![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
উন্নতির সুযোগ রংধনুর মতো আসে এবং অল্প সময় পরেই চলে যায়। বাংলাদেশের সামনে এ রকম সুযোগ দফায় দফায় এসেছিল। কিছুদিন হলো এ রকম এক সুযোগের কথা শোনা যাচ্ছে। জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদেরা একে বলছেন পপুলেশন ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যা-সুবিধা। সহজ কথায় কোনো দেশে যখন কাজ করা মানুষের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা কমে যায়, তখন সেই দেশ জনসংখ্যার দিক থেকে দারুণ সুবিধাজনক জায়গায় চলে যায়। বাংলাদেশে এখন প্রতি তিনজনে দুজনই উপার্জনক্ষম। নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা, বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়ায় জাতীয় সঞ্চয় বাড়ে, কেনাকাটা বাড়ে, অর্থনীতি সবল হয়।
এর অন্যদিকটাও দারুণ। বাংলাদেশে এখন ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা পৌনে পাঁচ কোটি। এর সঙ্গে ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী যুব জনসংখ্যাকে ধরলে বলা যায় যে জনসংখ্যার তিন ভাগের দুই ভাগই টগবগে তরুণ। ঠিক এ রকম জনসংখ্যা-সুবিধা নিয়েই ১৯৬৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে পূর্ব এশীয় ‘টাইগার’ অর্থনীতির দেশগুলো উন্নতি করেছিল। চীন বিপ্লবের পরের উত্থানও ছিল অনেকটা তরুণদেরই রক্ত ও ঘামের ফসল। স্বাধীনতার পরের জাগ্রত বাংলাদেশ, আশির দশকের প্রতিবাদী বাংলাদেশ, নব্বইয়ের দশকের গণতান্ত্রিক আত্মবিশ্বাসের বাংলাদেশে এ রকম সুযোগের রংধনু দেখা গিয়েছিল। এবং যথারীতি হেলাফেলার কারণে সেই রংধনু উবেও গিয়েছিল। এখন এসেছে নতুন আশাবাদের মৌসুম; জনসংখ্যা-সুবিধার অন্তত ১০ আনাও যদি কাজে লাগানো যায়, তাহলে দুঃখিনী বাংলা সোনার বাংলা না হোক, তাম্রবাংলা হতে পারে।
এটা কেবল পরিসংখ্যানের সত্য নয়, মানুষের মনের ভাবও এ রকমই। বাংলাদেশের সাধারণ একজন তরুণ আশা করতে পারেন যে পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি কোটিপতি হয়ে যাবেন। অধিকাংশ তরুণের মনেই সীমা ডিঙানোর এমন সংকল্প কম দেশেই দেখা যায়। আরও বড় কথা, কম দেশের মানুষ তা সম্ভব করতে পারে। ছোট ব্যবসাকে বড় করে ফেলার আশা, রিকশাচালকের সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করার স্বপ্ন, কাঁচাবাড়িকে পাকা করার সাধ, অপরের দয়ামুখী অবস্থা থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার আত্মবিশ্বাস, কর্মী থেকে নেতা হওয়ার উচ্চাভিলাষ তো আমরা চারপাশেই দেখতে পাই। এসব উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়নের উপায় সব ক্ষেত্রে সুন্দর না হলেও, প্রেরণাটা অস্বীকার করা যায় না।
পিঁপড়া যেমন নিজের ওজনের কয়েক গুণ ভার নিয়ে পথ চলে, বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যক্তিমানুষ নিজের সাধ্যের চেয়ে বড় আশার পেছনে খাটতে পারেন। এভাবে প্রতিটি মানুষ যার যার পিঠে করে আসলে দেশটাকেই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা-সুবিধার হিসাব-নিকাশ তাত্ত্বিকদের মাথায় আসার আগেই দেখা গেছে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এইসব রংধনু সংগ্রাম। এই সংগ্রামে আমাদের ওয়াসফিয়া যেমন দুনিয়ার বড় বড় পর্বত শিখর পায়ের নিচে ফেলে, তেমনি উত্তাল সমুদ্রে ভাঙা নৌকায় তরুণেরা প্রবাসে কাজের খোঁজে জীবন বাজি রাখে। আর যা-ই হোক, কর্মের উদ্দীপনায় কোনো ঘাটতি নেই বাংলাদেশিদের।
কিন্তু তারুণ্যে ভরপুর আশাবাদের বিপরীতে হতাশাজনক পরিসংখ্যানও আছে। যাদের বরাতে জনসংখ্যা-সুবিধার তত্ত্ব ভুট্টার খইয়ের মতো ফুটছে, বয়সে তারা তরুণ বটে, কিন্তু যোগ্যতায় কেমন? এই পাঁচ কোটি তরুণ প্লাস আরও চার-পাঁচ কোটি যুবকের কত অংশ শিক্ষায়-দক্ষতায়-স্বাস্থ্যে যোগ্য? এ হিসাব নিয়ে বসলে জনসংখ্যা-সুবিধাতত্ত্ব, মধ্য-আয়ের দেশের স্বপ্নকে মিথ বলে মনে হতে পারে। শিক্ষা ও শ্রমশক্তির হিসাব নিলেই শুভঙ্করের ফাঁকিটা ধরা পড়ে। (২০১৩ সালের হিসাবে) প্রাথমিক পর্যায়েই ঝরে যাওয়া শিক্ষার্থীদের অনুপাত ২১ দশমিক ৪ শতাংশ। আমাদের মোট শ্রমশক্তির ৪০ দশমিক ১ শতাংশই অশিক্ষিত। এসএসসি সমমানের ডিগ্রি আছে মাত্র ৬ শতাংশের। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার মাত্র শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ। (তথ্যসূত্র: ব্যানবেইস)
আমাদের এক কোটি প্রবাসী শ্রমিকের ভগ্নাংশই প্রশিক্ষিত ও দক্ষ। বাদবাকি শ্রমিকেরা কেবল দেহ ও চেষ্টা সম্বল করে জীবিকা উপার্জন করছেন। ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিকের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। সামান্য মজুরিতে তাঁরা পেটে-ভাতে বেঁচে আছেন। ক্ষুধা জয় করা প্রাণিজীবনের সার্থকতা, কিন্তু মানুষ হিসেবে গর্ব করতে গেলে নিরাপত্তা, সচ্ছলতা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-আবাস ও মর্যাদা লাগে। আমাদের যুবশক্তির মাত্র ২-৩ শতাংশ সেই অর্জনের দাবিদার।
আজকাল প্রবৃদ্ধি দিয়ে উন্নয়ন পরিমাপের সংকীর্ণ পদ্ধতি চালু হয়েছে। সেদিক থেকে বললেও, যদি আমাদের যুবশক্তির বড় অংশকে মোটামুটি শিক্ষায়-প্রশিক্ষণে আনা যেত, তাহলে রাতারাতি প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ বেড়ে যেত। জিডিপির ৬ শতাংশ বা জাতীয় বাজেটের অন্তত ২০ ভাগ শিক্ষার জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত। অথচ গত বাজেটে টাকার অঙ্ক বাড়লেও মোট বাজেটের অনুপাতে শিক্ষার ভাগটা বরং কমেছে এবং পাকিস্তান বাদ দিলে বাংলাদেশের বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম (২.১%)।
একই দশা স্বাস্থ্যসেবাতেও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরামর্শ মানলে স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকা উচিত। অথচ প্রতিবছর কমতে কমতে ২০১৩-১৪-তে বরাদ্দ ছিল ৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য খাতে বছরে মাথাপিছু ৫৪ মার্কিন ডলার ব্যয় করা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যয় হয় ২৭ ডলার। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে তা ছিল ৫৯, নেপালে ৩৩, শ্রীলঙ্কায় ৯৭, ইন্দোনেশিয়ায় ৯৫, ভিয়েতনামে ৯৬ আর পাকিস্তানে ৩০ ডলার।
জনংসংখ্যা-সুবিধা থেকে ফল পেতে হলে তরুণদের কর্মজীবন ও আয়ুষ্কাল দুটোই বাড়াতে হবে। কিন্তু শিক্ষায় বরাদ্দ কম বলে আমাদের তরুণেরা কম শিক্ষিত। কম শিক্ষিত বলে তাদের দক্ষতা কম। কম দক্ষ বলে দেশে বা বিদেশে তাদের অস্বাস্থ্যকর ও কঠিন ধরনের কাজ করতে হয়, যা অন্য কেউ করতে চায় না। তাতে করে তাদের স্বাস্থ্য ও আয়ু দুটোই ধ্বংস হয়। তাঁদের কর্মজীবন ছোট হয়ে আসে। অল্প বয়সেই তাঁরা বুড়িয়ে যাবেন। আর যখন ভুগতে থাকবেন রোগে-বার্ধক্যে, তখন উপযুক্ত চিকিৎসা পাবেন না, বা তা কিনতে হলে কষ্টের টাকার বড় অংশটাই চলে যাবে। দারিদ্র্য থেকে উঠতে উঠতে এভাবে তাঁদের একটা অংশ দারিদ্র্যের তৈলাক্ত বাঁশের লাঠি থেকে পিছলে আবার নিচে পড়ে যান।
ইতিবাচক দিকেরও নেতিবাচক দিক আছে। বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠীর ‘উন্নতি করার’ তীব্র ইচ্ছা যেমন একটা সামাজিক-পুঁজি, তেমনি তাদের হতাশা অসন্তোষের সুতিকাগার। চাকরি-ঋণ-সরকারি সুযোগের দলীয়করণ চলতে থাকলে, মেধাবীরা যোগ্য কাজ না পেলে অস্থির হয়ে উঠবে। অদক্ষ শ্রমিকের দেশ, সস্তা শ্রমের জোগানদাতা দেশ, বিশ্বায়িত পুঁজির সেবাদাস সরবরাহকারী দেশ হয়ে থাকতে না হলে, জনসংখ্যা-সুবিধার মিথকে বাস্তবে পরিণত করা চাই। পোশাকশিল্পে আর সৌদি-কাতার-মালয়েশিয়ায় কেবল সস্তা বলেই বাংলাদেশিদের নেওয়া হয়। শ্রমবাজারে নতুন প্রতিযোগী এলে বা রাজনৈতিক অস্থিরতার দোষে এই সুযোগ টালমাটাল হয়ে যেতে পারে। ভরসা সৃষ্টি করতে হলে, তরুণ প্রজন্মের দুর্মর আশাবাদের যোগ্য উত্তর দিতে হলে, এই শ্রমিকদের পরের প্রজন্মকে শিক্ষিত ও দক্ষ করে তুলতে হবে।
আমাদের সব আছে, কিন্তু আশার কাছাকাছি প্রতিদান দেওয়ার মতো রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাই নেই। সেদিক থেকে জনসংখ্যা-সুবিধার সোনার ডিমটা অকস্মাৎ জনসংখ্যা-বোমা হওয়া ঠেকানোর কোনো রক্ষাকবচ কি আমাদের আছে? চাঁদের ওপর পিঠের আরও সংবাদ আসছে। এ সপ্তাহেই জানা গেল, বাংলাদেশের প্রায় সাত লাখ নাগরিক দাসত্বের জীবনে আটকা পড়ে আছে।
রাষ্ট্র পরিচালনা যাঁরা করেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন: ষাটের দশকে দক্ষিণ কোরিয়া আর নাইজেরিয়া একই রকম জনসংখ্যা-সুবিধা অর্জন করেছিল। সঠিক নীতি ও নেতৃত্বের হাত ধরে দক্ষিণ কোরিয়া আজ শিল্পোন্নত সমৃদ্ধ দেশ। আর ভুল নীতি ও নেতৃত্বের দায়ে নাইজেরিয়া হয়েছে সম্পদে সমৃদ্ধ কিন্তু দুর্ভাগা ও দরিদ্র মানুষের শিরোমণি। বাংলাদেশ বিকাশের যে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার একদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার পথ অন্যদিকে নাইজেরিয়ার পথ। কোন দিকে যাব আমরা—ঠিক করতে হবে এখনই।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
( প্রথম আলো )
©somewhere in net ltd.