![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার বুঝার বয়স থেকে শুরু করে আজ অব্ধি বাবা আমাকে কিছুই দেয় নি। প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় পাড়ার আর দশটা ছেলেদের হাতে গেইমসের খেলনা ছিলো, তখন আমার হাতে একটা লাটিমও ছিলো না খেলার মতো। অথচ বাবার পকেট থেকে চুরি করে টাকা নিয়ে একটা ইয়্যু ইয়্যু ( খেলনা) কিনেছিলেম বলে আমাকে বেধড়ক পিটিয়েছিলো বাবা। সেইদিন আমার প্রচুর রাগ, মনে মনে কত প্রতিজ্ঞা করে বসেছি। বড় হয়ে আমি এর প্রতিশোধ নিবোই নিবো।
আমার ফ্রেন্ডরা যখন নিত্যনতুন স্কুল ব্যাগ নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করতো তখনো মনে হতো আমার বাবাটার বাবা হওয়ার যৌগ্যতা নেই। চারুকলা কলা ক্লাসে যখন মেডাম ছবি আকঁতে বলতেন সবাই কত সুন্দর সুন্দর বাহারি রঙ পেন্সিল বের করতো ব্যাগ থেকে, অথচ তখন আমার কাছে বাবার দেওয়া সেই বিশ টাকার রঙ পেন্সিলের প্যাকেট। সবার সামনে খুলতেই ইচ্ছে করছিলো না। তখনও বাবার প্রতি প্রচুর রাগ জমেছিলো মনে, কি এমন ক্ষতি হতো একশো টাকা দিয়ে উন্নতমানের এক প্যাকেট রঙ পেন্সিল কিনলে।
ক্লাস সিক্সে উঠেছি, স্কুল অনেক দূর। আমার অনেক ফ্রেন্ড ফনিক্স আর হিরো ব্রান্ডের সাইকেল চালিয়ে ক্লাস করতে যেতো। অথচ বাবাকে বলতেই রেগে মেগে আমার উপর চড়াও। সেই থেকে আব্বুকে কোন কিছুর আবদার করতাম না। তবুও স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বু প্রতিদিন পাঁচ টাকার একটা নোট পকেটে গুঁজে দিতেন, আর বলতে কষ্ট করে পড়া লেখা করলে সেই পড়া লেখার মূল্য বেশি থাকে।
এরপর বাবার কাছ থেকে কিছুই আবদার করতাম না। আম্মুকেই সব বলতাম। বই বেশি হয়ে যাওয়াতে স্কুলে যেতে আসতে খুব কষ্ট হতো, এদিকে কম বেশি আমার সব ফ্রেন্ডের কাছে বাহারি ডিজাইনের ব্যাগ আছে।
আম্মু প্রতিদিন আব্বুর সাথে ব্যাগের কথা বলে বলে বখা খেতো। মনে মনে বলতাম "বাবা হয়েছে, ছেলের ইচ্ছে পূরণ করতে পারে না"।
একদিন রাতে আব্বু আমার জন্য একটা ব্যাগ এনেছিলো, তাও আবার দুইশত টাকা দিয়ে। এত সস্তা দামের ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাবো না বলে পণ করেছি । আম্মু অনেক বুঝালো আমাকে "সংসারের এত টানাপোড়নের ভিতরেও তোর আব্বু তোর জন্য এই ব্যাগ এনেছে, তুই স্কুলে না গেলে তোর আব্বুর খারাপ লাগবে"। আম্মুর কথা ফেলতে পারিনি সেইদিন।
কলেজ লেবেলে এসে একটা মোবাইলের জন্য কত কাকুতিমিনতিই না করলাম। কারণ বন্ধুরা সবাই মোবাইল ব্যবহার করে অথচ আমার মোবাইল নেই। আম্মুকে প্রতিদিন জ্বালাতন করতাম এই মোবাইলেন জন্য। কিন্তু মোবাইল আর চোখে দেখিনি। সেই থেকে পণ করেছিলাম "সংসার কিভাবে চলাতে হয় আমি বাবাকে শিখাবো, আমার ভাই বোনদের ইচ্ছে গুলো আমিই পূরণ করবো"
আজ বলতে গেলে বাবার জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে। সংসার এক প্রকার আমার রোজগারেই চলে। এখন বুঝতে পারছি বাবার গত ছাব্বিশটা বছর কত কষ্টে কেটেছে, একটা পরিবার উনি কিভাবে চালিয়েছে। পরিবারের সবার স্বপ্ন পূরণে যে মানুষটা নিজের কত স্বপ্ন মাটিচাপা দিয়েছে তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
নিজের সর্বশ দিয়ে সব সময় আমাদের খুশি রাখতেন তিনি। এক বেলা না খেয়ে উপোষ থাকতে হয়নি। অথচ আমি এই টুকুতেই হাপিয়ে উঠেছি। ভাই বোনের খুঁটিনাটি ইচ্ছে গুলো পূরণ করতে গিয়ে আমাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অথচ বাবা একাই আমাদের সবার বোঝা কাঁধেচাপা করে সংসার চালিয়ে গিয়েছিলো। এত কিছুর ভীড়েও ঈদ এলে নিজেদের সৌন্দর্যবর্ধন কাপড়ের কথা চিন্তা না করে আমাদের সবার কথা চিন্তা করতো। আমাদের সবার আবদার গুলো পূরণ করার চেষ্টায় মগ্নচৈতন্য থাকতো।
আজো বাবা আমাকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। এই বার্ধক্যজনিত অসুস্থ শরীর নিয়ে চাষাবাদ করে যাচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। কত করে বলি বাবা তোমাকে এইসব করতে হবে না আমি আছি তো। বাবা মুখে কিঞ্চিৎ হাসি দিয়ে বলে " তুই একা পারবি না, তোরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে নাকি"
"মাঝেমধ্যে আমার ভাবতেই কান্না আসে, এই বাবাকেই কিনা আমি তখন মনে মনে ঘৃণা করতাম"
©somewhere in net ltd.