![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১. ভূমিকা ও প্রেক্ষাপট
১.১ বিদ্রোহের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর)-এর সদর দফতর পিলখানায় সংঘটিত বিদ্রোহ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। এই ঘটনা পিলখানা হত্যাকাণ্ড বা পিলখানা ট্র্যাজেডি নামেও পরিচিত। এটি কেবল একটি বিদ্রোহ ছিল না, বরং একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড, যেখানে বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা এবং ১৭ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। এই নজিরবিহীন ঘটনাটি দেশের সামরিক কমান্ড কাঠামোকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দেয় এবং জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গভীর দুর্বলতা উন্মোচন করে।
এই হত্যাকাণ্ডে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের ব্যাপক প্রাণহানি ইঙ্গিত দেয় যে, এটি নিছক একটি অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা ছিল না, বরং রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগকারী কাঠামোর উপর একটি সুদূরপ্রসারী আঘাত ছিল। বিডিআর-এর কমান্ড কাঠামো সেনাবাহিনীর প্রেষণাধীন কর্মকর্তাদের উপর নির্ভরশীল ছিল, এবং ৫৭ জন কর্মকর্তার মৃত্যু কার্যত এই কমান্ড কাঠামোকে পঙ্গু করে দেয়। সীমান্ত সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত একটি আধা-সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বের এমন আকস্মিক বিলুপ্তি তাৎক্ষণিকভাবে তাদের অপারেশনাল সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ঘটনা কেবল একটি স্থানীয় বিদ্রোহের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এটি দেশের বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতার উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে একটি জাতীয় নিরাপত্তা সংকটে রূপান্তরিত হয়।
১.২ ২০০৯ সালের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রেক্ষাপট
২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হয়েছিল। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। বিদ্রোহটি নতুন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৫১ দিনের মাথায় ঘটেছিল, যা নবনির্বাচিত সরকারের জন্য একটি প্রাথমিক ও গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এই বিদ্রোহের পূর্বে, ২০০৭-২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে একটি সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। এই সময়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং "মাইনাস-টু ফর্মুলা" (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়া) সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কারের চেষ্টা করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালানো হয়, যেখানে অনেক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। ২০০৯ সালের শুরুতে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুর্বল ছিল এবং পুলিশ বাহিনীতে হামলার ঘটনাও ঘটেছিল।
বিদ্রোহের সময়কাল, অর্থাৎ নবনির্বাচিত বেসামরিক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের এত অল্প সময়ের মধ্যে এটি সংঘটিত হওয়া, ইঙ্গিত দেয় যে এটি সম্ভবত পুনঃপ্রতিষ্ঠিত বেসামরিক আধিপত্যের প্রতি একটি প্রত্যক্ষ চ্যালেঞ্জ ছিল, অথবা তত্ত্বাবধায়ক শাসনকাল থেকে উদ্ভূত সুপ্ত উত্তেজনাকে কাজে লাগানো হয়েছিল। সামরিক বাহিনীর পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা এবং "রাজনৈতিক প্রকৌশল" (মাইনাস-টু ফর্মুলা) এর মতো প্রচেষ্টা এমন একটি অস্থির পরিবেশ তৈরি করতে পারে যেখানে অসন্তুষ্ট উপাদান বা বাহ্যিক শক্তি দ্বারা এই ধরনের ঘটনা উস্কে দেওয়া বা ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ঘটনাটি বাংলাদেশের ভঙ্গুর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের জটিলতাকে তুলে ধরে।
১.৩ বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস)-এর সাংগঠনিক কাঠামো, দায়িত্ব ও ভূমিকা
বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি আধা-সামরিক বাহিনী ছিল। এর দীর্ঘ এবং বৈচিত্র্যময় ইতিহাস ১৭৯৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক গঠিত 'ফ্রন্টিয়ার প্রোটেকশন ফোর্স' পর্যন্ত বিস্তৃত। বিডিআর-এর মূল দায়িত্ব ছিল দেশের সীমান্ত রক্ষা, চোরাচালান প্রতিরোধ, মাদক পাচার দমন, সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করা। ২০০৯ সালে বিডিআর-এর প্রায় ৬৭,০০০ সদস্য ছিল, যার মধ্যে ৪০,০০০ সীমান্তে নিয়োজিত ছিল।
বিডিআর-এর একটি অনন্য কমান্ড কাঠামো ছিল: এর সৈনিকরা (জওয়ান) সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত ছিল, কিন্তু তাদের কমান্ডিং অফিসাররা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে আসতেন। এই হাইব্রিড কমান্ড কাঠামো, যেখানে পদস্থ সৈনিকরা তাদের প্রেষণাধীন সেনা কর্মকর্তাদের থেকে ভিন্ন ছিল, একটি অন্তর্নিহিত "আমরা বনাম তারা" গতিশীলতা তৈরি করেছিল। এই কাঠামোগত দুর্বলতা, বিডিআর-এর দ্বৈত ম্যান্ডেট (সীমান্ত নিরাপত্তা এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি) এর সাথে মিলিত হয়ে, এটিকে অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতি এবং বাহ্যিক কারসাজির জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছিল। নেতৃত্বের জন্য সেনা কর্মকর্তাদের উপর নির্ভরতা, যদিও এটি শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ছিল, তবে এটি বাহিনীর মধ্যে একটি শ্রেণীগত বিভেদ তৈরি করে, যা জওয়ানদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়ে তোলে কারণ তারা তাদের পদোন্নতির সম্ভাবনা সীমিত দেখতে পায়। এই কাঠামোগত ত্রুটি ছিল অভ্যন্তরীণ সংঘাতের একটি সম্ভাব্য উৎস।
১.৪ বিদ্রোহের পূর্ববর্তী সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের গতিশীলতা
২০০৯ সালের বিদ্রোহের পূর্ববর্তী সময়কাল সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি জটিল চিত্র তুলে ধরে। ২০০৭-২০০৯ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সামরিক বাহিনীর সমর্থনে গঠিত হয়েছিল এবং এই সময়ে সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ "নতুন ব্র্যান্ডের গণতন্ত্র" এবং "নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব" গঠনের ধারণা প্রচার করেন, যা নির্বাচিত সরকার ছাড়াই সামরিক আধিপত্যের ইঙ্গিত দেয়।
এই সময়ে, জরুরি ক্ষমতা অধ্যাদেশ ২০০৭ (EPO) এবং জরুরি ক্ষমতা বিধি (EPR) সামরিক বাহিনীকে অসাধারণ ক্ষমতা ও দায়মুক্তি প্রদান করে এবং নাগরিকদের অসংখ্য মৌলিক অধিকার স্থগিত করে। সামরিক বাহিনী সমস্ত নিরাপত্তা বাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে, যেখানে বিডিআর, র্যাব, পুলিশ সহ অন্যান্য সংস্থা যৌথ বাহিনী হিসাবে পরিচালিত হয়েছিল। এই সময়কালে সামরিক বাহিনীর বাজেট উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায় এবং অবসরপ্রাপ্ত ও সক্রিয় সামরিক কর্মকর্তাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিদ্রোহের পূর্ববর্তী এই সময়কাল সামরিক বাহিনীর দ্বারা বেসামরিক নিয়ন্ত্রণের উল্লেখযোগ্য অবক্ষয় দ্বারা চিহ্নিত হয়েছিল, যেখানে সেনাবাহিনী সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করছিল। এটি প্রশাসনে সামরিক প্রভাবের একটি নজির স্থাপন করে, যা নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে নির্দিষ্ট উপাদানগুলিকে উৎসাহিত করতে পারে এবং দায়মুক্তির অনুভূতি তৈরি করতে পারে। তাই, বিদ্রোহকে কেবল একটি অভ্যন্তরীণ বিডিআর সমস্যা হিসেবে দেখা যায় না, বরং এটি তত্ত্বাবধায়ক শাসনের পর বিস্তৃত নিরাপত্তা খাতের মধ্যে অমীমাংসিত উত্তেজনা এবং ক্ষমতার গতিশীলতার একটি সহিংস প্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই কাঠামোগত প্রেক্ষাপট নতুন বেসামরিক সরকারের জন্য সামরিক বাহিনীর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জকে আরও জটিল করে তোলে।
২. বিদ্রোহের কারণ ও দাবি
২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল, যা বিডিআর জওয়ানদের দীর্ঘদিনের অসন্তোষ, কাঠামোগত সমস্যা এবং কিছু নির্দিষ্ট ঘটনার সম্মিলিত ফল।
২.১ বিডিআর জওয়ানদের দীর্ঘদিনের অসন্তোষ ও অভিযোগ (বেতন-বৈষম্য, ভাতা, পদোন্নতি)
বিডিআর সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে নিম্ন বেতন ও সুযোগ-সুবিধা, পদোন্নতির সীমিত সুযোগ এবং সেনা কর্মকর্তাদের বিডিআর-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে প্রেষণে নিয়োগের কারণে তীব্র অসন্তোষে ভুগছিল। এই প্রেষণ ব্যবস্থা বিডিআর-এর নিজস্ব সদস্যদের পদোন্নতির পথ রুদ্ধ করে দিত, যা তাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছিল। তারা নিজেদেরকে সেনা পরিবারের সদস্যদের তুলনায় "দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক" মনে করত এবং তাদের সন্তানদেরও সেনা শিশুদের দ্বারা অবজ্ঞার শিকার হওয়ার অভিযোগ ছিল। এই ধরনের সামাজিক বৈষম্য তাদের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। অন্যান্য দাবির মধ্যে ছিল শতভাগ রেশনিং কার্যক্রম এবং বার্ষিক ছুটির পরিমাণ সেনাবাহিনীর সমান করা।
এই গভীর অসন্তোষ, বিশেষ করে "দ্বিতীয় শ্রেণীর" নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হওয়া এবং সেনা প্রেষণের কারণে সীমিত কর্মজীবনের উন্নতির ধারণা, বিডিআর-এর মধ্যে আস্থা ও সংহতির মৌলিক ভাঙন নির্দেশ করে। বেতন-ভাতার মতো স্পষ্ট বৈষম্য এবং সামাজিক অবজ্ঞার মতো অস্পষ্ট অপমানের কারণে এই অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতা, জওয়ানদের মধ্যে উগ্রপন্থাকে উৎসাহিত করেছিল এবং বিদ্রোহের আহ্বানকে গ্রহণ করার জন্য তাদের সংবেদনশীল করে তুলেছিল, তা স্বতঃস্ফূর্ত হোক বা পরিকল্পিত। এই বিদ্রোহ ছিল বিডিআর-এর মধ্যে দীর্ঘদিনের সুপ্ত পরিচয় সংকটের একটি সহিংস বহিঃপ্রকাশ, যেখানে কাঠামোগত অসমতা এবং অনুভূত সামাজিক অবমাননা (নিজেকে "দ্বিতীয় শ্রেণীর" মনে করা) অভ্যন্তরীণ সংহতি ও আনুগত্যকে ক্ষয় করে দিয়েছিল, যা বাহিনীকে অন্তর্নিহিতভাবে অস্থির এবং চরমপন্থার দিকে ধাবিত করেছিল।
২.২ "অপারেশন ডাল-ভাত" কর্মসূচির প্রভাব ও দুর্নীতির অভিযোগ
২০০৭-২০০৯ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে "অপারেশন ডাল-ভাত" নামে একটি কল্যাণমূলক কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্রদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করা। এই কর্মসূচিটি আপাতদৃষ্টিতে জনকল্যাণমূলক হলেও, এটি বিডিআর জওয়ানদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিডিআর সদস্যরা অভিযোগ করে যে, এই প্রকল্প থেকে সেনা কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে মুনাফা অর্জন করেছেন এবং অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, যা বিডিআর-এর সেবায় ফেরত আসেনি।
বিদ্রোহের দিন, মহাপরিচালক শাকিল আহমেদ যখন "ডাল-ভাত" কর্মসূচির অভিযোগ নিয়ে কথা বলছিলেন, তখনই গুলি শুরু হয়, যা ইঙ্গিত করে যে এই বিষয়টি কতটা সংবেদনশীল ছিল। পরবর্তীতে, হাইকোর্টের রায়েও "ডাল-ভাত" কর্মসূচিকে জওয়ানদের ক্ষোভের উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে শৃঙ্খলা বাহিনীকে এমন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত না করার সুপারিশ করা হয়েছে। "অপারেশন ডাল-ভাত", একটি কল্যাণমূলক কর্মসূচি হওয়া সত্ত্বেও, বিডিআর-এর নেতৃত্ব দিতে আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতির ধারণাকে উৎসাহিত করে বিদ্রোহের একটি প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল। এটি তুলে ধরে যে কীভাবে অনুভূত আর্থিক শোষণ, বিশেষ করে একটি শ্রেণিবদ্ধ সামরিক কাঠামোর মধ্যে, দ্রুত আস্থা ও বৈধতাকে ক্ষয় করতে পারে, একটি কল্যাণমূলক উদ্যোগকে গভীর অসন্তোষের উৎস এবং সহিংসতার প্রত্যক্ষ ট্রিগারে রূপান্তরিত করতে পারে।
২.৩ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের সুযোগ না পাওয়া
বিডিআর সদস্যদের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে (যা আর্থিকভাবে লাভজনক) অংশগ্রহণের অনুমতি না দেওয়া একটি বড় অসন্তোষের কারণ ছিল। যদিও ২০০৬ সালে একটি বিডিআর প্লাটুন বাংলাদেশ পুলিশের সাথে একটি মিশনে কাজ করেছিল, তবে সেনাবাহিনী ভবিষ্যতে বিডিআর-এর জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণ অস্বীকার করে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া, যা বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য অতিরিক্ত আয় এবং মর্যাদার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস,, বিডিআর জওয়ানদের আর্থিক এবং মর্যাদা-সম্পর্কিত অভিযোগকে আরও গভীর করেছিল। এই নীতি, সম্ভবত সেনাবাহিনীর এমন লাভজনক মিশনে তাদের একচেটিয়া ভূমিকা বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত, "দ্বিতীয় শ্রেণীর" ধারণাকে আরও দৃঢ় করে এবং বিদ্রোহের সময় বিস্ফোরিত হওয়া সামগ্রিক অসন্তোষে অবদান রাখে। এই বঞ্চনা শুধু একটি আর্থিক সুযোগের ক্ষতি ছিল না, বরং এটি কাঠামোগত বৈষম্যের প্রতীক ছিল এবং বিডিআর-এর প্রান্তিকতার অনুভূতিতে একটি শক্তিশালী অবদান রেখেছিল, যা অর্থনৈতিক এবং মর্যাদা-ভিত্তিক উভয় অভিযোগকে তীব্র করে বিদ্রোহকে সরাসরি ইন্ধন দিয়েছিল।
২.৪ ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সাথে সংঘাত ও জীবনযাত্রার মান নিয়ে ক্ষোভ
বিডিআর জওয়ানদের অভিযোগ ছিল যে, সেনা কর্মকর্তারা তাদের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করেন এবং সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে তা পৌঁছান না। সেনা কর্মকর্তাদের বিলাসবহুল জীবনযাপন বিডিআর সদস্যদের মধ্যে আরও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। কিছু সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক বিডিআর সদস্যদের শারীরিক ও মৌখিক নির্যাতনের অভিযোগও ছিল।
প্রেষণাধীন সেনা কর্মকর্তাদের অনুভূত অহংকার এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন, জওয়ানদের অভিযোগের প্রতি অবহেলা এবং তাদের প্রতি দুর্ব্যবহারের অভিযোগের সাথে যুক্ত হয়ে, একটি বিষাক্ত কমান্ড পরিবেশ তৈরি করেছিল। এই প্রত্যক্ষ আন্তঃব্যক্তিক সংঘাত, কাঠামোগত অসমতার উপরে স্তরবদ্ধ হয়ে, বিমূর্ত অভিযোগগুলিকে ব্যক্তিগত ক্ষোভে রূপান্তরিত করে, কর্মকর্তাদের বিদ্রোহের ক্রোধের প্রত্যক্ষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং পর্যবেক্ষিত চরম সহিংসতায় অবদান রাখে। এটি কেবল বেতন-ভাতার মতো বিমূর্ত বিষয় নয়, বরং সম্মান ও মর্যাদার মতো অস্পষ্ট সামাজিক অবমাননার বিষয়টিকেও নির্দেশ করে। এই মানসিক মাত্রা আর্থিক অভিযোগের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হতে পারে, কারণ এটি কর্মীদের মূল পরিচয় এবং আত্মমর্যাদাকে আক্রমণ করে। এটি তাদের চরমপন্থী আখ্যান বা বাহ্যিক উস্কানির প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল করে তোলে।
২.৫ ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব ও সম্ভাব্য দেশি-বিদেশি শক্তির জড়িত থাকার অভিযোগ
বিডিআর বিদ্রোহকে কেবল একটি বিদ্রোহ হিসেবে নয়, বরং একটি "পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড" হিসেবে দাবি করা হয়েছে। বিভিন্ন তত্ত্বে বিদেশি শক্তির জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছে, বিশেষ করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' (R&AW) এবং তাদের এজেন্ট লাকি বিষ্টের ভূমিকা। অভিযোগ ছিল যে 'র' বিডিআর-এর অভ্যন্তরীণ বিভেদকে কাজে লাগিয়ে বিদ্রোহ উস্কে দিয়েছে, যার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের সামরিক নেতৃত্বকে দুর্বল করা এবং সদ্য নির্বাচিত সরকারকে অস্থিতিশীল করা। কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ভারতীয় কিলার গ্রুপকে খেলোয়াড় বা রোগীর ছদ্মবেশে পিলখানায় ঢোকানো হয়েছিল এবং তারা হত্যাকাণ্ড শেষে অ্যাম্বুলেন্সে করে পিলখানা ত্যাগ করে।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তির জড়িত থাকার অভিযোগও ছিল, যেমন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরোধীরা বা "ওয়ান-ইলেভেন" (২০০৭-২০০৮ তত্ত্বাবধায়ক সরকার) সৃষ্টিকারীরা। হাইকোর্টের রায়েও "দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের" কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নবনির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা এবং দেশকে অস্থিতিশীল করা। গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, কেন এই ষড়যন্ত্রের কথা আগে জানা যায়নি।
এই ষড়যন্ত্রের তত্ত্বের ব্যাপক এবং ক্রমাগত উপস্থিতি, যা দেশি ও বিদেশি উভয় শক্তিকে জড়িত করে, ঘটনাটিকে নিছক অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের বাইরে নিয়ে যায়। এটি ইঙ্গিত করে যে বিডিআর-এর বিদ্যমান দুর্বলতা এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কৌশলগত অস্থিতিশীলতার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল, কেবল সৈনিকদের দাবি পূরণের জন্য নয়। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলির উপর চূড়ান্ত সরকারি অনুসন্ধানের অভাব, আদালতের পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও, জনমনে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে অমীমাংসিত রহস্য ও অবিশ্বাস তৈরি করে, যা ভবিষ্যতের অস্থিতিশীলতাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
চলবে...
শেয়ার করতে পারেন এবং আপনার কোন মতামত বা প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো।
©somewhere in net ltd.