![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রঙের দুনিয়ায় আমি এখনও ছাত্র,তবে শখের বশে লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আবার কখনো আরও অনেক কিছু।
আরববিশ্বে গত কয়েক বছরে সংঘটিত বিপ্লব, বিদ্রোহ এবং গৃহযুদ্ধের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিন ইস্যুটি যেন হারিয়েই গিয়েছিল। দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরবনেতাদের বক্তৃতা বিবৃতিও শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে সেই দৃশ্যপট পুরোটাই বদলে গেছে। আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে গাজা এবং ইসরাইল। দু পক্ষের হামলা ও আক্রমণে আবারও রক্ত ঝরছে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ ওই ভূখণ্ডে।
সন্দেহ নেই, গত ৭ই জুলাই থেকে শুরু হওয়া এ সংঘাতে বরাবরের মতো এবারও ফিলিস্তিনে নিহতের সংখ্যা কয়েক শ ছাড়িয়েছে। এ লেখাটি যখন লিখছি, তখন আলজাজিরার সূত্রমতে ফিলিস্তিনে নিহতের সংখ্যা ২৫২ ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ এবং বিধ্বস্ত হয়েছে অসংখ্য ঘরবাড়ি এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ঠিক এই মুহূর্তে গাজায় ইসরাইল যে স্থলযুদ্ধ শুরু করেছে তাতেও হামাস শক্ত প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছে এবং একজন ইসরাইলি সৈন্যকে হত্যার খবর জানিয়েছে। তবে সর্বশেষ ২০১২ সালের মতো এবার ইসরাইল শুরু থেকেই হামাসকে প্রতিহত করতে মোক্ষম সুযোগ পায়নি। ফলে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এবারের এ লড়াই আগের সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে।
আরববসন্ত শুরু হওয়ার পর থেকে তো বটেই, এরও কয়েক বছর আগে থেকে ফিলিস্তিনবাসী বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে, নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে তাদেরকেই সক্রিয় শক্তিশালী হতে হবে, অন্য কোনো দেশ বা গোষ্ঠীর উপর আর নির্ভরতা নয়। কোনো পশ্চিমা দেশ অথবা জাতিসংঘ কিংবা কোনো আরব প্রতিবেশীদেশও তাদের ভাগ্য ফিরিয়ে দেবে না। গত পঁচিশ বছর ধরে চলমান শান্তি আলোচনার আড়ালে ইতোমধ্যে ভূমিহীন হয়েছেন কয়েক লাখ ফিলিস্তিনি এবং ইসরাইল ক্রমেই ক্রমেই তার ঔদ্ধত্য বাড়িয়ে চলেছে। ফিলিস্তিনবাসী বিশেষত গাজার অধিবাসী এবং আরও নির্দিষ্ট করে বোঝাতে হামাস এই অনুধাবন থেকেই নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সব ধরণের প্রচেষ্টা ও কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। হামাসের এ কৌশল ও কর্মসূচী যে এতোদূর পর্যন্ত এগিয়েছে এবং তাদের সাফল্যও যে অনেককে অবাক করার মতো, তা চলমান এ যুদ্ধটি শুরু না হলে অনেকের কাছেই অজানা থেকে যেত। তেলআবিব আণ্ডার ফায়ার শিরোনাম দিয়ে প্রকাশিত ইসরাইলের সংবাদমাধ্যমেও এ বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাপক কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে।
হামাসের এমন বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা এবং সফলতা শুধু ইসরাইলকে নয়, বরং পুরো আরববিশ্বের সবাইকে অবাক করেছে। এই প্রথমবারের মতো হামাস শক্তিশালী রকেট ও মিসাইল ছুঁড়েছে যা এর আগে ইসরাইলের এতো গভীরে কখনো পৌঁছতে পারেনি। আগের যে কোনো যুদ্ধের চেয়ে এবার হামাসের ব্যবহৃত মিসাইলগুলোর শক্তিসীমাও বেড়েছে এবং ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিব ও বিভিন্ন জায়গায় তা আঘাত করেছে। এসব আঘাতপ্রাপ্ত স্থাপনাগুলোর মধ্যে ইসরাইলে স¤প্রচারিত টিভিচ্যানেলের অফিসও রয়েছে। আবাবিল নামে হামাস যে চালকবিহীন গোয়েন্দা বিমান (এফ১৬) ইসরাইলের আকাশসীমায় পাঠিয়েছে এবং সফলভাবে সেটি ফিরেও এসেছে, তা এ পর্যন্ত সংঘটিত কোনো যুদ্ধে অন্য কোনো আরবদেশ দেখাতে পারেনি। অভাব এবং অবরোধে বিপর্যস্ত গাজাই আরববিশ্বে প্রথম এমন গোয়েন্দাবিমান তৈরি করেছে এবং দুর্ধর্ষ শত্র“ ইসরাইলের সীমানায় তা সফলভাবে পাঠিয়ে মিশন শেষ করেছে।
ইসরাইল বেশ ভালোভাবেই অনুভব করছে, তাদের আক্রমণে ফিলিস্তিনের যে সাধারণ মানুষ এবং শিশুরা নিহত হচ্ছে, তাতে বিশ্ববাসী বরং তাদেরকেই আরও বেশি ঘৃণা করছে। আর ইসরাইলের এসব হামলায় হামাসের প্রতিরোধযোদ্ধারা এবং তাদের স্থাপনাগুলো সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো, হামাস তাদের নিয়ন্ত্রিত গাজা থেকে গত কয়েকবছরে ইসরাইলের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তিতে জড়িত সবাইকে উৎখাত করেছে এবং ইসরাইলের তথ্য সংগ্রহের প্রায় সবগুলো পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে গাজার অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে এবং গোয়েন্দা নেটওয়ার্কও বিস্তৃত করা হয়েছে। ফলে হামাসের এই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কোনো আগাম সংবাদ ইসরাইলের হাতে পৌছেনি।
গত কয়েকবছর আগেও হামাসের ব্যবহৃত রকেট ও মিসাইল নিয়ে আরবনেতারা পরস্পরে কৌতুক করতেন। খোদ ফিলিস্তিনের ফাতাহ কর্তারাও সেগুলোকে ট্যাঙ্কের নল বলে তাচ্ছিল্য করেছেন। কিন্তু ২০১২ সালে হামাস প্রতিশ্র“তি দিয়েছিল, খুব শিগগিরই তারা প্রযুক্তি কৌশলে নিজেদের পারদর্শিতা দেখাবে। গত দশদিনে স্পষ্ট হয়েছে, হামাস সত্যিই প্রতিশ্র“তি রেখেছে। তিন থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার গতিসীমার মিসাইলের জগত থেকে বেরিয়ে হামাসের সশস্ত্র শাখা আলকাসসাম বিগ্রেড এখন একশ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব অতিক্রমের শক্তিসম্পন্ন মিসাইল ব্যবহার করছে যা তেলআবিব এবং আরও দূরের শহর হাইফায় আঘাত হেনেছে।
মুখে দাম্ভিকতাপূর্ণ কথাবার্তা অব্যাহত রাখলেও মিসরের দেয়া যুদ্ধবিরতিপ্রস্তাব মেনে নিয়েছিল ইসরাইল। কিন্তু এটিকে নিজেদের পরাজয় মনে করে প্রত্যাখ্যান করেছে হামাস এবং তা সংশোধনের জন্য মিসরের প্রতি আহবান জানিয়েছে। হামাসের সামনে এখন খোলা পথ একটিই আর তা হলো, ইসরাইলকে নিজেদের শক্তির অস্তিত্ব জানান দিয়ে পশ্চিমাবিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক সংস্কার আনা। শুধু পশ্চিমা দুনিয়া নয়, হামাস চলমান যুদ্ধে ইসরাইলের অধিবাসীদের কাছে হিব্র“ ভাষায় যে বার্তা পাঠিয়েছে তাতেও এ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের চেষ্টা প্রতিফলিত হয়েছে।
হামাসের কর্তারা তাই বোঝাতে চাচ্ছেন, ফিলিস্তিন-ইসরাইল সমস্যার সমাধান ওয়াশিংটনে নয়, বরং সেটা তাদেরকেই করতে হবে নিজেদেরই উদ্যোগে এবং নিজেদেরই স্বার্থে। পাশাপাশি প্রতিবেশী আরবদেশগুলোর প্রতিও হামাস বার্তা পাঠিয়েছে, গত বিশ বছর ধরে আরব রাষ্ট্রনেতারা ইসরাইলের প্রতি যে নমনীয় ভূমিকা দেখাচ্ছে এতে বরং দিনদিন ইহুদিদের কপটতা ও শঠতা আরও বেড়েই চলেছে। মূলত এ বোধ থেকেই তারা মিসরের মতো শক্তিশালী প্রতিবেশীর দেয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার সাহস দেখিয়েছে। শান্তি আলোচনার মরিচীকার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত এবং ক্ষতবিক্ষত গাজার অধিবাসীরা হামাসের মাধ্যমেই নিজেদের স্বপ্নের বাস্তব প্রতিফলন দেখতে চান।
ঠিক এই সময়ে আপনি যখন বড্ড নিশ্চিন্তে বসে এ লেখাটি পড়ছেন, তখনও ফিলিস্তিনে রক্ত ঝরছে। শত্র“র বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে কোমলমতি শিশু-কিশোর ও আবাল বৃদ্ধবণিতা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অগণন প্রাণের বিনিময়েই বারবার ফিরে এসেছে স্বাধীনতা। মসজিদে আকসা নিয়ে যে স্বপ্ন আজ বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের চোখে মুখে অপেক্ষমান, ফিলিস্তিনের এই অসীম সাহসিকতা ও অজস্র প্রাণের বিনিময়ে সেই স্বপ্ন যেন সত্যিই স্বার্থক হয়- পরম শক্তিমান আল্লাহর কাছে এটুকুই এ সময়ের সবচেয়ে মূল্যবান প্রার্থনা।
-তামীম রায়হান
©somewhere in net ltd.