নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এই শহরে অনেক হাজার হাজার ছেলে আছে যারা চুপচাপ থাকে, কথা কম বলে। পৃথিবীতে তারা বোকা, লাজুক, হাঁদারাম নামে পরিচিত। আমাকে এর সাথে তুলনা করলে তেমন একটা ভুল হবে না। নিজের ব্যাপারে বলাটা অনেক কঠিন। তবে নিজেকে মাঝে মাঝে অনিকেত প্রান্তর ভাবি।

জাহিদুল হক শোভন

এই শহরের বোকা ছেলেটি।

জাহিদুল হক শোভন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: আগুনে পোড়া শহর

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ২:৫৬

পুরান ঢাকার চকবাজার নামটা শুনলেই মুগল আমলের একটা ভাব ভাব কাজ করে নিজের মাঝে।যদিও আমি এই মুগল আমলের দৃশ্য চোখে দেখিনি।শুধু কল্পনা করেছি বই এর পাতায় পড়ে।নিজেকে মুগলীয় মানুষ ভাবতে মন্দ লাগে না।আমি এই শহরটার মাঝে থাকি।খুব ছোট বেলায় আমি এই শহরটার মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম।যখন হারিয়ে গিয়েছিলাম তখন আমার বয়স তিন কি সাড়ে তিন হবে।আমি কিছুই চিনতাম না, ঠিক মত কথা বলতে পারতাম না।এই টুকু বয়সে কি বলবো? কোন কথার উত্তর কেমন করে দিতে হয় আমার কিছুই জানা ছিল না।আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কান্না করছিলাম সেই সময় আমার পাশে এসে একজন দাঁড়ালো। যার নাম জাফর মিয়া।তার একটা ছোট খাটো হোটেল আছে।আমি যে তার কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে এটা তিনি নিজ মুখেই কতবার বলেছে তার হিসেব নেই।দশ বছর বয়সে সিনেমা দেখতে যাবো বলে আমার এই বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করেছিলাম সেদিনই প্র্রথম তিনি উচ্চ সুরে মাকে বলেছিল “কুলাঙ্গারটারে ঘর থেইকা বাহির করো না ক্যালা? কাল সাপ পুষতাচি আমি। আমার খায়, আমার পড়ে, আমার পায়ে কুড়াল মারবার লাগচে।আরে সালা আমার পায়ে কুড়াল মারবার লাইগা রাস্তা থেইকা কৃড়াইয়া আনচি?” আমি তখন মায়ের শাড়ির আচলের পিছনে লুকিয়ে ছিলাম। মা আমার হাত ধরে সামনে এনে বললো “বাপজান তোমার আব্বা যা কইবার লাগচে তা সত্যই?” আমি নিচের দিকে তাকিয়ে শুধু হ্যাঁ সূচক ইশারা দিয়েছিলাম। মা কিছুক্ষন পর আদর করে একটা চড় মেরে বললো “আর এমন করবা না।এটা ভালো না আব্বা।” আমাকে এই কথা বলার পর বাবাকে বলেছিল “আমার পোলারে এমন কইরা বকবেন না।পোলাপান মানুষ বুজবার পারে নাইক্যা।” বাবা কাজে চলে যাওয়ার পর বিনি আপা আমাকে তার কাছে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলে “তোর সাহস কত এই বয়সে সিনেমা দেখতে যাস।তাও বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে।” আমি বুবুর দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষন পর বলেছিলাম “আপা কুড়িয়ে পাওয়া মানে কি?” আপা চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই দশ বছর বয়সে কুড়িয়ে পাওয়া ব্যাপারটাই আমি বুঝতাম না কি অদ্ভুত।বিনি আপা আমাকে এই কথার প্রত্যুত্তর দেয়নি সেদিন।বিনি আপা উত্তর না দিলেও আমি ঠিকি একটা সময় বুঝলাম এবং জানলাম আমি তাদের ছেলে না। যেদিন বুঝতে পারলাম এবং জানলাম সেদিনই আমার ভিতরটা কেমন করে যেন উঠেছিল।সেদিনের পর থেকেই আমি কেমন যেন হয়ে গেছি।আমার কিছুই ভালো লাগতো না। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে যেদিন বললাম “মা, বাবা যে বলে মাঝে মাঝে আমি তোমাদের কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে এটা একদম মিথ্যা না? বলো মিথ্যা না?” মা ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিয়েছিল। সেদিন আমার এই কথার উত্তর মাও দিতে পারেনি।মিথ্যে বুঝিয়েছিল আমাকে।কিন্তু আমি মায়ের কান্না দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম।

মাস যতই পার হতো আমি ততটা শান্ত হয়ে গিয়েছিলাম।বুবু আমাকে মাঝে মাঝে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে বলতো “তুই আমার একমাত্র ভাই।কলিজার টুকরার ভাই। এমন শান্ত হয়ে যাচ্ছিস কেন আদনান।এই বয়সে দুষ্টামি করতে হয় গাধা।একটু একটু দুষ্টামি করবি ঠিকাছে?” বুবু তখন ক্লাস টেনে পড়তো।আমি নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিলাম। বাবা আমাকে বকলেও মাঝে মাঝে আদর করে বলতো “আব্বাজান তোমারে আমি এই মাঝেমইধ্যে কত কিছু কইয়া ফালাই তুমি মনে কিছু নিবা না।কেমন?”

যখন এস এস সি পাস করলাম তখনি আমার ভিতরে অন্য আরেকটা ছায়া বাস করতে লাগলো।এই ছায়ার নাম কি দেওয়া যায় আমি জানি না। শুধু জানি একজনকে আমার ভালো লেগে গিয়েছিল।চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পাশেই থাকে।কি ভয়ংকর চোখ মিলির।শুক্র বারের নামাজ ছাড়া তো তেমন পড়তামই না। কিন্তু যখন জানলাম মিলির বাসা মসজিদের পাশে তখন কেন জানি আমি নামাজ পড়া শুরু করে দিলাম। নামাজ পড়ে ওর বাড়ির আশে পাশে ঘুরঘুর করতাম।শুধু ওর বাড়ির আশে পাশে না। ওর পিছন পিছনেও। আমার বন্ধু সজল কেমন করে জানি আচ করতে পেরে বলেছিল “তোর মতলব কি বলতো ভাই? তোর এতো এতো পরিবর্তন কেমনে কি?” আমি শুধু বলেছিলাম “দুর বাল কিছু না।” আর এই বিষয়টা চারপাশে ছড়িয়ে গেলো।মিলিও বিষয়টা বুঝতে পেরেছিল। ও একদিন আমায় ডাক দিয়ে বললো “এই ছ্যামড়া তোমার সসম্যা কি? আমি রাস্তা দিয়া ঠিক মত হাটবার পাড়ি না।কতগুলা পোলাপান আমারে দেখলেই চিল্লাই উঠে “এই আদনান” বইলা। তোমার নাম আদনান না?” আমি শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দিয়ে বললাম “তুমি খুব সুন্দর করে কথা বলো তো।” সে আামার কথা শুনে অবাক হয়ে বললো “ইদানিং দেখবার লাগচি তুমি আমায় ফলো করবার লাগচো।আমার বাপরে তুমি চিনো? চোখ খুইল্লা মারবেল খেলবো বুঝবার পারছো ছ্যামড়া?” আমি শুধু একটা হাসি দিয়ে বলেছিলাম “আমি আমার মাঝে নেই মেয়ে।তোমাকে ভালো লাগে।তোমাকে কি ভালো লাগা যাবে না?স্বপ্নে দেখা যাবে না?” সে আমার দিকে কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে চলে গিয়েছিল। আমাদের বয়সই বা তখন কত।এই বয়সে মানুষের ভিতরে আবেগ থাকে।সে আবেগ মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। এই আবেগের জন্যই আমাদের ভালোবাসা হয়ে যায় কিছুদিনের মধ্যেই।কিন্তু আজ এতো বছর আমাদের আবেগকে নষ্ট হতে দেইনি।আমরা রোজ স্বপ্ন দেখি।দিন যত যায় আমাদের ভালোবাসা তত বাড়ে। আমাদের ব্যাপারটা সবাই জানে। মিলি ভার্সিটি পাস করলেই ওকে আমার বউ করে ঘরে তুলবো।সামনের বছর ওর ফাইনাল পরীক্ষা। আর এই ছোট্ট মুগলীয় শহরটার মাঝে থাকতে থাকতে আমি ভুলে গিয়েছি আমি আমার মা বাবার কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে।এই শহরটার মাঝে এখন আমাকে এক নামেই চিনে আদনান।সবার প্রিয় আদনান।

অফিস শেষ করে যখন আমার প্রিয় পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকার গলির দিকে আসলাম তখন রিফাত ভাই আমাকে দেখে বললো “আদনান কি খবররে তোর?” আমি একটা হাসি দিয়ে বললাম “জ্বি ভাই।আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কি অবস্থা?” রিফাত ভাই বললো “আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো।তুই নাকি পায়েশ খাইতে চাইছিস সকালে তোর ভাবীর কাছে? তাই আমাকে ফোন করেই বলে দিয়েছিল অফিস থেকে ফেরার পথে দুধ আর চিনি নিয়ে আসতে।” আমি একটা হাসি দেই তারপর বললাম “আমি তো এমনি বলেছি।প্রায় বলি।তুমিও ভাবীর কথা শুনলা।এই অবস্থায় তাকে রান্না করতে দিবা তুমি?” রিফাত ভাই বললো “টুনাটুনির সংসার বুঝলি।তোর ভাবী বলছে। আম কি নিষেধ করতে পারি? তাছাড়া আমি আছিতো। দুজনে মিলে রান্না করবো।তুই রাত্র্রে আইশা খেয়ে যাইস।” রিফাত ভাই আর কিছু না বলে চলে যায়। রিয়া ভাবী অন্তঃসত্ত্বা।রিয়া ভাবী আর রিফাত ভাই রিলেশন করেই বিয়ে করে।কি মধুর সম্পর্ক তাদের মাঝে।এই মধুর সম্পর্কের মাঝে কি মায়া মায়া ভালোবাসা থাকে।মাঝে মাঝে রিফাত ভাই আর রিয়া ভাবী যখন ঝগড়া করে দুজন দুই রুমে আলাদা হয়ে বসে থাকে তখন রিয়া ভাবী আমাকে ফোন দিয়ে বলে “আদনান তুমি কি একটু আসবা বাসায়।তোমার ভাই রাগ করে খাবার খাচ্ছে না।মানুষটারে নিয়া আমি পারিও না। ছেলে মানুষের এতো অভিমান থাকতে হয়? তুমি বলো? যেখানে আমি অভিমান করলে সে আমার রাগ ভাঙ্গাবে, তা না তার অভিমান আমার থেকে ভাঙ্গাতে হয়।শুধু এইটুকু বলেছিলাম তুমি ঘুমের মাঝে নাক ডাকো কেন? তোমার সাথে ঘুমালে আমার ঘুম হয় না।কিন্তু এই নাক ডাকার শব্দ এখন না শুনলেই আমার ঘুম হয় না সেটা কি সে জানে? অভ্যাস হয়ে গিয়েছে না? সে কিছু না খেলে আমারও তো খেতে ইচ্ছে করে না।তাকে ছাড়া কি আমি কখনো খেয়েছি? সে এটা বুঝে না?” ঐদিকে রিফাত ভাইও আমায় ফোন দিয়ে বলে “আমি তোর ভাবীর সাথে রাগ করছি।আমি কিছু না খেলে সেও খাবে না এটা আমি জানি।এটাও আমি জানি তোর ভাবী তোকে ফোন দিয়েছে।ভাই একটু তাড়াতাড়ি আয় না। পেটে ক্ষুধা লাগছে।” আমি অনুভব করি এই মানুষ গুলার ভালোবাসাকে।এই ভালোবাসা যতদিন থাকবে আমাদের ভিতরের অনুভূতিগুলোও ততদিন সতেজ থাকবে।সতেজ থাকবে আমাদের মনটা।

সন্ধ্যার নাগাত বাবা আমার রুমে এসে বললো “আব্বাজান তোমার চাকরির কি খবর?” আমি বাবাকে বলি “ভালো বাবা।” বাবা বললো “ভালো চললেই ভালো।আগামীকাল ২১শে ফেব্রুয়ারী।আগামীকালই সন্ধ্যা বেলা বিনিরে দেখবার আসবো পাত্র পক্ষ।তুমি বাড়ির ছেলে তাই তোমারে জানাইবার আইচি।” আমি কিছু বলি না। বাবা আমাকে বকা দেওয়া অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। আমাকে তার বাড়ির ছেলে, নিজ ছেলেই মনে করে।আমার তখন মনে হয় আমার মাথার উপর ছাদটা এখনো আছে। আমি যখন ভার্সিটি পাস করেছিলাম বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল আর মাকে বলেছিল “দেখতে হইবো না কার পোলা।জাফর মিয়ার পোলা।” বাবা সেদিন হোটেলে সবাইকে ফ্রি খাইয়েছিল। এই একদিনের জন্য বাবার কতটাকা লোকসান হয়েছিল আমি জানি না।বাবা তোমার ব্যবসায় লোকসান হওয়াতে আমি দুঃখিত।

মিরাজ আমাকে বলে “আদনান ভাই মায়ের কথা মনে পড়ে।মাকে অনেক দিন দেখি না।গত দুই বছর বাড়িতে যাওয়া হয়নি।ছোট বোনটা মাঝে মাঝে ফোন করে বলে “ভাইয়া তুই কবে আসবি? হঠাৎ করেই আম্মা ঘুমের মধ্যে তোর নাম ধরে চিৎকার করে উঠে।” আজকে সকালে মাকে ফোন দিয়েছিলাম। মাকে ফোন করলেই খালি একটা কথা বলে “বাবা ঠিক মত খাস তো?” আমার তখন কান্না পায়। গ্রামের আলো বাতাস কতদিন শরীরে মাখাই না।মায়ের কথা মনে পড়লেই বুকটা কেমন করে উঠে।ছোট বেলার কথা মনে পড়ে।মা স্কুলে পাঠানোর সময় মাথায় চুবচুবা করে তেল দিয়ে দিত।আমি খুব রেগে যেতাম এমন করে তেল দিয়ে দিলে।কারণ এই তেল বেয়ে বেয়ে আমার ঘাড়ে এসে পড়তো।” আমি মিরাজের দিকে তাকিয়ে থাকি। ওর তিন বন্ধুও ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। মিরাজ পড়ালেখার জন্য এই শহরটাতে থাকে।মাঝে মাঝে আমি ওদের সাথে আড্ডা দেই।আমি জানি মিরাজ এখন কি করবে।ও যখনি এমন কথা বলে তখন ও ভাইব এর নষ্টালজিয়া গানটা গায়।এই গানটা ওর খুব প্রিয়।এটা ভাবতে ভাবতেই ও গাইতে থাকলো…

হুম…এখনোতো রোজ সকালে
লাল সুরুজটা ওঠে
আমরা নাই তবও সাঝে
হাসনাহেনা ফুটে
এখনোতো রোজ সকালে
লাল সুরুজটা ওঠে
আমরা নাই তবও সাঝে
হাসনাহেনা ফুটে
তোমরা সবাই সূর্য দেখো
জুই কামিনীর গন্ধ শোকো
মায়ের শুধু চোখের কোন্টা
ভিজে উঠে ধীরে
কবে যাবো ফিরে…. কবে যাবো ফিরে….. কবে যাবো ফিরে…

আমি যখনি ওর মুখে এই গানটা শুনি তখনি অদ্ভুত রকমের খারাপ লাগা শুরু করে।কি আছে এই গানটাতে যা ভিতরটাকে একদম নাড়া দিয়ে দেয়।তখন আমার আসল মা বাবার কথা মনে পড়ে।আমি জানি না আমার আসল বাবা মা কোথায়। ওরা হয়তো আমার জন্য রাত জেগে কান্না করে।হয়তো আমার মাও ঘুমের মাঝে চিৎকার দিয়ে উঠে আমার কথা ভেবে।যে কান্না আমার কাছে পৌছায় না।আমি ওদের বললাম “তোরা থাক আমি গেলাম।ভাল্লাগছে না।”

সিড়ি দিয়ে নেমেই যখন যখন সাদেক ভাই এর সাথে দেখা হলো আমি বললাম “কি ভাই কোথায় যান?” সাদেক ভাই আমার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো “বিরিয়ানী আনতে যাই। ছেলেটা বায়না ধরছে বিরিয়ানি খাবে বলে বুঝলা আদনান।প্র্রথমত রাজি হই নাই। কিন্তু যখন জড়াই ধইরা বলছে “আমি না তোমার কলিজা? আমাকে তুমি বেশি বেশি পড়তে বলো।আমি যদি ঠিক মত না খাই তাহলে কিভাবে পড়বো বলো তো?” ছেলের মা তো মুচকি মুচকি হাসে।ছেলের এই কথার উত্তর দিতে পারি নাই।এখন বিরিয়ানি আনতে যাই।ছেলের আবদার পূরণ করি।” আমি সাদেক ভাইকে আর কিছু বললাম না।এই পুরান ঢাকার চকবাজারে কত মানুষের অনুভূতি ঘুরে বেড়ায়।সেসব অনুভূতি মানুষকে এক সময় কাঁদায় আবার হাসায়।

একটু হেটে যেতেই মিলির ফোন। আমি রিসিভ করতেই বললো “এই যে মি. কোথায় আপনি?” আমি বললাম “তোমাদের গলির এইদিকে।” মিলি আমাকে বললো “আমার মন না কেমন যেন করছে সন্ধ্যা থেকে।কেমন যেন বিষণ্ন হয়ে আছে। এই বিষণ্ন হওয়ার কারণটা আমি খুঁজে পাইনা।হঠাৎ করে এমন কেন হচ্ছে আদনান? আমার খুব ভাল্লাগছে না?” আমি বললাম “শরীর খারাপ? জ্বর এসেছে?” সে বললো “না জ্বর আসেনি।একটা কথা বলবো?” আমি হুম করে একটা শব্দ উচ্চারন করলাম। মিলি আমার শব্দ পেয়েই বললো “আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমি তোমায় হারিয়ে ফেলবো।” আমি একটু সময় নিয়ে বললাম “এমন কেন মনে হচ্ছে তোমার? এসব একদম ভাববে না ঠিকাছে? আমি সব সময় তোমার পাশে আছি।” ও একটু চুপ করে থাকলো।আমি তার চুপ থাকা দেখে বললাম “আচ্ছা তুমি যখন আমার সাথে রাগ করে মাঝে মাঝে বলো “আবে হালা আমারে মিস করস না ক্যালা? আমারে একবারও আইজকা ফোন দিচস? এসব যখন বলো আমার না তখন খুব হাসি পায়। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে তুমি এমন করে বলো না।কেন বলো না? আমার মত কথা বলো।মাঝে মাঝে একটু বলতে পারো না? শুনলে ভালো লাগে তো।” মিলি আমার এই কথার তেমন কোন গুরুত্ব না দিয়েই বললো “ভালো লাগছে আদনান একদম ভালো লাগছে না।” আমি কথার প্রসঙ্গ বদলে তার মন অন্য দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সি ঠিকই আগের জায়গাই রয়ে গেলো।আমি ঠিক বুঝতে পারছি না এই চমৎকার মেয়েটার হঠাৎ এমন লাগছে কেন? আর কেনই বা তার মনে হচ্ছে সে আমাকে হারিয়ে ফেলবে? আমি বললাম “কিছু খেয়েছো?” সে বললো “ইচ্ছে করছে না।তুমি বাসায় যাও।আমি রাখছি একটু ঘুমাবো।” এটা বলেই মিলি ফোনটা রেখে দেয়।হঠাৎ করেই আমার মন কেমন যেন করতে লাগলো।ভালোবাসায় কি এমন আছে প্রিয় মানুষটার মন খারাপের কথা অপর মানুষটা শুনলে তারও খারাপ লাগে?

বাসায় যেতে যেতে ফিরোজ চাচার চায়ের টঙ্গের দোকানে আফরাজকে দেখলাম।ভাবলাম ওর সাথে একটু কথা বলি।ও ঢাকার নর্থসাউথ এ ফোর্থ সেমিষ্টারে পড়ে।ছেলেটা কি সম্মান দিযেই না কথা বলে।তার ইচ্ছা বিদেশ চলে যাবে।এই বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছাটা কেনই বা তার মাথায় চাপলো আমি বুঝি না।মাঝে মাঝে আমাকে বলে “বিদেশ গেলে আমার মায়ের জন্য অনেক মন কাঁদবে।আমি জানি যতটা না আমার মন কাঁদবে তারচেয়ে বেশি আমার জন্য আমার মায়ের মন কাঁদবে।কিন্তু আমার স্বপ্নটা পূরণ করতেই হবে আদনান ভাই।জীবনের পথটা যে অনেক বাকি।মা মাঝে মাঝে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থেকে বলে “বাজান তোমার এমন ইচ্ছা কেন হইলো? এই ইচ্ছা না করলে হয় না?” আমি কোন প্রত্যুত্তর দিতে পারি না।” আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি আর ভাবলাম থাক বাসায় চলে যাই।ওর সাথে পরে কথা হবে।

বাসায় এসেই বুবুর কাছে গিয়ে বললাম “বুবু তুই আমারে মিস করবি না?” বুবু আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে এর কথার প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললো “মায়ের দিকে খেয়াল রাখবি।আমি জানি না আমার কখন বিয়ে হবে।কিন্তু মেয়ে হয়ে যখন জন্ম নিয়েছি একদিন না একদিন বিয়ে তো দিবেই।আমাদের মেয়ের এই এক ঝামেলা, বিয়ে না হলে সমাজের চারপাশে নানান কথা ছড়ায়।তুই কি চাস তোর বুবুকে নিয়ে সমাজে নানান কথা রুটে যাক? তোদের ছাড়া আমারও থাকতে ভালো লাগবে না বিশ্বাস কর।” আমি বুবুর চোখে পানি দেখি।এই জল দেখতে আমার একটুও ভালো লাগে না।

আমি আমার রুমে চলে এসে নিজের বিছানায় শরীর তলিয়ে দেই। এই তলিয়ে দেওয়ার পরই কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ করেই মানুষের চিৎকারে আমার চোখ খুলে যায়।আমি বাহিরে বের হয়ে দেখি মানুষের আহাজারি। রাত তখন এগারোটা।মা আমাকে বলে “বাবা কই যাইবার লাগচো? ঘরে আহো।আমার ভয় লাগতাচে।” আমি মায়ের চোখে প্রচন্ড ভয়ের ছাপ দেখি।মাকে বললাম “ঘরে যাও” এটা বলেই আমি দৌড়াতে থাকি।আমি আকাশের দিকে তাকাই। রাত্রির কালো আকাশটা হঠাৎ করে কেন এমন রং পরিবর্তন করলো? আমি আকাশে লালচে রঙ এর আভা দেখতে পাই। এই লালচে রঙ এর আভায় আমার চোখ দুটোও লাল হয়ে যায়।দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।এ আগুন কেমন আগুন? সাড়ে দশটার নাগাত নাকি এই আগুন লেগেছিল। এই পুরো আধঘন্টায় কি ভয়ানয়ক অবস্থা হয়ে গিয়েছে। আমার মাথা ঝিম মারতে শুরু করলো। উপরে যে একজন বিধাতা আছে। এই পুরো শহরের মালিক আছে তাকে দেখা যায় না, শুধু মন থেকে ডাকা যায়। আমি তাকে ডাকতে শুরু করলাম “ও আল্লাহ, এসব কি দেখছি আমি, আল্লাহ রহম করো, দয়া করো আল্লাহ।” আমি মিলিকে ফোন করতে লাগলাম বার বার করতে লাগলাম। বাবা আমার পাশে এসে দাঁড়ায় আমি বাবার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে জড়িয়ে ধরে একটা চিৎকার দিয়ে বললাম “বাবা মিলি বাড়ির ভিতরে আছে।সে আমার ফোন ধরছে না।কেন ধরছে না? তাকে ফোন ধরতে বলো।প্লিজ বলো। আমি যাই বাবা ভিতরে? কত মানুষ আটকে আছে।” বাবা শুধু আমাকে ধরে রাখলেন শক্ত করে।আমি এপাশ ওপাশ তাকিয়ে ছটফট করে আবার বললাম “আমাকে ছাড়ো বাবা আমি ভিতরে যাবো” এটা বলার পর পরই আমার কি হয়েছিল আমি জানি না।এরপর দিন সকালে আমার হুশ আসলো।আমি চোখ খুলতেই দেখি মা আর বুবু আমার পাশে বসে আছে।বুবুর চোখে আমি পানি দেখি।আমি বুবুকে বললাম “মিলি কই?” বুবু কিছু বলে না।

আমি ওদের চুপ থাকা দেখে বের হয়ে যাই। আগুন নিয়ন্ত্রনে আনতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।আমি চারপাশটার দিকে তাকাই। কি অবস্থা হয়ে গেছে নগরীটা।আমি বাম দিকে যেতেই কয়েকজন বলাবলি করছে “গর্ভবতী স্ত্রী নামতে পারেননি; তাই স্বামীও নামেননি! গর্ভের সন্তানসহ স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু!” আমার ভিতরটা ধক করে উঠে।রিফাত ভাই আর রিয়া ভাবীর কথা মনে পড়লো।আমার গতকাল রাতেই পায়েশ খাওয়ার কথা ছিল। আমি ভুলে গিয়েছিলাম যেতে।আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।আমার শরীর কাঁপতে থাকে।এই কাপা কাপা শরীর নিয়ে আমি আর একটু সামনে যাই।সামনে যেতেই সাদেক ভাই কে কাঁদতে দেখলাম। সে কাঁদতে কাঁদতেই চিৎকার দিয়ে বলছে “আব্বা তুমি কই? আমি তোমার জন্য বিরিয়ানী নিয়ে আসছি তো।খাইবা না? তোমারে অনেক বড় হইতে হবে তো? কই তুমি?” আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে। গড়গড় করে পড়তে থাকে।সেই চোখের জল আমি মুছি না। মুছতে ইচ্ছে করে না। মানুষগুলো কেমন জড়ো হয়ে আছে। আমি এই মানুষ গুলোর ভিতরে যাই। গিযে খুঁজতে যাই ওখানে মিলি আছে কিনা।ও কি বেঁচে আছে? গিয়েই আফরাজের মাকে দেখলাম।খালা কেমন করে যেন কান্নাকাটি করছে একটা ছবি হাতে নিয়ে আর বলছে “আমার বাজানরে আয়না দাও।এক টুকরা মাংসের দলা হলেও আয়না দাও।আমার বাজানরে আমি বুকে জড়ায় রাখবো।ও সাংবাদিক ভাই বোনরা আমার বাজানরে আয়না দেন না?” আমার বুকের ধকধকানি বাড়তে থাকে।এ কেমন একটা দিনের স্বাক্ষাৎ পেলাম আমি।একজন ফায়ার সার্ভিসের লোক ভিতর থেকে এসে তার সহকর্মীকে বলছে “এই বিল্ডিং টার এই ফ্লোরে চারটা মাথার খুলি পরে আছে।আমি আমার মাঝে নাই ভাই।” এই বিল্ডিং আর ফ্লোরের কথা বলতেই মিরাজদের কথা চোখে ভাসলো। আমার শরীর অবশ হতে লাগলো। ওর মাকে ও শেষ বারের মত দেখে যেতে পারলো না।আমার কিছুই ভালো লাগছে না।আমি মাটিতে বসে গেলাম। ভিতরের দিকে কাউকে যেতে দিচ্ছে না।মিলির মামাকে দেখলাম।আমি আবার ছটফট করে বসা থেকে উঠে উনার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বুঝাতে লাগলাম মিলি কোথায়? আমার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।মামা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বললো “সব শেষ আদনান। সব শেষ।” আমি মামাকে আমার বুক থেকে ছাড়িয়ে অনেক কষ্টে বললাম “কোন শেষ না।মিলি শেষ হতে পারে না।আমার মিলি আমাকে ছাড়া একা কোথাও যাবে না।যেতে পারে না।” মামা আমাকে আবার জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে।” আমি শুধু তাকিয়ে দেখতে লাগলাম লাশের পর লাশ বের হচ্ছে।মানুষের পোড়া লাশ।সেই পোড়া লাশের মধ্যে দুই ভাইয়ের জড়াজড়ি করা লাশ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আলাদা করতে পারছিলনা। যখন আলাদা করলো তাদের বুকে জড়িয়ে ধরা এক শিশুর লাশ।” আমি একটা চিৎকার দিয়ে উঠি। আমি আবার কাঁদতে থাকি। বার বার কাঁদতে থাকি আর ভাবি এই আগুন কিভাবেই বা লাগলো? কেউ কেউ বলছে আগুন গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আবার কেউ কেউ বলছে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটে রাসায়নিক গুদামে ছড়িয়ে পড়েছে।আমি চারপাশের মানুষের দিকে তাকাই।তাকাই তাদের চোখের দিকে।সেই চোখে আমার মত জল গড়িয়ে পড়ে। বেদনার জল।প্রিয় মানুষকে হারানোর জল।আমার আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। এসব মানুষের কান্নাটা কি আকাশকে ছুয়ে দিতে পারবে? যখন আকাশটাকে ছুয়ে দিবে তখন কি আকাশটা কেপে উঠবে না? আমি জানি না।আমি শুধু এখন এইটুকু জানি আমি আগুনে পোড়া একটা শহরে আছি।সেই পোড়া শহরে লাশের মিছিল।সেই শহরে এখন বৃষ্টি ঝড়ছে। মানুষের চোখের বৃষ্টি…

এই লেখাটা লিখা আমার উচিৎ হয়েছে কিনা আমি জানি না। এই লিখার আদনান আর মিলি চরিত্র ছাড়া বাকি চরিত্র্রের মানুষ গুলো আর নেই। অনেকের নাম আমি জানি না। তাই ছদ্মনাম দিয়ে ব্যবহার করেছি। শুধু রিফাত আর রিয়া নামটা জানতে পেরেছিলাম। আদনান আর মিলি চরিত্রটা কাল্পনিক। কাল্পনিক হলেও হয়তো আমাদের জানা নেই এমন চরিত্রটা আমাদের সামনে আসেনি।যে সব মানুষ গুলো হারিয়ে গেছে এই হারানোর মাঝে প্রত্যেকের জীবনে একটা একটা করে গল্প আছে। আমরা মাত্র কয়েকজন মানুষের গল্পগুলো শুনেছি। এই মানুষ গুলোকে নিয়ে কত স্বপ্ন, আশা করেছিলেন তাদের আত্মীয় স্বজনরা। যে মানুষ গুলো আমাদের মাঝে আর নেই লেখার প্রয়োজনে তাদেরকে নিয়ে যে সংলাপগুলো ব্যবহার করেছি তা শুধু একান্তই আমার চিন্তা ভাবনা থেকে।সবশেষ এইটুকু বলবো আল্লাহ যেন এই শহীদদের বেহেশতে নসীব করুক।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৩:২০

চাঁদগাজী বলেছেন:


মিলিকে ১ম বার যা বলা হয়েছে, সেটা বলার মতো কথা, সেটুকু পছন্দ হয়েছে

২| ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:৫০

রাজীব নুর বলেছেন: চকবাজার অগ্নিকাণ্ডে নিহত সকলের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

৩| ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:২০

মা.হাসান বলেছেন: বড় কান্নার গল্প, বড় মন খারাপের গল্প। পত্রিকায় এই বিভৎস খবরগুলো হেড লাইনের পর আর পড়ি না। আপনি মানুষগুলোকে, তদের ভালবাসকে, এমন ভাবে তুলে আনলেন, তাদের মৃত্যুতে যেন মনে হলো আমার নিকটাত্মীয় হারালাম। আল্লাহ তাদের জান্নাত নসীব করুন।

৪| ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:১৩

পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: খুব ভালো লাগলো আপনার গল্পটি পড়ে। ++
শুভকামনা জানবেন।

৫| ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:৩৯

মাহমুদুর রহমান সুজন বলেছেন: পুরো ট্রেডিজির কথনে বেদনাময় গল্পটি এক টানে পড়ে নিলাম। বুকের মধ্যে সেই হাহাকার যখন খবর দেখছিলাম তখন এমন হয়েছিল। আপনার লিখনীও চমৎকার।

৬| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:২৮

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: কষ্টের গল্পে ++++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.