![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জীবন পথের এক অজানা পথিক আমি। উদ্দেশ্যহীন জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে বেড়ানই আমার কাজ। যদিও জানি যে জীবনে উদ্দেশ্য থাকা বা না থাকা কোন প্রভাব ফেলে না।
“ কালক্রমে আরো দুই-চারিবার রোগ ও আরোগ্য হইবার পরে দেখিলাম আমার সেই সন্ধ্যাকালের মানস-সভায় পৃথিবীর কোটি কোটি পুরুষ-সংখ্যা অত্যন্ত হ্রাস হইয়া ক্রমে একটিতে আসিয়া ঠেকিল , আমার পৃথিবী প্রায় জনশূন্য হইয়া আসিল । জগতে কেবল একটি ডাক্তার এবং একটি রোগী অবশিষ্ট রহিল । ”
“ আমি গোপনে সন্ধ্যাবেলায় একটি বাসন্তী রঙের কাপড় পরিতাম , ভালো করিয়া খোঁপা বাঁধিয়া মাথায় একগাছি বেলফুলের মালা জড়াইতাম , একটি আয়না হাতে লইয়া বাগানে গিয়া বসিতাম । ”
“ কেন । আপনাকে দেখিয়া কি আর পরিতৃপ্তি হয় না । বাস্তবিকই হয় না । কেননা, আমি তো আপনি আপনাকে দেখিতাম না । আমি তখন একলা বসিয়া দুইজন হইতাম । আমি তখন ডাক্তার হইয়া আপনাকে দেখিতাম , মুগ্ধ হইতাম এবং ভালোবাসিতাম এবং আদর করিতাম , অথচ প্রাণের ভিতরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস সন্ধ্যাবাতাসের মতো হূ হূ করিয়া উঠিত । ”
“ সেই হইতে আমি আর একলা ছিলাম না; যখন চলিতাম নত নেত্রে চাহিয়া দেখিতাম পায়ের অঙ্গুলিগুলি পৃথিবীর উপরে কেমন করিয়া পড়িতেছে, এবং ভাবিতাম এই পদক্ষেপ আমাদের নূতন-পরীক্ষোত্তীর্ণ ডাক্তারের কেমন লাগে; মধ্যাহ্নে জানলার বাহিরে ঝাঁ ঝাঁ করিত , কোথাও সাড়াশব্দ নাই , মাঝে মাঝে এক-একটা চিল অতিদূর আকাশে শব্দ করিয়া উড়িয়া যাইত ; এবং আমাদের উদ্যানপ্রাচীরের বাহিরে খেলেনাওয়ালা সুর করিয়া ‘ চাই খেলেনা চাই, চুড়ি চাই ' করিয়া ডাকিয়া যাইত; আমি একখানি ধব্ধবে চাদর পাতিয়া নিজের হাতে বিছানা করিয়া শয়ন করিতাম ; একখানি অনাবৃত বাহু কোমল বিছানার উপর যেন অনাদরে মেলিয়া দিয়া ভাবিতাম , এই হাতখানি এমনি ভঙ্গিতে কে যেন দেখিতে পাইল , কে যেন দুইখানি হাত দিয়া তুলিয়া লইল , কে যেন ইহার আরক্ত করতলের উপর একটি চুম্বন রাখিয়া দিয়া আবার ধীরে ধীরে ফিরিয়া যাইতেছে। মনে করো এইখানেই গল্পটা যদি শেষ হয় তাহা হইলে কেমন হয় । ”
আমি বলিলাম , “ মন্দ হয় না । একটু অসম্পূর্ণ থাকে বটে , কিন্তু সেইটুকু আপন মনে পূরণ করিয়া লইতে বাকি রাতটুকু বেশ কাটিয়া যায় । ”
“ কিন্তু তাহা হইলে গল্পটা যে বড়ো গম্ভীর হইয়া পড়ে । ইহার উপহাসটুকু থাকে কোথায় । ইহার ভিতরকার কঙ্কালটা তাহার সমস্ত দাঁত ক ' টি মেলিয়া দেখা দেয় কই । ”
“ তার পরে শোনো । একটুখানি পসার হইতেই আমাদের বাড়ির একতলায় ডাক্তার তাঁহার ডাক্তারখানা খুলিলেন । তখন আমি তাঁহাকে মাঝে মাঝে হাসিতে হাসিতে ঔষধের কথা , বিষের কথা , কী করিলে মানুষ সহজে মরে , এই-সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতাম । ডাক্তারির কথায় ডাক্তারের মুখ খুলিয়া যাইত । শুনিয়া শুনিয়া মৃত্যু যেন পরিচিত ঘরের লোকের মতো হইয়া গেল । ভালোবাসা এবং মরণ কেবল এই দুটোকেই পৃথিবীময় দেখিলাম ।
“ আমার গল্প প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে- আর বড়ো বাকি নাই । ”
আমি মৃদুস্বরে বলিলাম , “ রাত্রিও প্রায় শেষ হইয়া আসিল । ”
কিছুদিন হইতে দেখিলাম ডাক্তারবাবু বড়ো অন্যমনস্ক এবং আমার কাছে যেন ভারি অপ্রতিভ । একদিন দেখিলাম তিনি কিছু বেশিরকম সাজসজ্জা করিয়া দাদার কাছে তাঁহার জুড়ি ধার লইলেন , রাত্রে কোথায় যাইবেন । ”
আমি আর থাকিতে পারিলাম না । দাদার কাছে গিয়া নানা কথার পর জিজ্ঞাসা করিলাম , ‘ হাঁ দাদা , ডাক্তারবাবু আজ জুড়ি লইয়া কোথায় যাইতেছেন । '
সংক্ষেপে দাদা বলিলেন , ‘ মরিতে । '
আমি বলিলাম , ‘ না , সত্য করিয়া বলো-না । '
তিনি পূর্বাপেক্ষা কিঞ্চিৎ খোলসা করিয়া বলিলেন , ‘ বিবাহ করিতে । '
আমি বলিলাম ‘ সত্য নাকি । '— বলিয়া অনেক হাসিতে লাগিলাম । অল্পে অল্পে শুনিলাম, এই বিবাহে ডাক্তার বারো হাজার টাকা পাইবেন ।
কিন্তু আমার কাছে এ সংবাদ গোপন করিয়া আমাকে অপমান করিবার তাৎপর্য কী । আমি কি তাঁহার পায়ে ধরিয়া বলিয়াছিলাম যে , এমন কাজ করিলে আমি বুক ফাটিয়া মরিব । পুরুষদের বিশ্বাস করিবার জো নাই । পৃথিবীতে আমি একটিমাত্র পুরুষ দেখিয়াছি এবং এক মুহূর্তে সমস্ত জ্ঞান লাভ করিয়াছি ।
ডাক্তার রোগী দেখিয়া সন্ধ্যার পূর্বে ঘরে আসিলে আমি প্রচুর পরিমাণে হাসিতে হাসিতে বলিলাম , ‘ কী ডাক্তার- মহাশয়, আজ নাকি আপনার বিবাহ। '
আমার প্রফুল্লতা দেখিয়া ডাক্তার যে কেবল অপ্রতিভ হইলেন তাহা নহে , ভারি বিমর্ষ হইয়া গেলেন ।
জিজ্ঞাসা করিলাম , ‘ বাজনা-বাদ্য কিছু নাই যে। '
শুনিয়া তিনি ঈষৎ একটু নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন , ‘ বিবাহ ব্যাপারটা কি এতই আনন্দের । '
শুনিয়া আমি হাসিয়া অস্থির হইয়া গেলাম । এমন কথাও তো কখনো শুনি নাই । আমি বলিলাম , ‘ সে হইবে না , বাজনা চাই , আলো চাই । '
দাদাকে এমনি ব্যস্ত করিয়া তুলিলাম যে, দাদা তখনই রীতিমত উৎসবের আয়োজনে প্রবৃত্ত হইলেন ।
আমি কেবলই গল্প করিতে লাগিলাম বধূ ঘরে আসিলে কী হইবে , কী করিব । জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ আচ্ছা ডাক্তার- মহাশয় , তখনো কি আপনি রোগীর নাড়ী টিপিয়া বেড়াইবেন । ' হি হি! হি হি! যদিও মানুষের বিশেষত পুরুষের মনটা দৃষ্টিগোচর নয় , তবু আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি, কথাগুলি ডাক্তারের বুকে শেলের মতো বাজিতেছিল ।
অনেক রাত্রে লগ্ন । সন্ধ্যাবেলায় ডাক্তার ছাতের উপর বসিয়া দাদার সহিত দুই-এক পাত্র মদ খাইতেছিলেন । দুইজনেরই এই অভ্যাসটুকু ছিল । ক্রমে আকাশে চাঁদ উঠিল ।
আমি হাসিতে হাসিতে আসিয়া বলিলাম , ‘ ডাক্তার-মশায় ভুলিয়া গেলেন নাকি । যাত্রার যে সময় হইয়াছে । '
এইখানে একটা সামান্য কথা বলা আবশ্যক । ইতিমধ্যে আমি গোপনে ডাক্তারখানায় গিয়া খানিকটা গুঁড়া সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিলাম এবং সেই গুঁড়ার কিয়ংদশ সুবিধামত অলক্ষিতে ডাক্তারের গ্লাসে মিশাইয়া দিয়াছিলাম । কোন্ গুঁড়া খাইলে মানুষ মরে ডাক্তারের কাছে শিখিয়াছিলাম ।
ডাক্তার এক চুমুকে গ্লাসটি শেষ করিয়া কিঞ্চিৎ আর্দ্র গদ্গদ কণ্ঠে আমার মুখের দিকে মর্মান্তিক দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন , ‘ তবে চলিলাম । '
বাঁশি বাজিতে লাগিল, আমি একটি বারাণসী শাড়ি পরিলাম; যতগুলি গহনা সিন্দুকে তোলা ছিল সবগুলি বাহির করিয়া পরিলাম- সিঁথিতে বড়ো করিয়া সিঁদুর দিলাম । আমার সেই বকুলতলায় বিছানা পাতিলাম ।
বড়ো সুন্দর রাত্রি । ফুট্ফুটে জ্যোৎস্না । সুপ্ত জগতের ক্লান্তি হরণ করিয়া দক্ষিনে বাতাস বহিতেছে । জুঁই আর বেল ফুলের গন্ধে সমস্ত বাগান আমোদ করিয়াছে ।
বাঁশির শব্দ যখন ক্রমে দূরে চলিয়া গেল , জ্যোৎস্না যখন অন্ধকার হইয়া আসিতে লাগিল , এই তরুপল্লব এবং আকাশ এবং আজন্মকালের ঘরদুয়ার লইয়া পৃথিবী যখন আমার চারি দিক হইতে মায়ার মতো মিলাইয়া যাইতে লাগিল তখন আমি নেত্র নিমীলন করিয়া হাসিলাম ।
ইচ্ছা ছিল যখন লোকে আসিয়া আমাকে দেখিবে তখন এই হাসিটুকু যেন রঙিন নেশার মতো আমার ঠোঁটের কাছে লাগিয়া থাকে । ইচ্ছা ছিল যখন আমার অনন্তরাত্রির বাসর-ঘরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করিব তখন এই হাসিটুকু এখান হইতেই মুখে করিয়া লইয়া যাইব । কোথায় বাসর-ঘর। আমার সে বিবাহের বেশ কোথায় । নিজের ভিতর হইতে একটা খট্খট্ শব্দে জাগিয়া দেখিলাম , আমাকে লইয়া তিনটি বালক অস্থিবিদ্যা শিখিতেছে। বুকের যেখানে সুখদুঃখ ধুক্ধুক্ করিত এবং যৌবনের পাপড়ি প্রতিদিন একটি একটি করিয়া প্রস্ফুটিত হইত সেইখানে বেত্র নির্দেশ করিয়া কোন্ অস্থির কী নাম মাস্টার শিখাইতেছে । আর, সেই যে অন্তিম হাসিটুকু ওষ্ঠের কাছে ফুটাইয়া তুলিয়াছিলাম তাহার কোনো চিহ্ন দেখিতে পাইয়াছিলে কি । ”
“ গল্পটা কেমন লাগিল । ”
আমি বলিলাম , “ গল্পটি বেশ প্রফুল্লকর । ”
এমন সময় প্রথম কাক ডাকিল । জিজ্ঞাসা করিলাম , “ এখনো আছ কি । ” কোনো উত্তর পাইলাম না ।
ঘরের মধ্যে ভোরের আলো প্রবেশ করিল ।
©somewhere in net ltd.