেখে ভাসিয়ে দিল পানিতে। তখন ঢেউ ছিল না, কিন্তু স্রোত ছিল, সেই স্রোতের টানে ধীরে ধীরে ভেলাটা দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। সবাই তাকিয়ে দেখছে। এমন দৃশ্য সচরাচর কেউ দেখে না। যদিও মাঝে মাঝে অচেনা লোকের লাশ ভেসে আসে এই পদ্মায়। তবুও এই সব দৃশ্য দেখে সবাই শিহরিত হয়। বারবার দেখতে চায়।
ভেলাটা এখন অনেক দূরে চলে গেছে। লোকজনও কমতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে ভেলাটা অদৃশ্য হয়ে গেল। সবাই যাওয়ার পরও একজন বৃদ্ধ লোক সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। হয়ত তার নিজের মৃত্যুর কথা চিন্তা করছে। এতই গভীর ভাবে চিন্তা করছে যে বারবার ভেলার উপর লাশের দৃশ্য তার মনের আয়নায় ভেসে উঠছে।
©somewhere in net ltd.