![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রঙের দুনিয়ায় আমি এখনও ছাত্র,তবে শখের বশে লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আবার কখনো আরও অনেক কিছু।
আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশ এবং এখানকার আরবসমাজের মধ্যে যে কয়েকটি বিষয়ে মৌলিক পার্থক্য খুব স্পষ্ট, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বিষয় ইসলাম ও ইসলামী আদর্শ। খুব সহজভাবে বলতে গেলে, ধরা যাক বাংলাদেশের কথাই। নিয়মিত নামাজ পড়া, কুরআন তেলাওয়াত করা, রোজা ও জাকাত এবং অন্যান্য ফরজ ইবাদতের বিষয়ে যতœবান থাকাসহ ইসলামী বিধিবিধান বিষয়ে আমাদের মধ্যে এবং আরবদের মধ্যে বিস্তর তফাত। আমাদের সমাজে যারা মোটামুটি দ্বীনদার, কেবল তারাই এসব বিষয়ে সচেতন এবং গুরুত্বের সঙ্গে তা পালন করেন। এর বাইরে সমাজের বিশাল অংশ এ বিষয়গুলোকে নিজেদের জন্য সম্ভব নয় বলে ধরে নিয়েছেন।
যেমন, শুক্রবার মসজিদে গেলে ইমাম সাহেব তার বয়ান শুরু করা পর্যন্ত সমবেত মুসল্লিরা চুপ করে বসে থাকেন। নিঃশব্দে এদিক ওদিক তাকান বসে বসে। কেউ হয়তো দু-চার রাকাত নামাজ পড়েন। হাতে গোনা দুয়েকজন হয়তো সামনে বসে কুরআন তেলাওয়াত করেন। একই জুমার দিনে যদি আরবদেশগুলোর কোনো সাধারণ মসজিদের কথাও ধরা হয়, তবে দেখা যাবে, ইমাম সাহেব তার বয়ান কিংবা খুতবা শুরু করা পর্যন্ত কেউ চুপচাপ বসে নেই। শতকরা নব্বইভাগের বেশি মুসল্লি মসজিদে বসে কুরআন তেলাওয়াত করেন। শিক্ষিত কিংবা সাধারণ মানুষও মসজিদে এসে প্রথমেই দু রাকাত নামাজ আদায় করে নেবেন এবং তারপরই কুরআন শরীফ নিয়ে তেলাওয়াতে মগ্ন হবেন।
এই যে বিষয়টি, এর মানে এই নয় যে, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ কুরআন পড়তে জানেন না। বরং খুব কমসংখ্যক মানুষই হয়তো দেখে দেখে কুরআন পড়তে অপারগ। বরং আজকে যাদের বয়স পঞ্চাশোর্ধ, তাদের অধিকাংশই ছোটবেলায় মক্তব পড়েছেন এবং দুর্বলভাবে হলেও তারা অন্তত দেখে দেখে কুরআন শরীফ পড়তে পারেন। কিন্তু পরিবেশটাই এমন যে, পড়তে জানলেও কুরআন হাতে নিয়ে বসা এবং তেলাওয়াতে কেউ আগ্রহবোধ করেন না। শুধু অবসর সময়টুকু বসে কুরআন পড়ার বিষয়টি নয়, এমন অনেক সহজ সাধারণ বিষয়েও আমরা এবং আমাদের সাধারণ মানুষ একেবারেই উদাসীন। তারা হয়তো ভাবেন, আমার এতো পাপ, আমার তেলাওয়াত কি আর মহান আল্লাহ কবুল করবেন।
শুধু ইবাদত নয়, বরং সংস্কৃতি ও সভ্যতার দৃষ্টিতেও ইসলাম আমাদের কাছে আলাদা একটি বিষয়। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি যেমন রয়েছে, তেমন ধর্মাবলম্বী হিসেবে ইসলামও আমাদেরকে আলাদা সংস্কৃতি দিয়েছে। আমাদের আদিসভ্যতার সঙ্গে ইসলামের কোনো যোগসূত্র নেই, কিন্তু তবুও ইসলামের ইতিহাস ও সভ্যতাকে আমরা আমাদেরই ঐতিহ্য ও সম্পদ বলে আনন্দ অনুভব করি। আবার কেউ হয়তো দুটোকে বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন। দেশীয় সংস্কৃতিই তার কাছে মৌলিক, আর ইসলামের ব্যাপারগুলো তার কাছে গৌণ হিসেবেই বিবেচ্য।
পক্ষান্তরে আরবসমাজের সাধারণ মানুষ ইসলাম এবং ইসলামের আদর্শকে নিজেদের একান্ত আপন বলেই ভেবে নিয়েছে গত দেড়হাজার বছর ধরে। ফলে একজন সাধারণ আরবের কাছে ইসলামী বিধিবিধান ভয় কিংবা দূরের কিছু নয়। তাদের বিশ্বাস, এটাই আমার জীবনাদর্শ, এটাই আমার পরিচয়। এ বিশ্বাস তার রক্ত ও মাংসে মিশে আছে। ফলে অবসর সময়ে কুরআন পড়া, নিজের রুমে কিংবা গাড়িতে একখানা পবিত্র কুরআন রাখা, সময় হলে মসজিদে গিয়ে নামাজটুকু আদায় করা, কথাবার্তায় নানাপ্রসঙ্গে দুআ উচ্চারণ করা এ সমাজে অপরিচিত কিংবা অস্বস্তির কোনো বিষয় নয়। সমাজের একেবারে সাধারণ স্তরে সবার বিশ্বাস, ইসলামই তাদের মৌলিক পরিচয়।
এ বিশ্বাসের শক্তিতে বলীয়ান বলেই পশ্চিমা সংস্কৃতিকে আরবরা কখনোই নিজেদের ভাবতে পারেনি। এমনকি যে তরুণরা এখানে পশ্চিমা ফ্যাশন আর সংস্কৃতিতে নিমগ্ন, তারাও ভেতরে হৃদয়ের গভীর থেকে বিশ্বাস করেন, এটা আমার নয়, ওদের। দিনশেষে বেলা ডুবলে তারা ঠিকই ফিরে আসেন ইসলামের ছায়াতলে। কারণ, ছোট থেকে বড় সবাই জানেন, ইসলাম ছাড়া আমাদের অন্য কোনো সংস্কৃতি নেই।
এ বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য করেই আজ থেকে কয়েক দশক আগেই নড়েচড়ে বসেছিল পশ্চিমাজগত। ঠিক তখন তারা কিছু নতুন কর্মসূচী পরীক্ষামুলক বাস্তবায়ন শুরু করে। আরবজগতের মেধাবী তরুণ এবং কৃতি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির দরজা খুলে তাদেরকে স্বদেশে আমন্ত্রণ জানায় আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশগুলোও। তারপর শুধু শিক্ষা নয়, বিদেশি ভাষার সঙ্গে এই ভিন্ন সংস্কৃতির গুণাগুণও তাদের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয় সুকৌশলে। লেবাননের নাগরিক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী জর্জি জায়দান (১৮৬১-১৯১৪) এসময় তার সম্পাদিত ম্যাগাজিন আলহেলাল ও অন্যান্য উপন্যাস ও সাহিত্যরচনাগুলোতে এ বিষয়ে বেশ জোরেশোরে প্রচারণাও শুরু করেন।
আর সূক্ষভাবে তাদেরকে তখন বোঝানো হয়, ধর্মের পরিচয় কেন জাতিগত পরিচয়ের উপর প্রাধান্য পাবে? দুটো তো সম্পূর্ণ আলাদা। তোমাদের প্রধান পরিচয়, তোমরা আরব। ইসলাম ও মুসলমানিত্ব তোমাদের দ্বিতীয় বা ঐচ্ছিক পরিচয়। ইসলামের নাম নিয়ে জয়ধ্বনি করলে তোমাদের স্বভাষী খ্রিস্টান এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে ঐক্য হবে কীভাবে? তাই বরং, তোমরা নিজেদের পরিচয় হিসেবে সমাজজীবনে সর্বত্র আরব জাতীয়তাবাদের প্রচার শুরু করো।
আজ কয়েকদশক পর বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমা ও তাদের মিত্রদের এ কৌশল সফল হতে চলেছে। আরব জাতীয়তাবাদের শ্লোগান তুলে মূলত তখন থেকেই মিসর এবং পাশ্ববর্তী অঞ্চলে নতুন আলোচনা শুরু হয়। সাহিত্য সংস্কৃতি এবং সমাজের সবশাখায় ‘আরব আরব’ বলে নতুন ধ্বনি শোনা যায়। এর আড়ালে ধীরে ধীরে ইসলামকে এ জাতির প্রথম পরিচয় ও সংস্কৃতির প্রতীক থেকে মুছে ফেলার প্রক্রিয়াও চলে সুকৌশলে। তারপর ধীরে ধীরে সুশীল সমাজের মধ্যে একটি স্পষ্ট ব্যবধান গড়ে ওঠে। একদল ইসলামকে আরব জাতীয়তাবাদের বিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টায় লিপ্ত, অন্য দলটি আরব জাতীয়তাবাদকে ইসলামবিরোধী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে।
এভাবেই ধীরে ধীরে বিদেশ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত সমাজে আরব এবং ইসলামকে দুটো আলাদা আলাদা বিষয় হিসেবে বিবেচনার প্রবণতা শুরু হয়। কিন্তু এ গোষ্ঠীর সামনে অনেক বাধা এবং প্রতিকূলতা আজও বিরাজমান। আরবী ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সুবাদে এটি এখন আর নির্দিষ্ট কোনো জাতিগোষ্ঠীর ভাষা নয়, বরং পুরো একটি দ্বীনের সব অনুসারীই এ ভাষাকে নিজেদের একান্ত আপন বলে ভাবেন। অন্যভাষীরাও প্রবল আগ্রহে আরবি শেখা এবং গবেষণায় নিজেদের জীবন ও মেধা উৎসর্গ করে দিয়েছেন। আরব অঞ্চলের সীমানা ডিঙিয়ে এ ভাষার শেকড় ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর অজস্র অঞ্চলে। ফলে ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে একতরফা খেলার নিশ্চিন্ত সুযোগ ওই শ্রেণির কপালে জুটেনি। কোনোভাবেই আরবি ভাষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা ইসলাম ও কুরআনের প্রসঙ্গ তারা আলাদা করতে পারেনি।
আরবির সঙ্গে অন্য ভাষী লোকদের এমন নিবিড় সম্পর্ক তো বটেই, আরবসমাজের সাধারণ মানুষ গভীরভাবে বিশ্বাস পোষণ করেন, ইসলাম ধর্মটি পৃথিবীতে না এলে তারা চিরকালই বর্বরতার যুগে রয়ে যেতেন। এ ইসলাম তাদের পরিচয় পাল্টে দিয়েছে, বর্বরতা থেকে মুক্ত করে বিশ্বশাসন তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল এই ইসলাম। ফলে, সাফল্য এবং সমৃদ্ধির সব রহস্য কেবলই ইসলামের মধ্যে নিহিত, অন্য কোনো মাধ্যমে নয়। বলাবাহুল্য, আরব জাতীয়তাবাদের পথচলা আজ কয়েক দশক পার হলেও সাধারণ মানুষের কাছে এটি তার বাণী পৌছাতে করুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
এ পরিক্রমায় আজ ফিলিস্তিন এবং ইসরাইলের মধ্যকার সংঘাত কারো কাছে দুটি দেশের যুদ্ধ, কারো কাছে তা পবিত্র জিহাদ। স্বয়ং ফিলিস্তিনেও আজ এটাকে জিহাদ মনে করার চেয়ে নিজেদের স্বদেশ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন অনেকেই। সেজন্যই আরবঅঞ্চলের কোনো এক শায়খ বলেছিলেন, এ লড়াইকে যদি তোমরা জিহাদ মনে না করো, তবে আল্লাহ পাকের সাহায্য আসবে কোত্থেকে? তোমরা যদি এটিকে নিজেদের দেশরক্ষার সংগ্রাম হিসেবে ধরে নাও, তবে এমন পার্থিব লড়াইয়ে জয়-পরাজয় অস্ত্র ও সমরশক্তির উপরই নির্ভর করে, খোদায়ী মদদে নয়।
শুধু ফিলিস্তিন ও ইসরাইল সংঘাত নয়, আরব জাতীয়তাবাদের ধোঁকায় মোহগ্রস্ত হয়ে আরবশাসকরা গোটা আরবজাহানকে বিভক্তির দিকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ফলে উম্মাহর পরিচয় থেকে দূরে সরে, আরব পরিচয়ও ভুলে গিয়ে আজ কুয়েতি, কাতারি কিংবা মিসরি ও জর্ডানি পরিচয়টাই নিজেদের আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠছে শাসকমহলে। খোশখবর এটুকুই যে, আরব সাধারণ সমাজে এসব ব্যধি ও পশ্চিমাদের শেখানো বুলি এখনও ছড়িয়ে পড়েনি।
যে উম্মাহর পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আজকের এই সমৃদ্ধ ইসলামী সভ্যতা, সেই উম্মাহ পরিচয় মুছে দিতে দিনদিন আরও সচেষ্ট হচ্ছে পশ্চিমাশক্তি, বিশেষ করে আমেরিকা। কতো কতো উপায়ে এ ধ্যানধারণা আরবসমাজে পাচার করা যায়, তা নিয়ে চলছে নিত্য নতুন গবেষণা। আগামী ভবিষ্যত বলে দেবে, কতটুকু সফল হবে তাদের বাস্তবতা।
আরব বিশ্ব সম্পর্কিত অন্যান্য লেখা
©somewhere in net ltd.