নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি হুসাইন বিল্লাহ একজন ডিজিটাল মার্কেটিং স্পেশালিষ্ট এবং ব্লগার।

হুসাইন বিল্লাহ

হুসাইন বিল্লাহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাক্ষাৎকার: জ্যাক ক্রিস্টোফ - ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর অর্থনৈতিক মডেল

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ১২:২১

মানুষের কল্পনা শক্তি ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রথম ধাপ। আজকের কল্পনা হয়তো আগামীর বাস্তবতা। "ভবিষ্যতের সাক্ষাৎকার" সেই কল্পনাকে ভিত্তি করেই গড়ে তোলা একটি অনন্য সংগ্রহ, যেখানে পাঠক ১০০ কাল্পনিক মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এরা কেউ অর্থনীতির অগ্রপথিক, কেউ প্রযুক্তি বিপ্লবের রূপকার, আবার কেউ কৃষি ও মহাকাশ গবেষণায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দূত। তাঁদের চিন্তা, জীবনযাপন এবং কাজের ধারা আপনাকে ভবিষ্যতের প্রতিটি দিগন্ত সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করবে।

বইটির লেখক হুসাইন বিল্লাহ সোনিসিয়াম লি: এর সিইও, ডিজিটাল মার্কেটিং প্রশিক্ষক এবং "যুব উন্নয়ন ফ্রিল্যান্সিং একাডেমি"-এর প্রতিষ্ঠাতা। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং সৃজনশীল চিন্তার সমন্বয়ে তিনি এই বইটি লিখেছেন, যা শুধুমাত্র পাঠকদের অনুপ্রাণিত করবে না বরং তাঁদের কল্পনার শক্তিকে জাগিয়ে তুলবে।

"ভবিষ্যতের সাক্ষাৎকার" আপনাকে নিয়ে যাবে এমন এক জগতে, যেখানে সীমাবদ্ধতার কোনো জায়গা নেই। এটি কেবলমাত্র একটি বই নয়—এটি ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার একটি নতুন উপায়। আপনার চিন্তা ও কল্পনাকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলতে, আপনাকে এক অবিশ্বাস্য যাত্রায় আমন্ত্রণ জানাচ্ছে "ভবিষ্যতের সাক্ষাৎকার"।

এখানে প্রকাশিত হলো প্রথম সাক্ষাৎকারের প্রথম দ্বিতীয় পর্ব:

প্রশ্ন: আপনি মনে করেন ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়ন কীভাবে বৈষম্য সৃষ্টি করছে এবং এর সমাধান কী হতে পারে?

উত্তর:

ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়ন একদিকে বিশ্বকে দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে এর কারণে বৈষম্যের নতুন এক রূপ সৃষ্টি হয়েছে। যখন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়, তখন এর সুবিধা সাধারণত প্রথমে উন্নত দেশ ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ মানুষের কাছেই পৌঁছায়। উন্নত দেশগুলোতে ডিজিটাল অবকাঠামো, ইন্টারনেট সুবিধা এবং প্রযুক্তিগত ডিভাইসগুলো সহজলভ্য হওয়ায়, সেখানে দ্রুতগতিতে প্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহার করা সম্ভব হয়। কিন্তু অনেক উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশ এবং সেখানকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী এই প্রযুক্তিগত সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এই প্রক্রিয়াটিই ডিজিটাল বৈষম্য সৃষ্টি করে।

ডিজিটাল বৈষম্য বলতে বোঝানো হয় যে, কিছু মানুষ সহজে প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করতে পারে, আর কিছু মানুষ তা থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষত শিক্ষার ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং চাকরির সুযোগগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সহজে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু যাদের কাছে এই প্রযুক্তির সুবিধা নেই, তারা এসব সুযোগ থেকে পিছিয়ে পড়ে। এই বৈষম্য সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রভাব ফেলে। প্রযুক্তিগত অবকাঠামো না থাকায় অনেক মানুষ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অনেক কর্মী প্রযুক্তি ব্যবহার না করায় কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকছে।

১. বৈষম্য সৃষ্টির কারণ

# ক) প্রযুক্তির প্রাপ্যতা এবং সহজলভ্যতার ঘাটতি
প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো প্রযুক্তির প্রাপ্যতা ও সহজলভ্যতার ঘাটতি। উন্নত দেশগুলোতে দ্রুতগতির ইন্টারনেট, কম খরচে প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সহজলভ্য ডিজিটাল ডিভাইস রয়েছে, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই সুবিধা এখনও অনেক জায়গায় সীমিত। এমনকি দেশগুলোর মধ্যে গ্রামীণ ও শহুরে অঞ্চলের মধ্যেও বিশাল পার্থক্য রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেটের গতি ধীর, অনেক জায়গায় তা একেবারেই নেই। এছাড়াও, আধুনিক ডিজিটাল ডিভাইস যেমন স্মার্টফোন, কম্পিউটার ইত্যাদির দাম অনেক বেশি, যা অনেক মানুষের পক্ষে ক্রয় করা সম্ভব হয় না।

# খ) ডিজিটাল শিক্ষার অভাব
অনেক জায়গায়, মানুষ ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা নিতেও পারে না, কারণ তাদের ডিজিটাল শিক্ষা নেই। প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রাথমিক জ্ঞান না থাকলে, তারা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। গ্রামীণ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে এই ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব অত্যন্ত প্রকট। ফলে তারা প্রযুক্তির সুবিধাগুলি বুঝতে ও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়।

# গ) অর্থনৈতিক বৈষম্য
অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে অনেক মানুষ প্রযুক্তির সুবিধা ভোগ করতে পারে না। দরিদ্র মানুষরা ইন্টারনেট বা প্রযুক্তিগত ডিভাইসের খরচ বহন করতে পারে না। এতে তারা প্রযুক্তিগত সেবা থেকে পিছিয়ে পড়ে, যেখানে উন্নত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষরা সহজেই তা ভোগ করে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রেও ডিজিটাল বৈষম্য তৈরি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে আরও বড় ধরনের বৈষম্য তৈরি করে।

# ঘ) সামাজিক এবং ভৌগোলিক বৈষম্য
ডিজিটাল বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়, সামাজিক এবং ভৌগোলিক অবস্থানের ওপরও নির্ভর করে। কিছু সমাজের নারীরা প্রযুক্তির ব্যবহারে পিছিয়ে থাকে কারণ তাদের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ এবং স্বাধীনতা সীমিত থাকে। এছাড়া ভৌগোলিক বৈষম্যের কারণে অনেক দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষ ডিজিটাল সংযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।

২. সমাধান

# ক) প্রযুক্তির প্রাপ্যতা বাড়ানো
ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে প্রথম এবং প্রধান পদক্ষেপ হলো, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে উন্নয়নশীল দেশ এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান করতে হবে। এমনকি স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের মাধ্যমে গ্রামীণ ও দূরবর্তী অঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছানো যেতে পারে। এতে করে প্রত্যেক মানুষ ডিজিটাল দুনিয়ার অংশ হতে পারবে।

# খ) ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার
মানুষের মধ্যে ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানোর জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা প্রয়োজন। সরকার এবং এনজিওগুলোর সহযোগিতায় স্থানীয় স্কুল, কলেজ, এবং কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে বিনামূল্যে বা কম খরচে ডিজিটাল প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে। এই প্রশিক্ষণগুলোতে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রাথমিক ধারণা থেকে শুরু করে উচ্চতর প্রযুক্তিগত দক্ষতা শেখানো হবে, যাতে সবাই প্রযুক্তির সুবিধা নিতে পারে।

# গ) প্রযুক্তির উপর আর্থিক ভর্তুকি প্রদান
ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর জন্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট সেবার উপর আর্থিক ভর্তুকি বা সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য বিনামূল্যে বা কম খরচে ইন্টারনেট পরিষেবা দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া, সাশ্রয়ী দামে স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট সরবরাহ করার মাধ্যমে আরও বেশি মানুষকে ডিজিটাল সেবা গ্রহণে সহায়তা করা যেতে পারে।

# ঘ) সরকারি এবং বেসরকারি অংশীদারিত্ব
ডিজিটাল বৈষম্য দূর করতে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে। সরকার এককভাবে এই বৈষম্য দূর করতে পারবে না, তাই বেসরকারি টেলিকম কোম্পানি, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং এনজিওগুলোকে যুক্ত করে ডিজিটাল সেবার বিস্তৃতি বাড়ানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার, যা ডিজিটাল সংযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বৈষম্য দূর করবে।

# ঙ) সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন
ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে নীতিগত সমাধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দেশ এবং অঞ্চলে ডিজিটাল সেবা প্রসারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যা ডিজিটাল অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং সবার জন্য প্রযুক্তির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করবে। এই নীতিমালা অনুসরণ করে সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলো নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করবে এবং ডিজিটাল বৈষম্য কমবে।

ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়ন সমাজের বিভিন্ন স্তরে নতুন ধরনের বৈষম্য তৈরি করছে, যা শুধু প্রযুক্তিগত নয় বরং অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে মানুষকে বিভক্ত করছে। তবে, সঠিক উদ্যোগ, শিক্ষার প্রসার, এবং প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব। সরকার, প্রতিষ্ঠান, এবং সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ডিজিটাল বৈষম্য কমিয়ে সমাজের প্রতিটি স্তরকে ডিজিটাল দুনিয়ার অংশ করে তুলতে পারে।

প্রশ্ন: ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের কী ভূমিকা থাকা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর:

ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং এটি বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ডিজিটাল অবকাঠামোতে বিনিয়োগ এবং এর যথাযথ ব্যবস্থাপনা একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হতে পারে। তাই সরকারকে এই ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করতে হবে। নিচে ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কিছু প্রধান দিক আলোচনা করা হলো:

১. নিয়ন্ত্রক এবং নীতিমালা প্রণয়নকারী
প্রথমত, সরকারকে ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সঠিক নীতিমালা এবং আইন প্রণয়ন করতে হবে। এই নীতিমালা নিশ্চিত করবে যে, ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরি এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবার জন্য সমান সুযোগ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারকে টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরের জন্য একটি স্বচ্ছ এবং কার্যকর নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি করতে হবে, যাতে বেসরকারি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ধারিত নিয়মাবলির মধ্যে থেকে ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারে।

সরকারের দায়িত্ব হলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর কার্যকর এবং নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করা। সাইবার নিরাপত্তা ও তথ্যের সুরক্ষার বিষয়ে স্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে জনগণকে একটি সুরক্ষিত ডিজিটাল পরিবেশ প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়াও, ডিজিটাল সেবা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তথ্য অধিকার, ডেটা প্রাইভেসি, এবং অনলাইন নিরাপত্তা নীতিমালাও জরুরি।

২. অবকাঠামোগত বিনিয়োগ
সরকারের আরেকটি বড় দায়িত্ব হলো ডিজিটাল অবকাঠামোয় সরাসরি বিনিয়োগ করা। উদাহরণস্বরূপ, দ্রুতগতির ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক, এবং ব্রডব্যান্ড পরিষেবার বিস্তৃতি সরকারী অর্থায়ন এবং নীতিমালার মাধ্যমে ত্বরান্বিত করা যেতে পারে। বিশেষত গ্রামীণ এবং দুর্গম এলাকায় যেখানে বেসরকারি কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিক কারণে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়, সেখানে সরকারকেই বিনিয়োগ করতে হবে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এসব অঞ্চলে এখনও প্রযুক্তির সুযোগ সীমিত। এই অঞ্চলে ডিজিটাল অবকাঠামো পৌঁছানো সম্ভব হলে দেশের সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া, সরকারের উদ্যোগে বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারলে গ্রামীণ এবং শহুরে অঞ্চলের মধ্যে ডিজিটাল বৈষম্য কমে আসবে।

৩. ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং শিক্ষা
ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি সরকারকে ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ শুধুমাত্র অবকাঠামো উন্নয়ন করলেই হবে না, জনগণকে এর সঠিক ব্যবহার শেখাতে হবে। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিজিটাল শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে হবে।

ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার করতে সরকারকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে, যাতে সাধারণ জনগণও ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। বিশেষ করে প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মাঝে এই শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত জরুরি।

৪. বেসরকারি খাতের সাথে সহযোগিতা
ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার এবং বেসরকারি খাতের মধ্যে একটি কার্যকর অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা প্রয়োজন। বেসরকারি টেলিকম এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। তবে, সরকার যদি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে মিলে পরিকল্পনা করে কাজ করে, তাহলে এটি আরও কার্যকর হবে।

যেমন, সরকার বেসরকারি কোম্পানিগুলোর জন্য কর ছাড় বা ভর্তুকির সুবিধা প্রদান করতে পারে, যাতে তারা দূরবর্তী ও অনুন্নত অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়। এছাড়া, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (PPP) মাধ্যমে সরকার এবং বেসরকারি খাত মিলে বৃহত্তর ডিজিটাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে।

৫. ইন্টারনেট সুবিধার সমতা নিশ্চিত করা
ইন্টারনেট সুবিধা সবার জন্য সমানভাবে নিশ্চিত করা সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। শহরাঞ্চলে অনেক সময় ইন্টারনেট সুবিধা সহজলভ্য হলেও, গ্রামীণ এবং দরিদ্র এলাকাগুলোতে এটি অত্যন্ত সীমিত। সরকারের উচিত এই বৈষম্য কমিয়ে সকল মানুষের জন্য সমানভাবে ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করা।

সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামীণ ও প্রান্তিক এলাকাগুলোতে উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপনের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। উদাহরণস্বরূপ, ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার স্থাপন এই লক্ষ্যে একটি বড় পদক্ষেপ হতে পারে। এতে করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও ডিজিটাল দুনিয়ার সাথে যুক্ত হতে পারবে এবং তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং অর্থনৈতিক সেবায় ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে অংশগ্রহণ করতে পারবে।

৬. সাইবার নিরাপত্তা ও নৈতিক ব্যবহারের বিধান
ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি। সরকারের উচিত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নৈতিক ব্যবহার এবং সুরক্ষিত তথ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আইন প্রণয়ন করা। সাইবার আক্রমণ, তথ্য চুরি, এবং অন্যান্য ডিজিটাল অপরাধ থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য উপযুক্ত নীতি ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

সরকারকে অবশ্যই একটি শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা দেশের সকল ডিজিটাল সম্পদকে রক্ষা করবে। সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত প্রচারণা এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালানো প্রয়োজন।

৭. বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তিগত মানদণ্ড রক্ষা
বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে, একটি দেশের প্রযুক্তিগত মানদণ্ড আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে দেশের ডিজিটাল অবকাঠামো আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি মানদণ্ড মেনে চলে। এর ফলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারবে এবং বৈশ্বিক প্রযুক্তি ব্যবস্থায় সংযুক্ত হতে পারবে।

উপসংহার
ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, সরকারের নেতৃত্ব এবং সহযোগিতা ছাড়া এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন। সঠিক নীতি, অবকাঠামোগত বিনিয়োগ, শিক্ষার প্রসার, এবং সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সরকার ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে এবং ডিজিটাল যুগের সুযোগগুলো সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারে।

প্রশ্ন: প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা কীভাবে ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে সাহায্য করতে পারে?

উত্তর:

প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে ডিজিটাল প্রযুক্তির উপর নির্ভরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা ছাড়া কোনো ব্যক্তির পক্ষে নতুন প্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ডিজিটাল বৈষম্য বলতে বোঝায় সেই ব্যবধান, যা প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিদ্যমান। ডিজিটাল বৈষম্য ঘোচাতে প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা কীভাবে কাজ করে, তা নিচে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

১. প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়ানো
ডিজিটাল সাক্ষরতা মানুষকে প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা প্রদান করে। অনেক মানুষই আজকের যুগে প্রযুক্তির অভাবে পিছিয়ে পড়ছে, বিশেষত যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে না বা কম্পিউটার পরিচালনায় দক্ষ নয়। প্রযুক্তিগত শিক্ষা এ ধরনের মানুষদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি তাদের প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সচেতন করে এবং তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা প্রদান করে।

যেমন, ইন্টারনেট ব্রাউজ করা, ইমেল ব্যবহার করা, অনলাইন ফর্ম পূরণ করা, অথবা মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা—এগুলো ডিজিটাল দুনিয়ার মৌলিক কাজ, যা শিখতে পারলে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে ডিজিটাল সুযোগগুলো গ্রহণ করতে পারবে। ডিজিটাল সাক্ষরতার মাধ্যমে এই ধরনের মৌলিক দক্ষতা অর্জন করা সহজ হয়, যা ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে সাহায্য করে।

২. শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি
ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ালে শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি পায় এবং মানুষ তার পেশাগত জীবনে প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। ডিজিটাল সাক্ষরতা মানুষকে বিভিন্ন অনলাইন শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্মে সংযুক্ত হতে সাহায্য করে, যা তাকে নতুন দক্ষতা শেখার সুযোগ দেয়। যেমন, একজন শিক্ষার্থী অনলাইনে কোর্স করতে পারে বা নতুন কোনো বিষয় সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে পারে, যা তার পেশাগত জীবনে কাজে আসবে।

অনলাইনে চাকরি খোঁজা, আবেদন করা, বা অনলাইন মার্কেটপ্লেসে নিজের কাজের প্রচার করার মতো সুযোগগুলোও ডিজিটাল সাক্ষরতার মাধ্যমে পাওয়া যায়। প্রযুক্তিগত শিক্ষার মাধ্যমে একজন মানুষ অনলাইনে কাজ করে অর্থ উপার্জনের সুযোগ তৈরি করতে পারে, যা তার অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং বৈষম্য হ্রাসে সহায়তা করে।

৩. প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি
ডিজিটাল বৈষম্যের একটি প্রধান কারণ হলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে গ্রামীণ বা দরিদ্র অঞ্চলগুলির মানুষ ডিজিটাল প্রযুক্তির সুযোগ গ্রহণ করতে পারে না। এই অঞ্চলে ডিজিটাল অবকাঠামো এবং ইন্টারনেট সংযোগের অভাব থাকে এবং অনেক মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহারের পদ্ধতি জানে না। প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় যুক্ত করতে পারে।

ডিজিটাল সাক্ষরতা কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে প্রশিক্ষণ দিতে পারে। এতে করে তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সেবা পেতে সক্ষম হবে। বিশেষত, অনলাইন ব্যাঙ্কিং, সরকারি সেবা গ্রহণ, এবং ব্যবসায়িক সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে তারা অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পারবে।

৪. তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি
ডিজিটাল বৈষম্য দূর করতে তথ্যের সহজলভ্যতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিজিটাল সাক্ষরতা মানুষকে ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করার দক্ষতা প্রদান করে। ইন্টারনেট হলো এক বিশাল তথ্য ভাণ্ডার, যেখানে মানুষ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণা করতে পারে, নতুন নতুন ধারণা ও জ্ঞান অর্জন করতে পারে। এটি তাদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ায় এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সহায়তা করে।

যারা ডিজিটাল সাক্ষরতায় দক্ষ, তারা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সেবা সম্পর্কে সহজেই জানতে পারে। তারা অনলাইনে ব্যাংকিং সেবা, চিকিৎসা সেবা, এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধার তথ্য পেতে সক্ষম হয়। এভাবে ডিজিটাল সাক্ষরতার মাধ্যমে মানুষ তার প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে বৈষম্য কমে আসে।

৫. নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ বৈষম্য কমানো
ডিজিটাল বৈষম্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো লিঙ্গ বৈষম্য। অনেক সময় নারী ও মেয়েরা ডিজিটাল প্রযুক্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, বিশেষত গ্রামীণ বা দরিদ্র পরিবারে। তবে ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে।

যেমন, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নারীরা নতুন দক্ষতা অর্জন করতে পারে এবং ঘরে বসেই ফ্রিল্যান্সিং বা অনলাইন ব্যবসা শুরু করতে পারে। এছাড়া, ডিজিটাল শিক্ষার মাধ্যমে নারীরা তাদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন হতে পারে এবং বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগে অংশ নিতে পারে। এভাবে নারীরা ডিজিটাল দুনিয়ার সুযোগ গ্রহণ করে তাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান উন্নত করতে পারে এবং লিঙ্গ বৈষম্য কমাতে সহায়তা করতে পারে।

৬. স্বাস্থ্যসেবার প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি
ডিজিটাল সাক্ষরতার মাধ্যমে মানুষ অনলাইন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারে, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, টেলিমেডিসিন এবং অনলাইন ডাক্তারের পরামর্শ সুবিধা মানুষকে স্বাস্থ্যসেবার দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য হলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ সমানভাবে এই সেবা গ্রহণ করতে পারে।

অনলাইন স্বাস্থ্য পরামর্শ, ভিডিও কনসালটেশন, এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অ্যাপ্লিকেশনগুলো ব্যবহার করে মানুষ দূরবর্তী এলাকাতেও চিকিৎসা সেবা নিতে পারে। এভাবে প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও ডিজিটাল সাক্ষরতা মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণে সহায়তা করে এবং বৈষম্য কমায়।

৭. অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ব্যবসার প্রসার
ডিজিটাল সাক্ষরতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব, কারণ এটি মানুষকে অনলাইন ব্যবসার সুযোগ প্রদান করে। একজন প্রযুক্তি শিক্ষিত মানুষ অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে দেশ-বিদেশের ক্রেতাদের সাথে সহজেই যোগাযোগ করতে পারে এবং পণ্য বা সেবা বিক্রি করতে পারে। ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স, এবং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে নতুন নতুন ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও ডিজিটাল সাক্ষরতা মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন করে তুলতে পারে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করতে পারে। ডিজিটাল বৈষম্য কমিয়ে এই প্রযুক্তিগত জ্ঞান মানুষকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নত সুযোগ দেয়।

উপসংহার
প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা মানুষকে শুধু প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করতে নয়, বরং নিজের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করতে সহায়তা করে। এটি ডিজিটাল বৈষম্য কমিয়ে সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে, যা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই, ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধির জন্য সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে একসাথে কাজ করতে হবে।
প্রশ্ন: ডিজিটাল ডিভাইসের প্রাপ্যতা কীভাবে সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য করা যায়?

উত্তর:

ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য ডিজিটাল ডিভাইস সহজলভ্য করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল ডিভাইস বলতে বোঝায় স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, এবং ইন্টারনেট সংযোগের মতো প্রযুক্তি যা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। তবে, অনেক উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশে এই ডিভাইসগুলোর প্রাপ্যতা এখনও সীমিত। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কিছু কার্যকরী কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে, যা ডিজিটাল ডিভাইসগুলোকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য করতে সাহায্য করবে। নিচে সেই কৌশলগুলো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

১. সাবসিডি ও সরকারি সহায়তা প্রদান
সরকার সাধারণ মানুষের কাছে ডিজিটাল ডিভাইস সহজলভ্য করার জন্য সরাসরি সহায়তা বা আর্থিক সুবিধা দিতে পারে। যেমন, ডিজিটাল ডিভাইস কেনার জন্য সাবসিডি বা আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করা যেতে পারে, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষদেরকে কম দামে ডিভাইস কিনতে সাহায্য করবে। বিশেষ করে শিক্ষা খাতে ডিজিটাল ডিভাইসের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে সরকারের উদ্যোগ আরও কার্যকর হতে পারে। শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে বা সস্তায় ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, বা স্মার্টফোন বিতরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে, যা তাদের ডিজিটাল শিক্ষায় অংশগ্রহণ সহজ করবে।

২. বাজেট-বান্ধব ডিভাইস উত্পাদন
অনেক সময় ডিজিটাল ডিভাইসের উচ্চমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকে। তাই বাজেট-বান্ধব ডিভাইস উত্পাদন করা একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানি এবং স্টার্টআপগুলো সাশ্রয়ী মূল্যের স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, এবং ল্যাপটপ তৈরির জন্য বিনিয়োগ করতে পারে। এর মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষরাও এই ডিভাইসগুলো কিনতে সক্ষম হবে।

বাজারে এ ধরনের ডিভাইস সহজলভ্য করার জন্য সরকার এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো একত্রে কাজ করতে পারে। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের পণ্যের দাম কমিয়ে বাজেট-বান্ধব মডেল তৈরি করে, তাহলে ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যাপক প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

৩. ব্যবহৃত ডিভাইস পুনর্ব্যবহার এবং বিতরণ
ব্যবহৃত বা পুরনো ডিভাইস পুনর্ব্যবহার করে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করা যেতে পারে। অনেক উন্নত দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিরা পুরনো স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, এবং ট্যাবলেট ফেলে দেয় বা প্রতিস্থাপন করে। এই ডিভাইসগুলো পুনর্ব্যবহার করে দরিদ্র অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে বিতরণ করা যেতে পারে।

বিশেষ করে এনজিও এবং সামাজিক সংগঠনগুলো এ ধরনের পুনর্ব্যবহারযোগ্য ডিভাইস সংগ্রহ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে বিতরণ করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পুরনো ডিভাইসগুলোকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করা সম্ভব, যা অনেক উন্নয়নশীল দেশের জনগণের জন্য উপকারী হতে পারে।

৪. ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা
ডিজিটাল ডিভাইস ক্রয়ের জন্য নিম্ন আয়ের মানুষদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। অনেকে একবারে ডিভাইসের সম্পূর্ণ মূল্য প্রদান করতে অক্ষম হলেও কিস্তিতে পরিশোধ করতে সক্ষম। এজন্য ব্যাংক, মোবাইল অপারেটর, বা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে পারে।

এই ঋণ প্রদানের সুবিধা মানুষকে ধাপে ধাপে অর্থ প্রদান করার মাধ্যমে স্মার্টফোন বা ল্যাপটপের মালিক হতে সহায়তা করবে। বিশেষত, শিক্ষার্থীরা এই ঋণের মাধ্যমে ডিজিটাল ডিভাইস কিনতে পারবে, যা তাদের পড়াশোনার কাজে সহায়তা করবে এবং ডিজিটাল বৈষম্য হ্রাস করবে।

৫. ট্যাক্স রিলিফ এবং শুল্ক মওকুফ
ডিজিটাল ডিভাইস আমদানির ক্ষেত্রে উচ্চ শুল্ক বা কর সাধারণত ডিভাইসের মূল্যে বৃদ্ধি ঘটায়। সরকার যদি ডিজিটাল ডিভাইস আমদানির ওপর কর ও শুল্ক মওকুফ করে, তবে এই ডিভাইসগুলো কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হবে। এভাবে সাধারণ মানুষের কাছে ডিভাইসগুলোর প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং ডিজিটাল বৈষম্য কমানো সম্ভব হবে।

বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলো এই ধরনের নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে, যা প্রযুক্তি আমদানিকে সহজতর করবে এবং ডিজিটাল ডিভাইসের দাম কমাবে। এর ফলে, সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষার্থীরা কম দামে ডিভাইস কিনতে সক্ষম হবে এবং প্রযুক্তির সুবিধা ভোগ করতে পারবে।

৬. মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেট সংযোগ উন্নয়ন
ডিজিটাল ডিভাইস সহজলভ্য করার পাশাপাশি ইন্টারনেট সংযোগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোবাইল অপারেটর এবং ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যদি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে, তবে ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার আরও কার্যকর হবে। অনেক মানুষই ডিজিটাল ডিভাইস থাকলেও ইন্টারনেট সংযোগের অভাবে তা ব্যবহার করতে পারে না।

সরকার এবং বেসরকারি খাতের মধ্যে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ইন্টারনেট অবকাঠামো উন্নত করা সম্ভব এবং সাশ্রয়ী ইন্টারনেট প্যাকেজ তৈরি করা যেতে পারে। এতে করে প্রান্তিক মানুষরাও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে এবং তারা ডিজিটাল প্রযুক্তির সুযোগ গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।

৭. সামাজিক উদ্যোগ ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান
বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ডিভাইস বিতরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য কাজ করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বা শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বা সাশ্রয়ী মূল্যে ডিভাইস বিতরণ করতে পারে।

এছাড়াও, সমাজের ধনী ব্যক্তিরা তাদের ব্যবহৃত ডিভাইসগুলো দান করে এই উদ্যোগে অংশ নিতে পারে। এই ধরনের দাতব্য কাজ মানুষকে প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করতে সহায়তা করে এবং বৈষম্য কমায়।

৮. স্কুল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন
সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল ডিভাইসের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে পারে। এতে করে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে থেকে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে।

বিশেষ করে প্রান্তিক এবং দূরবর্তী অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ প্রযুক্তির সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে সহায়ক হবে। এতে করে ডিজিটাল বৈষম্য কমে আসবে এবং শিক্ষার্থীরা আরও দক্ষ হয়ে উঠবে।

৯. অফলাইন এবং অনলাইন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি
প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আয়োজন করা যেতে পারে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষকে প্রযুক্তি ব্যবহারের পদ্ধতি শেখানো হবে এবং ডিভাইস ব্যবহারের প্রাথমিক দক্ষতা প্রদান করা হবে।

অনেক মানুষই ডিজিটাল ডিভাইসের সুবিধা গ্রহণ করতে পারে না কারণ তারা সেই ডিভাইস ব্যবহারে অদক্ষ। তাই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি করা গেলে, তারা নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারবে।

উপসংহার
ডিজিটাল বৈষম্য দূর করার জন্য ডিজিটাল ডিভাইসের প্রাপ্যতা সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই ডিভাইসগুলো সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হলে সরকার, বেসরকারি খাত এবং সামাজিক উদ্যোগগুলোর একসাথে কাজ করা দরকার। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে প্রযুক্তির সুবিধা সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব এবং ডিজিটাল বৈষম্য কমিয়ে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ সমাজ গঠন করা সম্ভব।

চলবে...

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.